3
শয়তানি ফুর্তি
কিন্তু খবর পেয়েও কালোদেড়ে কিছুমাত্র দমল না বা ভীত হল না। নিজের দলের সবাইকে ডেকে অবহেলা ভরে বললে, ওহে, শুনেছ? টোরিয়াস চিঠি লিখে জানিয়েছে যে, রাজার সৈন্যরা নাকি আমাদের শাস্তি দিতে আসছে। জাহান্নমে যাক রাজা! যারা আসতে চায় আসুক তারা! আমি তো জাকিয়ে বসে আছি নিজের আড্ডায়—সিংহের গহ্বরে ঢুকে ফেরুপাল কী করতে পারে?
তখন সন্ধ্যাকাল। হ্যান্ডস ও আরও দুইজন বোম্বেটেকে নিয়ে কালোদেড়ে নিজের কামরার ভিতরে প্রবেশ করে খুব খুশিমুখে বললে, আবার লড়াই হবে—কী মজা রে, কী মজা! ঢালো মদ, প্রাণ ভরে পান করো—আজ আমাদের আনন্দের দিন! দেখা যাক, কে কত বেশি মদ খেতে পারে!
একটা টেবিলের চারিদিক ঘিরে বসে চারজনে মিলে মদ্যপান শুরু করে দিলে। বাতির আলোতে খালি কালোদেড়ের গলার হার ও আঙুলের আংটিগুলো নয়, মুখের দাড়ি-গোঁফের ঘন জঙ্গলের ভিতর থেকে তার খুদে খুদে চোখদুটো জুলজুল করে জুলছিল—এবং জহির করছিল যেন কোনও নির্দয় কৌতুকের রহস্যময় ইশারা!
শয়তানের কাছে গিয়ে শয়তানি ছাড়া আর কী আশা করা যায়? বোধ করি সেই কারণেই প্রচুর মদ্যপান করেও জনৈক চালাক বোম্বেটে নেশায় ঝিমিয়ে পড়েনি—নিজের দৃষ্টিকে রেখেছিল অত্যন্ত জাগ্রত!
হঠাৎ সে দেখলে, কালোদেড়ের দুটো পিস্তলসুদ্ধ দুখানা হাত ধীরে ধীরে টেবিলের তলায় গিয়ে ঢুকল। সে চটপট উঠে দাঁড়িয়ে একটা ওজর দেখিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল উদভ্ৰান্তের মতো।
অকস্মাৎ বিকট চিৎকার করে কালোদেড়ে এক ফুয়ে নিবিয়ে দিলে বাতিটা এবং অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে ছুঁড়লে তার পিস্তলদুটো! তারপরেই আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জন ও ভয়াবহ আর্তনাদ এবং একটা ভারী দেহপতনের শব্দ!
তাড়াতাড়ি আলো জেলে দেখা গেল, হ্যান্ডস দুই হাতে হাঁটু চেপে যন্ত্রণায় ছটফট করছে এবং তার আহত হাঁটু থেকে হু হু করে বেরুচ্ছে রক্তের ধারা!
একজন বোম্বেটে জিজ্ঞাসা করল, এর অর্থ কী?
হা হা করে হাসতে হাসতে কালোদেড়ে বললে, এর অর্থ হচ্ছে, মাঝে মাঝে এক-একজনকে শাস্তি না দিলে সবাই ভুলে যাবে যে, এ জাহাজের আসল কর্তা কে? তারপর সে হেট হয়ে পড়ে বললে, চলে এসো হ্যান্ডস, চলে এসো—তোমার বিশেষ কিছু হয়নি বাপু! হাঁটুর উপরে একটা ছোটো ছ্যাঁদা বই তো নয়, শহরে গিয়ে ডাক্তার দেখালেই দু-দিনে সেরে যাবে—কী বলো হ্যান্ডস?
কিন্তু হ্যান্ডস কিছুই বললে না, পরদিন সকালেই তাকে দোলায় তুলে শহরে পাঠিয়ে দেওয়া হল।
কালোদেড়ের প্রভাতি ভোজ
ওদিকে তরুণ নৌসেনাপতি লেফটেনান্ট মেনার্ড প্রস্তুত হচ্ছিলেন যুদ্ধের জন্যে।
বোম্বেটেদের জাহাজ তখন বাহির-সমুদ্রে ছিল না, একটা খাড়ির (স্থলভাগে প্রবিষ্ট সমুদ্রের অপ্রশস্ত অংশ) ভিতরে গিয়ে নোঙর ফেলে যুদ্ধের জন্যে অপেক্ষা করছিল।
মেনার্ড বুঝলেন, তার অধীনে ‘নইম’ ও পাল’ নামে যে দুখানা প্রকাণ্ড রণতরী আছে, গভীর সাগরের আনাগোনার উপযোগী করে তারা গঠিত। একে তো খাড়ির জলপথ সংকীর্ণ, উপরন্তু চড়া পড়েছে তার যেখানে-সেখানে—বড়ো জাহাজ ঢুকলেই চড়ায় আটকে অচল ও অকেজো হয়ে পড়বে। কালোদেড়ের চালাকি বুঝে নিয়ে রণকুশল মেনার্ড তার ফাঁদে ধরা পড়তে রাজি হলেন না। তিনি ‘স্নুপ’ বা এক-মাস্তুলের দুখানা অপেক্ষাকৃত ছোটো ও হালকা জাহাজ নির্বাচন করলেন—তারা অগভীর জলেও চলা-ফেরা করতে পারবে অনায়াসেই। তার উপরে তাদের আরও হালকা করবার জন্যে ভারী ভারী কামানগুলোও সরিয়ে ফেলা হল। পরিবর্তে আমদানি করা হল গাদি গাদি বন্দুক—বড়ো কামানের অভাব পূরণ করবে তাদের সংখ্যাধিক্যই।
খবর নিয়ে জানা গেল, বোম্বেটেদের দলে পঁচিশজনের বেশি লোক নেই, কারণ কালোদেড়ে অতিরিক্ত লাভের লোভে দল অতিশয় হালকা করে ফেলেছে। মেনার্ড সঙ্গে নিলেন প্রায় পঞ্চাশজন সৈন্য। পঞ্চাশজন বন্দুকধারীর সামনে দাঁড়ালে পঁচিশজনকে পড়তে হবে যার-পর-নাই বেকায়দায়— এই ছিল তার ধ্রুবধারণা।
অপরাহু কাল
খাঁড়ির বাঁকের মুখে আচম্বিতে দেখা গেল, দুখানা জাহাজের মাস্তুলের চূড়া।
বোম্বেটে-জাহাজের প্রহরী চেঁচিয়ে উঠে বললে, হুশিয়ার! দুখানা জাহাজ আসছে!
লাফ মেরে পাটাতনের উপরে উঠে কালোদেড়ে এক নজরে যা দেখবার সব দেখে নিয়ে বললে, হুঁ, রাজার অভিযান! কিন্তু আমার এখানে আসার মজাটা ওদের ভালো করেই টের পাইয়ে দেব! বাছারা ঘুঘু দেখেছে, ফাঁদ তো দেখেনি। সে তখনও জানত না তার ফাদ আছে মেনার্ডের নখদর্পণে!
রাজার জাহাজ কাছে এসে পড়ল। কালোদেড়ে হাঁকলে, কে তোমরা?
মেনার্ড উত্তরে ধীর স্বরে বললেন, টের পাবে অবিলম্বেই।
তিনি তীক্ষ্ণদৃষ্টি চালনা করে বুঝলেন যে, বোম্বেটেদের জাহাজখানা আকারে তাদের চেয়ে বিশেষ বড়ো না হলেও ওর মধ্যে নিশ্চয়ই গাদাগাদি করা আছে কামানের পর কামান। ওখানাও এমন হালকা ভাবে তৈরি যে এই বিপদসংকুল অগভীর জলেও অনায়াসেই আনাগোনা করতে পারে।
ভ্রু কুঞ্চিত করলেন মেনার্ড। ওদের পোতপার্শ্বের কামানগুলোর দারুণ অগ্নিবৃষ্টিতে মুষড়ে পড়লে চলবে না, তাঁকে একেবারে বোম্বেটে-জাহাজের পাশাপাশি গিয়ে পড়ে মুষলধারে গুলিবৃষ্টি করে প্রথমেই শত্রুদের রীতিমতো অভিভূত করে ফেলতে হবে। সৈন্য ও বন্দুকের সংখ্যাধিক্যের উপরেই তাঁর প্রধান ভরসা।
কিন্তু জলে এখন ভাটার টান, সময়টা এখানকার যুদ্ধের পক্ষে উপযোগী নয়। জোয়ারের জন্যে কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে—এই স্থির করে মেনার্ড আজকের মতো নোঙর ফেলবার হুকুম দিলেন।
সেদিন রাতে বারে বারে মাতাল কালোদেড়ে পাটাতনের উপরে ছুটে এসেছিল এবং ভয়ানক গলাবাজি করে জানিয়েছিল--"ওরে রাজার চাকরগুলো, কাল প্রভাতি খানার সময় তোদের সকলকেই হতে হবে আমার শকের জলখাবার।
মেনার্ড একবার খেপে গিয়ে উত্তরে বলেছিলেন, ওরে শুয়োর, শোন! তোর ওই নোংরা উকুনভরা কালো দাড়িতে পেরেক মেরে তোকে আমার জাহাজের গায়ে লটকে দেব-এই আমার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা!
রাজার জাহাজে নোঙর ফেলা হচ্ছে দেখে কালোদেড়ে আন্দাজে বুঝে নিলে যে, আপাতত বোম্বেটেরা নিরাপদ, কারণ সুচতুর শক্রর ভাটার সময়ে অগভীর জলে জাহাজ চালিয়ে বিপদে পড়তে চায় না। সকালে জোয়ার আসার সঙ্গে সঙ্গেই শত্রুপক্ষের আক্রমণ শুরু হবে।
সে একজন বোম্বেটেকে কাছে ডেকে এনে, একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে তার চোখের কাছে নাড়তে নাড়তে ফিস-ফিস করে বললে, ওরে মুখ্যু, ভালো করে শুনে রাখ! যদি দেখিস আমরা হেরে যাচ্ছি আর রাজার সেপাইরা আমাদের জাহাজের উপরে উঠে পড়েছে, তখনই দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে আমাদের বারুদখানায় আগুন লাগিয়ে দিবি! তারপর কী মজা হবে জানিস তো? দড়াম করে এক দুনিয়া-কাঁপানো ধুন্ধুমারের সঙ্গে সঙ্গেই আমরা সবাই মিলে সরাসরি গিয়ে নরক গুলজার করে তুলব। কী রে, পারবি তো?
এই ভয়ানক প্রস্তাব শুনে বোম্বেটে-বাবাজির আত্মা শুকিয়ে যাবার উপক্ৰম! মুখরক্ষা করবার জন্যে তবু সে কোনওরকমে মাথা নেড়ে সায় দিলে।
কালোদেড়ে বললে, যা তবে! বারুদখানায় গিয়ে প্রস্তুত হয়ে থাক! কাল এসপার কি ওসপার!
বোম্বেটে দুরু-দুরু বুকে কাঁপতে কাঁপতে প্রস্থান করল।
চাঁদ উঠল। জ্যোৎস্না ফুটল। মদে শুকনো গলা ভিজিয়ে নেবার জন্যে কালোদেড়ে নিজের কামরার দিকে ছুটল এবং যেতে যেতে আর-একবার গর্জিত কণ্ঠে জানিয়ে দিয়ে গেল যে—ওরে রাজার দাসানুদাসের দল! শুনে রাখ তোরা রাত পোয়ালেই আমি তোদের হাড় খাব, মাস খাব আর চামড়া নিয়ে ডুগডুগি বাজাব—হা হা হা হা হা হা!
যুদ্ধজাহাজের দুর্দশা
উষার সিঁদুরমাখা আকাশ ঢেকে রাখতে পারলে না পাতলা কুয়াশার পর্দা। খাঁড়ির বুকে এসেছে জোর জোয়ার। জলে জেগেছে কলকল করে কলহাস্য।
রাজার জাহাজ-জোড়া এগিয়ে আসছে ধীরে, ধীরে, ধীরে।
মেনার্ড নিজের লোকজনদের ভরসা দিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলছিলেন, কোনও ভয় নেই—আগে চল, আগে চল ভাই! বোম্বেটেরা বড়ো জোরে একবার কি দুইবার কামান ছোড়বার ফুরসত পাবে, তার পরেই আমরা ছুটে গিয়ে গুড়মুড় করে তাদের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ব, দেখব তখন পঁচিশটা বন্দুক কেমন করে সামলায় পঞ্চাশটা বন্দুকের ঠেলা! আগে চল!
এতক্ষণ পরে কালোদেড়ের মন দোলায়মান হল সন্দেহদোলায়। কুয়াশার ফিনফিনে পর্দা ফুঁড়ে দেখা যাচ্ছে, রাজার জাহাজ দুখানা এগিয়ে আসছে।--ক্রমেই এগিয়ে আসছে তার দিকে। ঘনায়মান বিপদ! একেবারে শেষ-মুহুর্তেই সে আন্দাজ করতে পারলে, শত্রুরা দলে তার চেয়ে দুগুণ বেশি ভারী! সে স্থির করলে, জাহাজ নিয়ে খাড়ির ভিতরে আরও দুর্গম অংশে গিয়ে আশ্রয় নেবে। সে চেচিয়ে হুকুম দিলে—নোঙর তোলো, নোঙর তোলো!
কিন্তু সময় নেই—সময় নেই! শক্র যে শিয়রে! পালাবার পথ যে বন্ধ!
কালোদেড়েকামান দেগে পথের বাধা দূর করতে চাইলে—হ্যাঁ, এই হচ্ছে বাঁচবার একমাত্র উপায়।
প্রচণ্ড চিৎকারে শোনা গেল তার চরম আদেশ—কামান ছোড়ো, একসঙ্গে সব কামান ছোড়ো। আগুনের ঝড়ে উড়িয়ে দাও সামনের সব প্রতিবন্ধক!
কর্ণভেদী বজ্রনাদ ধ্বনিত করে সোঁ সোঁ শব্দে বাতাস কেটে তীব্র বেগে ছুটে গেল সেই সর্বনাশা অগ্নিপিণ্ডগুলো—কিন্তু হায় রে হয়, তারা রাজার জাহাজকে স্পর্শ করবার আগেই জলের ভিতরে ঝুপ ঝুপ করে পড়ে তলিয়ে গেল!
মেনার্ড বিপুল পুলকে বলে উঠলেন, গোলাগুলো গিয়েছে জলের জঠরে—আমরা অক্ষত। এইবারে গর্জন করুক আমাদের বন্দুকগুলো—তারা কেউ ব্যর্থ হবে না?
গুড়ুম, গুড়ুম, গুম! গুডুম, গুড়ম, গুম!
রাগে পাগলের মতো হয়ে কালোদেড়ে দেখলে, তার দুজন গোলন্দাজ হাত-পা ছড়িয়ে মৃত্যু-ঘুমে এলিয়ে পড়ল এবং তার জাহাজখানাও চড়ায় আটকে অচল হল! কন্ঠে তার ফুটতে লাগল প্যাঁচার মতো কর্কশ চিৎকার।
আবার গুডুম, গুড়ম, গুম! ওরে বাবা, গুলির ঝাঁক বনবনিয়ে ছুটছে কানের পাশ দিয়ে। কালোদেড়ে প্রাণ বাঁচাবার জন্যে তাড়াতাড়ি হুমড়ি খেয়ে বসে পড়ল!
কিন্তু এ কী দৈব-বিড়ম্বনা! হঠাৎ স্রোতের টানে পড়ে রাজার জাহাজ দুখানার মুখ গেল ঘুরে এবং কালোদেড়েও ছাড়লে না এই দুর্লভ সুযোগ।
তৎক্ষণাৎ লাফ মেরে দাঁড়িয়ে বজ্র-কষ্ঠে সে গজে উঠল—আবার কামান ছোড়ো, আবার কামান ছোড়ো!
আবার জাগল কামানগুলোর ভৈরব হুংকার! এবারে তারা ব্যর্থ হল না এবং তাদের সঙ্গে যোগ দিতে ছাড়লে না বোম্বেটেদের বন্দুকও!
তারপর মনে হল সেখানে সৃষ্ট হয়েছে অভাবিত এক শব্দময় মহানরক! ফটাফট ফেটে গেল রাজার জাহাজ দুখানার নানা জায়গা, হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল তাদের মাস্তুল, মৃত্যুন্মুখ যোদ্ধাদের চিৎকার ছুটে গেল দিকে দিকে! নৌসেনাদের উনত্রিশজনের মৃতদেহ পড়ে রইল পাটাতনের যেখানেসেখানে।
বিকট উল্লাসে চেঁচিয়ে কালোদেড়ে বলে উঠল, এবার ওদের পেয়েছি হাতের মুঠোর মধ্যে। আবার ছোড়ো কামান-বন্দুক! ডুবিয়ে দাও জাহাজ দুখানা মড়াগুলোর সঙ্গে জীবন্তরা মেটাক মাছেদের ক্ষুধা!
লেফটেনান্ট মেনার্ড দিকে দিকে ছুটোছুটি করে নিজের দলের হতভম্ব লোকদের উৎসাহিত করতে লাগলেন। এবং ইতিমধ্যে দুইপক্ষের জাহাজ পরস্পরের খুব কাছে এসে পড়ল।
মেনার্ড ভাবলেন একবার যদি সদলবলে ওদের জাহাজে লাফিয়ে উঠতে পারেন তাহলে আর কোনও ভাবনাই থাকে না! কিন্তু তৎক্ষণাৎ তিনি বুঝে ফেললেন, ব্যাপারটা অত সহজ নয়!
দুই পক্ষের মধ্যে ব্যবধান ক্রমেই কমে আসছে দেখে কালোদেড়ে নতুন হুকুম জারি করলে—নিয়ে এসো হাত-বোমা! সবাই হাত-বোমা ছোড়ো!
নতুন বিপদের সম্ভানা দেখে মেনার্ড নিজেদের সৈন্যদের ডেকে বললেন, তাড়াতাড়ি পাটাতনের তলায় গিয়ে গাঢাকা দাও!
দুই পক্ষের জাহাজে জাহাজে লেগে গেল বিষম ঠোকাঠুকি—শোনা যেতে লাগল মড়মড়িয়ে কাঠভাঙার শব্দ!
দুম, দুম, দুম! বোমার পর বোমা ফাটার বেজায় আওয়াজ, ধুমধড়াক্কা! রাজার জাহাজ দুখানার পাটাতন ভগ্ন-চুর্ণ, ধূমায়িত, অগ্লুৎপাতে ভয়াবহ চোখের সামনে যেন মারাত্মক আতশবাজির খেলা দেখতে দেখতে বিকট উল্লাসে কালোদেড়ে অট্টহাস্য করতে লাগল।
কালোদেড়ে কালগ্রাসে
কালোদেড়ের রোমশ, মদমত্ত ও অমানুষিক দেহ তরবারি ঘোরাতে ঘোরাতে মেনার্ডের ‘রেঞ্জার' নামক জাহাজের উপরে লাফিয়ে পড়ল এবং তার পিছনে পিছনে অনুসরণ করলে অন্যান্য বোম্বেটেরাও!
হুহুংকারে শোনা গেল তার হিংস্র কষ্ঠে—সিংহার! সংহার! হা রে রে রে! শুরু হোক প্রলয়কাণ্ড!
আচম্বিতে পাটাতনের দরজা ঠেলে কৃপাণ তুলে মেনার্ড ও তার সৈন্যদের আবির্ভাব! ব্যাপারটা এতটা অভাবিত যে বোম্বেটেরা বিস্ময়ে স্তম্ভিত! কিন্তু পলকের মধ্যে নিজেদের হতভম্ব ভাব সামলে নিয়ে তারা সবেগে আক্রমণ করলে—লেগে গেল হাতাহাতি লড়াই! খড়ো খড়েগ হত্যা-ঝঞ্ছনা! আগ্নেয়াস্ত্রের ধ্রুম-ধ্রাম! যোদ্ধাদের গর্বিত বাক্যাড়ম্বর!
তারপরেই অন্য জাহাজ থেকেও মেনার্ডের আরও সৈন্য এসে যুদ্ধে যোগদান করে বোম্বেটেদের অবস্থা করে তুললে শোচনীয়। জাহাজের নীচে জলস্রোত, জাহাজের উপরে রক্তস্রোত!
কালোদেড়ে তখনও ভয় পেলে না—তার একহাতে তরবারি, আর-একহাতে পিস্তল! মৃতদের পায়ে মাড়িয়ে এবং জীবিতদের ঠেলে সে যেন প্রলয়ংকর মূর্তি ধারণ করে একেবারে মেনার্ডের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে সিংহগর্জনে বলে উঠল, আরে রে ঘৃণ্য জীব! নরকে যাবার সময় তোকেও আমি ছেড়ে যাব না বৃহৎ তার রক্তস্নাত কৃপাণ, তাকে ঠেকাতে গিয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল মেনার্ডের তরবারি! আর রক্ষা নেই! উন্মত্তের মতো অট্টহাসি হেসে ও দীপ্ত নেত্ৰে অগ্নিবর্ষণ করে কালোদেড়ের ভীমবাহু আবার তুললে তার সাংঘাতিক অস্ত্ৰ—কিন্তু পরমুহুর্তে একজন নৌসৈন্য ছুটে এসে বন্দুকের কুঁদে দিয়ে তার মাথার উপরে করলে প্রচণ্ড আঘাত!
পাটাতনের উপরে ধড়াম করে আছড়ে পড়ল বোম্বেটে সর্দার। মুহুর্তের মধ্যে চারিদিক থেকে তাকে ছেঁকে ধরলে নৌসৈন্যের দল এবং তরবারি, ছোরা ও বন্দুকের কুদো দিয়ে সবাই অশ্রান্ত ও নিষ্ঠুর ভাবে বিরাট দেহের উপরে করতে লাগল প্রবল আঘাতের পর আঘাত!
কিন্তু কী অসাধারণ তার সহ্যক্ষমতা ও প্রতিহিংসা-প্রবৃত্তি, সেইসব মারাত্মক আঘাতের পরেও সে কাবু হতে চাইলে না, উলটে দুই হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে বসল এবং তার শেষ পিস্তল তুলে লক্ষ্য স্থির করলে মেনার্ডের দিকে। ওই পর্যন্ত! তার জীবনীশক্তি তখন একেবারে ফুরিয়ে এসেছে, পিস্তল ছোড়বার আগেই সে আবার ধপাস করে পড়ে গেল এবং তার সর্বাঙ্গে জাগল অন্তিম শিহরন সুদীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে সে প্রাণত্যাগ করলে।
তার কালো দাড়ি তখন রক্তরাঙা, সর্বাঙ্গও রক্তভীষণ। গুনে দেখা গেল, তার দেহের পঁচিশ জায়গায় রয়েছে পঁচিশটা প্রাণনাশক আঘাতের চিহ্ন!
যুবক যোদ্ধা মেনার্ড নিহত বোম্বেটে-সর্দারের প্রকাণ্ড মূর্তির দিকে তাকিয়ে রইলেন বিস্ময়প্রশংসাপূর্ণ নেত্রে। তাকে অভিভূত করে ফেলেছে তার বন্য সাহস!
কিন্তু অভিভূত হলেও মেনার্ড নিজের প্রতিজ্ঞা ভুললেন না। একজন সৈনিককে ডেকে বললেন, বোম্বেটে-সর্দারের মুণ্ডটা কেটে জাহাজের গায়ে ঝুলিয়ে দাও।
বলা বাহুল্য, সর্দারের পতনের পর হতাশ হয়ে আত্মসমপণ করেছিল বাকি বোম্বেটেরাও। এই ভয়ঙ্কর বোম্বেটে দলকে দমন করে লেফটেনান্ট মেনার্ড ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।