4
বোম্বেটে না বর্বর
বোম্বেটে কাকে বলে সবাই তা জানে। বোম্বেটে বা জলদস্যু পৃথিবীর সব দেশেই সব সময়ে ছিল। এখনও আছে।
তবে বোম্বেটে-জীবনের গৌরবময় যুগ আর নেই। আগেকার বোম্বেটেদের ক্ষমতা ছিল অবাধ ও খ্যাতি ছিল আশ্চর্য, এখনকার বোম্বেটেরা তাদের কাছে হচ্ছে তিমিমাছের কাছে পুঁটিমাছের মতো।
উড়োজাহাজ, বাষ্পীয় পোত ও বেতার টেলিগ্রাফের মহিমায় আজ আর কোনও বোম্বেটেই বেশি মাথা তুলতে বা বেশিদিন কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পারে না। চীনে বোম্বেটেরা আজও মাঝে মাঝে মাথা চাগাড় দেয় বটে, কিন্তু তাদের জারিজুরি ওই চীনা সমুদ্রের ভিতরেই। চীনদেশের ভিতরকার অবস্থা ভাল নয়, রাজ্যবিপ্লব নিয়েই সেখানকার গভর্নমেন্ট ব্যতিব্যস্ত, সেইজন্যেই চীনে বোম্বেটেরা মাঝে মাঝে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করবার সুযোগ পায়।
অন্যান্য দেশের আধুনিক বোম্বেটেরা উল্লেখযোগ্য জীব নয়। তারা আছে—এইমাত্র। বাংলাদেশে বোম্বেটে কথাটি বেশিদিনের নয়। বার ভূঁইয়ার সময়ে বাংলাদেশে পর্তুগিজ জলদস্যুদের বিষম উপদ্রব হয়েছিল। তখনকার রডা, গঞ্জালিস ও কার্ভালো প্রভৃতি জলদস্যুর নাম বাঙালি এখনও ভুলতে পারেনি, কারণ বর্গির অত্যাচার ও মগের অত্যাচারের মতো পর্তুগিজ জলদস্যুদের অত্যাচারও ছিল তখনকার বাংলাদেশের নিত্য-নৈমিত্তিক বিভীষিকা। ওই সময়েই বোম্বেটে কথাটি বাংলাদেশে চলতে শুরু হয়। ইংরেজি Bombardier-এর বাংলা হচ্ছে ‘গোলন্দাজ সৈন্য’। পর্তুগিজ জলদস্যুরা গোলন্দাজিতে অর্থাৎ কামান-বন্দুকের ব্যবহারে দক্ষ ছিল। তাই বোধহয়, ওই ইংরেজি কথাটা থেকে বাংলা 'বোম্বেটিয়া’ বা বোম্বেটে’ কথাটির সৃষ্টি হয়, আর সাধারণভাবে জলদস্যুদেরই প্রতি ব্যবহৃত হতে থাকে।
‘বোম্বেটে’ কথাটি খাঁটি বাংলা কথা না হলেও খাঁটি বাঙালি বোম্বেটের অভাব বাংলাদেশে ছিল না। তবে এখানে তো সমুদ্রতীরবর্তী নগর বেশি নেই, কাজেই বোম্বেটেদের ছোট ছোট নৌকা করে নদ-নদীর ভিতরে এসেই ব্যবসা চালাতে হত। বড় বড় জাহাজে চড়ে পৃথিবীর নামজাদা বোম্বেটেদের মতো সমুদ্রের উপর বড়রকমের ডাকাতি করার সুযোগ তাদের বেশি ছিল না।
সেকেলে বাংলার জল-ডাকাতদের সাধারণ নিয়ম ছিল এই রকম: কোনও যাত্রীনৌকো দেখলেই তারা নিজেদের নৌকো নিয়ে তার কাছে গিয়ে বলত, “আমাদের আগুন নিবে গেছে। একটু আগুন দেবে ভায়া?” যাত্রী নৌকোর লোকেরা কোনরকম সন্দেহ না করে আগুন দেবার জন্যে বোম্বেটে নৌকোর পাশে গিয়ে হাজির হত এবং অমনি সেই সুযোগে বোম্বেটেরা যাত্রী নৌকোর ভিতরে লাফিয়ে পড়ে সর্বনাশের সৃষ্টি করত। বারে বারে এমনি ঠকে শেষটা অচেনা নৌকো আগুন চাইলেই তারা তাড়াতাড়ি আরও তফাতে সরে পড়ে পলায়ন করত।
বাংলাদেশে জল-ডাকাতরা প্রায়ই ছিপ নৌকো ব্যবহার করত। এখানকার ডাঙার ডাকাতরা তাড়াতাড়ি যাবার জন্যে ব্যবহার করত ‘রণপা’। রণপা হচ্ছে দুটো লম্বা বাঁশের ডাণ্ডা—মানুষের মাথার চেয়ে অনেক উঁচু। সেই ডাণ্ডার মাঝখানে পা রাখবার জায়গা থাকে। (ইউরোপেরও অনেক দেশের চাষীরা শস্যক্ষেতে চলাফেরা করবার সময়ে এমনই রণপা ব্যবহার করে থাকে) কিন্তু বাংলার ডাঙার ডাকাতরাও জলপথে তাড়াতাড়ি যাবার জন্যে বোম্বেটেদেরই মতো ছিপ ব্যবহার করত।
আইনের চোখে অপরাধী হলেও সামাজিক হিসাবে, আগেকার বোম্বেটেরা বোধহয় সাধারণ খুনি বা ডাকাতের চেয়ে উচ্চশ্রেণীর জীব ছিল। কারণ, দেখা যায়, আগেকার এমন কয়েকজন লোক নৌ-যোদ্ধারূপে বিখ্যাত হয়ে প্রভূত যশ ও রাজসম্মান অর্জন করে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় অমর হয়ে রয়েছেন, যাদের বোম্বেটে বললে খুব ভুল করা হয় না।
যেমন ভাস্কো ডা গামা। পর্তুগালের এই নামজাদা যোদ্ধা-নাবিক পর্তুগিজ অধিকৃত ভারতবর্ষের বড়লাটরূপে কোচিতে প্রাণত্যাগ করেন (১৫২৪)। কিন্তু আফ্রিকার স্থানে স্থানে ও ভারতের কলিকটে তিনি যেসব কাজ করে গেছেন, তা বোম্বেটের পক্ষেই সাজে। পর্তুগালের আর এক নাবিক-নেতা ফাৰ্ণান ম্যাগেল্যানও স্বদেশে যথেষ্ট শ্রদ্ধা প্রতি লাভ করেছেন, কিন্তু তিনি সাধারণ ইতর বোম্বেটের চেয়ে ভাল লোক ছিলেন না।
ইংলন্ডকে স্পেনের ‘আর্মাডা’র কবল থেকে বাঁচিয়ে এবং অনেক নূতন নূতন দেশ আবিষ্কার ও ব্রিটিশসাম্রাজ্যভুক্ত করে স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক আজ স্বদেশভক্ত বীর বলে সুপরিচিত। সে হিসাবে সত্যসত্যই তিনি এই সম্মানের অধিকারী। কিন্তু জলদস্যুরা যে কাজ করলে নিন্দিত হয়,তাঁর অনেক অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যেই তা লক্ষ্য করা যায়। ড্রেক একালে জন্মালে, পৃথিবী বোধহয় তাকে ক্ষমা করত না। ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে তিনি যথেচ্ছভাবে লুটতরাজ করেছেন, হাজার হাজার অসহায় মানুষকে হত্যা করেছেন, বড় বড় শহরকে আগুনের মুখে সমৰ্পণ করেছেন। সে দেশের লোকের কাছে তিনি নিশ্চয়ই বীর নামে পরিচিত হন নাই। যুদ্ধের নামগন্ধনেই, নগর লুণ্ঠনও শেষ হয়ে গেছে, তবু হাইতি দ্বীপের রাজধানী স্যাণ্টো ডোমিঙ্গো শহরের নিরীহ বাসিন্দাদের উপর ড্রেক অনবরত গুলিগোলা বৃষ্টি করেছেন। নগরের চতুর্দিকে যখন ভীষণ অগ্নির তাণ্ডবলীলা,নিরপরাধ নর-নারী ও শিশুর আর্তনাদে যখন আকাশ-বাতাস পরিপূর্ণ এবং ড্রেকের সৈন্যরা যখন ক্রমাগত গুলিগোলা বৃষ্টি করে একেবারে নেতিয়ে কাবু হয়ে পড়েছে, তখনও লক্ষাধিক মুদ্রা ঘুষ না পাওয়া পর্যন্ত ইংলন্ডের এই মহাবীর তুষ্ট হতে পারেননি।
পনের, ষোল ও সতের শতাব্দীতে ইংলন্ডবাসীরা নৌ-যোদ্ধা ও বোম্বেটেকে যে প্রায় অভিন্ন বলে মনে করত, তার অসংখ্য ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে। তখন সমুদ্রে ও সাগর তীরবর্তী স্থানে শক্ৰদের সঙ্গে যুদ্ধ করবার সময়ে, ইংরেজরা অধিকাংশ সময়েই সাধারণ বোম্বেটেদের সাহায্য গ্রহণ করত। ইংলন্ডের রাজা, রানী ও শাসনকর্তারা পর্যন্ত বেতনভুক্ত নিয়মিত নীে-সৈন্যদের সঙ্গে বোম্বেটেদের পালন করতে লজ্জিত হতেন না—যেমন হতেন না বাংলা দেশের বার ভূঁইয়ারাও। রাজার সাহায্য পেয়ে বোম্বেটেদেরও বুক দশহাত হয়ে উঠত, তারা রাজশক্রদের বিরুদ্ধে লড়াই করবার অজুহাতে নিরীহ প্রজাদের ধন-প্রাণ নিৰ্ভয়ে লুণ্ঠন করত।
এই শ্রেণীর বোম্বেটেদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে হেনরি মর্গান। এই ভীষণ বোম্বেটেকে ইংলন্ডের রাজসরকার টাকা, জাহাজ ও লোকজন দিয়ে সাহায্য করেন। তার ফলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছাকাছি দ্বীপপুঞ্জে এবং দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরাঞ্চলে কারুর পক্ষে ধন-প্রাণ বজায় রেখে বাস করাই অসম্ভব হয়ে ওঠে। পানামার মতো শহরেও হেনরি মর্গ্যান হানা দিতে ভয় পায় নি, তার কবলগত হয়ে পানামার অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস হয়ে যায় এবং যথাসর্বস্ব হারিয়েও এখানকার কত হাজার বাসিন্দা যে মৃত্যুমুখে পড়তে বাধ্য হয়, তার কোনও হিসাব নেই। ওই ওঁচা বোম্বেটেকে জলদস্যুরা পর্যন্ত ঘৃণা করত। কারণ সে কাক হয়েও কাকের মাংস খেত,—অর্থাৎ মর্গান কেবল পরিচিত নির্দোষ ব্যক্তিরই ধন-প্রাণ কেড়ে নিত না, নিজের দলের লোকদেরও টাকা দুহাতে চুরি করত। জলপথে ও স্থলপথে অসংখ্য অত্যাচার, নরহত্যা, লুণ্ঠন ও পাপকাজ এবং বোম্বেটেদেরও তহবিল তছরুপ করে, শেষটা সে সকলকে ফাঁকি দিয়ে হঠাৎ একদিন লুকিয়ে সরে পড়ে। তখন ইংলন্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের ধর্মভাব হঠাৎ জেগে উঠল। তার হুকুমে মর্গানকে ধরে দেশে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু বোম্বেটে সর্দারকে স্বচক্ষে দেখে রাজার মন এত খুশি হয়ে উঠল যে, শাস্তি দেওয়া দূরে থাক, স্যার উপাধি ও কর্ণেল পদ দিয়ে তিনি তাকে আবার জামাইকা দ্বীপের ছোটলাট করে পাঠালেন।
রেমব্রাণ্ডের মতো বিশ্ববিখ্যাত ও সর্বজনমান্য চিত্রকর আঁকলেন কর্ণেল স্যার হেনরি মগ্যানের ছবি এবং যার মরা উচিত ছিল ফাঁসিকাঠে, ছোটলাটের উঁচু, পুরু ও নরম গদিতে বসে সে সাধু অসাধুর শাসনভার—অর্থাৎ মুণ্ডপাতের ভার পেয়ে চৌদ্দ বৎসর সুখে সম্মানে কাটিয়ে তিয়াত্তর বৎসর বয়সে পরম নিশ্চিন্তভাবে ইহলোক ত্যাগ করলে! পাপের এমন জয়ের দৃষ্টান্ত পৃথিবীর অন্য কোনও দেশের ইতিহাসে দেখা যায় না! এমনকি আজও দেখি, অনেক নামজাদা ইংরেজ লিখিয়ে এই বোম্বেটের কলঙ্ক ক্ষালনের জন্যে প্রাণপণে ব্যর্থ চেষ্টা করছেন। আশ্চর্য!
অথচ ওই সময়কার ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরা কানহোজি আংগ্রেকে জলদস্যু রূপে বর্ণনা করতে লজ্জিত হন নি। ভারতে যখন ঔরংজেবের রাজত্ব, মারাঠী নৌ-বীর কানহোজি আংগ্রের নামে তখন আরবসাগরগামী সমস্ত জাহাজ ভয়ে থরহরি কম্পমান হত। স্থলপথে ছত্রপতি শিবাজির মতন জলপথে কানহোজি আংগ্রেও ছিলেন সমান অজেয়। ইংলন্ডে জন্মালে তিনি ড্রেক বা নেলসনেরই মতো পৃথিবীজোড়া অমর নাম অর্জন করবার সুযোগ পেতেন। মোগল, ইংরেজ, ওলন্দাজ ও পর্তুগিজদের কোনও জাহাজই তার কবল থেকে সহজে নিস্তার পেত না। ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয় জাতিরা একসঙ্গে অনেক যুদ্ধজাহাজ নিয়ে বার বার তাকে আক্রমণ করেছে, কিন্তু প্রতিবারই একাকী লড়েও জলযুদ্ধে জয়ী হয়েছেন মহাবীর কানহোজি আংগ্রেই! অথচ তখন ইউরোপের পূর্বোক্ত জাতিরা স্থলযুদ্ধের চেয়ে জলযুদ্ধেই বেশি বিখ্যাত ছিলেন। বার বার পরাজিত শত্রুদের কলমে ‘বোম্বেটে’ বলে নিন্দিত এই অসাধারণ ভারতীয় নৌ-বীরের বীরত্বকাহিনী যে আজও এখানে ঘরে ঘরে পরিচিত হয়নি, আমাদের ঐতিহাসিকদের পক্ষে এটা অল্প কলঙ্কের কথা নয়। বাংলা ভাষায় প্রায় তিন যুগ আগে পুরাতন ‘ভারতী’তে একবার কানহোজি আংগ্রে সম্বন্ধে একটি ছোট প্রবন্ধ দেখেছিলুম, তারপর আর কারুর তাকে মনে পড়েনি!
সাধারণ হত্যা বা দস্যুতার মধ্যে লুকোচুরি ও কাপুরুষতা আছে যতটা, বোম্বেটের কাজে যে ততটা নেই, সত্যের অনুরোধে এ কথা স্বীকার করা চলে অনায়াসেই। যে যুগে বোম্বেটেদের প্রাধান্য ছিল খুব বেশি, তখন সমুদ্রযাত্রার সময়ে প্রত্যেক জাহাজের আরোহীরাই তাদের দেখা পাবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যেতেন ও সাবধান হয়ে থাকতেন এবং বোম্বেটেদের ভয়ে অধিকাংশ সওদাগরী জাহাজেও কামান-বন্দুক ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র রাখা হত। অনন্ত সমুদ্র,—সাধারণ খুনে বা ডাকাতের মতো বোম্বেটেরা অতর্কিতে হঠাৎ এসে আক্রমণ করতে পারত না, তাদের অনেক দূর থেকেই স্পষ্ট দেখা যেত এবং আক্রান্তরাও আত্মরক্ষা করবার সুযোগ পেত যথেষ্ট। কিন্তু তবু যে তারা বাঁচতে পারত না, তার প্রধান কারণ হচ্ছে বোম্বেটেদের সাহস ও বীরত্ব। তবে জলদস্যুদের এত নিন্দা কেন? তাদের মূলমন্ত্র হচ্ছে, জোর যার মুল্লুক তার। এ মূলমন্ত্র সমাজের শান্তিরক্ষার পক্ষে অচল। তার উপরে সেকালকার বোম্বেটেদের নিষ্ঠুরতা ও হিংসুকতা ছিল অসম্ভব—দয়ামায়ার অস্তিত্ব পর্যন্ত তারা মানত না। অধিকাংশ সময়েই তারা কোনও জাহাজ দখল ও লুট করে সমস্ত আরোহীকেই নির্বিচারে সমুদ্রের জলে নিক্ষেপ করত। প্রাণে মারবার আগে অনেক লোককে তারা অমানুষিক যন্ত্রণা দিতেও ছাড়ত না। তারা নরপশু ছিল বলেই তাদের সমস্ত সাহস ও বীরত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভষ্মে ঘৃতাহুতির মতো। যে বীরত্বে ক্ষমা নেই, দয়া নেই, মনুষ্যত্ব নেই, তা একেবারেই উল্লেখযোগ্য নয়।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জের ফরাসি জলদস্যু লোলোনজের পাশবিক বীরত্বের কাহিনী আমরা পরে বিবৃত করব। ব্রেজিলিয়ানো নামে আর এক বোম্বেটের গল্পও আমরা পরে বলব, যা পড়তে পড়তে পাঠককে শিউরে উঠতে হবে। এ শ্রেণীর লোকের সাহস ও বীরত্ব না থাকলেই ভাল ছিল।
জলদস্যু হচ্ছে প্রাচীন যুগেরই জীব। গ্রিকদের সময়েও জলদস্যুদের প্রভাব ছিল যথেষ্ট। সে সময়ে সমুদ্রে বেরিয়ে এক জাহাজ যদি আর এক জাহাজকে দেখতে পেত, তাহলে সর্বাগ্রে প্রশ্ন করত, “তোমরা বোম্বেটে, না সওদাগর?” রোমানদের সময়েও গ্রিক বোম্বেটেরা দলে এত ভারি ছিল যে, ভূমধ্যসাগর দিয়ে সাধারণ জাহাজ প্রায় চলাফেরা করতে পারত না বললেই চলে।
ভূমধ্যসাগরে বোম্বেটে জাহাজের সংখ্যা তখন এক হাজারের কম ছিল না। রোমানরা শেষটা বাধ্য হয়ে বিপুল এক রণতরীর বাহিনী পাঠিয়ে এই দস্যুতা দমন করেছিল। কিন্তু এর পরেও অনেকবার জলদস্যুদের অত্যাচারে রোমকে যারপরনাই কষ্টভোগ করতে হয়েছিল। সেকালকার ইংলন্ড, ফ্রান্স, পর্তুগাল ও স্পেনের সমুদ্রতীরবতী নগরগুলি নানাদেশি বোম্বেটেদের অত্যাচারে যখন তখন ত্ৰাহি ত্ৰাহি ডাক ছাড়ত।
পঞ্চদশ শতাব্দীর আরম্ভে চীনারা সিংহলদেশের উপরে কি বিষম ডাকাতি করেছিল এইবারে সেই কথাই বলি। চেংহো নামে এক চীনা খোজা একবার জাহাজে চড়ে সিংহলদেশে গিয়েছিল। সেখানে বুদ্ধদেবের পবিত্র দাঁত আছে শুনে সে আব্দার ধরে বসল, তাকে ওই দাঁত উপহার দিতে হবে। বলাবাহুল্য, সিংহলের তখনকার রাজা অলগাক্ষোনারা (?) তার সে অন্যায় আব্দার গ্রাহ্য করলেন না। চেং হো সেবারের মতো মুখ চুন করে খালি হাতেই চীনদেশে ফিরে গেল।
কিন্তু ১৪০৯ খ্রিস্টাব্দে বাষট্টিখানা জাহাজ নিয়ে সে আবার সিংহলদেশে আবির্ভূত হল। সিংহলের রাজার সৈন্যদের সঙ্গে চীনাদের তুমুল লড়াই লেগে গেল। সেই ফাঁকে চেং হো একদল সৈন্য নিয়ে সিংহলি সৈন্যদের চোখে ধুলো দিয়ে হঠাৎ রাজধানীতে এসে কৌশলে নগর দখল করলে এবং রাজা ও রাজপরিবারের ছেলেমেয়ে ও রাজ্যের প্রধান প্রধান লোকদের বন্দি করে সটান আবার চীনদেশে গিয়ে হাজির হল। পরে রাজ্যচ্যুত রাজাকে চীনারা আবার সিংহলদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিল বটে, কিন্তু তারপর, কিছুকাল পর্যন্ত সিংহল দেশকে চীনসম্রাটের অধীনতা স্বীকার করে কর পাঠাতে হত। এই বোম্বেটেগিরির পরে, ভারতসাগরে চীনাদের প্রভাব দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছিল।
চীনদেশেরও সমুদ্রতীরবর্তী স্থানগুলি নিরাপদ ছিল না—সেসব জায়গায় জাপানি বোম্বেটেরা সকলকে নাস্তানাবুদ করে তুলেছিল। ষোড়শ শতাব্দীর পর ইংরেজ ও ওলন্দাজ বোম্বেটেদের দৌরাত্ম্যেও চীনাদের বড় কম নাকাল হতে হয়নি।
আগেই বলেছি, ইংরেজরাও সেকালে বোম্বেটের ব্যবসায়ে যথেষ্ট বদনাম কিনেছিল। রানী এলিজাবেথ অনেক ইংরেজ বোম্বেটেকে নিজের নৌ-সেনাদলে ভর্তি করে নিয়েছিলেন। সে সময়ে জন স্মিথ নামে এক মহা ধড়িবাজ বোম্বেটের জ্বালায় ইংরেজরা পর্যন্ত অস্থির হয়ে উঠেছিল এবং তাকে বন্দি করে ফাঁসিকাঠে লটকে দেবার জন্যে চারিদিকে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু কেউ তাকে ধরতে পারেনি।
এমন যে শয়তান, তারও মনে ছিল প্রচুর দেশভক্তি। হঠাৎ সে একদিন নিজেই কর্তৃপক্ষের কাছে এসে হাজির—ধরা দিলে মুক্তি নেই জেনেও। সকলেই অবাক হয়ে গেল! কিন্তু বোম্বেটে জন স্মিথ বললে, দেশের বিপদ দেখেই আমি ধরা দিচ্ছি। সবাই প্রস্তুত হও! আমি স্বচক্ষে দেখে এসেছি, ইংলন্ড ধ্বংস করবার জন্যে ‘স্প্যানিস আর্মাডা’ আসছে।” এ খবর তখনও দেশের কেউ পায়নি,—শুনেই সারা ইংলন্ডে ‘সাজো সাজো’ রব উঠল, সকলে যথাসময়ে সাবধান হবার সুযোগ লাভ করলে। বলা বাহুল্য, বোম্বেটে জন স্মিথের নিঃস্বাৰ্থ আত্মসমর্পণ ব্যর্থ হল না। কেবল শাস্তি থেকে মুক্তি নয়—সেই সঙ্গে সে যথেষ্ট পুরস্কারও লাভ করলে।
স্পেন থেকে মরক্কোয় বিতাড়িত হবার পর ষোড়শ শতাব্দীর মুররা ভয়ঙ্কর বোম্বেটে রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল। তাদের ভয়ে ভূমধ্যসাগরের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার মতো হয়েছিল। সারা ইউরোপের শক্তি তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারেনি। প্রথমে উর্জ ও পরে তার ভাই খয়েরুদ্দিনের নামে তখনকার খ্রিস্টান নাবিকদের বুক ভয়ে ঠাণ্ডা হয়ে যেত। কারণ মূর বোম্বেটেরা কেবল জাহাজ লুট করত না,উপরন্তু খ্রিস্টানদেরও ধরে নিয়ে গিয়ে আফ্রিকায় গোলাম করে রাখত এবং তাদের পথের কুকুরের মতো কষ্ট দিত। একবার আন্দ্রিয়া ডোরিয়া নামে এক নৌ-বীর বহু জাহাজ ও সৈন্য নিয়ে জলযুদ্ধে মূর বোম্বেটেদের হারিয়ে দেন এবং তাদের কবল থেকে বিশ হাজার খ্রিস্টান স্ত্রী-পুরুষকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন—তাদের মধ্যে ইউরোপের অনেক বড়ঘরের ছেলে-মেয়েও ছিল। কিন্তু তবু মূর বোম্বেটেরা কাবু হয়ে পড়ল না। অবশেষে কয়েক শত বৎসরের প্রাণপণ চেষ্টার পরে, উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে, মূর জলদস্যুদের প্রতাপ দূর হয়। ইংরেজনৌ-সেনাপতি লর্ড এক্সমাউথ ওলন্দাজদের সঙ্গে মিলে মূর বোম্বেটেদের আস্তানা ভেঙে দেন এবং তারপর ফরাসিরা আলজিয়ার্স দেশ অধিকার করলে মুররা আর মাথা তুলতে পারলে না। ইউরোপে এমন বোম্বেটের বিভীষিকা আর কখনও হয়নি।
এরা কারা—কবেকার—কোথাকার?
আমরা পৃথিবীর বোম্বোটদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়েছি। কিন্তু এখন আমরা কেবল ইউরোপীয় বোম্বেটেদেরই গল্প বলব। প্রথমেই বলে রাখি, এই গল্পগুলির ঘটনাস্থল ইউরোপ নয়—আমেরিকা।
ঘটনাগুলি পড়বার আগে দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকার মানচিত্রের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করুন।
উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার ঠিকমধ্যবর্তী স্থানে পানামা। তার বামে প্রশান্ত মহাসাগর ও ডাইনে আটলান্টিক মহাসাগর। এখন পানামায় খাল কেটে এই দুই মহাসাগরকে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু যখনকার কথা বলছি (সপ্তদশ শতাব্দী) তখন এই খাল ছিল না (পানামা খাল ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে কাটা হয়)।
আটলান্টিক মহাসাগরের এক অংশকে বলে ক্যারিবিয়ান সমুদ্র। তারই ভিতরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জ—হাইতি, জামাইকা, কিউবা প্রভৃতি। কিউবার বামদিকে হচ্ছে মেক্সিকো উপসাগর। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিণে ক্যারিবিয়ান সমুদ্র দক্ষিণ আমেরিকার ভেনেজুয়েলা প্রদেশকে স্পর্শ করেছে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জে, তার চারিপাশের সমুদ্রবক্ষে ও নিকটবর্তী ভূভাগে ষোড়শ থেকে সপ্তদশ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যে রোমাঞ্চকর রক্তাক্ত নাটকের একটানা অভিনয় হয়েছিল, কাল্পনিক উপন্যাসও তার কাছে হার মানে। কিন্তু সকলের কাছে আর একটু ধৈর্য প্রার্থনা করি, কারণ মূল গল্প শুরু করবার আগে স্থান-কাল-পাত্রের কথা আরও কিছু না বললে আসল ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে না।
সর্বপ্রথমে কলম্বাস এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জ আবিষ্কার করেন। কলম্বাস নিজে স্পানিয়ার্ড ছিলেন না, কিন্তু স্পেনদেশের রানী ইসাবেলার আনুকূল্য লাভ করে এই অসমসাহসিক নাবিক নূতন দেশ আবিষ্কারের জন্য সমুদ্রযাত্রা করবার সুযোগ পেয়েছিলেন। অজানা সমুদ্রের উপর ক্ষুদ্র পোতে ভাসমান হয়ে, শত বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে, নিদারুণ কষ্ট সহ্য করে, তিনি ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত কোনও এক অজ্ঞাতনামা (কলম্বাস এই দ্বীপটির নাম রেখেছিলেন ‘স্যান স্যালভেডর’, সম্ভবতঃ আধুনিক ‘ওয়াটলিং দ্বীপ’) দ্বীপে উপস্থিত হয়েছিলেন; আর স্পেনদেশের রাজা ও রানির নামে দ্বীপটি দখল করে, সেখানে স্পেনের রাজপতাকা প্রোথিত করেছিলেন। কাজেই স্পানিয়ার্ডরই সর্বপ্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জে দলে দলে এসে উপনিবেশ স্থাপন করবার সুবিধা পেয়েছিল। তারা কিন্তু অধিকৃত দ্বীপগুলি সব সময়ে শাসনে বা দখলে রাখতে পারত না। ফরাসি, ইংরেজ, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ প্রভৃতি জাতির দুঃসাহসিক লোকেরা মাঝে মাঝে দল বেঁধে জাহাজে চড়ে এসে ওই সকল দ্বীপে উৎপাত করত, আর এক একটা দ্বীপ বা তার খানিকটা, স্থায়ী বা অস্থায়ী ভাবে দখল করে বসত। এই সব কাজে বোম্বেটেদের সাহায্য নিতে তারা কিছুমাত্র সঙ্কোচবোধ করত না।
১৬২৫ খ্রিস্টাব্দে একদল দুঃসাহসিক ইংরেজ ও ফরাসি জল-ডাকাতি করে টাকা রোজগার করবার জন্যে সেন্ট ক্রিস্টোফার দ্বীপে এসে আড্ডা গাড়ে। তারা স্পানিয়ার্ডদের অধিকৃত হিস্পানিওলা বা হাইতি দ্বীপে (পূর্বে সমগ্র দ্বীপের নাম ছিল হাইতি বা হিম্পানিওলা। পরবর্তীকালে হাইতি দ্বীপের রাজধানী সান্টো ডোমিঙ্গোর নাম অনুসারে ওই দ্বীপের পূর্বখণ্ডের নামকরণ হয় সান্টো ডোমিঙ্গো আর পশ্চিমখণ্ডের নাম ‘হাইতি’ থাকিয়া যায়। ম্যাপ দেখুন) লুটতরাজ করত, আর লুট করা শূকরের মাংস শুকিয়ে চলতি সওদাগরি জাহাজে বিক্রি করত। ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দে তারা টর্টুগা দ্বীপে চলে যায়। মেক্সিকোর উপসাগরের মুখে দশটি ছোট ছোট দ্বীপ আছে। সেগুলিকে টৰ্টুগা দ্বীপপুঞ্জ বলে। টর্টুগা দ্বীপ ও টর্টুগা দ্বীপপুঞ্জ যে এক নয়, তা মনে রাখা দরকার।
বোম্বেটের টর্টুগা দ্বীপে নূতন করে আড্ডা গাড়লে, ইউরোপের নানা দেশ থেকে ভিন্ন ভিন্ন জাতির দুঃসাহসিক দুৰ্বত্তেরা এসে তাদের দলে ভিড়ে যেতে লাগল। এইরূপে বোম্বেটেরা দলে বেশ ভারি হয়ে উঠল। স্পানিয়ার্ডদের জাহাজ লুট করা বা তাদের দখলি দ্বীপে বা ভূভাগে এসে হানা দেওয়া তাদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়াল। স্পানিয়ার্ডরা অস্থির হয়ে উঠল।
সমুদ্রে ডাকাতি করে ফিরে তারা টর্টুগা দ্বীপে অথবা জামাইকা বা অন্য কোনও দ্বীপে এসে আশ্রয় গ্রহণ করত। তারপর দু'এক মাসের মধ্যেই মদ খেয়ে, জুয়া খেলে ও অন্যান্য বদখেয়ালিতে সব টাকা ফুঁকে দিয়ে তারা আবার নতুন শিকারের খোঁজে জাহাজে চড়ে বেরিয়ে পড়ত। এই সব দ্বীপের শাসনকর্তারা প্রায়ই ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের মতো হতেন না। বোম্বেটেরা তাদের সঙ্গে একটা পাকা বন্দোবস্ত করে ফেলত, নিজেদের পাপের টাকার খানিক অংশ ঘুষ দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে রাখত। দুএকজন কড়া শাসনকর্তা তাদের যদি শাসনে রাখবার চেষ্টা করতেন, তাহলে হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়াত। কারণ বোম্বেটের দল এতটা প্রবল ছিল যে, সকলে একসঙ্গে বিদ্রোহ প্রকাশ করে যেন-তেন-প্রকারেণ সাধু শাসনকর্তাকে সেখান থেকে না তাড়িয়ে ছাড়ত না। সময়ে সময়ে, শাসনকর্তা যেখানে শাসন করছেন, সেই দ্বীপ পর্যন্ত তারা কেড়ে নিত। কাজেই সাধুতা ছিল সেখানে ব্যর্থ।
ও সব দ্বীপে স্পানিয়ার্ডরাই সংখ্যায় ছিল বেশি। তাদের শূকরের ব্যবসাই ছিল প্রধান। তারা পাল পাল শূকর পুষত এবং এই সব শূকরের রক্ষিত মাংস তারা জাহাজে করে নানা দেশে চালান দিত। ওসব জায়গায় ফরাসি, ইংরেজ বা ওলন্দাজেরও অভাব ছিল না। তারা এখানে সেখানে আড্ডা গেড়ে বসবাস করত, অনেকে তামাক বা আখের চাষ করত, আবার অনেকের শিকারই ছিল ব্যবসা। স্পানিয়ার্ডরা ছিল ঘোর অত্যাচারী, তারা সুযোগ পেলে এদের উপরও অত্যাচার করতে ছাড়ত না; এরাও তাদের দুচক্ষে দেখতে পারত না, অত্যাচারের নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নিত। স্পানিয়ার্ড, ফরাসি, ইংরেজ, ওলন্দাজ–সবাই ওই সকল দ্বীপের আদিম অধিবাসী লাল মানুষদের বা আফ্রিকা থেকে চালানি নিগ্রোদের ক্রীতদাস করে রাখত। অনেক শ্বেতাঙ্গকেও ইউরোপ থেকে লোভ দেখিয়ে, চুরি করে বা জোর-জবরদস্তি করে ধরে এনে ওসব দ্বীপে বিক্রি করা হত। শ্বেতাঙ্গরাই তাদের কিনত। কিন্তু মনিবদের অত্যাচার ছিল এত অমানুষিক যে, গোলামরা পালিয়ে গিয়ে বোম্বেটের দলে মিশে নিষ্ঠুর জঘন্য জীবন যাপন করাও বাঞ্ছনীয় বোধ করত।
তা হলেই অবস্থাটা কেমন দাঁড়িয়েছিল, দেখুন। স্পানিয়ার্ডরা অধিকাংশ দ্বীপের মালিক --তারা ঘোরতর অত্যাচারী; ক্ষেত-বাড়ির শ্বেতাঙ্গ মালিকরা অত্যাচারী, শিকারীরা অত্যাচারী; বোম্বেটের জলে অত্যাচারী, স্থলে অত্যাচারী; শ্বেতাঙ্গ কৃতদাসেরা প্ৰভুদের হুকুমে বা ব্যবহারে অত্যাচারী; লাল মানুষ বা নিগ্রো ক্রীতদাসেরা মনিবদের অত্যাচারে বা তাদের নিষ্ঠুর আদেশ পালনে অভ্যস্ত হয়ে অত্যাচারী। সর্বত্র অত্যাচার। শুধু অত্যাচার নয়, পাপের বীভৎস লীলা। সুরাপান, ব্যভিচার, জুয়াখেলা, লুটতরাজ, মারামারি, কাটাকাটি, খুন, জখম, অগ্নিকাণ্ড-- পাপ যত মূর্তিতে প্রকাশ পেতে পারে তাই। সপ্তদশ শতাব্দীর সভ্যতার চমৎকার এক পৃষ্ঠা।
বোম্বেটেদের রীতিনীতি সম্বন্ধেও দুচার কথা বলে নিই, কারণ পরে আর বলবার সময় হবে না।
বোম্বেটেদের কোনও নতুন দল গঠিত হলে, সমুদ্রযাত্রা করবার আগে দলের সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হত, কবে তাদের জাহাজ ছাড়বে এবং কাকে কত বারুদ ও বন্দুকের গুলি আনতে হবে। তারপর যাত্রাকালের খাবার জোগাড় করবার ব্যবস্থা হত। তাদের প্রধান খোরাক ছিল শূকর ও কচ্ছপের মাংস। বোম্বেটের প্রায়ই জাহাজ ছাড়বার আগে ছলে-বলে-কৌশলে শূকর সংগ্রহ করত—যথামূল্যে শূকর কেনবার জন্যে কোনওদিনই তারা আগ্রহ প্রকাশ করত না।
তারপর পরামর্শসভায় স্থির হত, শিকার জুটলে কার ভাগে কত অংশ পড়বে। অবশ্য সবচেয়ে বেশি অংশ পেত কপ্তেন, তারপর জাহাজের ডাক্তার। ছুতারমিন্ত্রীও অন্য লোকের চেয়ে বেশি অংশ লাভ করত। কিন্তু সেইসঙ্গে এটাও স্থির থাকত যে শিকার না জুটলে কারুর ভাগ্যে কিছুই জুটবে না।
যুদ্ধবিগ্রহে কেউ মারা পড়লে বা কারুর অঙ্গহানি হলে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থাকত। সবচেয়ে বেশি দাম ছিল ডান হাতের। তারপর যথাক্রমে বাম হাত, ডান পা ও বাম পায়ের দাম। সর্বশেষে, একটা চোখ বা হাতের বা একটা আঙুলের দাম ছিল সমান!
নিজেদের ভিতরে তাদের রীতিমতো একটা বোঝাপড়া ছিল। তাদের প্রত্যেককেই শপথ করতে হত যে, দল ছেড়ে সে পালাবে না বা লুটতরাজের কোনও জিনিসও দলের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখবে না। কেউ অবিশ্বাসী হলে তখনই তাকে দল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হত।
এমন যে অমানুষ ও হিংস্র পশুর দল, কিন্তু দলের ভিতরে তাদেরও পরস্পরের সঙ্গে স্নেহ, প্রেম ও সদ্ভাব ছিল যথেষ্ট। একের দুঃখকষ্টে অন্যে যথেষ্ট সহানুভূতি প্রকাশ করত তো বটেই, উপরন্তু সেই দুঃখকষ্ট দূর করবার জন্য টাকা দিয়ে দেহ দিয়ে যে কোনরকম সাহায্য করতেও নারাজ হত না।
আমরা অতঃপর গল্প শুরু করব। কিন্তু এই গল্প প্রধানত যার বই থেকে নেওয়া হয়েছে তারও পরিচয় দেওয়া দরকার। তার নাম হচ্ছে আলেক্স অলিভিয়ার এক্সকুইমেলিন, জাতে তিনি ওলন্দাজ। তিনি ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। এক্সকুইমেলিন সাহেব আগে নিজেও একজন বোম্বেটে ছিলেন এবং এই পুস্তকে বর্ণিত অধিকাংশ ঘটনাই তার চোখের সামনেই ঘটেছিল। কোনও কোনও ঘটনা, ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল এমন সব বোম্বেটের মুখে তিনি নিজের কাণে শ্রবণ করেছিলেন। তিনি যা দেখেছেন ও যা শুনেছেন সমস্তই হুবহু লিখে ১৬৮৪-৮৫ খ্রিস্টাব্দে পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। সে পুস্তকের এত আদর হয়েছিল যে, ইউরোপের অধিকাংশ ভাষাতেই তার অনুবাদ দেখা যায় এবং এতকাল পরেও তার পুস্তকের নূতন সংস্করণ হচ্ছে। বোম্বেটের নিজের মুখেই বোম্বেটের কাহিনী শুনতে কার না আগ্রহ হয়? আর এক্সকুইমেলিন সাহেবের পক্ষে বিশেষ প্রশংসার কথা হচ্ছে এই যে, কোনও অন্যায়কেই কোথাও তিনি গোপন করেননি বা ফেনানো ভাষার আড়ালে অস্পষ্ট করে তোলবার চেষ্টা করেননি। তার ভাষা সহজ ও সরল। এইজনেই তার কথিত কাহিনীগুলির ঐতিহাসিক মূল্য সামান্য নয়।