জলদস্যু কাহিনী by হেমেন্দ্রকুমার রায়, chapter name 7

7

এ অঞ্চলের জানোয়ার

 

যে মুল্লুকের মানুষ-জানোয়ারের কথা নিয়ে এত আলোচনা করছি, সেখানে জলে-স্থলে আসল জানোয়ারও আছে অনেক রকম। মাঝখানে একটুখানি হাঁপ ছাড়বার জন্যে তাদের কারুর কারুর কথা এখানে কিছু বলতে চাই।

এখানে স্থলে থাকে অজগর, জাগুয়ার, পুমা, বানর, টেপির, প্রবাল সাপ, অন্ধ সাপ, আর্মাডিলো, ভ্যাম্পায়ার বাদুড় প্রভৃতি এবং জলে থাকে কুমির, হাঙর, লণ্ঠন মাছ, ব্যাঙ মাছ, কাছিম, শুশুক, অক্টোপাস, খুনে তিমি, স্কুইড, উকো মাছ, ছিপধারী মাছ, পাইপ মাছ, সিল, উড়ন্ত মাছ, ফিতে মাছ, এবং অন্যান্য তিমি জাতীয় মাছ প্রভৃতি-সব জীবজন্তুর ফর্দও এখানে দেওয়া অসম্ভব। এদের মধ্যে অনেক জন্তুই খোশমেজাজে ও বোম্বোটেদের চেয়ে কম হিংসাকুটে নয়, একটু সুবিধা পেলেই মানুষকে ফলার করবার জন্যে তারা হাঁ করে ছুটে আসে!

দু’একটা জন্তুর ভীষণ প্রকৃতির কথা এখানে বলব। এখানে যে জাতের কুমির পাওয়া যায়, তাদের ‘কেম্যান’ বলে ডাকা হয়। ভারতীয় কুমিরের সঙ্গে তাদের চেহারা ও প্রকৃতি ঠিক মেলে না। বোম্বেটেরা এইসব কুমিরের ভয়ে সর্বদাই তটস্থ হয়ে থাকত। একজন বোম্বেটে এই “কেম্যান” সম্বন্ধে যা বলছে তা হচ্ছে এই।

এই সব কেম্যান ভয়ঙ্কর জীব। সময়ে সময়ে এক একটা সত্তর ফুট লম্বা কেম্যানও দেখা গিয়েছে। নদীর ধার ঘেঁসে এমন নিশ্চেষ্ট হয়ে তারা ভাসতে থাকে যে দেখলেই মনে হয়, যেন একটা পুরনো গাছ পড়ে গিয়ে জলে ভাসছে। সেই সময়ে কোনও গরু কি মানুষ নদীর ধারে এলে আর তার বাঁচোয়া নেই!

এদের দুষ্টুবুদ্ধিও বড় কম নয়। শিকার ধরবার আগে তিন-চারদিন ধরে এরা উপোস করে। সেই সময়ে ডুব মেরে নদীর তলায় গিয়ে কয়েক মণ পাথর বা নুড়ি গিলে ফেলে এরা নিজেদের দেহ আরও বেশি ভারি করে তোলে। ফলে তাদের স্বাভাবিক শক্তি অধিকতর বেড়ে ওঠে।

কেম্যানরা শিকার ধরে টাটকা মাংস খায় না। আধা পচা না হওয়া পর্যন্ত তাদের জলের তলায় ডুবিয়ে রাখে। তাদের আরও অদ্ভুত রুচি আছে। এখানকার লোকেরা নদীর কাছাকাছি জায়গায় যদি মরা জন্তুর চামড়া শুকোবার জন্যে রেখে দেয়, তাহলে কেম্যানরা প্রায়ই ডাঙায় উঠে সেগুলো চুরি করে নিয়ে পালায়। সেই চামড়াগুলো কিছুদিন জলে ভিজলেই তাদের লোমগুলো ঝরে পড়ে যায়। তখন তারা সেগুলো খেয়ে ফেলে।

একদিন একজন লোক নদীর জলে তার তাঁবু কাচছিল। হঠাৎ একটা কেম্যান এসে সেই তাঁবু কামড়ে ধরে জলে ডুব মারবার চেষ্টা করলে। সে ব্যক্তি অত সহজে তাঁবু খোয়াতে নারাজ হল-তাঁবুর একদিক ধরে প্রাণপণে টানাটানি করতে লাগল। বাধা পেয়ে কেম্যানের মেজাজ গেল চটে। সে এক ডিগবাজি খেয়ে জল থেকে ডাঙায় উঠে তাঁবুর অধিকারীকেও নিয়ে নদীর মধ্যে ডুব মারবার ফিকির করলে।

ভাগ্যে লোকটির কাছে একখানা বড় কসাই ছুরি ছিল এবং ভাগ্যে সে কেম্যানের দেহের ঠিক জায়গায় ছুরিখানা দৈবগতিকে বসিয়ে দিতে পারলে, তাই লোকটিকে ছেড়ে দিয়ে সেই জলদানব তখনই খাবি খেতে বাধ্য হল! তার পেট ফেড়ে পাওয়া গেল রাশি রাশি বড় বড় নেড়ানুড়ি!

কেবল বড় বড় জীব নয়, কেম্যানরা পুঁচকে মাছি পেলেও টপ করে খেয়ে ফেলতে ছাড়ে না। কেম্যানরা ডাঙায় উঠে। ডিম ছাড়ে এবং ডিমগুলোর উপরে পা দিয়ে বালি ছড়িয়ে দেয়। রোদের আঁচে ডিম ফোটে, এবং বাচ্চাগুলো ডিম ছেড়ে বেরিয়েই জলের ভিতরে চলে যায়। পাখিরা অনেক সময়ে ডিম নষ্ট করে। মা কেম্যান সেদিকেও নজর রাখতে ভোলে না। পাখির ঝাঁক আসবার সম্ভাবনা দেখলে প্রায়ই তারা নিজেদের ডিম আবার কোৎ কোৎ করে গিলে ফেলে। তারপর বিপদ কেটে গেলে ডিমগুলোকে ফের হড়াৎ করে উগরে বার করে দেয়!

ডিম ফুটলে মা কেম্যান তার বাচ্চাদের নিয়ে জলে খেলা করে। আমি স্বচক্ষে দেখেছি, কেলা করতে করতে বাচ্চা কেম্যানরা তাদের মায়ের মুখের ভিতর দিয়ে পেটের ভিতরে গিয়ে ঢুকছে, আবার বেরিয়ে আসছে!

নদীপ্রধান জায়গায় আড্ডা গাড়তে হলে এই কেম্যানদের ভয়ে সব সময়েই আমরা ব্যস্ত থাকতুম। রাত্রে কারুকে পাহারায় না রেখে ঘুমোতে পারতুম না।

আমাদের দলের একজন লোক একবার তার কাফ্রি চাকরের সঙ্গে বনের ভিতরে ঢুকেছিল। কোথায় কোন ঝোপে একটা পাঁজি কেম্যান ঘুপটি মেরে ছিল, হঠাৎ সে বেরিয়ে এসে লোকটির একখানা পা কামড়ে ধরে মাটিতে পেড়ে ফেললে। তাই না দেখেই কাফ্রি চাকরিটা-সাহায্য করা দূরে থাক-টেনে লম্বা দিলে।

আমাদের বন্ধু ভীরু ছিল না, বিপদে পড়ে ভেবড়ে গেল না। তার গায়ে জোরও ছিল যথেষ্ট, যদিও সে জোর কেম্যানের পাল্লায় পড়ে বেশি কাজে লাগল না। কিন্তু সে তার লম্বা ছুরিখানা নিয়ে কেম্যানের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগল। এ যুদ্ধ ডাঙায় হচ্ছিল বলেই রক্ষা, তাই খানিকক্ষণ যোঝাযুঝির পরে অনেকগুলো ছুরির ঘা খেয়ে কেম্যানটা ছটফট করতে করতে মারা পড়ল। আমাদের বন্ধুর সর্বাঙ্গ তখন ক্ষতবিক্ষত। রক্তপাতে নেহাৎ দুর্বল হয়ে সেইখানেই মড়ার মতো পড়ে রইল।

এতক্ষণ পরে কফ্রিবীরের মনে হল, তার মনিবের অবস্থােটা কিরকম, একবার উঁকি মেরে দেখে আসা উচিত! তার মনিবের দেহ কেম্যানের উদরে অদৃশ্য হয়ে যায়নি দেখে সে আশ্বস্ত হয়ে তাকে পিঠে তুলে নিয়ে প্রায় তিন মাইল পথ পেরিয়ে আমাদের কাছে এসে হাজির হল। আমরা তখনই তাকে জাহাজে নিয়ে এলুম।

এই বদমাইশ কেম্যানরা প্রায়ই আমাদের জাহাজের কাছে আসত এবং জাহাজের গায়ে আঁচড়াআচড়ি করত। একদিন দড়িতে লোহার হুক লাগিয়ে আমরা একটা মস্ত কেম্যান ধরলুম। ধরা পড়ে সে কিন্তু জলের দিকে গেল না, উল্টে জাহাজের মই বেয়ে উপর দিকেই উঠতে লাগল! তখন আমরা ব্যস্ত হয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তার দফা একেবারে রফা করে দিলুম!

ও মুল্লুকে খোলা হাওয়ায় রাত্রে কি ঘুমিয়েও নিশ্চিন্ত হবার যো আছে? ওখানে রাত্রে পিশাচবাদুড়রা শিকার খোঁজে। তারা এমন চুপিসাড়ে এসে মানুষের গায়ে ক্ষুরধার দাঁত দিয়ে ছাদা করে রক্ত টেনে নেয় যে, মানুষের ঘুম প্রায়ই ভাঙে না। আর না ভাঙাই ভাল! কারণ রক্তপানের পর ওই পিশাচবাদুড়েরা লালা দিয়ে ক্ষতস্থানের মুখ বন্ধ করে দিয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ বাধা পেয়ে তারা যদি উড়ে যেতে বাধ্য হয়, তাহলে ক্ষতের রক্তপড়া আর সহজে বন্ধ হতে চায় না। পিশাচবাদুড়ের লালা কেবল রক্ত বন্ধ করে না, ক্ষতস্থান বিষিয়ে উঠতেও দেয় না।

এ দেশে বাঘ জাতীয় জন্তুদের মধ্যে জাগুয়ার আর পুমাই প্রধান। জাগুয়ার পুমার চেয়ে আকারে বড় হয় এবং তার প্রকৃতিও বেশি হিংস্র। তারা প্রায়ই মানুষকে আক্রমণ করতে ছাড়ে না। তাদের আক্ৰমণ আরও বিপজ্জনক এইজন্যে যে, তারা গাছের ডালে পাতার আড়ালে লুকিয়ে বসে থাকে এবং তাদের কখন যে কার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বার বিন্দকুটি শখ হবে, আগে থাকতে তা জানতে পারা যায় না।

পুমারাও গাছে চড়তে পারে। ব্ৰেজিলে তাদের ‘কাউগার’ বলে ডাকা হয়। উত্তর আমেরিকায় তাদের আর একটা নাম- ‘পেণ্টার’। ‘পুমা’ হচ্ছে পেরু দেশিয় নাম—যদিও ওই নামই বেশি চলে। তারা ল্যাজসুদ্ধ লম্বা হয় ছয় থেকে নয়ফুট পর্যস্ত।

পুমারা সবচেয়ে খেতে ভালবাসে ঘোড়ার মাংস। অভাবে গরু, মেষ, শূকর, হরিণ, ভেড়া, খরগোশ-এমনকি ইঁদুর ও শামুক পর্যন্ত! বানরও তাদের মনের মতো। বানররা এ গাছ থেকে ও গাছে লাফিয়েও পাের পায় না, কারণ গাছে গাছে লাফালাফি করতে বানরদের চেয়ে পুমারাও কম তৎপর নয়। মাটি থেকে বিশ ফুট উঁচুতে লাফিয়ে পুমারা গাছের ডালে চড়তে পারে! দীর্ঘ লম্ফে তারা প্ৰায় চল্লিশ ফুট জমি পার হয়ে যায়!

কিন্তু মানুষের পক্ষে পুমা মোটেই বিপজ্জনক নয়। কারণ তারা মানুষকে সহজেই কাত করে ফেলতে পারলেও সাধারণত মানুষকে তেড়ে আক্রমণ করে না। এমন কি, অনেক সময়ে মানুষ তাকে আক্রমণ করলেও সে আত্মরক্ষার চেষ্টা পর্যন্ত করে না! অথচ এই পুমা তার চেয়ে বড় ও হিংস্র জীব জাগুয়ারকেও আক্রমণ করে।

মধ্য আমেরিকার এক কাঠুরে একদিন জঙ্গলে গিয়েছিল। হঠাৎ একটা পুমা ল্যাজ তুলে বনের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল এবং আদুরে বিড়ালের মতো ঘড়র ঘড়র শব্দ করতে করতে সেই কাঠুরের পায়ের ফাঁক দিয়ে খেলাচ্ছলে আনাগোনা করতে লাগল! কিন্তু সেই পুমা বেচারার অদৃষ্ট ছিল নেহাৎ মন্দ। কারণ কাঠুরে এমন ভয় পেলে যে, তার কুডুলের বাড়ি পুমাকে দিলে এক ঘা বসিয়ে! পুমা তখন সেই বন্দরসিকের কাছ ছেড়ে পালাতে বাধ্যহয়।

হাডসন সাহেব বলেন, আমি একবার একটা পুমাকে বধ করে অত্যন্ত দুঃখিত হয়েছিলুম। তাকে ধরেছিলুম আমি গলায় ফাঁসকল লাগিয়ে। সে একটা পাথরে ঠেসান দিয়ে চুপ করে বসে রইল। আমি যখন ছোরা তুললুম। সে পালাবার চেষ্টা পর্যন্ত করলে না। তাকে দেখে মনে হল, আমি যে তাকে বধ করব সে যেন তা বুঝতে পেরেছে! সে কাঁপতে লাগল, তার দু'চোখে জল ঝরতে লাগল, সে করুণস্বরে আর্তনাদ করতে লাগল। তাকে বধ করার পর আমার মনে হল আমি যেন হত্যাকারী!

রেড ইন্ডিয়ানরা কিছুতেই পুমাকে মারতে চায় না। তাদের বিশ্বাস, পুমাকে বধ করলে সেই মুহূর্তেই মানুষের মৃত্যু হয়। রেড ইন্ডিয়ানরাই হচ্ছে আমেরিকার আদিম অধিবাসী। তারা পুমাকে মারে না বলেই বোধহয় পুমাও মানুষকে হিংসা করতে অভ্যস্ত হয়নি।

গরিলার মতো বড় জাতের বানর পৃথিবীতে আর নেই বলে শোনা যায়। কিন্তু হালে দক্ষিণ আমেরিকায় টাররা নদীর ধারে অদ্ভূত ও বৃহৎ এক অজানা জাতের বানরের সন্ধান পাওয়া গেছে।

একদল লোক নদীর ধার দিয়ে যাচ্ছিল, আচম্বিতে দুটো প্ৰকাণ্ড বানর জঙ্গল থেকে বেরিয়ে তাদের আক্রমণ করে। একটাকে তারা গুলি করে মেরে ফেললে এবং অন্যটা আবার জঙ্গলের আড়ালে পালিয়ে গেল। যেটা মারা পড়ল সেটা স্ত্রীজাতীয় বানর হলেও তার মাথার উচ্চতা পাঁচফুটেরও বেশি। এর থেকেই বোঝা যায়; এ জাতের নর-বানররা মাথায় আরও বেশি ঢাঙা। এই অদ্ভুত জীব অনেকটা গরিলার মতো দেখতে হলেও গরিলা নয় মোটেই। পণ্ডিতরা বলছেন, এরা মানুষ ও বানরের মাঝামাঝি জীব! এই নূতন আবিষ্কার জীবতত্ত্ববিদদের মধ্যে বিশেষ উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। পণ্ডিতরা বহুদিন ধরে মানুষ ও বানরের মাঝামাঝি জীবের সন্ধান করে আসছেন, হয়তো এরা তাদের চিন্তার খোরাক জোগাবে। এদের গায়ের জোর কত, আজও সে পরীক্ষার সুবিধা পাওয়া যায়নি, তবে শক্তিতে হয়তো এরাও গরিলার চেয়ে কম যায় না।

 

মহাবীর গভর্নর

 

এইবার কাপ্তেন মর্গ্যানের পালা শুরু করা যাক। প্রথম পরিচ্ছেদেই মর্গ্যানের মোটামুটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও ছবি দিয়েছি। এই চাষার ছেলে মর্গ্যান বোম্বেটের ব্যবসায় অবলম্বন করেও কেমন করে `স্যার’ পদবি পেয়ে লাটের গদিতে বসেছিল তারই বিচিত্র ইতিহাস বলব। এ সত্য ইতিহাস যে কোনও কাল্পনিক উপন্যাসেরও চেয়ে চিত্তাকর্ষক।

মর্গ্যানের আর একটা উপাধি হচ্ছে-“বোম্বেটের রাজা”! লোলোনেজের চেয়ে সে কম শক্তি পরিচয় তো দেয়নি বটেই, বরং সময়ে সময়ে তার কীর্তি লোলোনেজের যশগৌরবকেও স্নান করে দিয়েছে!

হেনরি মর্গ্যানের জন্ম ইংলণ্ডের ওয়েলস প্রদেশে। তার বাবা ছিলেন এক সাধু ও ধনী চাষী-নিজের সমাজে তিনি ছিলেন এক মাননীয় ব্যক্তি। কিন্তু ছেলেবয়স থেকেই বাপের কাজে মর্গ্যানের একটুও রুচি ছিল না। অতএব পিতার আশ্রয় ছেড়ে সে সাগরগামী জাহাজে একটা নিচু কাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

সেই কাজের মেয়াদ ফুরোবার পর মর্গ্যান এল জামাইকা দ্বীপে। এটি ছিল বোম্বোটদের আর একটি প্রিয় দ্বীপ। বেকার হয়ে বসে না থেকে মর্গ্যান বোম্বোটদের এক জাহাজে চাকুরি গ্ৰহণ করলে। সমুদ্রে তিন-চারবার বোম্বেটেধর্ম পালন করে সে এ বিষম ব্যবসায়ের যা কিছু শেখবার সব শিখে ফেললে—এমন ভাল ছাত্র বোম্বেটেরা খুব কমই পেয়েছে!

তারপর কয়েকজন সঙ্গীর সঙ্গে পরামর্শের পর মর্গ্যান স্থির করলে, তারাও সকলে মিলে রোজগারের পয়সা দিয়ে একখানা জাহাজ ক্রিয় করবে। রত্নাকর বহু রত্নের আকর—একখানা জাহাজ কিনলেই তা আহরণ করা ভারি সহজ।

জাহাজ কেনা হল। দলের ভিতরে মর্গ্যানই ছিল সকলের চেয়ে সাহসী,বিদ্বান ও বুদ্ধিমান। কাজেই দলের বাকি সবাই একবাক্যে তাকেই দলপতি বা কপ্তেন বলে মেনে নিলে। সেইদিন মর্গ্যানের ছেলেবেলাকার স্বপ্ন সফল হল।

লোলোনেজের পরিণাম দেখে। যেমন ধারণা হয় যে, কোনও একজন মহাবিচারক সর্বদা সজাগ হয়ে আছেন, মর্গ্যানের জীবনকাহিনী পড়লে তেমনই সন্দেহ হয় যে, মাঝে মাঝে সেই মহাবিচারকও হয়তো ঘুমিয়ে পড়েন!

প্রথমবারের সমুদ্রযাত্রাতেই নতুন কাপ্তেনের উপরে অদৃষ্ট সুপ্ৰসন্ন হল। সে একে একে অনেকগুলো জাহাজ দখল করে আবার জামাইকায় ফিরে এল। এবং এই অভাবিত সাফল্যে বোম্বোটেদের ভিতরে তার মানসন্ত্ৰম বেড়ে উঠল অত্যন্ত!

জামাইকা দ্বীপে ছিল এক বুড়ো বোম্বেটে, তার নাম ম্যানসভেল্ট। সে এই সময়ে খুব বড় এক নৌ-বাহিনী গঠন করে চারিদিকে লুটপাট করবার আয়োজনে ব্যস্ত ছিল। সে দেখলে, মর্গ্যান হচ্ছে একজন মস্ত কাজের লোক। অতএব তাকে সে নিজের ভাইস আডমিরালের পদে নির্বাচন করে নিলে। ভুল নির্বাচন হয়নি! এই হল মর্গ্যানের বোম্বেটে জীবনের দ্বিতীয় উন্নতি।

পনেরখানা জাহাজ ও পাঁচশ বোম্বেটে নিয়ে ম্যানসভেল্ট ও মর্গ্যান সমুদ্রে পাড়ি দিলে। তারা প্রথমেই স্পানিয়ার্ডদের দ্বারা অধিকৃত সেন্ট কাথারাইন দ্বীপে গিয়ে নামল। তারপর লড়াই করে স্পানিয়ার্ডদের কাছ থেকে সেই দ্বীপটাি কেড়ে নিলে।

কিন্তু তার অল্পদিন পরেই বুড়ো বোম্বেটে ম্যানসভেল্ট পৃথিবীর লীলাখেলা সাঙ্গ করে ভগবানের কাছে জবাবদিহি করতে চলে গেল।

তারপর কাপ্তেন মর্গ্যান নিজেই এক নৌ-বাহিনী গঠন করলে। বারখানা ছোট বড় জাহাজ ও সাতশ লোক নিয়ে আবার সে বেরিয়ে পড়ল। দুএকটা ছোটখাট শহর লুট করলে। কিন্তু লুটের মাল ভাগ করবার সময়ে বোম্বোটেদের মধ্যে এমন মন কষাকষি হল যে, কপ্তেন মর্গ্যানের কাছ ছেড়ে একদল লোক রাগ করে চলে গেল। তাদের সন্দেহ হয়েছিল, মর্গ্যান জুয়াচুরি করে অনেক টাকা সরিয়ে ফেলেছে। খুব সম্ভব, তাদের সে সন্দেহ মিথ্যা নয়। যারা দল ছাড়ল তারা সবাই ফরাসি। মর্গ্যানের সঙ্গে রইল কেবল ইংরেজ বোম্বেটেরা।

কিন্তু দল ছােট হয়ে গেল বলে মর্গ্যান একটুও দমল না। আরও কিছু লোক ও জাহাজ সংগ্রহ করে মর্গ্যান আর একদিকে আবার পাড়ি দিলে। কোথায় যাওয়া হবে সেকথা কারুর কাছে প্ৰকাশ করলে না। খালি বললে, আমি তোমাদের সর্দার, তোমাদের ভালমন্দের জন্যে আমিই দায়ী রইলুম। আমাকে বিশ্বাস করো, তাহলেই চটপট তোমরা ধনী হতে পারবে।

বোম্বেটেরা মর্গ্যানের কথায় বিশ্বাস করলে!

দিন কয় পরে তারা কোস্টারিকা দ্বীপে গিয়ে উপস্থিত হল।

তখন মর্গান বললে, আমরা পাের্ট বেলো শহর লুট করতে যাচ্ছি। এ কথা আমি আর কারুকে বলিনি, সুতরাং চরের মুখে খবর পেয়ে শত্রুরা সাবধান হবার সময়ও পায়নি।

দু’একজন প্রধান বোম্বেটে বললে, পোটো বেলো হচ্ছে মস্ত শহর, সেখানে অনেক সৈন্য আছে। আমাদের লোকসংখ্যা মোটে সাড়ে চারশ। কেমন করে আমরা অতবড় শহর দখল করব?

মৰ্গান বললে, আমাদের দল ছোট বটে, কিন্তু আমাদের জান খুব বড়। দল ছোট হলেই একতা আর লাভের সম্ভাবনা বেশি। কুছ পরোয়া নেই-এগিয়ে চলো!

অতঃপর পোর্টো বেলো নগরের একটু বর্ণনা দিতে হবে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে স্পেনিয় রাজ্যের মধ্যে পোর্টো বেলো তখন দুৰ্ভেদ্য নগর হিসাবে হাভানা ও কার্টেজেনার পরেই তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিল। বন্দরের পিছনেই নগরকে রক্ষা করবার জন্যে দুটি বড় বড় দুর্গ আছে। এই দুৰ্গ দুটির অজ্ঞাতসারে বন্দরের মধ্যে কোনও জাহাজ বা নৌকো প্রবেশ করতে পারে না। দুৰ্গ দুটিও এমন সুরক্ষিত যে, সকলে তাদের অজেয় বলে মনে করে। প্রথম দুর্গটির মধ্যে তিনশ সৈন্য থাকে। নগরের এখনকার জনসংখ্যা সাড়ে নয়হাজারের উপরে, তখন কম ছিল। মর্গান সরাসরি বন্দরে প্রবেশ না করে, সেখান থেকে ত্ৰিশ মাইল দূরে সমুদ্র কুলে চুপিসাড়ে জাহাজ লাগালে। তারপর স্থলে পদব্রজে ও নদীতে নৌকোয় চড়ে তারা প্রথম দুর্গটির কাছে এসে পড়ল। দুর্গের অধিবাসীদের বলে পাঠালে-হয় আত্মসমৰ্পণ কর, নয় মরবার জন্যে প্রস্তুত হও।

উত্তরে দুর্গের কামানগুলো ভৈরব হুঙ্কারে অগ্নিবৰ্ষণ করলে। কামানগর্জন শুনে দূর থেকে নগরের বাসিন্দারা সভয়ে বুঝতে পারলে যে, কাছেই কোনও মস্ত বিপদ এসে আবির্ভূত হয়েছে।

নিকটবর্তী অঞ্চলের স্পানিয়ার্ডরা বোম্বোটেদের বাধা দেবার যথাসাধ্য চেষ্টা করলে। কিন্তু কোনও ফল হল না, তারা হেরে গেল, অনেকে বন্দি হল। দুর্গের ভিতরের সৈন্যরাও শেষ পর্যন্ত দুর্গারক্ষা করতে পারলে না। কোনওরকম পূর্বাভাস না দিয়ে শত্রু এমন অতর্কিত শিয়রে এসে পড়েছিল যে, তার কবল থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভবপর হল না। মর্গ্যান দুৰ্গ দখল করলে। মৰ্গান হুকুম দিলে, প্রত্যেক বন্দীকে কেটে দু’খানা করে ফেল! শহরের লোেকরা তাহলে বুঝতে পারবে, আমরা বড় লক্ষ্মীছেলে। নই-আমাদের বাধা দিলে তাদেরও নিশ্চিত মরণ!--বন্দীদের মাথাগুলো উড়ে গেল।

দুর্গের ভিতরের সে সকল সৈন্য ও সৈন্যাধ্যক্ষরা ধরা পড়েছিল, তাদের একটা ঘরে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। এইবার বারুদখানায় আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল, দুৰ্গসুদ্ধ সমস্ত প্ৰাণী শূন্যে উড়ে পঞ্চভূতে মিশিয়ে গেল। কেবল দুর্গের অধ্যক্ষ প্ৰাণ নিয়ে নগরে প্রস্থান করতে পারলেন।

বোম্বেটেরা নগর আক্রমণ করতে চলল। সেখানকার বাসিন্দারা তখনও আত্মরক্ষার সময় পায়নি।--তারা আত্মরক্ষা করতে পারলেও না। পোর্টো বেলোর গভর্নর তাদের কোনওরকমে উত্তেজিত করতে না পেরে, বাকি যে দুর্গটা তখনও শক্ৰহস্তগত হয়নি, তার মধ্যে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলেন।

বোম্বেটেরা নগর দখল ও লুট করে অনেক পাদ্রীকে সপরিবারে বন্দি করলে। ওদিকে দুর্গ থেকে তাদের উপরে গোলাগুলি বৃষ্টি হচ্ছিল অজস্রধারে। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বোম্বেটেরাও দুর্গ আক্রমণ করলে। তাদের এ আক্রমণের আর এক উদ্দেশ্য, শহর থেকে অনেক নাগরিক বহু ধনসম্পত্তি নিয়ে কেল্লার ভিতরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল।

সারাদিন যুদ্ধ চলল—কোন পক্ষের জয় হবে তখনও তা অনিশ্চিত। অনেক বোম্বেটে মারা পড়ল—তবু তারা কেল্লার কাছ ঘেঁষতে পারলে না। তারা বোমা ছােড়বার সুযোগ পর্যন্ত পেলে না-কেল্লার পাঁচিলের কাছে গেলেই উপর থেকে হুড়মুড় করে ভারি ভারি পাথর ও জলন্ত বারুদ এসে পড়ে তাদের যমালয়ে পাঠিয়ে দেয়।

মগ্যান প্রায় হতাশ হয়ে পড়ে শেষ উপায় অবলম্বন করলে। সে আগে কেল্লার পঁচিলে ওঠবার জন্যে খুব উঁচু দশ-বারখানা মই তৈরি করালে। তারপর বন্দি পাস্ত্রী ও তাদের স্ত্রী-কন্যাদের বললে, সেই মইগুলো পাঁচিলের গায়ে লাগিয়ে দিয়ে আসতে।

গভর্নরকে জানানো হল, এখনও আত্মসমৰ্পণ কর।

গভর্নর বললেন, প্ৰাণ থাকতে নয়।

তখন মই নিয়ে যাবার হুকুম হল। মৰ্গান ভেবেছিল, সপরিবারে ধর্মযাজকেরা মই নিয়ে অগ্রসর হলে গভর্নর তাঁদের উপরে আর গুলিবৃষ্টি করতে পারবেন না।

বোম্বেটের দল পাদ্রীদের পিছনে পিছনে এগিয়ে পিস্তল উচিয়ে বললে, শীঘ্ৰ পাঁচিলে গিয়ে মই লাগাও। নইলে গুলি করে মেরে ফলব।

কেল্লার পাঁচিলের উপরেও গভর্নর সৈন্য সাজিয়ে রেখেছিলেন, তারাও বন্দুক তুললে। পাদ্রী ও তাদের পরিবারবর্গ করুণ চিৎকারে স্পানিয়ার্ডদের বললেন, আমরা তোমাদেরই ধর্মযাজক বাবা, আমাদের মেরো না।

কিন্তু মর্গ্যান এই বীর ও দৃঢ়প্ৰতিজ্ঞ গভর্নরকে ভুল বুঝেছিল-সৈনিকধর্মপালনের জন্যে তিনি আর সব ধর্মকে বর্জন করতে প্ৰস্তুত।

সপরিবারে ধর্মযাজকেরা কাঁধে মই নিয়ে অগ্রসর হলেন, সঙ্গে সঙ্গে কেল্লার উপর থেকে শিলাবৃষ্টির মতো গোলাগুলি এসে তাঁদের ভূতলশায়ী করতে লাগল। বাইরে থেকে শক্ৰইহােক আর মিত্ৰই হােক, কেল্লার ক্রিসীমানায় কারুকে আসতে দেওয়া হবে না-এই ছিল গভর্নরের প্ৰতিজ্ঞ।

পাদ্রী ও তাদের পরিবারবর্গের দেহ একে একে মাটির উপরে আছড়ে পড়তে লাগল। কিন্তু তবু তারা কোনওরকম পাঁচিলের গায়ে মই লাগিয়ে পালিয়ে এলেন। তখন বোম্বেটেরা বোমা ও বারুদের পাত্ৰ হাতে করে পাচিলের উপরে গিয়ে দাঁড়াল এবং কেল্লার ভিতরে সেইসব নিক্ষেপ করতে লাগল।

স্পানিয়ার্ডরা তখন বাধ্য হয়ে আত্মসমৰ্পণ করলে।

কিন্তু সেই বীর গভর্নর! কোনও আশা নেই, তবু তিনি আটল! তখনও নিজের সৈন্যদের ডেকে তিনি বলছেন, অস্ত্ৰ নাও, অস্ত্ৰ নাও! শত্ৰুবধ করো!

কেউ তাঁর কথায় কান পাতলে না, তারা বোম্বোেটদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে জীবনভিক্ষা করতে লাগল।

—তবে মর কাপুরুষ কুকুরের দল!—এই বলে তাঁর যেসব সৈন্য কাছাকাছি ছিল, মুক্ত তরবারি নিয়ে তিনি তাদের উপরে গিয়ে পড়লেন এবং নিজের হাতেই নিজের সৈন্যদের বধ করতে লাগলেন।

বোম্বোেটদের নীচহৃদয় পর্যন্ত এই অসাধারণ বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে গেল। তারা সসন্ত্রমে বললে, এখন আপনি আত্মসমৰ্পণ করবেন তো?

গভর্নর দৃঢ়হস্তে অসিধারণ করে সগর্বে মাথা তুলে বললেন, নিশ্চয়ই নয়! কাপুরুষের মতো তোদের হাতে আমি ফাঁসিতে মরব না—আমি মরতে চাই লড়াই করতে করতে বীর সৈনিকের মতো।—বলেই তিনি আবার তাদের আক্রমণ করলেন।

গভর্নরের সহধর্মিণী ও কন্যা কাঁদতে কাঁদতে কাকুতি-মিনতি করতে লাগলেন—ওগো তুমি অস্ত্ৰ ছাড়ো! আত্মহত্যা করে আমাদের পথে বসিও না।

কিন্তু সেই বীরের পাথর-প্ৰাণ কোনও অশ্রই নরম করতে পারলে না-সিংহের মতো একলাই তিনি অগুণতি শত্রুর সঙ্গে যুঝতে লাগলেন।

বোম্বেটেরা তাঁকে জীবন্ত অবস্থায় বন্দী করবার অনেক চেষ্টা করলে—কিন্তু পারলে না। শেষ পর্যন্ত শত্ৰু মারতে মারতে নিজের শেষ রক্তপাত করে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে অস্তিম নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। যে জাতির মধ্যে এমন বীরের জন্ম হয় সে জাতি ধন্য!

তারপর যা হবার তা হল। অত্যাচার, লুণ্ঠন, হত্যা। পোর্টো বেলোর যত ঐশ্বর্য দুর্গের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়েছিল, সমস্তই বোম্বেটেরা হস্তগত করলে। অত বড় বীর গভর্নরের হাত থেকে অমন অজেয় দুর্ভেদ্য দুর্গ এত কম সৈন্য নিয়ে মর্গ্যান যে কি করে কেড়ে নিলে, সকলেরই কাছে সেটা প্ৰহেলিকার মতো বোধ হল।

পানামা নগরের স্পানিয়ার্ড গভর্নর সবিস্ময়ে বোম্বেটেদের কাছে দূত পাঠিয়ে জানতে চাইলেন,—কোন আশ্চর্য হাতিহার দিয়ে তোমরা দুর্গের অত বড় বড় কামান ব্যর্থ করে দিয়েছ?

মর্গ্যান সহাস্যে দূতের হাতে একটা ছোট পিস্তল দিয়ে বলে পাঠালে, কেবল এই আশ্চর্য হাতিয়ার দিয়ে আমি কেল্লা ফতে করেছি! এই অস্ত্র আমি এক বৎসরের জন্যে আপনাকে দান করলুম। তারপর নিজেই পানামায় গিয়ে আমার অস্ত্র আবার আমি ফিরিয়ে আনব।

পানামার গভর্নর। তখনই সেই পিস্তল ফেরৎ পাঠিয়ে বললেন, এ অস্ত্রে আমার দরকার নেই। তোমাকে আর কষ্ট করে পানামায় আসতে হবে না। কারণ পোর্টো বেলোর মতো এত সহজে পানামা আত্মদান করবে না।

পোর্ট বেলো শহরে শরীরী মড়কের মতো এক পক্ষাকাল বাস করে চারিদিকে হাহাকার তুলে মর্গ্যান সদলবলে আবার জাহাজে এসে উঠল। বিপুল ঐশ্বৰ্য নিয়ে তারা কিউবা দ্বীপে ফিরে এল। বোম্বেটাদের সবাই বুঝলে, লোলোনেজের অভাব পূরণ করতে পারে এখন কেবল এই কাপ্তেন মর্গ্যান! তার তারকা আজ উদীয়মান!

 

অমানুষী অত্যাচার ও অগ্নিপোত

 

মর্গ্যান তারপর এল জামাইকা দ্বীপে-এখানকার গভর্নর হচ্ছেন তারই স্বজাতি, অর্থাৎ ইংরেজ।

মর্গ্যানের শক্তি ও খ্যাতি শুনে ফুলমধুলোভী ভ্ৰমরের মতো চারিদিক থেকে বোম্বেটের পর বোম্বেটে এসে তার দলে যোগ দিতে লাগল-তাদের বেশির ভাগই ইংরেজ। জামাইকার গভর্নর পর্যন্ত তাকে আর বোম্বেটের মতো অভ্যর্থনা করলেন না,-এমন কি তাকে একখানা মস্তবড় জাহাজও দান করলেন। এমন দান পেয়ে মর্গ্যানের আনন্দ আর ধরে না, কারণ এর উপরে ছিল ছত্ৰিশটা কামান! এতবড় জাহাজ কোনও বোম্বেটেরই ভাগ্যে জোটে না।

সেই সময়ে ওখানে এসে একখানা বড় ফরাসি জাহাজও নাঙ্গর করেছিল, তার উপরে ছিল চব্বিশটা ইস্পাতের ও বারটা পিতলের কামান। এ জাহাজখানাকে পেলে তার শক্তি অত্যন্ত বেড়ে উঠবে বলে মর্গ্যান ফরাসিদের কাপ্তেনকে নিজের দলে যোগ দেবার জন্যে আহ্বান করলে। কিন্তু ফরাসিরা রাজি হল না-ইংরেজ বোম্বোটেদের তারা বিশ্বাস করে না।

মৰ্গানের ভারি রাগ হল—ফরাসিদের সাজা দেবার জন্যে ছুতো খুঁজতে লাগল। ছুতো পাওয়া গেল।

কিছুদিন আগে সমুদ্রে খাদ্যাভাব হওয়ার দরুন ফরাসিরা একখানা ইংরেজ জাহাজ থেকে খাদ্য সংগ্রহ করেছিল এবং তখন জাহাজে টাকা ছিল না বলে ইংরেজদের সঙ্গে এই ব্যবস্থা করেছিল যে, জামাইকায় ফিরে এসে তারা খাবারের দাম কড়ায় গণ্ডায় চুকিয়ে দেবে।

ব্যাপারটা কিছু অন্যায় নয়। কিন্তু এই ছুতেই বিবেক বুদ্ধিহীন মর্গ্যানের পক্ষে যথেষ্ট হল। সে বাইরে কিছু না ভেঙে ফরাসি জাহাজের কাপ্তেন ও কয়েকজন পদস্থ কর্মচারীকে নিজের জাহাজে নিমন্ত্রণ করলে। তারা কোনওরকম সন্দেহ না করেই নিমন্ত্রণ রাখতে এল। তখন তাদের হাতে পেয়ে দুষ্ট মর্গ্যান বললে, ইংরেজদের কাছ থেকে তোমরা খাবার কেড়ে নিয়েছ। সেই অপরাধে তোমাদের বন্দি করলুম।—তারপর সে জামাইকার গভর্নরের দেওয়া বড় জাহাজখানায় বন্দীদের পাঠিয়ে দিলে।

আবার নতুন সমুদ্রযাত্রা করবার দিন স্থির হল। ইংরেজ বোম্বেটেরা আসন্ন লাভের আনন্দে জাহাজে জাহাজে উৎসবে মেতে উঠেছে। নাচ-গান-বাজনা চলছে-সবাই মদের নেশায় বেহুঁশ। আচম্বিতে একসঙ্গে যেন অনেকগুলো বাজ ডেকে উঠল এবং সমুদ্রের বুকে যেন দপ করে জ্বলে উঠল একসঙ্গে শত শত বিদ্যুৎ!..চারিদিকে সাড়া পড়ে গেল।

মর্গ্যানের সেই বড় সাধের বিরাট জাহাজ শূন্যে উড়ে গেল ভেঙে গুড়ো হয়ে। মাত্র ত্ৰিশজন লোক কোনওগতিকে রক্ষা পেলে এবং এক মুহূর্তেই মারা পড়ল তিনশ পঞ্চাশজন ইংরেজ।

বোম্বেটোদের মতে, বন্দি ফরাসি কাপ্তেন ও তাঁর সঙ্গীরাই নিজেদের মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও জাহাজের বারুদখানায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন।

মর্গ্যানের সেই বিশ্বাসঘাতকতার ফল তাকে হাতে হাতেই পেতে হল।

অতবড় জাহাজ ও এত লোক হারিয়ে মৰ্গান একেবারে ভেঙে পড়ল। কিন্তু সে বেশিক্ষণের জন্যে নয়। রাগে অজ্ঞান হয়ে বাকি বোম্বোেটদের নিয়ে আবার ফরাসিদের সেই বড় জাহাজখানা আক্রমণ ও অধিকার করলে।

তারপর তারা সমুদ্রের জলে নিজেদের দলের বোম্বোটেদের লাশ খুঁজতে লাগল -অন্তোষ্টিক্রিয়ার জন্যে নয়, লুণ্ঠন করবার জন্যে। যাদের আঙুলে আংটিছিল তাদের আংটিসুদ্ধ আঙুল কেটে নেওয়া হল, যাদের পকেটে টাকাকড়ি ছিল তাদের পকেট থেকে টাকাকড়ি চুরি করা হল। তারপর মৃতদেহগুলোকে সামুদ্রিক জীবদের মুখে সমৰ্পণ করে তারা অম্লানবদনে আবার জাহাজে উঠে অগাধ সাগরে পাড়ি দিল।

দলের সাড়ে তিনশ লোক মারা পড়ল, তবু মৰ্গানের নামের জোরে সঙ্গীর সংখ্যা হল যথেষ্ট! পনেরখানা জাহাজে প্রায় হাজারখানেক বোম্বেটে তার সঙ্গে চলল। দুরাত্মার পাপসঙ্গীর অভাব হয় না। সবচেয়ে বড় জাহাজে রইল মর্গ্যান নিজে-কিন্তু তাতে কামান ছিল মােটে চোদ্দটা, তাও ছোট ছোট।

এবারে মর্গ্যান কিছু মুশকিলে পড়ল। কারণ যাত্রারম্ভের সময়ে তার মাথায় অনেক বড় বড় ফন্দি ছিল; কিন্তু কিছুদিন পরে তার দলের প্রায় পাঁচশ লোকসুদ্ধ সাতখানা জাহাজ আকুল সাগরে কোথায় হারিয়ে গেল। মর্গ্যান কিছুকাল অপেক্ষা করেও তাদের দেখা পেলে না। কাজেই এখানে ওখানে ছোটখাট ডাকাতি করেই সে সময় কাটাতে লাগল।

মর্গ্যানের দলে এক ফরাসি কাপ্তেন আছে, সে আগে ছিল বিখ্যাত লোলোনেজের সঙ্গে। সে পরামর্শ দিলে, আপনিও মারাকেবো শহর লুট করবেন চলুন। আমি সেখানকার পথঘাট চিনি, আমাদের কোনও কষ্ট হবে না।—এ প্রস্তাবে মর্গ্যানের নারাজ হবার কারণ ছিল না। তারা মারাকেবোর সমুদ্রে এসে হাজির হল। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে যখন শহরের খুব কাছে এসে পড়ল, স্পানিয়ার্ডরা তখন তাদের দেখতে পেলে। লোলোনেজের নগর লুণ্ঠনের পর তারা এখন আর একটা নূতন কেল্লা তৈরী— সেইখানে বোম্বেটেদের সঙ্গে তাদের বিষম যুদ্ধ হল। কিন্তু এবারেও স্পানিয়ার্ডরা জিততে পারলে না, মারাকেবো শহরের হতভাগ্য বাসিন্দারা আবার নরকযন্ত্রণা ভোগ করলে। সেই একই বিয়োগান্ত নাটকের পুনরাভিনয়। সবিস্তারে আর বর্ণনা করবার দরকার নেই।

তারপর জিব্রালটার নগরের পালা। কিন্তু লোলোনেজ তাদের যে সর্বনাশ করে গিয়েছিল, জিব্রালটারের বাসিন্দারা এখনও তা ভুলতে পারেনি। কাজেই বোম্বোটেদের সাড়া পেয়ে তারা পঙ্গপালের মতো দলে দলে শহর ছেড়ে পলায়ন করতে লািগল—সমস্ত মূল্যবান জিনিস সঙ্গে নিয়ে।

বোম্বেটেরা শহরে ঢুকে দেখলে-সে এক নিঝুম পুরী। না আছে রসদ, না আছে। ধনরত্ন, না আছে জনমনুষ্য! চারিদিক সমাধির মতো খাঁ খাঁ করছে।

কেবল একটি লোক পালায়নি। তার পোষাক ময়লা, তালিমারা, ছেড়াখোড়া। বোম্বেটেরা জানত না যে, সে জন্মজড়ভরত-পাগল বললেও চলে।

তারা তাকে যত কথা শুধোয়, সে খালি বলে, আমি কিছু জানিনা, আমি কিছু জানি না।

বোম্বেটেরা তখন তাকে নিজেদের প্রথামত বিষম যন্ত্রণা দিতে শুরু করলে।

পাগলা বললে, ওগো, আর যাতনা দিওনা! আমার সঙ্গে চলো, আমি তোমাদের আমার সমস্ত ঐশ্বৰ্য দান করছি!

বোম্বেটেরা ভাবলে, এ লোকটা নিশ্চয়ই কোনও ধনী ব্যক্তি, কেবল তাদের চোখে ধুলো দেবার ফিকিরেই গরিবের সাজ পরেছে।

অতএব তারা তার সঙ্গে সঙ্গে চলল। পাগলা তাদের নিয়ে একখানা ভাঙা কুঁড়েঘরে গিয়ে বললে, দেখো, আমার কত ঐশ্বর্য!

ঘরের ভিতরে ছিল কেবল কতকগুলো মাটির বাসন ও গুটিতিনেক টাকা।

বোম্বেটেরা খাপ্পা হয়ে বললে, কী! আমাদের সঙ্গে ঠাট্টা? দেখ। তবে মজাটা।

পাগলা বললে, জানো আমি কে? আমার নাম হচ্ছে শ্ৰীযুক্ত সিবাস্টিয়ান স্যানসেজ, আমি হচ্ছি মারাকেবোর লাটসাহেবের ভাই।

বোম্বেটেরা তার কথা সত্য ভেবে নিয়ে অধিকতর লুব্ধ হয়ে তাকে আবার যন্ত্রণাদিতে লাগল। তাকে দড়িতে বেঁধে শূন্যে টেনে তুললে এবং তার গলায় ও দুই পায়ে বিষম ভারি ভরি বোঝা বুলিয়ে দিলে। তারপর সেই অভাগাকে পাপিষ্ঠরা জ্যান্ত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে মারলে।

বোম্বেটেরা তারপর সে দেশের বনে বনে চারিদিকে খুঁজে বেড়াতে লাগল এবং অনেক চেষ্টার পর একে একে প্রায় আড়াইশ স্পানিয়ার্ডকে গ্রেপ্তার করলে।

স্পানিয়ার্ডদের সঙ্গে ছিল এক কাফ্রি গোলাম। মৰ্গান তাকে হুকুম দিলে, ওরা কিছুতেই যখন টাকার কথা বলবে না, তখন ওদের দল খানিকটা হালকা করে দে!

কফ্রি গোলাম একে একে কয়েকজনকে হত্যা করলে-অন্যান্য বন্দীদের চোখের সামনেই। তারপর বোম্বোটেদের খুশি করবার জন্যে সেই দুষ্ট কফ্রি একজন বৃদ্ধ স্পানিয়ার্ডকে দেখিয়ে বললে, ওই লোকটা অনেক টাকার মালিক।

বুড়োর কপাল পুড়ল। বোম্বেটেরা টাকা চাইলে, বুড়ো বললে, এ পৃথিবীতে আমার যথাসর্বস্ব হচ্ছে চারশ টাকা।

বোম্বেটেরা বিশ্বাস করলে না। দড়ি দিয়ে বেঁধে তারা সেই বুড়োর দু’খানা হাতই মড়মড় করে ভেঙে দিলে। তারপর তার হাত ও পায়ের বুড়ো আঙুলে দড়ি বেঁধে তাকে শূন্যে টেনে তুললে। সেই অবস্থায় তারা লাঠি দিয়ে দড়ির উপরে এমন ঝাঁকানি মারতে লাগল যে, প্রত্যেক ঝাঁকানির সঙ্গেই বৃদ্ধের ক্ষীণ প্ৰাণ বেরিয়ে যাবার সম্ভাবনা হল। এই বর্বরচিত নিষ্ঠুরতাতেও খুশি না হয়ে বোম্বেটেরা বুড়োর পেটের উপরে সেই অবস্থাতেই আড়াই মণ বোঝা চাপিয়ে দিলে। এবং সেই সঙ্গে আগুন জ্বেলে হতভাগ্যের দাড়ি-গােঁফ, চুল ও মুখের চামড়া-সব পুড়িয়ে দিলে। তারপর তাকে নামিয়ে একটা থামে বেঁধে রাখা হল এবং চারদিন তাকে প্রায় অনাহারে রাখা হল বললেই চলে।

বুড়ো বেচারি খুব ছোট একটা সরাইখানা চালিয়ে কোনও রকমে দিন গুজরান করত। অনেক কষ্ট ও অনেক চেষ্টার পর কিছুটাকা ধার করে এনে বোম্বোটদের দিয়ে সে যাত্রা সে মুক্তি পেল বটে, কিন্তু তার দেহ এমন ভয়ানক ভাবে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল যে, খুব সম্ভব তাকে আর বেশিদিন এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে হয়নি।

এরাই হচ্ছে প্রেমের অবতার খ্রিস্টদেবের শিষ্য-যার ধর্মের বড় মন্ত্র হচ্ছে প্রেমের মন্ত্র। এবং এরাই ভারতবাসীদের ও আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের ঘৃণা করে বর্বর বলে। উপরন্তু এদের মতে এশিয়ার বাসিন্দারা নাকি নিষ্ঠুরতায় পৃথিবীতে অতুলনীয়। কিন্তু যেসব অকথ্য নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়ে ইংরেজ রাজের কাছ থেকে মর্গ্যান সম্মান, উপাধি ও উচ্চপদ লাভ করেছে, সেগুলোকে আমরা কি পরম করুণার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত বলে মাথায় তুলে রাখব? মৰ্গান ওখানে পূর্বকথিত ব্যাপারটিরও চেয়ে ভয়ানক এমন সব পৈশাচিক কাণ্ডের অনুষ্ঠান করেছিল, পাঠকরা সহ্য করতে পারবেন না বলে এখানে সেগুলোর কথা আর বললুম না। তাদের তুলনায় ঢের বেশি ভদ্র ও শান্ত দুটো দৃষ্টান্ত এখানে দিচ্ছি।

অনেক স্পানিয়ার্ডকে ধরে মর্গ্যান পায়ে ও হাতে পেরেক মেরে ক্রুশে বিদ্ধ করে রেখেছিল—সঙ্গে সঙ্গে তাদের হাতের ও পায়ের আঙুলগুলোর ফাঁকে জ্বলিয়ে দিয়েছিল তৈলাক্ত সলিতা। এবং আরও অনেককে ধরে বেঁধে অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে তাদের পাগুলোকে এমন কৌশলে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল যে, যাতে তারা ‘রোস্টের মতো ধীরে ধীরে সিদ্ধ হয়। এত জঘন্য অত্যাচার কেবল সামান্য টাকার জন্যেই—যে টাকা পরে বোম্বেটেরা মদ খেয়ে জুয়া খেলে দুদিনেই উড়িয়ে দেবে!

জিব্রালটার শহরে ঐশ্বৰ্যলাভের দিক থেকে কিছুই সুবিধা করে উঠতে না পেরে মর্গ্যান বুঝলে, এ যাত্ৰা কপাল তার ভাল নয়। কিন্তু সেই সময়েই খবর পাওয়া গেল, জিব্রালটারের গভর্নর অনেক ধনরত্ন ও শহরের স্ত্রীলোকদের নিয়ে নদীর মাঝখানে একটা দ্বীপে গিয়ে লুকিয়ে আছেন। মর্গ্যান অমনি নৌকো ভাসিয়ে সদলবলে তাদের ধরতে ছুটল।

খবর পেয়ে গভর্নর দ্বীপ থেকে পালিয়ে সকলকে নিয়ে একটা পাহাড়ের শিখরে উঠে বসে রইলেন। বোম্বেটেরাও নাছোড়বান্দা-তারাও পিছনে পিছনে ছুটল। তখন বর্ষাকাল। ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে। পাহাড়ে যাবার পথে নদীর জল ফুলে উঠেছে। স্রোতের তোড়ই বা কী! নদী সেদিন পৃথিবীকে অনেকগুলো বোম্বেটের পাপভার সইবার দায় থেকে নিস্কৃতি দিলে-স্রোতের টানে তারা একেবারে সটান পাতালে চলে গেল।

পাহাড়ের তলায় গিয়ে মর্গ্যানের সব আশা ফুরিয়ে গেল। খাড়া পাহাড়ের গা-পাঁচ সাত হাত উপরেও উঠবার উপায় নেই। একটিমাত্র সরু লিকলিকে পথ টঙে গিয়ে উঠেছে-সে পথে সার বেঁধে পাশাপাশি দুজন যেতে পারে না। টঙ থেকে যদি একজনমাত্ৰ স্পানিয়ার্ড গুলি চালায়, তাহলে একে একে শত শত বোম্বেটের দেহ হবে প্রপাতধারণীতলে। তার উপরে বৃষ্টির জলে বোম্বেটোদের সমস্ত বারুদ ভিজে জবজবে হয়ে গিয়েছে।

এই সময়ে যদি মাত্র পঞ্চাশজন স্পানিয়ার্ড বুক বেঁধে আক্রমণ করত, তাহলে সেই চারপাঁচশ বোম্বেটে মনুষ্যসমাজকে আর যন্ত্রণা দেবার সুযোগ পেত না। কিন্তু ঘা খেয়ে খেয়ে স্পানিয়ার্ডরা তখন নেতিয়ে পড়ে সব সাহস থেকেই বঞ্চিত হয়েছে। তারা আক্রমণ করবে কি, গাছের পাতাটি নড়লেও ‘ওই বোম্বেটে আসছে’ ভেবে আঁতকে পালিয়ে যায়।

কিন্তু মর্গ্যান তা বুঝতে পারেনি। সেই সরু পথে যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর ছায়া দেখে সে আর অগ্রসর হতে সাহস করলে না, সমস্ত লোকজন নিয়ে মনেপ্ৰাণে সেখান থেকে সরে পড়ল।

জিব্রালটোর নগরে ফিরে এসে পাঁচ হপ্তা ধরে নারকীয় কাণ্ড করবার পর বোম্বেটেরা বিষম এক দুঃসংবাদ পেলে। স্পানিয়ার্ডদের তিনখানা বড় বড় যুদ্ধজাহাজ মারাকেবো বন্দরে এসে হাজির হয়েছে। সবচেয়ে বড় জাহাজখানায় কামান আছে চল্লিশটা, তার চেয়ে কিছু ছোট জাহাজে ত্ৰিশটা, সব ছোট জাহাজে চব্বিশটা। মর্গ্যানের সবচেয়ে বড় জাহাজেও চোদটার বেশি কামান নেই।

বোম্বোটেদের ফেরবার পথ হচ্ছে মারাকেবো বন্দরের ভিতর দিয়েই। তাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল! আর বুঝি রক্ষা নেই-পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবার সময় এসেছে।

কিন্তু সত্যিকার নেতার আসল গুণ হচ্ছে, দারুণ বিপদেও হাল না ছাড়া। এ গুণ মৰ্গানেরও ছিল। সে বুক ফুলিয়ে বললে, কুছ পরোয়া নেই। আসুক ওরা,—আমরাও লড়াই করব।

স্পানিয়ার্ড নৌ-বাহিনীর অ্যাডমিরালের এক চিঠি এল, বোম্বেটে সর্দার মর্গ্যান, আমাদের মহারাজের রাজত্বে এসে তুমি যেসব ভীষণ উৎপাত করছ, তা আমি শুনেছি। অতঃপর তুমি যদি আমার কাছে বিনাবাক্যব্যয়ে আত্মসমর্পণ কর আর লুটের সমস্ত মাল ও বন্দীদের ফিরিয়ে দাও, তাহলে আমি স্বীকার করছি, তোমাদের সকলকেই ছেড়ে দেব। আর আমাদের কথা যদি না শোনো, তাহলে এও প্রতিজ্ঞা করছি যে, তোমাদের প্রত্যেককেই আমি বধ না করে ছাড়ব না!

বোম্বোেটদের পরামর্শসভা বসল। মর্গ্যানের কথার উত্তরে সকলেই একবাক্যে বললে, “র্দার, জান কবুল! এত বিপদ সয়ে আমরা যে লুটের মাল পেয়েছি আর তা ফিরিয়ে দেব না! যতক্ষণ আমাদের শেষ রক্তবিন্দু থাকবে ততক্ষণ আমরা আত্মসমৰ্পণ করব না!

তবু যদি ভালয় ভালয় এই বিপদ চুকে যায়, সেই আশায় মর্গ্যান অ্যাডমিরালের কাছে তিনটি প্রস্তাব করে পাঠালে প্রথমত, আমরা আর মারাকেবো শহরের কোনও অনিষ্ট করব না বা বাসিন্দাদের কাছ থেকে কোনও অর্থ দাবি করব না। দ্বিতীয়ত, বন্দীদের আমরা স্বাধীনতা দেব। তৃতীয়ত, কেবল জিব্রালটারের বাসিন্দারা আমাদের যে অর্থ দেবে বলে স্বীকার করেছে, তা না পাওয়া পৰ্যন্ত এখানকার চারজন প্রধান ব্যক্তি জমিনদার রূপে আমাদের সঙ্গে থাকবে। অ্যাডমিরাল জবাবে বলে পাঠালেন : তোমাদের আর দুদিন সময় দিলুম। এর মধ্যে যদি আত্মসমৰ্পণ না কর, তাহলে তোমাদের কারুকে আমি ক্ষমা করব না।

মর্গ্যান খাপ্পা হয়ে বললে, সাজো তবে সবাই রণসাজে! নিজের জোরে আমরা এই ফাঁদ ছিড়ে বেরিয়ে যাব। দেখি, আমাদের কে রুখতে পারে!

তখনই তারা সর্বাগ্রে একখানা অগ্নিপোত নির্মাণে নিযুক্ত হল। অগ্নিপোত কাকে বলে এদেশের অনেকেই বোধহয় তা জানেন না। সেকালে জলযুদ্ধে প্রায়ই এই অগ্নিপোত ব্যবহৃত হত। এই অগ্নিপোতের ভিতরে সহজে জ্বলে ওঠে এমন সব জিনিস ভাল করে ঠেসে দেওয়া হত। তার বাইরেটা হত সাধারণ জাহাজের মতোই—কাজেই শত্রুপক্ষ তাকে সন্দেহ করতে পারত না। তারপর সেই অগ্নিপোতখানার ভিতরে আগুন লাগিয়ে শত্রুদের নৌবাহিনীর মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হত। শত্রুদের জাহাজগুলোর কাছে সে যখন যেত, তার সর্বাঙ্গ অগ্নিময় এবং সেই আগুন শত্রুদের জাহাজও অগ্নিময় করে তুলত। আজকালিকার যুদ্ধযাহাজ হয়। শীঘ্রগামী ও লৌহময়, তাই অগ্নিপোতের ব্যবহার এখন উঠে গেছে।

বোম্বেটেরা সমস্ত ধনরত্ন নিয়ে বড় বড় নে্ৗকায় চড়ে বসল, অগ্নিপোতখানাকে সঙ্গে নিলে, তারপর মারাকেবো বন্দরের দিকে তারা অগ্রসর হল, অগ্নিপোতখানা যেতে লাগল আগে আগে।

তারা সন্ধ্যার সময়ে বন্দরে গিয়ে স্পানিয়ার্ড নৌ-বাহিনীকে দেখতে পেলে। এগুলো প্রকাণ্ড জাহাজই বটে এদের সঙ্গে সাধারণভাবে লড়াই করবার সাধ্য তাদের ছিল না।

দুই পক্ষই পরস্পরকে দেখতে পেয়ে পরস্পরের দিকে অগ্রসর হল।

বোম্বেটেদের অগ্নিপোত দেখে স্পানিয়ার্ডরা তার সাংঘাতিক স্বরূপ আন্দাজ করতে পারলে না। তারা ভাবলে, একখানা অতিসাহসী বোম্বেটে জাহাজ একলাই তাদের আক্রমণ করতে আসছে। অতিসাহসের মজাটা বুঝিয়ে দেবার জন্যে তারা বিপুল উৎসাহে তাকে আক্রমণ করবার জন্যে বেগে তেড়ে এল।

কিন্তু তার কাছে এসেই তাদের চক্ষুস্থির! এ যে অগ্নিপোত, এর ভিতরে যে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠেছে এবং সে আগুন হুহু করে বেড়ে উঠছে মুহূর্তে মুহূর্তে!

স্পানিয়ার্ডদের জাহাজ তিনখানা পালিয়ে বাঁচবার চেষ্টা করল—কিন্তু তখন পালাবারও সময় নেই। অগ্নিপোত একেবারে সবচেয়ে বড় শত্রুজাহাজের পাশে গিয়ে লাগল—তখন তার ভিতরকার অগ্নি ঠিক যেন অসংখ্য জুলন্ত রক্তদানবের মতো মহাশূন্যে বাহু তুলে তাথৈ তাথৈ তাণ্ডবনৃত্য করছে! মাঝে মাঝে তার গর্ভস্থ বারুদ বিস্ফোরণের ভৈরবধ্বনি,—কান কালা হয়ে যায়!

দেখতে দেখতে স্পানিয়ার্ডদের অতিকায় জাহাজখানাও অগ্নিপোতের মতোই অগ্নিময় হয়ে উঠল! এবং দেখতে দেখতে তার একাংশ আগুনে পুড়ে জীর্ণ হয়ে সমুদ্রগর্ভে অদৃশ্য হয়ে গেল! স্পানিয়ার্ডদের দ্বিতীয় জাহাজখানা ভয়ে আর সেখানে দাঁড়াল না, তাড়াতাড়ি বন্দরের নিরাপদ অংশে ঢুকে পড়ে একেবারে কেল্লার তলায় গিয়ে উপস্থিত হল। পাছে সেখানা বোম্বেটেদের হাতে গিয়ে পড়ে, সেই ভয়ে স্পানিয়ার্ডরা নিজেরাই তাকে জলেল ভিতর ডুবিয়ে দিলে।

বোম্বেটের তৃতীয় জাহাজখানাকে পালাতেও দিলে না। তারা চারিদিক থেকে প্রবল বেগে তাকে আক্রমণ করলে। এমন দুর্জয় নৌ-বাহিনীর এই কল্পনাতীত পরিণাম দেখে স্পানিয়ার্ডরা তখন ভয়ে ও বিস্ময়ে এত স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছে যে, বোম্বেটেদের সঙ্গে তারা মাথা ঠিক রেখে লড়তেও পারলে না। অল্পক্ষণ যুদ্ধের পরেই তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল।

কাপ্তেন মর্গ্যানের এই বিচিত্র ও অপূর্ব জয়কাহিনী যখন ইংলণ্ডে গিয়ে পৌছল, তখন সেখানেও তার নামে ধন্য ধন্য রব উঠল। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজে বোম্বেটেমহলে তার নাম হল যেন উপাস্য দেবতার নাম! কথায় বলে, ঢাল নেই—খাড়া নেই, নিধিরাম সর্দার! কিন্তু ঢালখাড়া না থাকলেও কেবল উপস্থিত বুদ্ধিবলে যে কি অসাধ্য সাধন করা যায়, নিধিরাম তা জানলে আজ তাকে ঠাট্টার পাত্র হতে হত না। কেবল বুদ্ধিবলেই কাপ্তেন মর্গ্যান আজ বিনা জাহাজে জলযুদ্ধ-বিজয়ী নাম কিনলে!