জলদস্যু কাহিনী by হেমেন্দ্রকুমার রায়, chapter name 8

8

একটিমাত্র তীরে কেল্লা ফতে!

 

যেমন হয়, এবারেও তেমনই হল! জুয়াখেলা, মাতলামি, বদমাইশি! নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে, শত শত সাধুর জীবনদীপ নিবিয়ে দিয়ে, দুনিয়ার অভিশাপ কুড়িয়ে বোম্বেটেরা যে টাকা রোজগার করলে, জামাইকা দ্বীপে ফিরে এসে তা দুহাতে বদখেয়ালিতে উড়িয়ে দিতে তারা কিছুমাত্র বিলম্ব করলে না!

অল্পদিন পরেই দেখা গেল, বোম্বেটেদের পকেট আর বাজে না, তা একেবারেই ফোক্কা!

কাপ্তেন মর্গ্যান ছিল চালাক মানুষ। উড়নচণ্ডীর পুজো সে করেনি কোনওদিন খরচ করত বুঝেসুঝে। কাজেই এর মধ্যেই সে এমন দু’পয়সা জমিয়ে ফেলেছিল যে ইচ্ছে করলেই বাকি জীবনটা পায়ের উপরে পা দিয়ে গদিয়ান হয়ে বসে বসে খেতে পারত।

কিন্তু তার উচ্চাকাঙক্ষা সামান্য ছিল না। সে চায় এমন যশের শিখরে উঠে দাঁড়াতে, যার নাগাল কেউ পাবে না! দুনিয়ায় অনেক ছোট ডাকাত পরে রাজা মহারাজা হয়েছে, সাগরবাসী বোম্বেটেই বা কেন দেশমান্য মহাপুরুষ হতে পারবে না? হয়তো এমনই সব কথাই ভেবে মনটা তার উসখুস করছিল আবার সাগরে আর সাগরের তীরে তীরে কালবৈশাখীর মতো ছুটে যেতে!

এমন সময়ে এসে ধর্না দিলে তার লক্ষ্মীছাড়া চালা-চামুণ্ডার দল!

—কিহে, খবর কি? মুখ অত শুকনো কেন?

—সর্দার! আমরা খেতে পাচ্ছি না!

—বেশ তো, সেজন্য ভাবনা কি? টাকা রোজগার করো!

—আমরা তো সেইজন্যেই তোমার কাছে এসেছি সর্দার! আমরা খেতে পাচ্ছি না। আমরা টাকা রোজগার করতে চাই। আমরা আবার সমুদ্রে ভাসতে চাই।

মর্গ্যান হাসিমুখে বললে, আচ্ছা, তাই হবে। তোমরা প্রস্তুত হও।

—আমরা প্রস্তুত! পাওনাদার হতভাগারা ভারি ছোটলোক, তারা এখানে আমাদের আর তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না!

মর্গান যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হতে লাগল। এবার সে যে আয়োজনে নিযুক্ত হল, তার আগে পৃথিবীতে আর কোনও পেশাদার বোম্বেটে স্বপ্নেও তা করেছে কিনা সন্দেহ। তার আয়োজনের বিপুলতা দেখলে তাকে আর বোম্বেটে বলেও মনে হবে না। ছোটখাট লুটপাট বা রাহাজানি যারা করে, পৃথিবী তাদের ডাকাত বলে ডাকে। কিন্তু চেঙ্গিজ খাঁ, তৈমুর লং, আলেকজান্দার, সিজার, নাদির শা বা নেপোলিয়নকে ডাকাত বলতে সাহস করে না কেউ। এই হিসাবে, মর্গ্যানও আজ বেঁচে থাকলে, তাকে বোম্বেটে বলে ডাকলে হয়তো মানহানির মামলা আনতে পারত!

মর্গ্যানের এবারকার নৌ-বাহিনীতে জাহাজের সংখ্যা হল সাঁইত্রিশখানা! অ্যাডমিরালের— অর্থাৎ মর্গ্যানের—জাহাজে ছিল বাইশটা প্রকাণ্ডকামান ও ছয়টা ছোট পিতলের কামান। বাকি কোনওখানাতে বিশটা, কোনওখানাতে আঠারটা, কোনওখানাতে ষোলটা, এবং সবচেয়ে ছোট জাহাজেও কামানের সংখ্যাছিল অন্তত চারটে লোকও গেল অনেক। তাদের নাবিক ও চাকর-বাকর ছিল ঢের,কিন্তু তাদের বাদ দিলেও সৈনিক বা বোম্বেটেরা গুণতিতে দাঁড়াল পুরোপুরি দুইহাজার! এবারে মর্গ্যান নিজের দলকে আর বোম্বেটের দল বলতেও রাজি হল না, তার মতে তারা হচ্ছে ইংলণ্ডপতির কর্মচারী! যারা ইংলণ্ডের রাজার মিত্র নয়, তাদের সঙ্গেই সে নাকি লড়াই করতে যাচ্ছে! ইংলণ্ডের রাজার বিনা হুকুমের ও বিনা মাহিনার ভৃত্যু হয়ে তারা নিজেদের পাপকার্য অর্থাৎ নরহত্যা, দসু্যতা ও লুণ্ঠনকেও বৈধ বলে প্রমাণিত করতে চলল।

তারপর আরম্ভ হল আগেকার দৃশ্যেরই পুনরাভিনয়—জলে স্পানিয়ার্ড জাহাজ দেখলেই তারা দখল করে, স্থলে স্পানিয়ার্ডদের শহর বা গ্রাম পেলেই লুণ্ঠন করে, বন্দীদের মেরে ফেলে বা মারাত্মক শাস্তি দেয়। সেন্ট কাথারাইন দ্বীপও তারা অধিকার করলে। কিন্তু এসব কথা আর খুঁটিয়ে না বললেও চলবে।

আমরা এখানে বোম্বেটে মর্গ্যানের জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল ঘটনার কথাই বলব—অর্থাৎ পানামা অধিকার।

পানামার নাম জানে না, সভ্য পৃথিবীতে এখন এমন লোক বোধহয় নেই। সকলেই জানেন, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার সংযোগস্থলে আছে এই নগরটি। পানামায় তখন ছিল স্পানিয়ার্ডদের প্রভুত্ব, এখন তা স্বাধীন প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে। পানামা নগরের বর্তমান লোকসংখ্যা ৫৯,৪৫৮। কিন্তু পানামার পথঘাট বোম্বেটেদের ভাল করে জানা ছিল না। কাপ্তেন মর্গ্যান তখন পানামা অঞ্চলের কোনও ডাকাতকে খুঁজতে লাগল। পৃথিবীতে সাধু খুঁজে পাওয়াই প্রায়ই অসম্ভব ব্যাপার, অসাধুর সন্ধান পাওয়া তো অত্যন্ত সহজ! অবিলম্বেই পানামার তিন ডাকাতকে পাওয়া গেল—নৃশংস ও নিম্নশ্রেণীর ডাকত। লুটের লোভে তারা এক কথাতেই মর্গ্যানের পথপ্রদর্শক হবার জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করলে।

পানামায় যেতে হলে চাগ্রে নদীর ধারে একটা দুর্ভেদ্য কেল্লা পার হয়ে যেতে হয়। মর্গ্যান আগে সেই কেল্লাটা দখল করবার জন্যে সৈন্য ও সেনাপতি পাঠিয়ে দিলে। যেমন নেতা, তেমনই সেনাপতি। তার নাম কাপ্তেন ব্রোডলি, এ অঞ্চলে অগুণতি ডাকাতি করে সে দুর্নাম কিনতে পেরেছে যথেষ্ট। তিনদিন পরে সে চাগ্রে দুর্গের কাছে গিয়ে হাজির হল—স্পনিয়ার্ডর তাকে সেন্ট লরেন্স দুর্গ বলে ডাকত। এই দুর্গটি উঁচু পাহাড়ের উপর অবস্থিত—তার চারিদিকে শক্ত পাথরের মতো পাঁচিল। পাহাড়ের শিখরদেশ দুই ভাগে বিভক্ত, মাঝখানে ত্ৰিশফুট গভীর এক খাল। সেই খালের উপরকার টানা সাঁকোর সাহায্যে দুর্গের একমাত্র প্রবেশপথের ভিতরে ঢোকা যায়। বড় দুর্গের তলায় আছে আবার একটা ছোট—কিন্তু রীতিমতো মজবুত কেল্লা, —আগে সে কেল্লা ফতে না করে নদীর মুখে প্রবেশ করাই অসম্ভব।

গুণধর বোম্বেটেদের সঙ্গে চোখের দেখা হতেই স্পানিয়ার্ডরা মুষলধারে গোলাগুলি বৃষ্টি শুরু করলে। কেল্লা তখনও মাইল তিনেক তফাতে। পথঘাট ধূলোকাদায় ভরা, চলতে বড় কষ্ট। তবু বোম্বেটেরা দাঁড়াল না, তারা যত এগোয় স্পানিয়ার্ডরা ততই পিছিয়ে যায়। এইভাবে অগ্রসর হয়ে বোম্বেটের দল দুর্গের কাছে খোলা জমিতে এসে পড়ল।

ইতিমধ্যেই তাদের লোকক্ষয় হয়নি বড় কম। কিন্তু এখন তাদের বিপদ আরও বেড়ে উঠল। খোলা জমি, শত্রুপক্ষের গুলির ধারা সিধে তাদের দিকে ছুটে আসছে, কোথাও এমন ঠাই নেই যে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করা যায়। সামনেই কামানের সারের পর সার সাজিয়ে খাড়া হয়ে আছে বিরাট ওই দুর্গ, দেখলেই মনে হয় ওকে দখল করা অসম্ভব। এবং এই মুক্ত স্থানে আর অপেক্ষা করাও সম্ভবপর বা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এখন হয় পালানো, নয় আক্রমণ করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই! পালালে অপমান, এগুলেও পরাজয় বা মৃত্যু!

হতাশভাবে গোলোকধাঁধায় পড়ে বোম্বেটেরা অনেকক্ষণ পরামর্শের পর স্থির করল—দুর্গ আক্রমণ করতেই হবে—মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন!..এক হাতে তরবারি ও আর এক হাতে বোমা নিয়ে তারা অগ্রসর হতে লাগল অকুতোভয়ে!

স্পানিয়ার্ডরা দুর্গপ্রাকার থেকে কামান ছুড়ছে, ছুড়ছে আর ছুড়ছেই! বোম্বেটেরা হতাহতের ভিতর দিয়ে পথ করে যখন আরও কাছে এগিয়ে এল, স্পানিয়ার্ডরা তখন চিৎকার করে বললে, ওরে ইংরেজ কুত্তার দল! তোরা হচ্ছিস ভগবান আর আমাদের রাজার শক্র! আয়, এগিয়ে আয়, তোদের পিছনে যারা আছে তারাও এগিয়ে আসুক! তোদের আর এ যাত্রা পানামায় যেতে হচ্ছে না।

বোম্বেটেরা কেল্লার পাঁচিলের উপরে ওঠবার চেষ্টা করলে—কিন্তু বৃথা গরম গরম গোলার ঝড়ে ও গুলির বৃষ্টিতে জীবন্ত সব দেহ মুহূর্তে মৃতদেহে পরিণত হল! তখন সে রাত্রের মতো তারা যুদ্ধে ক্ষান্তি দিয়ে পালিয়ে এল।

সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আবার যুদ্ধ আরম্ভ! বোম্বেটেরা বোমা ছুড়ে যখন কেল্লার পাঁচিলকে কাবু করবার চেষ্টা করছে তখন আশ্চর্য এক কাণ্ড হল! তখন বন্দুকের ব্যবহার আরম্ভ হলেও ধনুকের ব্যবহার একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। স্পানিয়ার্ডরা বন্দুকের সঙ্গে ধনুকও ছুঁড়ছিল। হঠাৎ একটা তীর এসে একজন বোম্বেটের দেহকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিলে। কিছুমাত্র ভ্ৰক্ষেপ না করেই সে সেই তীরটা নিজের বুকের উপর থেকে একটানে আবার উপড়ে ফেললে। তারপর তার কি কেয়াল হলো খানিকটা তুলো নয়ে তীরের গায়ে জড়িয়ে সেটা নিজের বন্দুকের নলচের ভিতরে পুরে দুর্গ লক্ষ্য করে সে গুলি ছুড়লে গুলির সঙ্গে তীরটাও বন্দুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে দুর্গের ভিতরে গিয়ে পড়ল। দুর্গের ভিতরে যেসব বাড়ি ছিল সেগুলোর ছাদ হচ্ছে তালপাতায় ছাওয়া। তীরসংলগ্ন জ্বলন্ত তুলোর গুণে দুই তিনখানা বাড়ির ছাদে আগুনের শিখা দেখা দিলে। যুদ্ধে ব্যস্ত স্পানিয়ার্ডরা সেদিকে নজর দেবার সময় পেলে না। সকলের অজ্ঞাতসারেই সেই অদ্ভুত উপায়ে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি একরাশ বারুদের স্তুপকে স্পর্শ করলে,—সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ আগ্ন্যুৎপাত, বিষম বারুদ-গর্জন, বহুকন্ঠের সচকিত চিৎকার ও স্পানিয়ার্ডদের সভয়ে ছুটোছুটি যুদ্ধ ভুলে সকলেই তাড়াতাড়ি আগুন নেবাবার চেষ্টা করতে লাগল।

বোম্বেটেরা এমন মহা সুযোগ ত্যাগ করলে না, দৈবের অনুগ্রহে আবিষ্কৃত পূর্বকথিত উপায়ে তারা দুর্গের আরও নানা জায়গায় অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি করলে। স্পানিয়ার্ডদের ভয়, কাতরতা ও ব্যস্ততা বেড়ে উঠল—একটা আগুন নেবায় তো আরও দু’জায়গায় দপদপ করে নূতন আগুন জ্বলে উঠে।

সেই আগুনে অবশেষে অনেক জায়গায় দুর্গের বেড়া উড়েপুড়ে গেল এবং প্রাচীরের বিরাট মৃত্তিকাস্তুপ ধসে নিচেকার খাল ভরাট করে ফেললে! বোম্বেটেরা তার সাহায্যে অনায়াসে খাল পার হয়ে দুর্গের প্রথম প্রাচীরের ভিতরে গিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল।

তবু যুদ্ধ থামল না—গভীর রাত্রে মানুষেরা স্বজাতিকে ধ্বংস করবার জন্য বন্যপশুর মতো যুঝতে লাগল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বোম্বেটেদের কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারলে না। সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হল দেখে বীর স্পানিয়ার্ডরা আত্মসমর্পণের চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয় ভেবে দলে দলে জলে ঝাপ দিয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নিলে। দুর্গের গভর্নরও জীবন থাকতে আত্মদান করলেন না,বোম্বেটেরা যখন তাঁর দেহ স্পর্শ করতে পারলে, তখন তাঁর আত্মা পরলোকে। দুর্গের তিনশ চোদ্দজন লোকের মধ্যে জ্যান্ত অবস্থায় পাওয়া গেল মাত্র ত্রিশজন লোক—তাদের মধ্যেও কুড়িজন আহত। কেবল নয়জন লোক পানামার গভর্নরের কাছে খবর দিতে গেছে—বাকি সবাই মৃত! বোম্বেটেদেরও ক্ষতি বড় সামান্য নয়। তাদের একশজন হত ও সত্তরজন আহত হয়েছে।

জীবিত স্পানিয়ার্ডরা শারীরিক যন্ত্রণার চোটে স্বীকার করতে বাধ্য হল যে, পানামার গভর্নর বোম্বেটেদের আগমনের সব খবরই আগে থাকতেই পেয়েছেন এবং আগে থাকতেই তাদের ভাল করে অভ্যর্থনা করবার জন্যে দস্তুরমতো প্রস্তুত হয়ে আচেন। চাগ্রে নদীর ধারে সর্বত্রই তাঁর সৈনরা অপেক্ষা করছে এবং সর্বশেষ তিনিও অপেক্ষা করছেন তিন হাজার ছয়শ সৈন্য নিয়ে।

অতঃপর বোম্বেটেদের উচ্চ জয়ধ্বনির মধ্যে কাপ্তেন মর্গান তার বাকি বারশত সৈন্য নিয়ে দুর্গের মধ্যে প্রবেশ করলে। পানামা বিজয়ের পথের কাঁটা দূর হয়েছে, সকলের মুখেই হাসি আর ধরে না।

যে একশ বোম্বেটে অর্থলোভে সেখানে প্রাণ দিলে, জীবিত সঙ্গীদের মুখের হাসি দেখবার সুযোগ তাদের দেহহীন আত্মারা সেদিন পেয়েছিল কিনা কে জানে!

 

পানামার যুদ্ধ

 

১৬৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই আগস্ট তারিখে কাপ্তেন মর্গ্যান চাগ্রে দুর্গ ছেড়ে পানামা নগরের দিকে অগ্রসর হল সদলবলে।

যাত্রা শুরু হল জলপথে, নদীতে নৌকোয় চড়ে। যতই অগ্রসর হয়, দেখে নদীর দুই নির্জন তীর মরু-শ্মশানের মতো হা হা করছে, শস্যক্ষেতে কৃষক নেই, গ্রামে বাসিন্দা নেই, পথে কুকুরবিড়াল নেই, কোথাও জীবনের এতটুকু চিহ্ন পর্যন্ত নেই!স্পানিয়ার্ডরা সবাই পালিয়েছে তাদের ভয়ে এবং সঙ্গে করে নিয়ে গেছে জীবনের যত কিছু আনন্দ!

প্রথম থেকেই ঘটল খাদ্যাভাব। মর্গ্যান সঙ্গে বেশি খাবার নিয়ে ভারগ্রস্ত হতে চায়নি, ভেবেছিল পথে লোকালয়ে নেমে তরোয়াল উচিয়ে বিনামূল্যে প্রচুর খাদ্য আদায় করবে। তার সে আশায় ছাই পড়ল। মানুষ নেই, খাবারও নেই। শূন্য উদরের অভাব ভোলবার জন্যে বোম্বেটেরা তামাকের পাইপ মুখে দিয়ে অন্যমনস্ক হবার ব্যর্থ চেষ্টা করে।

তারপর জলপথে নৌকোও হল অচল। বৃষ্টির অভাবে নদী ক্রমেই শুকিয়ে আসছে। নৌকো ছেড়ে বোম্বেটেরা ডাঙায় নামল। চলতে চলতে তারা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করতে লাগল, শক্ররা তাদের আক্রমণ করতে আসুক! কারণ শত্রুরা এলে খাবারও তাদের সঙ্গে আসবে এবং শত্রু মেরে তারা সেই খাবারে ভাগ বসাতে পারবে!

আজ যাত্রার চতুৰ্থ দিবস। আজশক্রদের বদলে তাদের পরিত্যক্ত একটা ছাউনি পাওয়া গেল, তার ভিতরে পড়েছিল অনেকগুলো চামড়ার ব্যাগ,হয়তো ভুলে ফেলে গেছে! ক্ষুধার্ত বোম্বেটেরা পরম আনন্দে সেই শুকনো চামড়ার ব্যাগগুলো নিয়েই কড়াকড়ি করতে লাগল—গরম জলে সিদ্ধ ও নরম করে সেই ব্যাগের চামড়াই খেয়ে আজ তারা পেটের জ্বালা নিবারণ করবে!

পঞ্চম দিনে তারা আর এক জায়গায় এসে স্পানিয়ার্ডদের আর একটা পরিত্যক্ত ছাউনি আবিষ্কার করলে। কিন্তু হায় রে, একটা চামড়ার ব্যাগ পর্যন্ত এখানে পাওয়া গেল না! কী দুর্ভাগ্য! এ হতচ্ছাড়া দেশে কি একটা জ্যান্ত কুকুর বা বিড়াল পর্যন্ত ল্যাজ নাড়ে না? নিদেন দুচারটে ইঁদুর?

লোকে গালাগলিতে জুতো খেতে বলে। তারাও হয়তো জুতো খেতে রাজি ছিল—ব্যাগ আর জুতোর চামড়ায় তফাৎটা কি? কিন্তু জুতোগুলোও খেয়ে ফেললে খালি পায়ে এইসব কাটাভরা জঙ্গল আর কাঁকরভরা উঁচুনিচু পথ দিয়ে ক্রোশের পর ক্রোশ পার হয়ে ধনরত্ন লুটতে যাবে কেমন করে?

তারা বাংলাদেশের সেপাই হলে জুতোগুলো এত সহজে রেহাই পেত না। বাংলায় খালিপায়ে কাঁকর বেঁধে না, কাঁটা ফোটে না!

অনেকে বোধ করি অবাক হচ্ছেন? কিন্তু এতে অবাক হবার কী আছে? পেটের জ্বালা কেমন, দুর্ভিক্ষের দেশ তা জানে। পেটের জ্বালায় মানুষ মানুষের মাংসও বাদ দেয় না। ইতালির এক কারারুদ্ধ কাউণ্ট নাকি ক্ষিধের চোটে নিজের ছেলের মাংসও খেতে ছাড়েননি।

...এই নির্জন মরু-শ্মশানে দেবতার হঠাৎ এ কী আশীৰ্বাদ! কলির দেবতারাও হয়তো ভীতু, কারণ প্রায়ই তারা অসাধুর দিকেই মুখ তুলে চান। বোম্বেটেরা পথের মাঝে এক পাহাড়ের গুহা আবিষ্কার করলে, তার ভিতরে পাওয়া গেল খাবারের ভাণ্ডার—এমন কি ফল আর মদ পর্যন্ত! সম্ভবত স্পানিয়ার্ডরা পালাবার সময়ে এগুলো এখানে লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল!

সবাই উপোসী শকুনির মতো সেই ভাণ্ডার লুণ্ঠন করলে। ভাল করে না হোক, পেট তবু কতকটা ঠাণ্ডা হল।

যষ্ঠ দিনেও পথের শেষ নেই। কখনও জলপথ, কখনও স্থলপথ,—যখন যেমন সুবিধা। আবার অশ্রাস্ত ক্ষুধার আবির্ভাব। চারিদিক তেমনই নিরালা আর নিঝুম, যারা পালিয়েছে তারা খাবারের গন্ধটুকু পর্যন্ত চেঁচেমুছে নিয়ে পালিয়েছে! বোম্বেটেরা মনে মনে কেবল শক্রকে ডাকতে লাগল। শক্র! সেও আজ মিত্রের মতো! কেউ গাছের পাতা ছিড়ে ও কেউ মাঠের ঘাস উপড়ে মুখে পুরে উদরের শূন্যতাকে ভরাবার চেষ্টা করতে লাগল। স্পানিয়ার্ডরা লড়ে তাদের এমন জব্দ করতে পারত না! গা ঢাকা দিয়ে তারা তাদের কী মারাত্মক শাস্তিই দিচ্ছে! প্রায় দেড়শ বৎসর পরে নেপোলিয়ন এবং খ্রিস্ট জন্মাবারও আগে পারস্যের এক সম্রাট রুশদেশ আক্রমণ করতে গিয়ে এমনই শাস্তিই পেয়েছিলেন।

শয়তানদের উপরে আবার দেবতার দয়া হল! এবারে এক চাষার বাড়িতে তারা পেলে ভুট্টার ভাণ্ডার। ভাড়ার লুটে তারা যত পারলে খেলে, বাকি মাল সঙ্গে করে নিয়ে চলল। কিন্তু বারশ ক্ষুধার্ত ডাকাতের কাছে সে ভুট্টার অস্তিত্ব আর কতক্ষণ ক্ষুধ মিটাল না, তবে আপাতত প্রাণ রক্ষা হল বটে।

সপ্তম দিনে দেখা গেল—দূরে একটা ছোট শহর, তার উপরে উড়ছে ধোঁয়া। বোম্বেটেরা আনন্দে নেচে উঠল। কারণ বিনা কার্য হয় না, আগুন বিনা ধোঁয়া হয় না। আর আগুন মানুষ ছাড়া আর কেউ জুলে না। বাসিন্দারা নিশ্চয়ই রাঁধছে—ও ধোয়া উনুনের ধোঁয়া।

পাগলের মতো তারা শহরের দিকে ছুটল—শূন্যে আকাশকুসুম চয়ন করতে করতে। এই তো, শহর তাদের সামনেই!

কারণ বিনা কার্য হয় না, আগুন বিনা ধোঁয়া হয় না। আর, আগুন মানুষ ছাড়া আর কেউ জ্বলে না।.হ্যাঁ, এ আগুনও মানুষই জ্বেলেছে বটে, স্পানিয়ার্ডরা শহর ছেড়ে অদৃশ্য হয়েছে এবং যাবার সময়ে শহরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে গেছে। বোম্বেটেরা এখানে ক্ষুদ্রকুড়োটি পর্যন্ত পেলে না। একটা জ্যান্ত বা মরা কুকুর বিড়ালও শক্ররা রেখে যায়নি।

একটা আস্তাবলে পাওয়া গেল কেবল প্রচুর মদ আর পাউরুটি। অমনি তারা সারি সারি বসে গেল ফলারে! কিন্তু পানাহার শুরু করতেই তাদের শরীর যাতনায় দুমড়ে পড়ল। চারিদিকে রব উঠল—শত্রুরা খাবারে বিষ মিশিয়ে রেখে গেছে? ভয়ে আঁতকে উঠে থুথু করে তারা তখনই মুখের খাবার ধুলোয় ফেলে দিলে।

অষ্টম দিনে বোম্বেটেরা পানামা নগরের খুব কাছে এসে পড়ল। ঘণ্টাদশেক পথ চলার পর তারা বনের ভিতরে একটা পাহাড়ের কাছে এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই তাদের উপরে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর বৃষ্টি হতে লাগল। তীর দেখেই বোঝা গেল, রেড ইন্ডিয়ানরাও স্পানিয়ার্ডদের পক্ষ অবলম্বন করেছে। বোম্বেটেরা বেজায় ভয় পেয়ে গেল, কারণ এ সব তীর যারা ছুড়ছে তাদের টিকিট পর্যন্ত কারুর নজরে পড়ল না।

বোম্বেটেরা বনপথে এগুবার চেষ্টা করলে, অমনি রেড ইন্ডিয়ানরা বিকট চিৎকার করতে করতে তাদের দিকে ছুটে এল। কিন্তু একে তাদের দল বোম্বেটেদের মতো পুরু নয়, তার উপরে তাদের আগ্নেয় অস্ত্রেরও অভাব, সুতরাং বেশিক্ষণ তারা যুঝতে পারলে না। রেড ইন্ডিয়ান সর্দার আহত হয়ে পড়ে গিয়েও আত্মসমর্পণ করলে না, কোনওরকমে একটু উঠে বসে একটা বোম্বেটের দিকে বর্শা নিক্ষেপ করলে, কিন্তু পর মুহুর্তেই পিস্তলের গুলিতে তার যুদ্ধের শখ এ জীবনের মতন মিটে গেল!

খানিক পরেই একটা বনের ভিতরে পাওয়া গেল দুটো পাহাড়। একটা পাহাড়ের উপরে উঠে বোম্বেটেরা দেখলে, অন্য পাহাড়টার উপরে চড়ে বসে আছে স্পানিয়ার্ড ও রেড ইন্ডিয়ানরা। তারা তখন নিচে এল। তাই দেখে শত্রুরাও নিচে নামতে লাগল। বোম্বেটেরা ভাবলে, এইবারে বুঝি আবার যুদ্ধ বাধে! কিন্তু শক্ররা এখানে লড়াই না করেই কোথায় সরে পড়ল!

সে রাত্রে বোম্বেটেদের বিষের পাত্র কানায় কানায় পূর্ণ করবার জন্যে আকাশে দেখা দিলে ঘনঘটা এবং তারপরেই নামল অশ্রান্ত বৃষ্টিধারা। নিরাশ্রয়ের মতো সেই ঝড়বাদলকে তাদের মাথা পেতেই গ্রহণ করতে হল। পরদিন সকালে—অর্থাৎ যাত্রার নবম দিনে প্রায় অনাহারে জলে ভিজে অত্যন্ত দুঃখিতভাবে তারা কাদা ভাঙতে ভাঙতে আবার অগ্রসর হল।

আচম্বিতে পথ সমুদ্রতীরে এসে পড়ল এবং দেখা গেল খানিক তফাতে কতকগুলো ছোট ছোট দ্বীপ রয়েছে। বোম্বেটেরা তখনই নৌকোয় চেপে দেখতে গেল, সে সব দ্বীপের ভিতরে কি আছে!

সে দ্বীপে পাওয়া গেল গরু, মোষ, ঘোড়া এবং সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় গাধা। বোম্বেটেরা মনের খুশিতে তাদের দলে দলে বধ করতে আরম্ভ করলে। তখনই তাদের ছাল ছাড়িয়ে আগুনের ভিতরে ফেলে দেওয়া হল। মাংস সিদ্ধ হওয়া পর্যন্তও তারা অপেক্ষা করতে পারলে না, ক্ষুধার চোটে প্রায় কাচা মাংসই চিবিয়ে খেতে লাগল। আজ এতদিন পরে এই প্রথম তারা মনের সাধুে পেট ভরে খাবার সুযোগ পেলে!

খাবার খেয়ে নূতন শক্তি পেয়ে মর্গ্যানের হুকুমে আবার তারা পথে নামল। সন্ধ্যা যখন হয় হয় তখন দেখা গেল, দূরে প্রায় দুইশত স্পানিয়ার্ড তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করছে এবং তাদের পিছন থেকে দেখা যাচ্ছে, পানামা শহরের একটা উঁচু গির্জার চুড়ো।

বোম্বেটেরা আশ্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বিপুল উল্লাসে জয়ধ্বনি করে উঠল—চারিদিকে পড়ে গেল আনন্দের সাড়া। এইবারে তাদের পথশ্ৰম, রোদে পোড়া, জলে ভেজা ও পেটের জ্বালা শেষ হল। আসল যুদ্ধ এখনও হয়নি বটে, নগর এখনও নাগালের বাইরে বটে, কিন্তু সে অসুবিধা বেশিক্ষণ আর ভোগ করতে হবে না! আর তাদের বাধা দেয় কে?.. সে রাতের মতো তাবু গেড়ে তারা ঘুমিয়ে পড়ল।

সকাল হল। শক্ৰদের পঞ্চাশজন অশ্বারোহী এসে দূরে থেকেই চেচিয়ে শাসিয়ে গেল—ওরে পথের কুকুরের দল! এইবারে আমরা তোদের বধ করব!—তারপরেই পানামা নগর থেকে গোলাবৃষ্টি আরম্ভ হল—কিন্তু মিথ্যা সে গোলাগুলোর গোলমাল, কারণ গোলাগুলোর একটাও তাদের কাছ পর্যন্ত এসে পৌছল না।

দশম দিনের সকালে বোম্বেটেরা বসে বসে নিশ্চিন্তপ্রাণে খানা খেয়ে নিলে—অনেকেরই এই শেষ খানা!

তারপরেই জেগে উঠল তাদের জয়ঢাক আর রণভেরীগুলো। বোম্বেটেরা শ্রেণীবদ্ধ হয়ে সমতালে পা ফেলতে ফেলতে অগ্রসর হল।

দেখা গেল, দূরে কামানের সারের পর সার সাজিয়ে স্পানিয়ার্ডরা যুদ্ধক্ষেত্রে অপেক্ষা করছে। তারা জানে, বোম্বেটেরা এই পথেই আসবে।

এমন সময়ে সেই পথপ্রদর্শক ডাকাতরা মর্গ্যানকে ডেকে বললে, হুজুর , এ পথে অনেক কামান, অনেক বাঁধা! বনের ভিতর দিয়ে আর একটা পথ আছে, সেটা ভাল নয় বটে কিন্তু সেখান দিয়ে খুব সহজেই শহরে পৌছানো যাবে।

মর্গ্যান তাদের কথামতোই কাজ করলে—বোম্বেটেরা অন্য পথ ধরলে। স্পানিয়ার্ডদের প্রথম চাল ব্যর্থ হল। বোম্বেটেরা যে হঠাৎ পথ বদলাবে, এটা তারা আশা করেনি। তাদের সমস্ত আয়োজন হয়েছিল এইখানেই। বাধ্য হয়ে তারাও অন্য পথে বোম্বেটেদের বাধা দেবার জন্যে ছুটল,—তাড়াতাড়িতে ভারি ভারি কামানগুলোকে এখান থেকে টেনে নিয়ে যাবারও সময় পেলে না। এই ভুল হল তাদের সর্বনাশের কারণ।

বোম্বেটেরা সভয়ে দেখলে, শক্রর যেন শেষ নেই! কাতারে কাতারে লোক তাদের আক্রমণ করবার জন্যে বিকট চিৎকারে ধেয়ে আসছে—তাদের পিছনে আবার কাতারে কাতারে সৈন্য। এত শত্রুসৈন্য এক জায়গায় তারা আর কখনও দেখেনি! অশ্বারোহী, পদাতিক, কামানবাহী —কিছুরই অভাব নেই!

তার উপরে আছে আবার হাজার হাজার বুনো মোষের পাল—রেড ইন্ডিয়ান ও কাফ্রিরা মোষগুলোকে তাদের দিকেই তাড়িয়ে আনছে। সেকালে ভারতের রাজারা যুদ্ধক্ষেত্রে যে ভাবে হাতির পাল ব্যবহার করতেন, এরা এই বুনো মোষগুলোকে ব্যবহার করবে সেই ভাবেই!

একটা ছোট পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বোম্বেটেরা শক্ৰদের এই বিপুল আয়োজন লক্ষ্য করতে লাগল। এখন তাদের পালাবারও পথ বন্ধ। পিছনে জেগে আছে জনহীন, আশ্রয়হীন ও খাদ্যহীন সেই নির্দয় শ্মশানভূমি নিজেদের বিপদসঙ্কুল অবস্থার কথা ভেবে বোম্বেটেরা একেবারে মরিয়া হয়ে উঠল। তারা স্থির করলে—হয় মরবে, নয় মারবে। তারা পালাবেও না, আত্মসমর্পণও করবে না!

রণভেরী বেজে উঠল। মর্গান সর্বাগ্রে দুইশত বাছা বাছা সুদক্ষ ফরাসি বন্দুকধারীকে দলের আগে আগে পাঠিয়ে দিলে।

স্পানিয়ার্ডরও অগ্রসর হতে হতে চিৎকার করে উঠল—ভগবান আমাদের রাজার মঙ্গল করুন!

প্রথমেই আসছে শক্ৰদের অশ্বারোহী সৈন্যদল। কিন্তু খানিক এগিয়েই তারা এক জলাভূমির উপরে এসে পড়ল—সেখানে ঘোড়া নিয়ে ঘোরাফেরাই দায়!

বোম্বেটে বন্দুকধারীরা এ সুযোগ অবহেলা করলে না, তারা মাটির উপরে এক হাঁটু রেখে বসে,টিপ ঠিক করে বন্দুক ছুঁড়লে এবং অনেকেরই লক্ষ্য হল অব্যর্থ ঘোড়সওয়াররা জলাভূমির ভিতরে হাঁকপাক করে বেড়াতে লাগল এবং গুলির পর গুলির চোটে হয় ঘোড়া নয় সওয়ার হত বা আহত হয়ে নিচে পড়ে যেতে লাগল।

অশ্বারোহীদের আক্রমণে ফল হল না দেখে, বোম্বেটেদের ছত্রভঙ্গ করবার জন্যে বুনো মোষগুলো লেলিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু মোষেদের বেশির ভাগই গোলাগুলির আওয়াজে চমকে ও ভড়কে অন্যদিকে ছুটে পালাল, যারা এগিয়ে গেল তাদের বেশি রাগ হল মানুষের বদলে রঙিন নিশানগুলোরই উপরে। তারা পতাকা লক্ষ্য করে তেড়ে এল এবং সেই ফাকে বোম্বেটেরা তাদের গুলি করে নিশ্চিন্তপুরে পাঠিয়ে দিলে।

তারপর আরম্ভ হল বোম্বেটেদের সঙ্গে স্পানিয়ার্ড পদাতিকদের লড়াই। বোম্বেটেরা জানত, হারলে তারা কেউ আর প্রাণে বাঁচবে না। তাই তারা এমন মরিয়া হয়ে লড়তে লাগল যে, একএকজন বোম্বেটেকে তিন-চারজন স্পানিয়ার্ড মিলেও কায়দায় আনতে পারলে না। বোম্বেটেদের এক হাতে পিস্তল, আর এক হাতে তরোয়াল,—দূরের শক্রকে গুলি ছুড়ে মারে, কাছে পেলে বসিয়ে দেয় তরোয়ালের কোপ! তারা অসম্ভব শক্র! ঘণ্টা দুইয়ের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ। স্পানিয়ার্ডরা যে যেদিকে পারলে সরে পড়ল—ছয়শজন মৃত সঙ্গীর দেহ যুদ্ধক্ষেত্রে ফেলে রেখে।

এত আয়োজনের পর এত শীঘ্র লড়াই শেষ হয়ে যাবে, এটা কেউ কল্পনা করতে পারেনি। পানামার পতন হল।

 

পলাতক বিজয়ী নেতা

 

খুব সহজে ও অল্প সময়ের মধ্যেই চেঙ্গিজ খাঁ, আলেকজান্দার, সিজার ও নেপোলিয়ন শত্রুসৈন্য ধ্বংস করতে পারতেন বলেই তাদের আজ এত নাম।

তাঁদের সঙ্গে বোম্বেটে মর্গ্যানের তুলনাই চলে না। কিন্তু মর্গ্যানের পানামা বিজয় যে বিশেষ বিস্ময়জনক ব্যাপার, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই।

পূর্বকথিত দিগ্বিজয়ীরা এক বা একাধিক সমগ্র জাতির সাহায্য পেয়েই বড় হয়েছিলেন।

কিন্তু মর্গ্যান হচ্ছে কতকগুলো জাতিচ্যুত, সমাজ থেকে বিতাড়িত, নীতিজ্ঞানশূন্য, হীন বোম্বেটের সর্দার। এবং তাদের শত্রুরা হচ্ছে অসংখ্য স্পানিয়ার্ড সৈনিক, প্রবল পরাক্রান্ত স্পেন সাম্রাজ্যের অতুলনীয় শক্তি তাদের পিছনে, অস্ত্রশস্ত্রে ও সংখ্যাধিক্যে বোম্বেটেদের চেয়ে তারা ঢের বেশি বলিষ্ঠ। তবু যে তারা এত অনায়াসে হার মানতে বাধ্য হল, এটা একটা মস্ত স্মরণীয় ব্যাপার বলে স্বীকার করতেই হবে।

পানামার পতন হল। তারপর যেসব কাণ্ড আরম্ভ হল পাঠকরা তা কল্পনাই করতে পারছেন। বোম্বেটেরা প্রথমে দু'চোখো হত্যা করতে লাগল—সৈনিক, সাধারণ নাগরিক, কফ্রি, বালক, নারী ও শিশু—খাড়া পড়ল নির্বিচারে সকলেরই উপরে। বোম্বেটেরা দলে দলে ধর্মযাজক বা পাদ্রী বন্দি করলে, প্রথমে তাদেরও পাদ্রী হত্যা করতে বিবেকে বাধল, তাই তাদের ধরে মর্গ্যানের কাছে নিয়ে গেল।

মর্গ্যান পাদ্রীদের কান্নায় কর্ণপাত না করে বললে, “মারো, মারো, সবাইকে মারো” লুণ্ঠন চলতে লাগল। পলাতকরা অনেক ধনরত্ব নিয়ে পালিয়েছিল, কিন্তু তখনও শহরে ছিল প্রচুর ঐশ্বর্য। সব পড়ল বোম্বেটেদের হাতে—হীরা, চুনি, পান্না, মুক্তো, সোনারুপোর আসবাব ও তাল এবং টাকাকড়ি আর যা কিছু।

তারপর মর্গ্যান জনকয়েক বোম্বেটেকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললে, তোমরা চুপি চুপি শহরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে এসো।

কেউ কিছু টের পাবার আগেই একদিন অকস্মাৎ সেই বৃহৎ নগরের উপরে অগ্নির রাঙা টকটকে জিভ লকলক করে জ্বলে উঠল। স্পানিয়ার্ডরা সবাই সেই আগুন নেবাতে ছুটল, এর মধ্যে তাদের সর্দারের হাত আছে না জেনে অনেক বোম্বেটেও তাদের সাহায্য করতে গেল,কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না— দেখতে দেখতে বিরাট অগ্নির বেড়াজালের মধ্যে গোটা শহরটাই ধরা পড়ল! বড় বড় প্রাসাদ, অট্টালিকা, কারুকার্য করা গির্জা, মঠ, গৃহস্থও গরিবের বাড়িসমস্তইগেল আগুনের গর্ভে। সেই অগ্নিকাণ্ডে ছোট-বড় আট হাজার বাড়ি পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে গেল!

মর্গ্যান রটিয়ে বেড়াল—“স্পানিয়ার্ডরাই এই কাণ্ড করেছে!” লুণ্ঠনের পর নির্যাতন। গুপ্তধনের সন্ধান। নির্যাতনের শতশত দৃষ্টান্তের মধ্যে একটা এখানে দেখাচ্ছি: জনৈক ধনী ভদ্রলোক বোম্বেটেদের ভয়ে ধনরত্ননিয়ে পালিয়ে যান। তার গরিব চাকরটা মনিবের একটা দামী পোষাক পেয়ে বুদ্ধির দোষে সেটা নিজে পরে ফেললে।কাঙলের ঘোড়ারোগ বরাবরই সাংঘাতিক। বোম্বেটেরা তাকে দেখেই ধরে নিলে, সে কোনও মস্তবড় লোক।

তার কাছ থেকে তারা টাকা দাবি করলে। সে কোথেকে টাকা দেবে? সে বললে, আমি চাকর ছাড়া আর কিছু নই। এ পোষাক আমার মনিবের।

বোম্বেটেরা বিশ্বাস করলে না। তখন প্রথমেই তারা সে বেচারার হাত দুখানা দুমড়ে একেবারে ভেঙে দিলে। তাতেও মনের মতো জবাব না পেয়ে তারা সেই চাকরের কপালের উপর দড়ির ফাঁস লাগিয়ে এমন জোরে পাকাতে লাগল যে, চামড়ায় টান পড়ে তার চোখদুটো ডিমের মতো বড় হয়ে ঠিকরে পড়বার মতো হয়ে উঠল। তখনও গুপ্তধনের সন্ধান মিলল না। তারপর তাকে শূন্যে দড়িতে ঝুলিয়ে রেখে ঘুষি ও চাবুক মারা হতে লাগল। তার নাক ও কান কেটে নেওয়া হল—জুলন্ত খড় নিয়ে মুখে ছাকা দেওয়া হতে লাগল। শেষকালে সে এই পৈশাচিক যাতনা থেকে মুক্তি পেলে বর্শার আঘাতে। অভাগা মরে বাঁচল।

তিন হস্তা পরে দুরাত্মা মর্গ্যান পানামার ভস্মস্তুপ ছেড়ে বিদায় গ্রহণ করলে।

সঙ্গে করে নিয়ে চলল ছয়শ বন্দীকে—প্রচুর টাকা না পেলে সে তাদের ছাড়তে রাজি নয়। সেই ছয়শত স্ত্রী, পুরুষ, শিশু, বালক, যুবা ও বৃদ্ধ বন্দীর মিলিত ক্ৰন্দনে আকাশ যেন ফেটে যাবার মতো হয়ে উঠল।

ভেড়ার পালের মত বন্দীদের আগে আগে তাড়িয়ে নিয়ে বোম্বেটেরা অগ্রসর হল। মর্গ্যানের হুকুমে বন্দীদের পানাহারও প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হল।

অনেক নারী আর সইতে না পেরে মর্গ্যানের পায়ের তলায় হাঁটু গেড়ে বসে কাতর মিনতির স্বরে বললে, ওগো, আর আমরা পারি না। আপনার পায়ে পড়ি, আমাদের ছেড়ে দিন—আমরা স্বামী-পুত্রের কাছে ফিরে যাই! আমাদের যথাসর্বস্ব গেছে, তবু পাতার কুঁড়ে তৈরি করে স্বামী-পুত্রের সঙ্গে বাস করব।

নিরেট লোহার মতো সুকঠিন মর্গান বললে, আমি এখানে কান্না শুনতে আসিনি—এসেছি টাকা রোজগার করতে। টাকা দিলেই ছাড়ান পাবে, নইলে সারাজীবন বাদী হয়ে থাকবে!

সমুদ্রের ধারে গিয়ে মর্গান বোম্বেটেদের সঙ্গে লুটের মাল ভাগ করতে বসল। নিজের মনের মতো হিসাব করে সকলকে সে অংশ দিলে।

কিন্তু সে অংশ সন্দেহজনক। এতবড় শহর লুটে এত পরিশ্রমের পর এই হল পাওনা, এত কম টাকা!

প্রত্যেক বোম্বেটে বিষম রাগে গরগর করতে লাগল। তাদের দৃঢ়বিশ্বাস হল, মর্গ্যান তাদের ফাঁকি দেবার জন্যে বেশিরভাগ দামী মালই সরিয়ে ফেলেছে! মর্গ্যানকে তারা মুখের উপরে কিছু খুলে বলতে সাহস করল না বটে, কিন্তু প্রত্যেকেই মারমুখো হয়ে রইল।

মর্গান বুঝলে, গতিক সুবিধার নয়। এরা প্রত্যেকেই মরিয়া লোক, যেকোনও মুহুর্তে সে বিপদে পড়তে পারে।

আচম্বিতে একদিন দেখা গেল, চারখানা জাহাজ ও জনকয়েক খুব বিশ্বাসী লোক নিয়ে চোর মর্গ্যান একেবারে অদৃশ্য হয়েছে! একরাত্রেই সে সমস্ত ধনরত্ব নিয়ে চলে গেল—বোম্বেটেরা তাকে ধরতে পারলে না। ধরতে পারলে কি হত বলা যায় না।

তারপর? তারপর মর্গ্যান আর কখনও বোম্বেটেদের সর্দার হয়নি। হবার উপায়ও ছিল না, হবার দরকারও ছিল না।

মর্গ্যানের চূড়ান্ত সৌভাগ্যের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তার নামডাক শুনে ইংলন্ডের রাজা তাকে দেখতে চাইলেন। তার সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করলেন। তাকে স্যার উপাধি দিলেন। তাকে জামাইকা দ্বীপের গভর্নর করে পাঠালেন। চোর, জোচ্চোর, খুনী, চরিত্রহীন, ডাকাত ও বোম্বেটে মর্গ্যান হল হাজার হাজার সাধুর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা—স্যার হেনরি মর্গান!

বিশ্বের শিয়রে মহাবিচারক মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়েন!

কিন্তু স্পানিয়ার্ডদেরও শাস্তির দরকার হয়েছিল। তাদের ভীষণ অত্যাচারে আমেরিকা নিদারুণ যন্ত্রণায় হাহাকার করছিল। ভগবানের মূর্তিমান অভিশাপেরই মতো হয়তো তাই মর্গান লোলোনেজ, পর্তুগীজ ও ব্রেজিলিয়ানোর দল এসে আবির্ভূত হয়েছিল স্পানিয়ার্ডদের মাঝখানে।