জলদস্যু কাহিনী by হেমেন্দ্রকুমার রায়, chapter name 6

6

কালাপাহাড়ি কাণ্ড

 

বোম্বেটে দ্বীপের সমস্ত বোম্বেটের কাছে খবর গেল—স্পেনরাজ্য লুণ্ঠনে মহাবীর লোলোনেজ তোমাদের আহ্বান করছেন!

মড়ার খোঁজ পেলে দলে দলে শকুনি যেমন আকাশ ছেয়ে উড়ে আসে, অ্যাডমিরাল লোলোনেজের কালো পতাকার তরায় চারিদিক থেকেই তেমনি করে ডাকাত, বোম্বেট ও হত্যাকারীর দল ছুটে আসতে লাগল।

এখন, বোম্বেটে দ্বীপে আর একজন মস্ত মাতব্বর ব্যক্তি বাস করে, তার নাম মাইকেল ডি বাস্কো, আপাতত মেজরের পদে অধিষ্ঠিত। ইউরোপের সমুদ্রেও আগে সে বড় একজন বোম্বেটে বলে নাম কিনেছিল। আজকাল অনেক টাকা রোজগার করে বকধার্মিক সেজে পায়ের উপরে পা দিয়ে পরম আরামে বসে বসে খাচ্ছে।

কিন্তু লোলোনেজের বিপুল আয়োজনে প্রচুর লাভের সম্ভাবনা দেখে সে আবার ভালমানুষের মুখোশ খুলে রাখলে। লোলোনেজের কাছে গিয়ে বাস্কো বললে, অ্যাডমিরাল, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সমস্ত পথঘাট আমার নখদর্পণে। তুমি যদি আমাকে প্রধান কাপ্তেনের পদ দাও, আমি তাহলে তোমাকে সাহায্য করতে পারি।

লোলোনেজ এতবড় একজন জাঁদরেল ও শক্তিশালী লোককে পেয়ে তখনই রাজি হয়ে গেল। বাস্কোকে সে কেবল প্রধান কাপ্তেন নয়, স্থলপথেও নিজের ফৌজের সেনাপতির পদে নিযুক্ত করলে।

এবারে আটখানা জাহাজ ও প্রায় সাতশজন লোক নিয়ে লোলোনেজ স্পানিয়ার্ডদের সর্বনাশ করতে বেরুল। সবচেয়ে বড় জাহাজখানা নিলে নিজে, তার ওপরে ছিল দশটা কামান। হাইতি দ্বীপের উত্তরদিক দিয়ে যেতে যেতে প্রথমেই তাদের নজরে পড়ল একখানা প্রকাণ্ড জাহাজ। লোলোনেজের নিজের জাহাজেরও চেয়ে সে জাহাজখানা বড়।

সে ইচ্ছা করলেই আটখানা জাহাজ নিয়ে আক্রমণ করে খুব সহজেই জয়লাভ করতে পারত। কিন্তু এখানে সে যথেষ্ট বীরত্ব ও আত্মশক্তির ওপরে নির্ভরতার দৃষ্টান্ত দেখালে। সে কেবল নিজের জাহাজখানাকে রেখে বাকি সাতখানা জাহাজকে সাভোনা দ্বীপের কাছে গিয়ে অপেক্ষা করতে বললে, তারপর শক্র-তরীর দিকে অগ্রসর হল।

স্পানিয়ার্ডরা বোম্বেটে জাহাজকে আসতে দেখেও ভয় পেলে না। কারণ তাদের জাহাজে ষোলটা কামান ও পঞ্চাশজন সৈনিক ছিল। এই দুঃসাহসই হল তাদের কাল।

যুদ্ধ হল তিন ঘণ্টা ধরে। তারপর স্পানিয়ার্ডদের সমস্ত শক্তি উবে গেল। জাহাজ, ধনরত্ন ও মালপত্তর বোম্বেটেদের হস্তগত হল। বন্দীদের কি দশা হল, প্রকাশ পায়নি। খুব সম্ভব তাদের কারুর কাধের উপরে কেউ আর মাথা বলে কোনও জিনিস দেখতে পায়নি।

অধিকৃত জাহাজখানা নিয়ে লোলেনেজ সানন্দে সাভোনা দ্বীপের দিকে নিজের নৌবাহিনীর খোঁজ করতে গেল। আনন্দের উপরে আনন্দ! সেখানে গিয়ে শোনে, তারাও একখানা ধনরত্বে পরিপূর্ণ জাহাজ হস্তগত করছে। লোলোনেজ বললে, “আমাদের যাত্রা শুভ দেখচি! গাছে না উঠতেই এক কাঁদি।”

সে আবার বোম্বেটে দ্বীপে ফিরে এল। আগে তাড়াতাড়ি ধনরত্ন, মালপত্তর বিলি করবার ও দ্বীপের লাটকে ঘুষ দেবার ব্যবস্থা করলে। আরও নতুন লোকজন নিলে। তারপর যে শক্রজাহাজ দখল করেছিল সেখানাকে নিজে নিয়ে আবার সদলবলে যাত্রা শুরু করলে। এবারে তার দৃষ্টি বিখ্যাত মারাকেবো নগরের দিকে।

মারাকেবো হচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকার ভেনেজুয়েলা প্রদেশের একটি বন্দর নগর। এখান থেকে এখন কফি, চিনি, রবার, কাঠ, চামড়া, নানা ধাতু ও কুইনিন প্রভৃতি চালান দেওয়া হয়। তখনও এ শহরটি প্রসিদ্ধ ব্যবসায়প্রধান স্থান ছিল। এর উত্তরে আছে পচাত্তর মাইল বিস্তৃত ভেনেজুয়েলা উপসাগর ও দক্ষিণে আছে বৃহৎ মারাকেবো হ্রদ। এর বর্তমান লোকসংখ্যা চুয়াত্তর হাজার, কিন্তু যখনকার কথা বলছি, তখন এই শহরের লোকসংখ্যা এত বেশি ছিল না। লোলোনেজ এই শহরের কাছে এসে নঙ্গর ফেললে। তারপর সদলবলে ডাঙায় গিয়ে নামল। শহরে যাবার পথেই পড়ে এক কেল্লা। তাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় জেনে সে যুদ্ধ করবার জন্যে প্রস্তুত হতে লাগল।

কিন্তু দ্বীপের লোকরাও অপ্রস্তুত ছিল না, লোলোনেজের শনির দৃষ্টি যে তাদের উপরে পড়েছে এ খবর তারা আগেই পেয়েছিল।

বোম্বেটের দল কেল্লার দিকে আসছে শুনে সেখানকার লাট একদল সৈন্যকে জঙ্গলের ভিতরে লুকিয়ে থাকবার জন্যে পাঠিয়ে দিলেন। তাদের উপরে হুকুম রইল, কেল্লার সৈন্যেরা যখন বোম্বেটেদের সমুখ থেকে আক্রমণ করবে, তখন তারা তাদের আক্রমণ করবে পিছনদিক থেকে। দুদিক থেকে আক্রান্ত হলে পর বোম্বেটেদের জনপ্রাণীও আর প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে পারবে না।

বন্দোবস্ত খুব ভাল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, লোলোনেজও ঘুমিয়ে ছিল না, সব খবরই সে জানতে পেরেছিল যথাসময়ে। সেও নিজের একদল লোককে জঙ্গলের ভিতরে পাঠিয়ে দিলে এবং তারা এমন বিক্রমে ও সবেগে শত্রুদের আক্রমণ করলে যে, একজন স্পানিয়ার্ডও আর কেল্লার ভিতরে ফিরে যেতে পারলে না!

তারপর তারা কেল্লার দিকে অগ্রসর হল। কেল্লার সৈন্যেরা পাচিলের ওপর বড় বড় ষোলটা কামান বসিয়ে তাদের অভ্যর্থনা করবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে ছিল।

বোম্বেটেরা বার বার কেল্লার দিকে এগিয়ে যায়,কিন্তু ষোলটা তোপের প্রতাপে বারবার ফিরে আসে। তাদের সঙ্গে তোপও ছিল না, বন্দুকও ছিল না—তাদের সম্বল খালি পিস্তল ও তরবারি! কিন্তু অনেকবার ফিরে আসার পর তারা এমন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে দুর্গ আক্রমণ করলে যে, কামানের গোলা ও বন্দুকের অগ্নিবৃষ্টিও আর তাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারলে না, প্রাণের সব মায়া ছেড়ে পাচিল টপকে তারা কেল্লার ভিতরে লাফিয়ে পড়ল। তিনঘণ্টা যুদ্ধের পর দুর্গ এল তাদের দখলে।

ইতিমধ্যে ভগ্নদূত গিয়ে শহরে খবর রটিয়ে দিয়েছে যে, হাজার হাজার বোম্বেটে কেল্লা ফতে করে শহর লুটতে ছুটে আসছে! ভয়ে সে কিছু বাড়িয়েই বললে!

এই মারাকেবো শহর এর আগেও আরও তিন-চারবার শক্ৰদের হাতে পড়েছে। সে যে কী বিপদ, কী যন্ত্রণা, কী বিভীষিকা, বাসিন্দারা আজও তা ভুলতে পারেনি। তখনই চারিদিকে রব উঠল—ওই এল রে, ওই এল! পালা! পালা! পালা! টাকাকড়ি ও মালপত্তর নিয়ে সবাই উর্ধ্বশ্বাসে শহর ছেড়ে লম্বা দিলে—কেউ গেল বনের ভিতরে, কেউ গেল জিব্রালটারের দিকে! বলা বাহুল্য, এই জিব্রালটার হচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকার নতুন শহর। কিন্তু এই নতুন শহরের নামও আজ আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

ওদিকে দুর্গপ্রাকারের উপর থেকে লোলোনেজ সঙ্কেত করে নিজের নৌ-বাহিনীকে জানিয়ে দিলে—পথ পরিষ্কার, তারা ভিতরে ঢুকে অনায়াসেই শহরের দিকে যাত্রা করতে পারে!

জলপথে মারাকেবো শহর সেখান থেকে আঠার মাইল। বোম্বেটের আগে দুর্গটাকে সমূলে ধ্বংস করলে এবং সেই কাজেই গেল পুরো একটি দিন। তারপর তারা নৌবাহিনী নিয়ে একেবারে শহরের কাছে গিয়ে নঙ্গর ফেললে।

একদল বোম্বেটে সমুদ্র থেকে শহরের উপরে গোলাবর্ষণ করতে লাগল, আর একদল নৌকো বেয়ে তীরে উঠে শহরের ভিতরে সার বেঁধে প্রবেশ করলে। কেউ বাধা দিলে না।

বাধা দেবে কে? সব লোক সে মুল্লুক ছেড়ে পিটটান দিয়েছে! বোম্বেটেরা শহরে ঢুকে দেখলে, চারিদিকে খাঁ খাঁ করছে! তখন তারা সেখানকার বড় বড় ও ভাল ভাল বাড়িগুলো দখল করে বসল—তেমন সব বাড়িতে তারা জীবনে কোনওদিন বাস করেনি। বাড়িগুলোর ভিতরে ময়দা, রুটি, শূকর ও মদ প্রভৃতি প্রচুর পরিমাণে পেলে, কিন্তু ধনরত্ন সব যেন অদৃশ্য হয়েছে ফুসমন্ত্রে! যা পেলে তাই নিয়েই তারা আপাতত আমোদ-আহ্লাদ করতে বসল বটে, তবে তাদের বড় আশায় ছাই পড়ল!

কিন্তু লোলোনেজ হাল ছাড়লে না। সে জনকয়েক বোম্বেটেকে পাঠিয়ে দিলে বনের ভিতরটা আঁতিপাতি করে খুঁজে দেখতে।

সেই রাত্রেই বোম্বেটেরা বনের ভিতর থেকে বিশজন স্ত্রী-পুরুষ, গাধার পিঠে চাপনে নানারকম মাল ও প্রায় নগদ লক্ষ টাকা নিয়ে ফিরে এল। কিন্তু একটা এত বড় শহরের পক্ষে লক্ষ টাকা তো তুচ্ছ জিনিস!

লোলোনেজ স্পানিয়ার্ডদের ডেকে জিজ্ঞাসা করলে, টাকাকড়ি কোথায় লুকিয়ে ফেলেছিস?

তারা কোনও সন্ধান দিলে না। তখন তাদের ভীষণ যন্ত্রণা দেওয়া হতে লাগল। তার ফলে কেবল জানা গেল যে টাকাকড়ি সব বনের ভিতরে লুকানো আছে। কিন্তু কোথায় আছে, সে ঠিকানা পাওয়া গেল না।

লোলোনেজ রাগে অগ্নিমূর্তি হয়ে উঠল। সে হঠাৎ খাপ থেকে তলোয়ার খুলে একজন স্পানিয়ার্ডকে তখনই কেটে কুচি কুচি করে ফেললে। তারপর চোখ পাকিয়ে বললে, কী! বলবিনি! তাহলে একে একে সকলকেই আমি মোরগের মতো জবাই করব!

এই নরপশুর ভয়ঙ্কর স্বভাব দেখে বন্দীরা স্তম্ভিত হয়ে গেল! একজন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললে, বনে যারা লুকিয়ে আছে, চলুন তাদের দেখিয়ে দিচ্ছি!

কিন্তু ডাকাতরা তাদের খুঁজতে আসছে, বনবাসী নাগরিকরীসে খবর পেয়েই উর্ধ্বশ্বাসে আবার নতুন এক জায়গায় গিয়ে গা ঢাকা দিলে। বোম্বেটেরা কারুর টিকি পর্যন্ত দেখতে পেলে না।

নিরুপায় হয়ে বোম্বেটেরা দিন পনের সেই শহরেই বাস করলে।

তারপর লোলোনেজ বললে, বন্ধুগণ, এই শহরের ধড়িবাজ লোকগুলো আমাদের কলা দেখাতে চায়! এখানে অনেক খাবারদাবার আছে বটে, কিন্তু খাবার খেতে আমরা এখানে আসিনি। এখানকার ধনরত্ন ওরা সব জিব্রালটারে নিয়ে গেছে—চলো, আমরা জিব্রালটার আক্রমণ করিগে!

তার অভিপ্রায় হওয়ার আগেই জিব্রালটারে গিয়ে পৌছল! সবাই আবার সে শহর ছেড়ে অন্য জায়গায় পালাবার জোগাড় করলে।

কিন্তু সেখানকার শাসনকর্তা বললেন, তোমাদের কোনও ভয় নেই। আসুক না বোম্বেটেরা–এখানে এলে বাছারা মজাটা টের পাবেন! আমি তাদের সমূলে বিনাশ করব!

শাসনকর্তা ছিলেন একজন পাকা যোদ্ধা, তিনি ইউরোপে অনেক লড়াই করেছেন। তিনি তখনই অসংখ্য কামান ও আটশজন সৈন্য নিয়ে বোম্বেটেদের অভ্যর্থনার আয়োজন করতে লাগলেন। সমুদ্রের দিকে কুড়িটি কামান বসানো হল। আর একদিকে বসানো হল আটটা বড় বড় কামান। শহরে যাবার একটি রাস্তা খুব শক্ত বেড়া দিয়ে বন্ধ করা হল। আর একটা রাস্তা খুলে রাখা হল—তাতে এমন পুরু পাক ও কাদা ছিল যে, সেখান দিয়ে পথ-চলাচল করা প্রায় অসম্ভব। সে পথে যারা আসবে সৈন্যদের অগ্নিবৃষ্টিতে তাদের অবস্থা হবে শোচনীয়।

বোম্বেটেরা যথাসময়ে নগর থেকে খানিক তফাতে এসে দেখলে, শহরের উপরে স্পেনরাজের পতাকা উড়ছে সগর্বে এবং স্পানিয়ার্ডরা শ্রেণীবদ্ধ হয়ে তাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। এরা যে যুদ্ধের জন্যে এমন বিপুল আয়োজন করবে, লোলোনেজ তা কল্পনাও করতে পারেনি। কিন্তু এজন্যে সে ভীত হল না, দলের মাথাওয়ালা লোকদের ডেকে পরামর্শ করতে বসল। পরামর্শ হচ্ছে এই যে, স্পানিয়ার্ডরা যখন উচিতমতো আত্মরক্ষা করবার জন্যে এত বেশি সময় পেয়েছে এবং তাদের সৈন্যসংখ্যাও যখন এমন অসামান্য, তখন তাদের আর আক্রমণ করা উচিত কিনা! লোলোনেজ বললে, “কিন্তু তবু আমি হতাশ হবার কারণ দেখি না। তোমরা অনায়াসেই বুক বেঁধে দাঁড়াতে পারে! বীরপুরুষের মতো আত্মরক্ষা করবার শক্তি আমাদের আছে। আমি তোমাদের সর্দার, আমি যা বলি তাই করো। এর আগেও আজকের চেয়ে কম লোক নিয়ে আমরা এর চেয়েও বড় বিপদকে এড়াতে পেরেছি। শত্রুরা দলে যত ভারি হবে, আমাদের গৌরবও তত বাড়বে!”

বোম্বেটেদের ধারণা ছিল যে মারাকেবোর সমস্ত ধনরত্নই এইখানে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। অতএব তারা একবাক্যে বললে, “সর্দার, তুমি যা বলবে আমরা তাই করব! তুমি যেখানে যাবে আমরা সেইখানেই যাব!

লোলোনেজ বজ্ৰগম্ভীর স্বরে বললে, সাবাস! কিন্তু শুনে রাখো, তোমাদের মধ্যে যে কেউ একটু ভয় পাবে, আমি তাকেই নিজের হাতে গুলি করে মেরে ফেলব!

প্রায় চারশ বোম্বেটে যুদ্ধের আগে পরস্পরের সঙ্গে করমর্দন করে বিদায় নিলে—সে দিন যে কার জীবনের শেষদিন, তা কে জানে?

লোলোনেজ সকলকার আগে গিয়ে দাঁড়িয়ে নেতার স্থান অধিকার করলে। তারপর শূন্যে তরবারি তুলে দৃপ্তকষ্ঠে বললে, “ভাই সব! এসো আমার সঙ্গে—‘মাভৈঃ!’ সকলে তার অনুসরণ করলে।

প্রথম পথে গিয়ে তারা দেখলে, তা এমন ভাবে বন্ধ যে এগুবার কোনও উপায় নেই। দ্বিতীয় পথ হচ্ছে পাক ও কাদাভরা পথ-সেটা স্পানিয়ার্ডদের ফাঁদ! তারা বনজঙ্গল থেকে ডালপালা-পাতা কেটে এনে পথের ওপরে পুরু করে ছড়িয়ে দিতে লাগল—যাতে করে পাকে-কাদায় পা বসে যাবে না। ইতিমধ্যে স্পানিয়ার্ডদের কামান ও বন্দুক এমন ভীষণ গর্জন করতে লাগল যে, বোম্বেটেরা পরস্পরের গলার আওয়াজ পর্যন্ত শুনতে পেলে না! কিন্তু সেই ভয়াবহ গুলিগোলা বৃষ্টির ভিতর দিয়েও তারা নিৰ্ভয়ে ও অটল পদে সমান অগ্রসর হতে লাগল।

অবশেষে তারা শুকনো মাঠের উপরে এসে পড়ল। এখানে আরও ছয়টা বড় বড় নতুন কামান অগ্নি উদগার করতে আরম্ভ করলে! ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় চারিদিক অমাবস্যার চেয়ে অন্ধকার! তার উপরে শক্ররা আবার দুর্গ ছেড়ে বেরিয়ে এসে সবেগে তাদের আক্রমণ করলে! সে এমন প্রবল আক্রমণ যে, বোম্বেটেরা পিছু না হটে পারলে না! তাদের দলের অনেক লোক হত ও আহত হয়ে রক্তাক্ত মাটির উপরে লুটোতে লাগল।

বোম্বেটেরা বনের ভিতর অন্য কোনও নতুন রাস্তা আবিষ্কারের চেষ্টা করলে--কিন্তু রাস্তা কোথাও নেই! শক্ররা আর কেল্লা ছেড়ে বেরুবার নামও করলে না—কিন্তু আড়াল থেকে সমান গোলাগুলি চালাতে লাগল।

লোলোনেজ তখন ভেবে চিন্তে পৃথিবীতে সব দেশেই সুপরিচিত একটি পুরনো উপায় অবলম্বন করলে—সকলকেই দিলে হঠাৎ একসঙ্গে পালিয়ে যেতে হুকুম!

তাদের ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে দেখে স্পানিয়ার্ডরা মহা উৎসাহে বলে উঠল—ওরা পালাচ্ছে! ওরা পালাচ্ছে! এসো, পিছনে পিছনে গিয়ে ওদের আমরা বধ করি!—তারা সার ভেঙে বিশৃঙ্খল হয়ে বোম্বেটেদের পিছনে পিছনে তেড়ে এল।

স্পানিয়ার্ডরা যখন অতিরিক্ত উৎসাহের ঝোকে কামানের গোলার সীমানা ছাড়িয়ে এগিয়ে এসেছে—বোম্বেটেরা তখন সর্দারের হুকুমে আচম্বিতে আবার ফিরে দাঁড়াল এবং প্রচণ্ডবিক্রমে শক্ৰদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ল! বিষম হাতাহাতি লড়াই শুরু হল।

খানিক পরে দেখা গেল, দু’শ স্পানিয়ার্ডের দেহ পৃথিবীকে বুকের রক্তে রাঙা করে ছেয়ে আছে এবং বাকি সবাই কেল্লার দিকে আসতে না পেরে বনের দিকে প্রাণের ভয়ে পলায়ন করছে!

কেল্লার স্পানিয়ার্ডরা তাই দেখে হতাশ ভাবে কামান ছোড়া বন্ধ করে বলে উঠল-- আমরা আত্মসমৰ্পণ করছি। আমাদের বধ কোরো না।

কেল্লার উপর থেকে তখনই স্পেনের রাজপতাকা নামিয়ে ফেলা হল—সেখানে উড়তে থাকল বোম্বেটেদের পতাকা! কেল্লা ফতে! শহর তাদের হাতের মুঠোয়!

কিন্তু সাবধানের মার নেই—বলা তো যায় না, বনের পলাতক শক্ররা আবার যদি সাহস সঞ্চয় করে ফিরে আসে! বোম্বেটেরা কেল্লার কামানগুলো আবার নিজেদের সুবিধামতো সাজিয়ে রাখলে।

মিথ্যা ভয়! রাত্রি প্রভাত, যারা পালিয়েছে তারা আর ফিরল না।

তখন হিসাব নিকাশ করে দেখা গেল, শক্ৰদের মৃতদেহের সংখ্যা পাঁচশত। শহরের ভিতরে আহত লোকও অসংখ্য এবং তাদের ভিতরেও অনেকে মারা পড়ছে ও মারা পড়বে। বন্দি শত্রুর সংখ্যা একশ পঞ্চাশ ও ক্রীতদাসেরা গুণতিতে পাঁচশত।

বোম্বেটেদের লোক মরেছে মাত্র চল্লিশ জন এবং জখম হয়েছে চল্লিশ জন—যদিও ক্ষত বিষিয়ে আহতদেরও অধিকাংশই মারা পড়ল।

বোম্বেটেরা শত্রুদের মৃতদেহ নিয়ে দুখানা নৌকো বোঝাই করলে, তারপর সমুদ্রের ভিতরে গিয়ে নৌকো দুখানা ডুবিয়ে দিলে।

তারপর আরম্ভ হল লুট! সোনার তাল, রুপের তাল, হীরে-মুক্তো, ভাল ভাল দামী আসবাব ও নানারকম মাল-শহরের কোথাও আর কিছু বাকি রইল না! কিন্তু লোভ এমনই জিনিস, সারা শহর লুটেও বোম্বেটোদের আশ মিটাল না, তাদের সন্দেহ হল আরও অনেক ধনরত্ন লুকিয়ে ফেলা হয়েছে। সুদীর্ঘ আঠার দিন ধরে চলল অবাধে এই পরস্বপহরণের বীভৎস পালা!

এরই মধ্যে বন্দি স্পানিয়ার্ডদের অধিকাংশই ইহলোক ত্যাগ করলে-অনাহারে! শহরে খাবার জিনিস-বিশেষ করে তাদের প্রধান আহার্য মাংসের যারপরনাই অভাব! যা ছিল তা বোম্বোেটদেরই পক্ষে অপ্রচুর। তা থেকে বন্দীদের ভাগ কেউ দিলে না। বন্দীদের খেতে দেওয়া হত খচ্চর ও গাধার মাংস। অনেকে তা মুখেই তুলতে পারত না, ক্ষিধের চােটে যারা তাও খেতে বাধ্য হত, অনভ্যাসের দরুন তারা পেটের অসুখে ভুগে ভবলীলা সাঙ্গ করলে। অনেক বন্দীকে গুপ্তধন দেখিয়ে দেবার জন্যে এমন দুঃসহ ও পাশবিক যন্ত্রণা দেওয়া হল যে, সইতে না পেরে তারাও পরলোকে প্রস্থান করলে।

অল্প যে কয়েকজন বেঁচে ছিল, লোলোনেজ তাদের ডেকে বললে, তোমাদের ছেড়ে দিচ্ছি। তোমরা বনের ভিতর গিয়ে তোমাদের সঙ্গীদের বলগে যাও যে, আমাকে আরও অনেক টাকা না দিলে আমি এই শহরে আগুন ধরিয়ে দেব। যাও, দুদিন সময় দিলুম।

দুদিন কেটে গেল। বোম্বেটেরা তখন শহরে আগুন ধরাতে আরম্ভ করলে। স্পানিয়ার্ডরা দূর থেকে তাই দেখতে পেয়ে তখনই দূত পাঠিয়ে দিলে। সে এসে জানালে,—টীকা এখনই নিয়ে আসা হবে, দয়া করে আপনারা আগুন নিবিয়ে দিন!

বোম্বেটেরা রাজি হল বটে, কিন্তু ততক্ষণে শহরের এক অংশ পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে গেছে!

তারপর তাদের টাকা এল। তবু চার হাপ্ত সেই শহরে দৈত্যলীলা করে সমস্ত ধনরত্ন নিয়ে তারা আবার জাহাজে গিয়ে উঠল।

আবার তারা মারাকেবো শহরে এসে হাজির! পাপ বিদায় হয়েছে ভেবে যারা ভরসা করে শহরে ফিরে এসেছিল, তারা ফের পালাতে লাগিল!

বোম্বেটেরা তাদের খবর পাঠিয়ে দিলে যে, হয় আমাদের ধনরত্ন দিয়ে খুশি কর, নয় আমরা সারা শহর আবার লুট করে আগুন ধরিয়ে দেব!

অনেক টাকা পাঠিয়ে মারাকেবোর অধিবাসীরা এই আসন্ন বিপদ থেকে উদ্ধারলাভ করলে। বিজয়গর্বে ফুলে উঠে লোলোনেজ আবার বোম্বেটে দ্বীপে ফিরে এল। তাদের অপূর্ব সৌভাগ্যের কাহিনী ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল-যারা তার সঙ্গী হয়নি তারা অনুতাপে হাহাকার করতে লাগল।

লোলোনেজ দলের প্রত্যেককে তার প্রাপ্য অংশ কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়ে দিলে-প্রত্যেকেরই রোগা পকেট মোটা হয়ে ফুলে উঠল। কিন্তু তারা এমনই লক্ষ্মীছাড়া যে, জুয়া খেলে আর মদ খেয়ে দুহাতে টাকা ওড়াতে লাগল। সে পাপের ধন আর বেশিদিন রইল না—অল্পদিন পরেই তারা যে গরিব ছিল সেই গরিবই হয়ে পড়ল। তখন তারা আবার নতুন শিকারের খোজে বেরিয়ে পড়বার জন্যে আগ্রহপ্রকাশ করতে লাগল!

সবাই বলে, সর্দার! আবার সাগরে জাহাজ ভাসাও!

সর্দার বলে, তথাস্তু!

 

মহাবিচারকের বিচার

 

বোম্বেটে দ্বীপে যদি ভাল গণৎকার থাকত তাহলে নিশ্চয়ই সে বলত, লোলোনেজ, সাবধান! এবারের যাত্রা শুভ নয়!

কিন্তু সে কথা সে কানে তুলত কিনা, সন্দেহ! নিয়তির সূত্র তাকে বাইরে টানছে। সে অনেক পাপ করেছে, এবারে প্রতিক্রিয়ার সময় এসেছে!

ভবিষ্যৎ ভাববার সময় তার ছিল না, বর্তমানের ঔজ্জ্বল্যে সে অন্ধ! বোম্বেটে দ্বীপে তার চেয়ে বড় নাম আজ আর কারুর নেই-সবাই তাকে ভয় করে সম্মান করে শ্রদ্ধা করে, যেন সে নরদেবতা! যেমন তার শক্তি, তেমনই ঐশ্বৰ্য্য!

কিন্তু তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাকে স্থির থাকতে দিলে না। তাই আবার সে যেদিন সমুদ্রযাত্রা করবে বললে, সেদিন সারা দেশে আনন্দ ও উৎসাহের বন্যা বইল! এবারে আর লোকজনের জন্যে তাকে একটুও মাথা ঘামাতে হল না, লোলোনেজের সঙ্গী হয়ে বিপদে পড়তেও লোকের এত আগ্রহ যে, তার দরজার সামনে উমেদার আর ধরে না। যত লোক সে চায়, তার চেয়ে ঢ়ের বেশি লোক এসে তার কাছে ধর্না দিয়ে পড়ল।

লোলেনেজ নতুন করে ছয়খানা জাহাজ সাজালে। এবারে তার সঙ্গীর সংখ্যা হল সাতশত, এর মধ্যে তিনশজন আগের বারেও তার সঙ্গে গিয়েছিল।

লোলোনেজ বললে, এবারে আমি নিকারাগুয়া জয় করতে যাব।

আবার সমুদ্র। বাংলায় সমুদ্রের আর এক নাম ‘রত্নাকর’ এবং এই বোম্বেটোদের পক্ষে সমুদ্র রত্নাকরাই বটে।

কিন্তু এবারে রত্বের এখনও দেখা নেই! তার উপরে অনুকূল বায়ুর অভাব, বোম্বোটদের জাহাজগুলো যেন অগ্রসর হতেই নারাজ! এইভাবে কিছুদিন কটবার পরেই খাদ্যাভাব উপস্থিত হল। তখন বাধ্য হয়েই বোম্বেটের প্রথম যে বন্দর দেখতে পেলে সেইখানেই জাহাজনঙ্গর করলে। সমুদ্র থেকে একটা নদী ডাঙার মধ্যে গিয়ে ঢুকেছে, নাম তার জাগুয়া। তার তীরে তীরে অসভ্য ও দরিদ্র লাল মানুষ বা রেড ইন্ডিয়ানের বাস। বোম্বেটেরা নীেকোয় চড়ে সেই নদীর ভিতরে গেল এবং রেড ইন্ডিয়ান বেচারাদের পালিত পশু ও অন্যান্য মালপত্তর নিঃশেষে কেড়ে নিলে-নিজেদের খাদ্যভাব দূর করবার জন্যে।

কেবল তাইতেই খুশি হল না। তারা স্থির করলে, যতদিন না অনুকূল বাতাস বয় ততদিন তারা আর বাহির সমুদ্রে যাবে না, এই দেশের যত শহর আর গ্রাম লুট করে সময় কাটাবে আর পকেট পূর্ণ করবে।

তারা গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর লুট করতে করতে পুয়ের্টে কাভাল্যো (মূল গ্রন্থের এই নামটি সম্ভবত ভুল। মধ্য আমেরিকার সমুদ্র উপকূলে পুয়ের্টে কাভালো নামে কোনও বন্দরের সন্ধান পাওয়া যায় না! দক্ষিণ আমেরিকার ভেনেজুয়েলা প্রদেশের সমুদ্র উপকূলে ওই নামের একটা সমৃদ্ধিশালী বন্দর আছে। কিন্তু লোলোনেজ এবার এ অঞ্চলে আসেনি। খুব সম্ভব, সে হণ্ডুরাস উপসাগরের মুখে পুয়োের্ট কার্টজ বন্দরে বাহিনী রেখে ভিতরে প্রবেশ করেছিল। কার্টজ বন্দর থেকে প্রায় ৩৬ মাইল ভিতর দিকে সান পেড্রো বা সেন্ট পিটার শহর এখনও বিদ্যমান রয়েছে। আমাদের পুস্তকের মানচিত্রে অনবধানত বশত কার্টজ বন্দর ও সেন্ট পিটার শহর দেখানো হয়নি। Everyman Encyclopaedia- World Atlas ভলুমের ১৯৪ পৃষ্ঠা দেখুন।) নামে এক বন্দরে এসে হাজির হল। সেখানে স্পানিয়ার্ডদের একটা আস্তানা ও একখানা বড় জাহাজ তিতার তৎক্ষণাৎ জাহাজখন দখল করে স্পািনয়ার্ডদের আস্তান ঘটে আগুন জ্বলিয়ে এর মধ্যে তারা কত লোককে বন্দি করেছে, কত বন্দীকে অকথ্য যন্ত্রণা দিয়েছে ও কত বন্দীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে, তার আর সংখ্যা হয় না। লোলোনেজের প্রকৃতি অতি ভয়ঙ্কর! কারুর জিভ সে নিজের হাতে টেনে বার করে ফেলে, কারুকে বা স্বহস্তে কেটে খণ্ড খণ্ড করে! যেখােন দিয়ে তার দল পথ চলে সেখানটাই যেন ধুধু শ্মশান হয়ে যায়! যেন সে নরদেহে প্ৰলয়কর্তা, যথেচ্ছভাবে ধ্বংস করাই তার একমাত্র কর্তব্য! স্পানিয়ার্ডদের কাছে সে যেন সাক্ষাৎ যম!

লোলোনেজের সঙ্গে আছে এখন তিনশ বোম্বেটে,-বাকি লোকজন ও জাহাজগুলি সে তার সহকারী মোসেস ফ্যান ফিন নামে এক ওলন্দাজের তত্ত্বাবধানে সমুদ্র উপকূলে রেখে এসেছে। প্রায় ছত্ৰিশ মাইল পথ হেঁটে লোলেনেজী সান পেড্রো বা সেন্ট পিটার শহরের কাছাকাছি একটা বনের ধারে এসে পড়ল।

তার অত্যাচারে পাগলের মতো হয়ে স্পানিয়ার্ডরা বনের মধ্যে অপেক্ষা করছিল। বোম্বোটদের দেখেই তারা গুলিবৃষ্টি আরম্ভ করলে। এখানে রীতিমতো একটা লড়াই হয়ে গেল এবং দুই পক্ষেই অনেক লোক হত ও আহত হল। তারপর স্পানিয়ার্ডরা পৃষ্ঠভঙ্গ দিলে। শত্ৰুদের যারা জখম হয়েছিল তাদের কারুর উপরেই বোম্বেটেরা দয়া করলে না-একে একে সবাইকে পরলোকের পথে পাঠিয়ে দিলে।

যারা বন্দি হল তাদের ডেকে লোলোনেজ বললে, এই বনের ভেতর দিয়ে শহরে যাবার আর কোনও ভাল। রাস্তা আছে?

তারা বললে, না।

লোলোনেজ আবার গর্জন করে বললে, ভাল চাস তো এখনও বল!

লোলোনেজের মগজে শয়তান জেগে উঠল। সামনেই যে স্পানিয়ার্ড দাঁড়িয়েছিল, ঘাড় ধরে তাকে কাছে টেনে আনলে-যেন সে তারই মতো মানুষ নয়, তুচ্ছ একটা বলির পশু মাত্র! ফস করে খাপ থেকে চকচকে তলোয়ারখানা বার করে ফেললে এবং সেই হতভাগ্য স্পানিয়ার্ডের বুকের ভিতরে তরোয়ালের ডগা ঢুকিয়ে দিয়ে মস্ত একটা ছিদ্রের সৃষ্টি করলে-তার মর্মভেদী আর্তনাদে কিছুমাত্র কান না পেতেই! তারপর সেই তখনও জীবন্ত দেহের ছ্যাঁদা করা বুকের মধ্যে নিজের হাত ঢুকিয়ে দিলে এবং তার নৃত্যশীল, তপ্ত ও রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ডটা সজোরে ছিনিয়ে নিয়ে নিজের মুখে পুরে পরম উপাদেয় খাদ্যের মতো কচমচ করে চিবোতে চিবোতে বললে, “বল কোথায় রাস্তা আছে? নইলে তোদের হৃৎপিণ্ডও আমার খাবার হবে!

গল্পের রাক্ষস কি আজ মানুষ মূর্তিতে সমুখে দেখা দিয়েছে? না এ ভূত-প্ৰেত, পিশাচ? বন্দীদের হৃৎপিণ্ডও যেন মহা আতঙ্কে বুকের ভিতরেই মূৰ্ছিত হয়ে পড়ল। শিউরোতে শিউরোতে তারা প্ৰায় রুদ্ধস্বরে বললে,--আমরা পথ দেখিয়ে দিচ্ছি, আমরা পথ দেখিয়ে দিচ্ছি!

রক্তমাখা ওষ্ঠাধর ফাঁক করে হা হা হা হা করে অট্টহাসি হাসতে হাসতে লোলোনেজ বললে, পথে এসো বাবা, পথে এসো! কোথায় পথ?

কিন্তু কোথায় পথ? গভীর অরণ্য, গাছের পর গাছ জড়ােজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের পায়ের তলায় কাঁটা ঝোপ আর জঙ্গল,—অজগর সাপ ও জাগুয়ার বাঘ ছাড়া সেখান দিয়ে আর কেউ আনাগোনা করে না। বন্দীরা ভয়ে ভেবড়েই পথের নাম মুখে এনেছিল, আসলে সেখানে কোনও পথ ছিল না!

দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে লোলোনেজ বললে, ‘পথ নেই? আচ্ছা স্পানিয়ার্ড কুত্তারাই এজন্যে শাস্তিভোগ করবে!’ লোলোনেজের শাস্তি-না জানি সে কী ভয়ানক!

এদিকে ও অঞ্চলের স্পানিয়ার্ডরা বুঝলে, এই দুর্ধর্ষ ও পাপিষ্ঠ বোম্বোটেদের জব্দ ও কাহিল করবার সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে, বনের ভিতরে অতর্কিতে বার বার আক্রমণ করা! এমনই বারংবার আক্রমণের ফলে বোম্বেটের সত্যসত্যই মহা জ্বালাতন হয়ে উঠল এবং তাদের সংখ্যাও ক্রমেই কমে আসতে লাগিল! কিন্তু বাঁধা পেয়েও শেষপর্যন্ত তারা সেন্ট পিটার শহরের কাছাকাছি এসে পড়ল।

এবার বিষম যুদ্ধ আরম্ভ হল। এ যুদ্ধে স্পানিয়ার্ডরা বড় বড় কামানও ব্যবহার করতে ছাড়লে না। কিন্তু যেই তারা কামান ছেড়ে, লোলোনেজের আদেশে বোম্বেটের অমনি মাটির উপরে শুয়ে পড়ে, তারপর গোলাগুলো তাদের পর হয়ে শূন্য দিয়ে চলে গেলেই, তারা চোখের নিমেষে উঠে পড়ে শহরের দিকে এগিয়ে যায় এবং হাই হই রবে বোমার পর বোমা ছুড়তে থাকে! বোমা ছুড়ে বহু শত্রু নিপাত করেও একবার স্পানিয়ার্ডদের প্রবল আক্রমণে চােখে সর্ষেফুল দেখতে দেখতে বোম্বেটেরা উর্ধ্বশ্বাসে পালিয়ে এল। কিন্তু লোলোনেজের দৃপ্ত বাক্যে উত্তেজিত হয়ে আবার তারা ফিরে দাঁড়িয়ে তেড়ে গেল! তখন স্পানিয়ার্ডদের সব সাহস ও শক্তি ফুরিয়ে গিয়েছে। সাদা নিশান হাতে করে শক্রদূত এসে জানালে, “আমরা শহরের ফটক খুলে দিচ্ছি-কিন্তু এই শর্তে যে, দুঘন্টার ভিতরে আমাদের উপরে কেউ কােনও অত্যাচার করতে পারবে না।

আর বেশি লোকক্ষয় করতে না চেয়ে লোলোনেজ এই শর্তেই রাজি হয়ে গেল। শহরের ফটক খুলল। বোম্বেটেরা সার বেঁধে ভিতরে গিয়ে ঢুকল।

লোলোনেজ আজ একটু ভদ্রতার পরিচয় দিলে। ঠিক দুটি ঘণ্টা সে লক্ষ্মীছেলের মতো হাত গুটিয়ে চুপটি করে বসে রইল। শত্রুরা দামী জিনিসপত্তর নিয়ে দলে দলে সরে পড়ছে দেখেও নিজের শয়তানীকে সে চেপে রাখলে! হঠাৎ তার এ সাধুতা, এ দুর্বলতা কেন? এ অনুতাপ কি অন্মিমকালের হরিনামের মতো?

ঠিক দুঘণ্টার জন্যে সৎপ্রবৃত্তির আনন্দ উপভোগ করে কুম্ভকৰ্ণ আবার ভীম হুঙ্কারে জেগে উঠল—‘লুট করো! বন্দি করো! হত্যা করো! দুঘণ্টা কাবার!’ যারা তখনও পালাতে পারেনি তারা এবং শহরে তখনও যা অবশিষ্ট ছিল সমস্তই বোম্বেটোদের হস্তগত হল। কিন্তু সে এমন বেশিকিছু নয়! স্পানিয়ার্ডরা সন্ধির দুঘণ্টার রীতিমতো সদ্ব্যবহার করেছে।

বোম্বেটের দিনকয় নগরেই বাস করলে, এবং এ কয়দিন তাদের স্বভাবগত নিষ্ঠুরতার, কদৰ্যতার ও ভীষণতার পরিচয় দিতে কিছুমাত্র ত্রুটি করলে না। এখান থেকে যাত্রা করবার দিনে তারা শহরেও আগুন লাগিয়ে দিয়ে গেল। সেই সাঙ্ঘাতিক দেওয়ালি উৎসব শেষ হলে পর দেখা গেল, আগে যেখানে শহর ছিল এখন সেখানে পড়ে রয়েছে শুধু বিরাট একটা ভস্মের পাহাড়!

সেন্ট পিটার শহর ধ্বংস করে লোলোনেজ খোশমেজাজে সমুদ্রতীরে ফিরে এল। তার দলের যে সব লোক জাহাজ ও নৌকা নিয়ে সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিল, তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে সে আবার নতুন শিকারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল।

দু'একদিন পরে গুয়াটেমালা নদীর মোহানায় এসে বোম্বেটেরা খবর পেলে যে, স্পানিয়ার্ডদের একখানা জাহাজ সেখানে এসে উপস্থিত হবে। তারা সেই জাহাজের অপেক্ষায় দলে দলে সেখানে পাহারা দিতে লাগল। কোনও দল সাগরের বুকে ছোট ছোট দ্বীপে কাছিম ধরতে গেল। কোনও দল গেল। সেখানকার রেড ইন্ডিয়ান ধীবরদের উপরে অত্যাচার করতে।

সেখানকার রেড ইন্ডিয়ানরা তখন একশ বছর ধরে স্পানিয়ার্ডদের অধীনে বাস করে আসছে। স্পানিয়ার্ডদের চাকর বাকর দরকার হলে তারাই এসে কাজকর্ম করে দিয়ে যায়। স্পানিয়ার্ডরা তাদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা দিয়েছিল।

কিছুকাল তারা খ্রিস্টধর্মের নিয়ম পালন করে। কিন্তু স্পানিয়ার্ড প্ৰভুদের অধ্যামিকের মতো ব্যবহার ও হিংস্র আর পশু প্রকৃতি দেখে খ্রিস্টধর্মে বোধহয় তাদের ভক্তি চটে যায়। তখন আবার তারা পিতৃ-পিতামহের ধর্মকে ফিরে ফিরতি গ্রহণ করে।

হিন্দুদের নাকি তেত্ৰিশ কোটি দেবতা আছে। কিন্তু তাদের দেবতাদের ‘সেনসাস’ কখনও নেওয়া হয়েছিল কিনা জানিনা। তবে রেড ইন্ডিয়ান দেবতারাও দলে খুব হালকা হবেন বলে মনে হয় না। কেননা তাদের ঘরে ঘরে নূতন নূতন দেবতার রকম-বেরকম লীলাখেলা দেখা যায়।

তাদের দেবতা নির্বাচনের একটা পদ্ধতির কথা বলি। পরিবারের মধ্যে যে মুহূর্তে একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে, তারা তখনই তাকে নিয়ে বনের ভিতরে মন্দিরে গিয়ে উপস্থিত হয়।

মেঝের উপরে মণ্ডলাকারে খানিকটা জায়গা খুঁড়ে তার মধ্যে পুরু করে ছাই বিছিয়ে দেয়। তারপরে সেই ছাইয়ের উপরে নবজাত শিশুকে শুইয়ে রেখে চলে আসে। মন্দিরের চারিদিকের সব দরজা খোলা থাকে। তার কাছে আর জনপ্ৰাণীও যায় না। যে কোনও হিংস্র জন্তু মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে, কিন্তু কোনও মানুষ আসবার হুকুম নেই। সারারাত এই ভাবে কেটে যায়!

সকালে শিশুর পিতা ও অন্যান্য আত্মীয়েরা আবার মন্দিরের ভিতরে আসে। অনেক সময়ে দেখা যায়, হিংস্ৰ জন্তুর আক্রমণে বা অন্য কারণে শিশুর মৃত্যু হয়েছে। অনেক সময়ে দেখা যায়, জীবস্ত ও অক্ষত শিশুকে। তখন সকলে ছাঁইয়ের উপরে কোনও জন্তুর পদচিহ্ন আছে কিনা পরীক্ষা করে। পদচিহ্ন যদি না থাকে, তবে সেই শিশুকে আবার সেখানে একলা রূপান্ত হয়। আর পহি দি থাকে।তবে পরখ কেরখেছি সেগুলাে কােন জন্তুর পদচিহ্ন।

যে জন্তুর পদচিহ্ন সেখানে থাকবে, সেই জন্তুই হবে শিশুর দেবতা,-তার সারা জীবনের উপাস্য!

এখন আবার বোম্বেটেরা কি করছে দেখা যাক। প্ৰায় তিনমাস পরে খবর এসেছে, স্পানিয়ার্ডদের জাহাজ বন্দরে দেখা দিয়েছে। সবাই সেইদিকে ছুটল।

বড় যে সে জাহাজ নয়, প্ৰকাণ্ড আকার, উপরে অনেক সৈন্যসামন্ত, বিয়াল্লিশটা কামান! কিন্তু এ সবের দিকে লোলোনেজ একটুও ভ্রুক্ষেপ করলে না, সে ভয়ের ধার ধারে না। বোম্বেটেরা একজোট হয়ে জাহাজখানাকে আক্রমণ করলে এবং জাহাজের একশ ত্ৰিশজন সৈন্যও তাদের বাধা দেবার জন্যে কম চেষ্টা করলে না, তবু শেষকালে জিত হল বোম্বোটেদেরই। কিন্তু এত পরিশ্রম ও লোকক্ষয়ের পরে জাহাজ দখল করেও বোম্বেটেরা হতাশ হয়ে পড়ল। তার ভিতরে লুট করবার মতো বিশেষ কিছুই নেই।

লোলোনেজ তখন পরামর্শসভা আহ্বান করলে। সে বললে, এইবারে আমি গুয়াটেমালার দিকে যেতে চাই। তোমাদের মত কি?

অনেকেই বললে, আমরা এইবার এ দেশ ছেড়ে ফিরে যেতে চাই।

লোলোনেজ বললে, কিন্তু আমি ফিরব না।

যারা এ কথা বললে তাদের অধিকাংশই হচ্ছে নূতন লোক-লোলোনেজের পূর্ব অভিযানে তারা তার সঙ্গে ছিল না। গত অভিযানের ফল দেখে তারা ভেবেছিল বোম্বেটের জীবন হচ্ছে অত্যন্ত রঙিন, গাছ নাড়া দিলে যেমন ফল ঝরে, রাশি রাশি মোহর ঝরাও বুঝি তেমনই সহজ! কিন্তু তাদের লাখ টাকার স্বপ্নঘোর আজ ছুটে গেছে।

তারা দলে রইল না। লোলোনেজের দলকে একেবারে হালকা করে দিয়ে বেশিরভাগ বোম্বেটেই কয়েকখানা জাহাজ নিয়ে সরে পড়ল। বনে বনে কাঁটাঝোপে ঘুরে, অনাহারে অল্পাহারে অনিদ্রায় কষ্ট পেয়ে ও স্পানিয়ার্ডদের গরম গরম গুলি খেয়ে খেয়ে তাদের শখ ক্রমশ ঠাণ্ডা হয়ে এসেছিল!

দল খুব ছোট হয়ে গেল, অন্য কেউ হলে এখানে আর থাকত না, কিন্তু একগুঁয়ে লোলোনেজ গ্ৰাহ্যও করলেন না। সিংহের মতন তার মেজাজ-নিষ্ঠুর, গর্বিত, অদম্য! সমুদ্রের কিনারে কিনারে বনের ভিতর দিয়ে বোম্বেটের দল চলেছে। খাদ্যাভাব হওয়াতে তারা বানর মেরে তারই মাংস ভক্ষণ করতে লাগিল—তবু অজানার নেশায় পথচলা তাদের থামলনা। কিন্তু তখনও লোলোনেজ আন্দাজ করতে পারেনি, তার পাপের পেয়ালা কানায় কানায় ভরে উঠেছে!

যেখানে দিয়ে তারা যাচ্ছে সেখানকার রেড ইন্ডিয়ানরাও যে শাস্ত ছেলে নয়, একদিন তার প্রমাণ পাওয়া গেল। আগেই বলেছি, বোম্বেটেরা রেড ইন্ডিয়ানদেরও ওপরে কম নিষ্ঠুর ব্যবহার করেনি, সুতরাং তারাও তাদের বাগে পেলে ছেড়ে কথা কয় না।

বোম্বোটেদের দলে একজন ফরাসি ও একজন স্পানিয়ার্ড ছিল। একদিন তারা দলছাড়া হয়ে খাদ্য বা অন্য কিছুর খোঁজে বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এমন সময়ে দেখতে পেলে, একদল সশস্ত্র রেড ইন্ডিয়ান তাদের দিকে ছুটে আসছে!

ছুটে কাছে এসে তারা যে আদর করে তাদের কোলে টেনে নেবে না, বোম্বেটেরা এটুকু বেশ বুঝতে পারলে। তারাও তারোয়াল বার করলে, কিন্তু দুখানা তরবারি দ্বারা এত লোককে ঠেকানো সোজা কথা নয়। তখন তারা পদযুগলের ওপরে নির্ভর করাই উচিত মনে করলে। ফরাসি বোম্বেটের পদযুগল এমন সুপটু ছিল যে, তীরের মতন সে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু স্পানিয়ার্ড ভায়া পায়ের কাজ ভাল করে শেখেনি, রেড ইন্ডিয়ানরা তাকে ধরে ফেললে।

দু’চারদিন পরে অন্যান্য বোম্বোেটদের সঙ্গে সেই ফরাসি আবার সঙ্গীর খোঁজে ঘটনাস্থলে এসে হাজির হল।

দেখা গেল, সেখানে একটা অগ্নিকুণ্ড রয়েছে, কিন্তু তার ভেতরে আগুন নেই। খানিক তফাতে পড়ে রয়েছে কতকগুলো হাড়। বোম্বেটেরা আন্দাজ করলে, স্পার্নয়ার্ড ভায়ার দেহে ‘রোস্ট” বানিয়ে রেড-ইন্ডিয়ানরা উদর পরিতৃপ্ত করেছে! অবশ্য এ অনুমান ভুল হতে পারে। কিন্তু স্পানিয়ার্ডকে আর পাওয়া যায়নি।

এদিকে লোলোনেজের অবস্থা কেমন দাঁড়িয়েছে দেখুন। দলের অনেকে তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ায় সে শক্তিহীন হয়ে পড়েছে। বিপদের ওপর বিপদ! রেড ইন্ডিয়ানরা স্পানিয়ার্ডদের সঙ্গে যোগ দিয়ে পিছনে লেগেছে। বোম্বেন্টেদের তারা বুঝেছে। এই হতচ্ছাড়া বোম্বেটেগুলো হচ্ছে, কলেরা বসন্তু ও প্লেগের মতো সমস্ত মানুষ জাতেরই শক্র! এদের উচ্ছেদ না করতে পারলে শান্তি নেই!

দিনের পর দিন তাদের সঙ্গে লড়ে লড়ে বোম্বোটেদের অধিকাংশই মারা পড়ল। তবু লোলোনেজ ফেরবার নাম মুখে আনে না!

কিন্তু শেষটা ফিরতে হল। এবার ফিরে লোলোনেজ তার সত্যিকার স্বদেশে গেল-অর্থাৎ নরকে; এবং সেই মহাপ্ৰস্থানের দৃশ্য লোলোনেজেরই উপযোগী।

ডেরিয়েন প্রদেশের রেড ইন্ডিয়ানরা একদিন বোম্বোেটদের ক্ষুদ্র দলকে আক্রমণ করলে। তাদের বেশির ভাগ মারা পড়ল, কতক পালাল, কতক বন্দি হল। বন্দীদের ভিতরে ছিল লোলোনেজ স্বয়ং হাজার হাজার বীর রক্তে যার হাত এখনও ভিয়ে আছে। সেই লোলোনেজ আজ বন্দী!

এমন বন্দীকে যে ভাবে অভ্যর্থনা করতে হয়, রেড ইন্ডিয়ানরা তাই করলে। তারা আগে লোলোনেজকে একটা গাছের গুড়িতে বাঁধলে। তারপর তার সমুখে বড় অগ্নিকুণ্ড জ্বাললে। কেউ হয়তো জীবন্ত লোলোনেজের নাক কেটে নিয়ে আগুনে ফেলে দিলে। কেউ কেটে নিলে কান। কেউ কাটলে জিভ। কেউ কাটলে হাত এবং কেউ বা পা। এইভাবে ক্ৰমে ক্রমে তার ভয়াবহ মৃত্যু ঘটল। তার দেহের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যখন পুড়ে ছাই হয়ে গেল, রেড ইন্ডিয়ানরা তখন সেই ছাইগুলো নিয়ে বাতাসে উড়িয়ে দিলে-যাতে এই অমানুষিক মানুষের কোনও ঘূর্ণিত স্মৃতিই পৃথিবীকে আর কলঙ্কিত না করতে পারে!

তার পাপসঙ্গীদেরও ওই দুৰ্দশই হল। কেবল একজন অনেক সাধ্যসাধনার পর কোন গতিকে শেষটা মুক্তি পেয়েছিল; বোম্বোটদের এই শোচনীয় পরিণামের কথা প্রকাশ পায় তার মুখেই।

লোলোনেজের পরিণামই আভাস দেয় যে, জীবের শিয়রে হয়তো সত্যই কোনও অদৃশ্য মহাবিচারকের দৃষ্টি সর্বদাই সজাগ হয়ে আছে!