5
‘পিটার দি গ্রেট’—বোম্বেটের আদিপুরুষ
টর্টুগা দ্বীপে সর্বপ্রথমে যে জলদস্যু বিশেষ নামজাদা হয়, জাতে সে ফরাসি। তার নাম ছিল ইংরেজিতে ‘পিটার দি গ্রেট’। সে একলা নিজের বুদ্ধিতে জনকয় লোকের সাহায্যে যে অসম্ভবকে সম্ভব করেছিল, তাইতেই তার ডাকনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
একদিন সে একখানা বড় নৌকোয় চড়ে হাইতি দ্বীপের কাছে সমুদ্রে শিকারের সন্ধানে ফিরছিল এবং তার সঙ্গে ছিল আটাশজন বোম্বেটে।
কয়েকদিন ধরে শিকারের অভাব, নৌকোয় খাবার ফুরিয়ে এল বলে। সকলকার মন বড় খারাপ,—পেট চলবে কেমন করে?
এমন সময়ে সমুদ্রের বুকে দেখা গেল, স্পেনের এক ‘ফ্লোটা’। ফ্লোটা হচ্ছে অনেকগুলো বড় বড় জাহাজের সমষ্টি এবং তাদের কাজ হচ্ছে ইউরোপের জিনিস আমেরিকার বন্দরে আনা ও আমেরিকার মাল ইউরোপে নিয়ে যাওয়া।
দেখা গেল, মস্ত একখানা জাহাজ ‘ফ্লোটা’র দলছাড়া হয়ে অনেক দূরে এগিয়ে পড়েছে।
পিটার তখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। সে বললে, “ভাই সব! যা থাকে কপালে! ওই দলছাড়া জাহাজখানাকে আমরা আজ দখল করবই করব!
পিটার অসম্ভব কথা বললে। একখানা নৌকো, ঊনত্রিশজন মাত্র তার আরোহী! এরই জোরে শতশত লোকের সঙ্গে লড়াই করে অতবড় জাহাজ দখণ করা আর লতা দিয়ে হাতি বাঁধবার চেষ্টা করা একই কথা।
কিন্তু পিটারের দলের লোকেরাও আসন্ন অনাহারের সম্ভাবনায় তারই মতন মরিয়া। তারাও পিটারের কথায় সায় দিয়ে বললে, তাই সই, সর্দার!
নৌকো বেয়ে জাহাজের কাছে এসে বোম্বেটেরা বুঝলে, দিনের আলোয় এমন অসাধ্যসাধন করা একেবারেই অসম্ভব। জাহাজের লোকরা একবার দেখতে পেলে মরণের মুখ থেকে তাদের কেউ বাঁচাতে পারবে না। অতএব তারা বুদ্ধিমানের মতো সন্ধ্যার অন্ধকারের অপেক্ষা করতে লাগল।
সন্ধ্যা এল।
পিটার বললে, আমাদের নৌকার তরায় ছ্যাঁদা করে দিই এস! সেই ছ্যাঁদা দিয়ে জল ঢুকে আমাদের নৌকোখানাকে ডুবিয়ে দিক। এই অকূল সমুদ্রে নৌকো ডুবে গেলে আমাদের আর বাঁচবার কি পালাবার কোনও উপায়ই থাকবে না। তাহলে আমরা আরও বেশি মরিয়া হয়ে লড়তে পারব আর আরও তাড়াতাড়ি জাহাজে ওঠবার জন্যে চেষ্টা করব। অত বড় জাহাজ আমাদের পক্ষে এখন ভয়ের কারণ বটে। কিন্তু তখন ওই জাহাজকেই মনে করব আমাদের একমাত্র আশ্রয়!
তখনই এই অদ্ভুত প্রস্তাব অনুসারে কাজ করা হল, ছ্যাঁদা করা নৌকে ধীরে ধীরে অতলে তলিয়ে যেতে আরম্ভ করল।
কিন্তু তার আগেই সাঁঝের আবছায়ায় গা ঢেকে বোম্বেটেরা চুপিচুপি একে একে জাহাজের উপর উঠতে লাগল—ছায়ামূর্তির সারির মতো। তাদের প্রত্যেকেরই কাছে একটি করে পিস্তল ও একখানা করে তরবারি ছাড়া আর কোনও অস্ত্র নেই!
জাহাজের এক কামরায় বসে কাপ্তেন ও আরও কয়েকজন লোক নিশ্চিন্ত আরামে তাস খেলছিলেন।
আচম্বিতে একটা লোক কামরায় ঢুকে কাপ্তেনের বুকের উপরে পিস্তল ধরে বললে, একটু নড়েচ কি গুলি করেচি!
কাপ্তেন একেবারে থ। এ যে বিনামেঘে বজ্রাঘাত! কাপ্তেনের অন্যান্য সঙ্গীরা সচকিতকণ্ঠে বলে উঠল, যীশু আমাদের রক্ষা করুন! কে এরা! কোত্থেকে এল? এরা কি সাক্ষাৎ শয়তান!
ততক্ষণে পিস্তল বাগিয়ে ও তরবারি উঁচিয়ে আরও কয়েকজন বোম্বেটে কামরায় এসে হাজির হয়েছে এবং দলের বাকি কয়েকজন লোক সর্বাগ্রে গিয়ে জাহাজের অস্ত্রশালা দখল করে বসেছে! কেউই এই অতর্কিত আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত ছিল না, যারা বাধা দেবার চেষ্টা করলে তাদের প্রত্যেককেই মরতে হল!
তখন জাহাজের বাকি সকলেই ভয়ে ভয়ে বোম্বেটেদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে! পরে শোনা গেল, সন্ধ্যার আগে কেউ কেউ নৌকোখানাকে দেখতে পেয়ে নাকি বলেছিল, ওখানা বোম্বেটে-নৌকো।
জবাবে কাপ্তেন বুক ফুলিয়ে বলেছিলেন, বয়ে গেল! আমার এত বড় জাহাজ, এত লোকবল, আমি কি ওই ক্ষুদে পিঁপড়ের মতো নৌকোখানাকে দেখে ভয় পাব? আমার জাহাজের সমান জাহাজ এলেও আমি থোড়াই কেয়ার করি।
জাহাজের জনকয় মাহিনা করা নাবিককে দলে রেখে, পিটার নাকি বাকি সবাইকে ডাঙায় নিয়ে গিয়ে নামিয়ে দিলে। তারপর সেই মূল্যবান মালে বোঝাই সুবৃহৎ জাহাজ নিয়ে ফ্রান্সের দিকে যাত্রা করলে। পিটার আর কখনও আমেরিকায় ফিরে আসেনি।
টর্টুগার যে সব লোক স্পানিয়ার্ডদের অত্যাচারে অবিচারে কাবু হয়ে হাহাকার করছিল, তারা যখন পিটারের এই অদ্ভুত বিজয়কাহিনী ও অপূর্ব সম্পদ লাভের কথা শুনলে, তখন একবাক্যে বিপুল উৎসাহে বলে উঠল, আমরাও তবে বোম্বেটে হব,—ম্পানিয়ার্ডদের ওপরে প্রতিশোধ নেব!
কিন্তু জল-ডাকাত হতে গেলে আগে দরকার অন্তত একখানা করে ছোট জাহাজ বা একখানা করে বড় নৌকো। তার মূল্য কে দেয়? ভেবেচিন্তে তারা উপায় আবিষ্কার করলে। বন্দরে বন্দরে স্পানিয়ার্ডরা ছোট ছোট নৌকো করে চামড়া ও তামাক প্রভৃতি সংগ্ৰহ করত। তারপর তারা সেই সব মাল নিয়ে হাভানা শহরে গিয়ে হাজির হত। কারণ ইউরোপ থেকে স্পানিয়ার্ডরা সেইখানেই ব্যবসা করতে আসত।
নতুন বোম্বেটেরা দল পাকিয়ে সেই সব মালবোঝাই জাহাজ স্পানিয়ার্ডদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে আরম্ভ করলে। তারপর সেই লুটের মাল বেচে তারা বড় বোম্বেটে হবার মূলধন সংগ্রহ করে ফেললে। ব্যাপারটা শুনতে খুব সোজা বটে, কিন্তু এর জন্যে বড় কম মারামারি, রক্তপাত ও নরহত্যা হল না।
তার মাস খানেক পরেই স্পেনদেশিয় ব্যবসায়ীদের বড় বড় দুখানা জাহাজ বোম্বেটেদের হাতে ধরা পড়ল—সে জাহাজ দুখানার ভিতরে ছিল প্রচুর সোনা ও রুপো।
টর্টুগার যে সব লোক তখনও নতমাথায় অত্যাচার সহ্য করছিল, তারাও আর লোভ সামলাতে পারলে না, তারাও বোম্বেটেদের দলে যোগ দিলে! বছর দুইয়ের মধ্যেই লুটের ঐশ্বর্যে টর্টুগারও যেমন শ্ৰীবৃদ্ধি হল, ব্যাঙের ছাতার মতো বোম্বেটের দলও তেমনই বাড়তে লাগল! তখন এই দ্বীপটি একরকম বোম্বেটেদেরই স্বর্গ হয়ে দাঁড়াল—স্পানিয়ার্ডরা সেখান থেকে একেবারেই পিটটান দিতে বাধ্য হল!
দেখতে দেখতে টর্টুগা দ্বীপে বোম্বেটে জাহাজের সংখ্যা হয়ে দাঁড়াল কুড়িখানারও বেশি। বুকে বসে এই দাড়ি ওপড়ানো স্পানিয়ার্ডরা আর সইতে পারলে না, দেশে—অর্থাৎ স্পেনে খবর পাঠিয়ে আত্মরক্ষা ও বোম্বেটে দমন করবার জন্যে প্রকাণ্ড দুখানা যুদ্ধজাহাজ অনাবার বন্দোবস্ত করলে।
পর্তুগিজ ও ব্রেজিলিয়ানো
এ অঞ্চলে এক বোম্বেটে ছিল, তার নাম বার্থোলোমিউ পর্তুগিজ। নাম শুনেই বোঝা যায় তার জন্ম পর্তুগালে। সবাই তাকে পর্তুগিজ বলে ডাকত। এর কাহিনী পিটার দি গ্রেটের চেয়েও বিচিত্র।
জামাইকা দ্বীপের কাছে সে একখানা বজরা নিয়ে শিকার অন্বেষণ করছিল। তার সঙ্গে ছিল চারটে ছোট কামান ও ত্রিশজন লোক।
সমুদ্রের মাঝখানে একখানা প্রকাণ্ড জাহাজ দেখতে পেয়ে পর্তুগিজ তার কাছে বজরা নিয়ে গেল।
সে বড় যে-সে জাহাজ নয়। তার ওপরে আছে কুড়িটা মস্ত মস্ত কামান ও সত্তর জন যোদ্ধা। আর আছে অনেক যাত্রী ও নাবিক।
কিন্তু পর্তুগিজ জানত না ভয় কাকে বলে। চারটে পুঁচকে কামান, ত্রিশজন মাত্র লোক ও বজরা নিয়েই সে সেই জাহাজখানাকে আক্রমণ করলে। প্রথম আক্রমণ সফল হল না। পর্তুগিজকে পিছনে হটে আসতে হল।
তারপর খানিক বিশ্রাম করে সে আবার সতেজে আক্রমণ করলে। আবার বড় বড় কামানের গোলা হজম করতে না পেরে সে পিছিয়ে এল। তার খানিক পরে আবার আক্রমণ! এমনই বারবার আক্রমণ ও সুকৌশলে অথচ সতেজে যুদ্ধ করে অনেকক্ষণ পরে পর্তুগিজ সত্যসত্যই সেই প্রকাণ্ড জাহাজখানাকে দখল করে ফেললে!
কিন্তু তার এত বীরত্বও ব্যর্থ হল। কারণ সেই বিজিত জাহাজখানাকে নিয়ে খানিক দূর এগুতে না এগুতেই, আচম্বিতে দৈবগতিকে স্পানিয়ার্ডদের আরও তিনখানা প্রকাণ্ড জাহাজের আবির্ভাব হল। পর্তুগিজ এদের সঙ্গে আর পাল্লা দিতে পারলে না—জয়ের আনন্দ ভাল করে ভোগ করতে না করতেই সদলবলে তাকে বন্দি হতে হল!
একটু পরেই উঠল বেজায় ঝড়। যে বিরাট জাহাজে বোম্বেটেরা বন্দি হয়ে ছিল, সেখানা অন্য জাহাজগুলোর সঙ্গ হারিয়ে অনেক কষ্টে একটা বন্দরে গিয়ে আশ্রয় নিলে।
পর্তুগিজকে দেখেই ত্ৰস্তস্বরে বলে উঠল, এ বদমাইশ বোম্বেটেকে আমরা চিনি! এ যে পর্তুগিজ! এ যে আমাদের অনেক সর্বনাশ করেছে, অনেক লোক খুন করেছে!
যে শহরের বন্দরে জাহাজ থেমেছিল, সেখানকার ম্যাজিষ্ট্রেট বোম্বেটেদের ডাঙায় পাঠাতে হুকুম দিলেন। কেবল পর্তুগিজকে পাঠাতে নিষেধ করলেন—পাছে সেই ফাঁকে কোনগতিকে সে পালিয়ে যায়, কারণ কিছুদিন আগে এই শহরেরই জেল ভেঙে সে লম্বা দিয়েছিল। তার জন্যে জাহাজের ওপরেই ফাসিকাঠ খাড়া করা হল। পরদিন সকালেই তাকেলটকে দেওয়া হবে। এই চমৎকার সুখবরটি পর্তুগিজকে ঘটা করে শোনানো হল। শুনে সে যে খুশি হয়ে হাসেনি, সেটা আর না বললেও চলে।
জাহাজে তাকে যেখানে রাখা হয়েছিল,সেখানে বড় বড় দু’টো মাটির খালি জালা ছিল—এই জালায় স্পানিয়ার্ডরা মদ রাখত। পর্তুগিজ একটুও সাঁতার জানত না, কাজেই জলে লাফিয়ে পড়ে সে যে সাঁতরে পালাবে, তারও উপায় নেই। অথচ কাল পৃথিবীর সূর্যোদয়ের সঙ্গেই তার জীবনের সূর্যস্ত। ফাঁসিকাঠে দোল খাবার শখ তার মোটেই ছিল না। কোনওরকমে সে মাটির জালা দুটোর মুখ এঁটে বন্ধ করলে। তারপর চুপ করে হাত গুটিয়ে বসে রইল নেহাৎ ভালমানুষটির মতো। তার আচরণের কারণ কেউ বুঝতে পারলে না।
রাত হল। সেপাই বন্দুক ঘাড়ে করে বসে বসে ঢুলছে।
হঠাৎ পর্তুগিজ বাঘের মতো তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কেউ কিছু টের পাবার আগেই সেপাই ইহলোক থেকে বিদায় নিলে।
পর্তুগিজ জালাদুটো জলে নামিয়ে দিয়ে নিজেও জাহাজ ত্যাগ করলে। মুখবন্ধ করা জালা জলে ভাসতে লাগল। পর্তুগিজ তাদের উপরে ভর দিয়ে ভাসতে ভাসতে ডাঙায় গিয়ে উঠল। তারপর গভীর অরণ্যে ঢুকে একটা গাছের কোটরে লুকিয়ে বসে রইল—কারণ সকাল হতে দেরি ছিল না।
সকাল। কর্তৃপক্ষ জাহাজে এলেন—একটা জাঁহাবাজ বোম্বেটেকে নিশ্চিন্তপুরে পাঠাবার জন্য। কিন্তু দেখা গেল, ফাঁসিকাঠে যে দুলবে সে অদৃশ্য!
চারিদিকে খোঁজ খোঁজ রব উঠল। দলে দলে লোক বন তোলপাড় করে খুঁজে দেখলে, কিন্তু পর্তুগিজের দেখা না পেয়ে হতাশভাবে ফিরে এল।
পর্তুগিজ তখন জঙ্গল ভেঙে চলতে শুরু করেছে। সমুদ্রের ধারে পাথর উলটে ‘সেল’ মাছ কুড়িয়ে এনে কোনরকমে পেটের জ্বালা নিবারণ করে। কাছে ছিল শুকনো লাউয়ের খোল, আর তাতে একটুখানি জল,—তাতেই তেষ্টা মেটায়। এইভাবে একশ কুড়ি মাইল পথ পার হল!
পথের মাঝে মাঝে নদী পড়েছে—অথচ সে সাঁতার জানে না। কেমন করে সে বাঁধা দূর করলে, তাও বড় কম আশ্চর্য কথা নয়!
সমুদ্রের ধারে জাহাজ ভাঙা একখানা তক্তা পাওয়া গেল, তার গায়ে বেঁধানো ছিল গোটাকয়েক মস্তবড় পেরেক বা হুক। সে বসে বসে পাথরের উপরে ঘষে ঘষে পেরেকের গায়ে অনেকটা ছুরির মতো ধার করলে। তারপর সেই অদ্ভূত ছুরির সাহায্যে গাছের ডালপালা কেটে ছোটখাট ভেলার মতো একটা কিছু বানিয়ে গভীর নদী পার হল। আপনারা অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন, এ রূপকথা? না, এ সম্পূর্ণ সত্য কথা!
একশ কুড়ি মাইল পথ পেরিয়ে পর্তুগিজ একদল চেনা বোম্বেটের দেখা পেলে। ইতিমধ্যে চোদ্দদিন কেটে গেছে।
বন্ধুদের কাছে নিজের বিপদের গল্প বললে। শুনে তারা যে তাকে খুব বাহাদুর দিয়েছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
পর্তুগিজ বললে, ভাই, আমাকে একখানা নৌকো আর কুড়িজন লোক দাও। আমি প্রতিশোধ নেব।
তারা আপত্তি করলে না।
আট দিন পরে সেই আশ্চর্য সাহসী পর্তুগিজ কুড়িজন সঙ্গীর সঙ্গে যে জাহাজে বন্দি হয়েছিল, যার ওপরে এখনও তার জন্যে আনা ফাঁসিকাঠ দাঁড়িয়ে আছে, আবার তার কাছেই বুক ফুলিয়ে ফিরে এল এবং অতর্কিতে আক্রমণ করে সেই প্রকাণ্ড জাহাজখানাকে আবার বন্দি করে ফেললে! উপন্যাসেও এমন বিচিত্র কাহিনী পড়া যায় না!
কিন্তু নিয়তি আবার তাকে নিষ্ঠুর পরিহাস করলে! প্রাণের ভয় থেকে এখন সে মুক্ত এবং মাল বোঝাই জাহাজ পেয়ে এখন সে ধনবান! কিন্তু তার আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হল না। ভবিষ্যতের অনেক সুখ-সৌভাগ্যের কল্পনা করতে করতে দিনকয় মস্ত জাহাজ নিয়ে সমুদ্রে সে ঘুরে বেড়ালে—কিন্তু তারপরেই দুর্ভাগ্য আবার ঝড়ের মূর্তিতে এসে পর্তুগিজের এই নতুন পাওয়া ঐশ্বর্যকে পাতালের অতল তলে তলিয়ে দিলে! সঙ্গীদের নিয়ে একখানা ভিডিতে চড়ে সে প্রাণে বাঁচল বটে, কিন্তু আবার সে গরিব—নিছক গরিব!
সে জামাইকা দ্বীপে এসে উঠল। কিন্তু ভাগ্যলক্ষ্মী তার ওপরে আর কোনদিন প্রসন্ন হননি। তার এত বুদ্ধি, সাহস ও বীরত্বও আর কোনও কাজে লাগল না। অবশ্য এ সব দুষ্প্রাপ্য গুণ আজীবনই তার কাজে লাগত, যদি সে অসৎ পথ অবলম্বন না করত। পর্তুগিজ যদি সত্যিকার মানুষ হত, তাহলে মরণের পরেও সে আজ মরত না, হয়তো পৃথিবীতে দেশে দেশে চিরস্মরণীয় হয়েই থাকতে পারত।
আর একজন বোম্বেটেও ওই সময়ে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। অনেককাল ব্ৰেজিলে বাস করেছিল বলে তার নাম হয়েছিল ব্রেজিলিয়ানো।
জলদস্যুর দলে ঢুকে প্রথমে সে সাধারণ বোম্বেটেরই মতন নিম্নশ্রেণীতে কাজ করত। কিন্তু নিজের প্রকৃতি ও বুদ্ধির গুণে সে শীঘ্রই সকলের মেহের ও শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠল।
যে দলে সে ছিল তার কাপ্তেনের সঙ্গে একবার সেই দলের অনেকের মনোমালিন্য হয়। তারা তখন দল ছেড়ে চলে এল এবং সকলের সম্মতি অনুসারে ব্রেজিলিয়ানোই দলপতি বা কাপ্তেনের পদ লাভ করলে।
নতুন কাপ্তেন দিনকয়েক পরেই নিজের বুদ্ধি ও শক্তির পরিচয় দিলে। আমেরিকায় তখন অনেক সোনা, রুপো ও অন্যান্য দামী ধাতু পাওয়া যেত। স্পানিয়ার্ডরা সেই সব ধাতুর বার বা তাল জাহাজে চাপিয়ে স্পেনে চালান দিত। এমনই সোনা-রুপোর তালনিয়ে একখানা মস্ত জাহাজ স্পেনে বা অন্য কোথাও যাচ্ছিল, ব্রেজিলিয়ানো হঠাৎ তাকে ধরে ফেললে। স্পানিয়ার্ডরা যথাসাধ্য বাধা দিয়েও কিছু করে উঠতে পারলে না। ব্রেজিলিয়ানো বামাল সমেত সেই জাহাজখানাকে গ্রেপ্তার করে জামাইকা দ্বীপে এসে উঠল। তার নামে চারিদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল!
কিন্তু ব্রেজিলিয়ানো ছিল যেমন মাতাল, তেমনই গোঁয়ার ও নির্দয়। যখন সে ছুটি নিয়ে ডাঙায় এসে ফুর্তি করত, তখন কেউ তার সামনে দাঁড়াতে ভরসা করত না। মদ খেয়ে রাজপথে হুল্লোড় করে বেড়াবার সময়ে যাকে সমুখে পেত তাকেই মেরে-ধরে হাড় গুড়িয়ে দিত। তার গায়েও ছিল অসুরের মতো ক্ষমতা, তাই কেউ বাধা দিতে বা প্রতিবাদ করতেও সাহস করত না।
সময়ে সময়ে এক পিপে মদ নিয়ে রাস্তার ওপরে বসে থাকত। সামনে দিয়ে কোনও পথিক গেলেই ডেকে বলত—‘এসো ভায়া, আমার সঙ্গ মদ খেয়ে ফুর্তি করে যাও!’ পথিক যদি বলত, “না, আমি মদ খাব না!”—তাহলেই আর রক্ষে নেই, ব্রেজিলিয়ানো অমনই পিস্তল বার করে বলত, “মদ খাবে, না খাবি খাবে?”
কখনও কখনও তার আর এক খেয়াল হত। রাস্তা দিয়ে স্ত্রী-পুরুষ কেউ গেলেই সে তাদের জামাকাপড়ে সর্বাঙ্গে হুড়হুড় করে মদ ঢেলে দিত।
স্পানিয়ার্ডদের ওপরে ছিল তার বিষম আক্রোশ। একবার সে শূকর চুরি করতে যায়। কিন্তু চুরি করতে না পেরে কয়েকজন স্পানিয়ার্ডকে ধরে শুধোলে, তোমরা কোথায় শুওর লুকিয়ে রেখেছ বলো।
তারা বললে, শুওরের সন্ধান আমরা জানি না।
ব্রেজিলিয়ানো দুচোখ পাকিয়ে বললে, কী জান না? রোসো, দেখো তবে মজাটা! ওরে, এদের ধরে রোস্ট বানিয়ে ফ্যাল তো! শূওর যখন পেলুম না তখন মানুষেরই রোস্ট হোক!
সাহেবরা মাংসের মধ্যে কাঠের শলাকা বিঁধিয়ে আগুনের আঁচে রেখে রোস্ট তৈরি করে। ব্রেজিলিয়ানোর চালারা তখনই সেই হতভাগ্য স্পানিয়ার্ডদের জীবন্ত দেহের ভিতরে পড় পড় করে কাঠের শলা চালিয়ে দিলে এবং জীবন্ত অবস্থাতেই তাদের দেহগুলোকে আগুনের ওপর ঝুলিয়ে রাখলে। ধীরে ধীরে তাদের জ্যান্ত দেহগুলো আগুনের আঁচে সিদ্ধ হতে লাগল।
অভাগাদের পরিত্রাহি চিৎকারে আকাশ পর্যন্ত কেঁপে উঠল, কিন্তু ব্রেজিলিয়ানোর মন তাতে একটুও গলল না—সে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই আর্তনাদ শুনতে লাগল, যেন খুব মিষ্টি গানই শুনছে!
একদিন ঝড়ে তার জাহাজ ডুবে গেল—ঝড়ে জাহাজ ডুবে যাওয়া ছিল তখনকার কালে খুব সহজ ব্যাপার। ব্রেজিলিয়ানো সঙ্গীদের নিয়ে একখানা নৌকোয় চড়ে কোনওরকমে ডাঙায় এসে উঠল। কিন্তু সেখানেও আবার নূতন বিপদ! দেখা গেল, একশ জন বন্দুকধারী ঘোড়সওয়ার স্পানিয়ার্ড তাদের দিকে আবার এক নতুন ঝড়ের মতন বেগে তেড়ে আসছে! বোম্বেটেদের সংখ্যা ত্রিশজনের বেশি নয়! তিনগুণেরও বেশি লোকের সঙ্গে কেউ কখনও যুঝতে পারে? এবারে ব্রেজিলিয়ানোর লীলাখেলা বুঝি সাঙ্গ হয়!
অন্য কেউ হলে তখনই বিনা বাধায় আত্মসমর্পণ করত। কিন্তু ব্রেজিলিয়ানো দমবার পাত্র নয়। সে দলের লোকদের ডেকে নিৰ্ভয়ে বললে, ভাই সব! স্পানিয়ার্ড কুকুররা তেড়ে আসছে—আসুক! ওরা বাগে পেলে আমাদের ভীষণ যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করবে! আমরা হচ্ছি বীর সৈনিক,—এসো আমরা লড়াই করতে করতে বীরের মতন মরি!
লড়াই শুরু হল—বোম্বেটেরা সবাই মরতে প্রস্তুত! এখন মরবার আগে যে যত শক্ৰ নিপাত করতে পারে, তারই তত বাহাদুর! বোম্বেটেরা এমন আশ্চর্যভাবে লক্ষ্যস্থির করে বন্দুক ছুঁড়তে লাগল যে, প্রায় প্রত্যেক গুলিতেই এক একজন ঘোড়সওয়ারের পতন হয়! স্পানিয়ার্ডরা আর কাছে আসতে সাহস পেলে না, দূর থেকেই যুদ্ধ করতে লাগল।
এক ঘণ্টা লড়াই চলল। শেষটা বোম্বেটেদের গরম গরম গুলি আর হজম করতে না পেরে স্পানিয়ার্ডরা ভয়ে পিটুটান দিলে। তাদের প্রায় চল্লিশ-পয়তাল্লিশ জন লোক হত বা আহত হয়ে মাটির ওপরে ছড়িয়ে পড়ে রইল। যারা তখনও বেঁচে ছিল, বোম্বেটেরা বন্দুকের কুঁদো দিয়ে মাথার খুলি ফাটিয়ে তাদেরও ভবযন্ত্রণা শেষ করে দিলে। বোম্বেটেদের দলে হত হয়েছিল দুজন ও আহত হয়েছিল দুজন মাত্র লোক!
বোম্বেটেরা তখন স্পানিয়ার্ডদের সওয়ারহীন ঘোড়াগুলোর পিঠে চেপে জয় জয় নাদে নতুন শিকারের খোঁজে যাত্রা করলে।
মারি তো গণ্ডার
এইবারে আমরা যে ভয়ঙ্কর ও অতুলনীয় বোম্বেটের কথা আরম্ভ করব, তার নাম হচ্ছে ফ্রান্সিস্ লোলোনেজ৷ জাতে ফরাসি। রোমাঞ্চকর তার কাহিনী।
ফ্রান্স থেকে নির্বাসিত হয়ে সে ওয়েস্ট ইন্ডিজে আসে। মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে পর ছাড়া পায়। কিন্তু তারপর সে আর স্বদেশে ফিরে না গিয়ে হাইতি দ্বীপে এসে আশ্রয় নেয়। প্রথমে হয় শিকারি, তারপর বোম্বেটে। তার ভবিষ্যৎ জীবন কি ভয়াবহ হবে এবং সে যে কত প্রলয়কাণ্ডের অনুষ্ঠান করবে, কর্তৃপক্ষ যদি তা কল্পনাও করতে পারতেন, তাহলে কখনই তাকে মুক্তি ও স্বাধীনতা দিতেন না। বোম্বেটেরূপে সে হয়ে উঠেছিল মূর্তিমান নরপিশাচ! অথচ তার সাহস, বুদ্ধি, বীরত্ব, উৎসাহ ও উদ্যম ছিল অসাধারণ। মানুষ এইসব দুর্লভ গুণের জন্যে আজন্ম সাধনা করে। কিন্তু অপাত্রে এইসব গুণ যে কতটা সাংঘাতিক হতে পারে, লোলোনেজ হচ্ছে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
টর্টুগা দ্বীপ তখন ফরাসিদের অধিকারে এসেছে। সেখানকার লাটও ফরাসি। তখন স্পানিয়ার্ডদের সঙ্গে ফরাসিদের সম্পর্ক ছিল সাপ আর নেউলের সম্পর্ক।
আগেই বলেছি, এখানকার লাটেরা প্রায়ই সাধু মানুষ হতেন না, তারা নিজেরাই বোম্বেটে পুষতেন। টর্টুগার ফরাসি লাট লোলোনেজকে বুদ্ধিমান ও সাহসী দেখে তার উপরে দয়া করলেন। অর্থাৎ তাকে একখানা জাহাজ ও লোকজন দিয়ে কাপ্তেন করে দিলেন। তারপর কাপ্তেন লোলোনেজ সমুদ্রের নীলজলে নিজের অদৃষ্ট পরীক্ষা করতে বেরুল। কিন্তু সে-ও যদি তখন নিজের ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে পারত, তাহলে সভয়ে এ পথ ছেড়ে ফিরে আসত। অদৃষ্টকে আগে থাকতে দেখা গেলে পৃথিবীর অনেক দুঃখই ঘুঁচে যেত–মানুষ এমন অন্ধের মতো বিপথে ঘুরে মরত না।
প্রথম কিছুকাল বেশ সুখেই কাটল। লোলোনেজ উপর উপরি স্পানিয়ার্ডদের কয়েকখানা ধনরত্বে ও বাণিজ্যদ্রব্যে পরিপূর্ণ জাহাজ দখল করে ডাকসাইটে নাম কিনে ফেললে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে স্পানিয়ার্ডদের ওপরে তার ভীষণ নিষ্ঠুরতার কাহিনীও চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল—তারা বুঝলে, আবার এক মারাত্মক আপদের আবির্ভাব হয়েছে। তখন তারাও মরিয়া হয়ে উঠল! লোলোনেজ তাদের আক্রমণ করলে তারা আর সহজে আত্মসমর্পণ করতে চাইত না—কারণ তারা বুঝে নিয়েছিল যে লোলোনেজের কাছে তাদের ক্ষমা নেই, সে তাদের কয়েদ করতে পারলে বিষম যন্ত্রণা দিয়ে প্রাণবধ না করে ছাড়বে না। তার চেয়ে লড়াই করে বা জলে ডুবে মরা ঢের ভাল।
তারপরইলোলোনেজ অদৃষ্টের কাছ থেকে প্রথম ধমক খেলে। আচম্বিতে একদিন নাবিকদের সবচেয়ে বড় শক্র ঝড় এসে তার জাহাজ ডুবিয়ে দিলে। সে আর তার সঙ্গীরা সমুদ্রের কবল থেকে কোনগতিকে বাঁচল বটে, কিন্তু ব্রেজিলিয়ানোর মতো সেও তীরে উঠে স্তম্ভিত নেত্রে দেখলে, দলে দলে স্পানিয়ার্ড অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তেড়ে আসছে দলবদ্ধ যমের মতো!
যুদ্ধ হল। কিন্তু শত্রুরা দলে এত ভারি ছিল যে, লোলোনেজের সঙ্গীরা অধিকাংশই প্রাণ হারালে—যারা বাঁচল, বন্দি হল।
লোলোনেজও আহত হল, কিন্তু চালাকির জোরে শক্ৰদের চোখে ধুলো দিলে। নিজের ক্ষতের রক্তের সঙ্গে তাড়াতাড়ি সমুদ্র তীরের বালি মিশিয়ে সে তার মুখে ও দেহের নানা জায়গায় মাখিয়ে ফেললে এবং বোম্বেটেদের মৃতদেহের সঙ্গে মিশিয়ে মড়ার মতো মাটিতে পড়ে রইল। শক্ররা তাকে মৃত মনে করে চলে গেল।
লোলোনেজ তখন উঠে বনের ভিতর গিয়ে ঢুকল। আগে নিজের দেহের ক্ষতস্থানগুলো যেমন তেমন করে ব্যান্ডেজ করে ফেললে। তারপর এক শহরে গিয়ে স্পানিয়ার্ডের ছদ্মবেশ গ্রহণ করলে।
স্পানিয়ার্ডরা অনেক ক্রীতদাস রাখত। কয়েকজন ক্রীতদাসের সঙ্গে তার আলাপ হল এবং দিনকয়েকের ভিতরেই সে আলাপ জমিয়ে তুলল রীতিমতো।
সে তাদের বললে, তোমরা যদি আমার কথা শোনো, তাহলে আমি তোমাদের স্বাধীন করে দেব। তোমাদের মনিবের একখানা নীেকো চুরি করে আমার সঙ্গে চলো—আমি তোমাদের রক্ষা করব।
অবশেষে তারা রাজি হয়ে গেল। এবং একখানা নৌকো চুরি করে লোলোনেজের সঙ্গে জলপথে বেরিয়ে পড়ল।
ওদিকে স্পানিয়ার্ডরা লোলোনেজের সঙ্গীদের খুব সাবধানে বন্দি করে রাখলে। এবং যখন শুনলে যে লোলোনেজ আর বেঁচে নেই, তখন তাদের আনন্দের আর সীমা-পরিসীমা রইল না। এত বড় শত্রু নিপাত হয়েছে শুনে চারিদিকে আলোকমালা সাজিয়ে তারা উৎসবে মত্ত হয়ে উঠল।
লোলোনেজ ফিরে এসে সব দেখলে—সব শুনলে। তারপর সেখান থেকে সরে পড়ে একেবারে টর্টুগা দ্বীপে এসে হাজির!
ওয়েস্ট ইন্ডিজে যত শয়তান আছে, এই দ্বীপ হচ্ছে তাদের নিরাপদ স্বদেশ। তার উপরে লোলোনেজ হচ্ছে তখন একজন নামজাদা ব্যক্তি—তার কীর্তি কাহিনী লোকের মুখে মুখে। সুতরাং এখানে এসে একখানা ছোটখাট জাহাজ ও লোকজন জোগাড় করতে তার বেশিদিন লাগল না। একুশজন লোকও দরকার মতোহাতিয়ারজোগাড় করে এবারে সে কিউবা দ্বীপেরদিকে বেরিয়ে পড়ল। এই দ্বীপের দক্ষিণে এক শহর তখন তামাক, চিনি ও চামড়ার ব্যবসার জন্যে বিখ্যাত। লোলোনেজ আন্দাজ করলে যে, সেখানে নিশ্চয়ই কোনও বড়গোছের শিকার পাওয়া যাবে।
নিজেদের সৌভাগ্যক্রমে কয়েকজন জেলে মাছ ধরতে ধরতে তাকে দেখেই চিনে ফেললে এবং তখনই চটপট দ্বীপের লাটসাহেবের কাছে গিয়ে ধর্না দিয়ে পড়ে বললে, হুজুর, রক্ষা করুন লোলোনেজ আমাদের সর্বনাশ করতে এসেছে!
লাটসাহেবের কাছে তখন খবর গিয়ে পৌচেছে যে, লোলোনেজ আর বেঁচে নেই। তাই তিনি জেলেদের কথায় নির্ভর করতে পারলেন না। তবু সাবধানের মার নেই ভেবে তিনি জেলেদের সঙ্গে একখানা বড় জাহাজ, নব্বইজন সৈনিক ও দশটা কামান পাঠিয়ে দিলেন। জাহাজের সেনাপতির ওপরে হুকুম রইল—‘বোম্বেটে বিনাশ না করে তিনি যেন ফিরে না আসেন। প্রত্যেক বোম্বেটেকে ফাঁসিকাঠে লটকে আসতে হবে—কেবল দলের সর্দার লোলোনেজ ছাড়া। তাকে জ্যাস্ত বন্দি করে হাভানা শহরে ধরে আনতে হবে।’ জাহাজের সঙ্গে একজন জল্লাদও চলল।
জাহাজখানা ঘটনাস্থলে এল। বোম্বেটেদের গুপ্তচর সর্দারকে এসে খবর দিলে— লাটসাহেবের জাহাজ তাদের ধরবার জন্যে বন্দরে গিয়ে হাজির হয়েছে।
কিন্তু লোলোনাজ এত সহজে ভড়কে যাবার ছেলে নয়। সে বললে, আমি পালাব না। ওই জাহাজখানাকেই আমরা বন্দি করব। আমাদের একখানা ভাল জাহাজ দরকার!
বোম্বেটেরা জনকয় জেলেকে ধরে ফেললে। লোলোনেজ তাদের বললে, আজ রাত্রে বন্দরে ঢোকবার পথ আমাকে দেখিয়ে দিতে হবে। নইলে তোদের খুন করব।
জেলেরা বাধ্য হয়ে সেই রাত্রে তাদের নিয়ে বন্দরে গিয়ে ঢুকল।
লাটের জাহাজের প্রহরী জিজ্ঞাসা করলে, কে তোমরা?
প্রাণের দায়ে জেলেরা বললে, আমরা জেলে।
—বোম্বেটেরা এখন কোথায়?
—আমরা কোনও বোম্বেটে দেখিনি।
জাহাজের লোকরা ভাবলে, তাদের দেখে কাপুরুষ বোম্বেটেরা নিশ্চয়ই ভয়ে লম্বা দিয়েছে। ভোর যখন হয় হয় তাদের ভুল ভাঙল তখন। বোম্বেটের দল দুই পাশ থেকে জাহাজ আক্রমণ করেছে!
স্পানিয়ার্ডরা বীরের মতো লড়াই করলে, কিন্তু তবু হেরে গেল। এরা দুর্জয় শত্ৰু, আত্মসমর্পণ করা ছাড়া উপায় নেই।
জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে বিজয়ী লোলোনেজ বললে, স্পানিয়ার্ডগুলোকে একে একে আমার সামনে নিয়ে এসো।
বন্দীদের একে একে সর্দারের সামনে আনা হতে লাগল।
লোলোনেজ বললে, একে একে এদের মাথা কেটে ফেলো।
একে একে তাদের মাথা উড়ে গেল।
সবশেষে নিয়ে আসা হল সেই জল্লাদকে। জাতে সে কাফ্রি।
জল্লাদ সর্দারের হাতে পায়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললে, আমাকে মারবেন না হুজুর! আপনি যা জানতে চান সব কথা খুলে বলব—কিছু লুকোব না।
লোলোনেজ তাকে গোটাকয়েক গুপ্তকথা জিজ্ঞাসা করলে। প্রাণরক্ষার আশায় সে সব কথার সঠিক জবাব দিলে।
লোলানেজ বললে, আর কিছু জানিস না?
—না হুজুর!
লোলোনেজ বললে, এ কালামানিককে নিয়ে আর আমার দরকার নেই। এর মাথাটা কেটে ফেলো।
জল্লাদেরও মাথা উড়ে গেল। কেবল একজন লোককে বোম্বেটেরা বধ করলে না। তাকে ডেকে লোলোনেজ বললে, যা, প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যা! তোদের লাটসাহেবকে আমার এই কথাগুলো জানিয়ে দিস :আজ থেকে কোনও স্পানিয়ার্ডকে আমি আর একফোটাও দয়া করব না। লাটসাহেব আমাদের ওপরে যে অসীম দয়া প্রকাশের চেষ্টা করেছিলেন তাও আমি কখনও ভুলব না। আমি খুব শীঘ্রই তার ওপরেও ঠিক সেইরকম দয়া দেখাবার জন্যে ফিরে আসব।
লাটসাহেব সব শুনে রাগে তিনটে হয়ে বললেন, আচ্ছা, আমিও প্রতিজ্ঞা করছি, এবার থেকে কোনও বোম্বেটেকে হাতে পেলে আমিও ছেড়ে কথা কইব না—তার একমাত্র দণ্ড হবে প্রাণদণ্ড!
হাভানার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বললেন, “কখনও আমন প্রতিজ্ঞা করা উচিত নয়! তাহলে বোম্বেটে ধরা পড়ুক আর না পড়ুক —আমাদেরই মারা পড়বার সম্ভাবনা বেশি!
লাটসাহেব তখন মনের রাগ মনেই পুষে নিজের প্রতিজ্ঞাকে বাতিল করতে বাধ্য হলেন। লোলোনেজ কিছুদিন ধরে সমুদ্রের এ বন্দর থেকে ও বন্দরে জাহাজ নিয়ে ঘুরে বেড়ালে এবং একখানা খুব মূল্যবান জাহাজকেও বন্দি করলে—তার ভিতরে অনেক সোনা-রুপোর তাল ছিল। তারপর রীতিমতো ধনীর মতো সে আবার বোম্বেটে দ্বীপে—অর্থাৎ টর্টুগায় ফিরে এল। সেখানকার বাসিন্দারা মহাসমারোহে তাকে সংবর্ধনা করলে!
লোলোনেজের মাথার ভিতরে তখন এমন এক বিরাট ফন্দির উদয় হয়েছে, এতদিন বোম্বেটে জগতে যা কল্পনাতীত ছিল। বোম্বেটে বলতে বোঝায়, জলপথে যারা ছোটখাট নৌকা বজরা বা বড়জোর জাহাজ লুট করে। সেই লুটের মাল নিয়েই তারা খুশি হয়ে গা-ঢাকা দেয়। কিন্তু লোলোনেজের উচ্চাকাঙক্ষ এইটুকুতেই তৃপ্ত হয়ে থাকতে পারলে না। সে দেখাতে চায়, ইচ্ছা করলে বোম্বেটেরাও কত অসামান্য কাজ করতে পারে!
তার ফন্দি হচ্ছে এই লুটের মাল বেচে এবারে সে অনেকগুলো জাহাজ কিনে প্রকাণ্ড এক নৌবাহিনী গঠন করবে। তার অধীনে বোম্বেটে সৈন্যের সংখ্যা হবে অন্তত পাঁচশত। তারপর সে ওয়েস্ট ইন্ডিজের নানা স্পেনিয় রাজ্যে হানা দিয়ে গ্রাম ও ছোটবড় নগর লুণ্ঠন করবে! তার উচ্চাকাঙক্ষা অত্যন্ত উচ্চ! স্পেনরাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা স্পেনসাম্রাজ্য সেসময়ে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিল—ইউরোপের কোনও শক্তিই তার কাছে পাত্ত পেত না!
বোম্বেটে দ্বীপও লোলোনেজের এ অসম্ভব প্রস্তাব শুনে আনন্দে ও উৎসাহে উচ্ছসিত হয়ে উঠল! মারি তো গণ্ডার—লুটি তো ভাণ্ডার!