প্রথম খণ্ড - চতুর্থ পরিচ্ছেদ
বিদায়
যে দিন রামহরির সহিত কথাবার্তা হইল, সেইদিন রাত্রিতে মা খেতুর গায়ে স্নেহের সহিত হাত রাখিয়া বলিলেন, “খেতু, বাবা, তোমাকে একটি কথা বলি”।
খেতু জিজ্ঞাসা করিল, “কি মা?”
মা উত্তর করিলেন, “বাছা, তোমার রামহরি দাদার সহিত তোমাকে কলিকাতায় যাইতে হইবে।”খেতু জিজ্ঞাসা করিল, “সে কোথায় মা?”
মা বলিলেন, “তোমার মনে পড়ে না? সেই যে-যেখানে গাড়ী-ঘোড়া আছে”।
খেতু বলিল, “সেইখানে? তুমি সঙ্গে যাইবে তো মা?”
মা উত্তর করিলেন, “না বাছা, আমি যাইব না, আমি এইখানেই থাকিব।”
খেতু বলিল, “তবে মা আমিও যাইব না।”
মা বলিলেন, “না গেলে বাছা চলিবে না। আমি মেয়েমানুষ, আমাকে যাইতে নাই। রামহরি দাদার সঙ্গে যাইবে, তাহাতে আর ভয় কি?”খেতু বলিল, “ভয়। ভয় মা আমি কিছুই করি না। তবে তোমার জন্য আমার মন কেমন করিবে। তাই মা বলিতেছি যে, যাইব না।”
মা বলিলেন, “খেতু সাধ করিয়া কি তোমাকে আমি কোথাও পাঠাই?। কি করি বাছা, না পাঠাইলে নয়, তাই পাঠাইতে চাই। তুমি এখন বড় হইয়াছ, এইবার তোমাকে স্কুলে পড়িতে হইবে। না পড়িলে শুনিলে মূর্খ হয়। মূর্খকে কেহ ভালবাসে না, কেহ আদর করে না। তুমি যদি স্কুলে যাও আর মন দিয়া লেখাপড়া কর, তাহা হইলে সকলেই তোমাকে ভালবাসিবে। আর খেতু, তোমার এই দুঃখিনী মার দুঃখ ঘুচিবে। এই দেখ, আমি আর সরু পইতা কাটিতে পারি না, চক্ষে দেখিতে পাই না। আর কিছু দিন পরে হয়তো মোটা পইতাও কাটিতে পারিব না। তখন বল, পয়সা কোথায় পাইব? লেখাপড়া শিখিয়া তুমি টাকা আনিতে পারিলে, আমাকে আর পইতা কাটিতে হইবে না।”খেতু বলিল, “মা, আমি যদি যাই, তুমি কাঁদিবে না?”
মা উত্তর করিলেন “না বাছা, কাঁদিব না।”
খেতু বলিল, “ওই যে মা কাঁদিতেছ।”
মা উত্তর করিলেন, “এখন কান্না পাইতেছে, ইহার পর আর কাঁদিবনা”।
সেইদিন আহারাদির পর, খেতুর ছেঁড়া-খোঁড়া কাপড়গুলি মা সেলাই করিতে বসিলেন।খেতু বলিল, “মা। আমি ছেঁড়ার দুই ধার এক করিয়া ধরি, তুমি ওদিক্ হইতে সেলাই কর, তাহা হইলে শীঘ্র শীঘ্র হইবে।”
এইরূপে মাতা-পুত্রে কথা কহিতে কহিতে কাপড় সেলাই হইতে লাগিল। তাহার পর মা সেইগুলিকে,ক্ষারে কাচিয়া পরিষ্কার করিয়া লইলেন। খেতু কলিকাতায় যাইবে, তাহার আয়োজন এইরূপে হইতে লাগিল।
বৈকাল বেলা খেতু নিরঞ্জনের বাটি গেল। নিরঞ্জন ও নিরঞ্জনের স্ত্রীকে প্রণাম করিয়া পায়ের ধুলা লইয়া কলিকাতায় যাইবার কথা তাঁহাদিগকে বলিল। রামহরির নিকট নিরঞ্জন পূর্বেই সমস্ত কথা শুনিয়াছিলেন। এক্ষণে খেতুকে আশীর্বাদ করিয়া, নানারূপ উপদেশ দিয়া নিরঞ্জন বলিলেন, “খেতু, সর্বদা সত্য কথা বলিবে, মিথ্যা কখনও বলিও না। নীচতা ও নিষ্ঠুরতা পরিত্যাগ করিবে। যথাসাধ্য পরোপকার করিবে। ইহাই ধর্ম।”এইরূপে খেতু নিরঞ্জন কাকার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিল। মঙ্গলবার রাত্রিতে মাতা-পুত্রের নিদ্রা হইল না। দুই জনে কেবল কথা কহিতে লাগিলেন, কথা আর ফুরায় না।
কতবার মা বলিলেন, “খেতু ঘুমাও, না ঘুমাইলে অসুখ করিবে।”
খেতু বলিল, “না মা, আজ রাত্রিতে ঘুম হইবে না। আর মা, কাল রাত্রিতে তো আর তোমার সঙ্গে কথা কহিতে পাইব না। কাল কতদূর চলিয়া যাইব। সে কথা যখন মা মনে করি, তখন আমার কান্না পায়।”প্রাতঃকালে রামহরি আসিলেন। খেতুর মা খেতুর কপালে দধির ফোঁটা করিয়া দিলেন, চাদরের খুঁটে বিল্বপত্র বাঁধিয়া দিলেন। নীরবে নিঃশব্দে রামহরির হাতের উপর খেতুর হাতটি দিলেন। চক্ষু ফাটিয়া জল আসিতে-ছিল, অনেক কষ্টে তাহা নিবারণ করিলেন।
অবশেষে ধীরে ধীরে কেবল এই কথাটি বলিলেন, “দু:খিনীর ধন তোমাকে দিলাম।”
রামহরি বলিলেন, “খেতু, মাকে নমষ্কার কর।”
খেতু প্রণাম করিল, রামহরি নিজেও প্রণাম করিয়া দুইজনে বিদায় হইলেন।যতক্ষণ দেখা গেল, ততক্ষণ খেতুর মা অনিমেষ নয়নে সেই পথপানে চাহিয়া রহিলেন। খেতুও মাঝে মাঝে পশ্চাৎ দিকে চাহিয়া মাকে দেখিতে লাগিল। যখন আর দেখা গেল না, তখন খেতুর মা পথের ধূলায় শুইয়া, পড়িলেন।
পথে পড়িয়া খেতুর মা কাঁদিতেছেন, এমন সময় তনু রায়ের স্ত্রী সেইখানে আসিলেন।
তাঁহার হাত ধরিয়া তুলিয়া ধীরে ধীরে তিনি বলিলেন, “দিদি, চুপ কর। চক্ষের জল ফেলিতে নাই, চক্ষের জল ফেলিলে ছেলের অমঙ্গল হয়।”খেতুর মা উত্তর করিলেন, “সব জানি বোন। কিন্তু কি করি? চক্ষের জল যে রাখিতে পারি না, আপনা-আপনি বাহির হইয়া পড়ে। আমি যে আজ পৃথিবী শূণ্য দেখিতেছি। কি করিয়া ঘরে যাই?”
তনু রায়ের স্ত্রী বলিলেন, “চল দিদি, ঘরে চল। সেইখানে বসিয়া চল খেতুর গল্প করি। আহা, খেতু কি গুণের ছেলে। দেশে এমন ছেলে নাই।” এই বলিয়া তনু রায়ের স্ত্রী খেতুর মার হাত ধরিয়া ঘরে লইয়া গেলেন। সেখানে অনেকক্ষণ ধরিয়া দুই জনে খেতুর গল্প করিলেন।
খেতু খাইয়া গিয়াছিল, তনু রায়ের স্ত্রী সেই বাসনগুলি মাজিলেন ও ঘর-দ্বার সব পরিষ্কার করিয়া দিলেন। বেলা হইলে খেতুর মা রাঁধিয়া খাইবেন, সে নিমিত্ত তরকারিগুলি কুটিয়া দিলেন, বাটনাটুকু বাটিয়া দিলেন।খেতুর মা বলিলেন, “থাক বোন থাক, আজ আর আমার খাওয়া দাওয়া। আজ আর আমি কিছু খাইব না।”
তনু রায়ের স্ত্রী বলিলেন, “না দিদি। উপবাসী কি থাকিতে আছে? খেতুর অকল্যান হইবে”।
“খেতুর অকল্যাণ হইবে” এই কথাটি বলিতেই খেতুর মা চুপ। যাহা করিলে খেতুর অকল্যাণ হয় তাহা কি তিনি করিতে পারেন?
তনু রায়ের স্ত্রী পুনরায় বলিলেন, “এই সব ঠিক করিয়া দিলাম। বেলা হইলে রান্না চড়াইয়া দিও। কাজ-কর্মসারা হইলে আমি আবার ও বেলা আসিব।”অপরাহ্ণে তনু রায়ের স্ত্রী পুনরায় আসিলেন। কোলের মেয়েটিকে সঙ্গে আনিয়াছিলেন।
খেতুর মা বলিলেন, “আহা। কি সুন্দর মেয়েটি বোন। যেমন মুখ, তেমনি চুল, তেমনি রং।”
তনু রায়ের স্ত্রী বলিলেন, “হাঁ। সকলেই বলে, তোমার গর্ভের এ কন্যাটি সুন্দর। তা দিদি। এ পোড়া পেটে কেন যে এরা আসে? মেয়ে হইলে ঘরের মানুষটি আহ্লাদে আটখানা হন। কিন্তু আমার মনে হয় যে, আঁতুড় ঘরেই মুখে নুন দিয়া মারি। গ্রীষ্মকালে একাদশীর দিন, মেয়ে দুইটির যখন মুখ শুকাইয়া যায়, যখন একটু জলের জন্য বাছাদের প্রাণ টা টা করে বল দেখি দিদি। মার প্রাণ তখন কিরূপ হয়? পোড়া নিয়ম।”খেতুর মাতে আর তনু রায়ের স্ত্রীতে নানারূপ কথাবার্তা হইতে লাগিল। খেতুর মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার এ মেয়েটি বুঝি এক বৎসরের হইল?”
তনু রায়ের স্ত্রী উত্তর করিলেন, “হাঁ এই এক বৎসর পার হইয়া দুই বৎসরে পড়িবে”।
খেতুর মা পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “মেয়েটির নাম রাখিয়াছ কি?”
তনু রায়ের স্ত্রী উত্তর করিলেন, “ইহার নাম হইয়াছে কনকাবতী”।খেতুর মা বলিলেন, “কঙ্কাবতী। দিব্য নামটি তো? মেয়েটিও যেমন নরম নরম দেখিতে, নামটিও সেইরূপ নরম নরম শুনিতে।”
এইরূপ খেতুর মা-তে আর তনু রায়ের স্ত্রী-তে ক্রমে ক্রমে বড়ই সদ্ভাব হইল। অবসর পাইলে তনু রায়ের স্ত্রী খেতুর মার কাছে আসেন, আর খেতুর মাও তনু রায়ের বাটিতে যান। মাঝে মাঝে তনু রায়ের স্ত্রী কঙ্কাবতীকে খেতুর মার কাছে ছাড়িয়া যান।
মেয়েটি এখনও হাঁটিতে শিখে নাই। হামাগুড়ি দিয়া চারিদিকে বেড়ায়, কখনও বা বসিয়া খেলা করে, কখনও বা কিছু ধরিয়া দাঁড়ায়। খেতুর মা আপনার কাজ করেন ও তাহার সহিত দুটি একটি কথা কহেন। কথা কহিলে মেয়েটি ফিক্ ফিক্ করিয়া হাসে, মুখে হাসি ধরে না। মেয়েটি বড় শান্ত, কাঁদিতে একেবারে জানে না।