কঙ্কাবতী - Konkaboti by Troilokyanath Mukhopadhyay, chapter name প্রথম খণ্ড - ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

প্রথম খণ্ড - ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

সম্বন্ধ

তের বৎসর বয়সে খেতু ইংরেজীতে প্রথম পাসটি দিল। পাস দিয়া জলপানি পাইল। জলপানি পাইয়া মার জন্য সে একটি ঝি নিযুক্ত করিয়া দিল। মা বৃদ্ধ হইতেছেন, মার যেন কোনও কষ্ট না হয়। এটি সেটি আনিয়া, কাপড়খানি চোপড়খানি কিনিয়া রামহরির সংসারেও সে সহায়তা করিতে লাগিল।

পনর বৎসর বয়সে খেতু আর একটি পাস দিল। জলপানি বাড়িল। সতর বৎসর বয়সে আর একটি পাস দিল। জলপানি আরও বাড়িল। খেতু টাকা পাইতে লাগিল, সেই টাকা দিয়া মার দুঃখ সম্পূর্ণরূপে ঘুচাইল। মা যখন যাহা চাহেন, তৎক্ষণাৎ তাহা পান।।তাহার আর কিছুমাত্র অভাব রহিল না।খেতু তিনটা পাস দিল, কন্যাভারগ্রস্ত লোকেরা রামহরির নিকট আনা-গোনা করিতে লাগিল। সকলের ইচ্ছা খেতুর সহিত কন্যার বিবাহ দেয়। কেহ বলে, “আমি এত সোনা দিব, এত টাকা দিব।” আবার কেহ বলে, “আমি এত দিব, তত দিব।” এইরূপে সকলে নিলাম ডাকাডাকি করিতে লাগিল।

রামহরি সকলকে বুঝাইয়া বলিলেন যে, যতদিন না খেতুর লেখাপড়া সমাপ্ত হয়, যতদিন না খেতু দুপয়সা উপার্জন করিতে পারে, ততদিন খেতুর বিবাহ দিবেন না। কিন্তু কন্যাভারগ্রস্ত লোকেরা সে কথা শুনিবে কেন? রামহরির নিকট তাহারা নানারূপ মিনতি করিতে লাগিল। অবশেষে রামহরি মনে করিলেন, দুর হউক। একস্থানে কথা দিয়ে রাখি। তাহা হইলে সকলে আর আমাকে এরূপ ব্যস্ত করিবে না। এই মনে করিয়া তিনি অনেকগুলি কন্যা দেখিলেন। শেষে জন্মেঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যাকে তিনি মনোনীত করিলেন। জন্মেঞ্জয়বাবু সংগতিপন্ন লোক ও সদ্বংশজাত। রামহরি কিন্তু তাহাকে সঠিক কথা দিতে পারিলেন না। খেতুর মার মত না লইয়া কি করিয়া তিনি কথা স্থির করেন?এদিকে কঙ্কাবতীর যতই বয়স হইতে লাগিল, ততই তাহার রূপ বাড়িতে লাগিল। কঙ্কাবতীর রূপে দশদিক আলো। কঙ্কাবতীর পানে চাওয়া যায় না। রংটি উজ্জ্বল ধবধবে, ভিতর হইতে যেন জ্যোতি বাহির হইতেছে। জল খাইলে যেন জল দেখা যায়। শরীরটি স্থূলও নয়, কৃশও নয়, যেন পুতুলটি, কি ছবিখানি। মুখখানি যেন বিধাতা কুঁদে কাটিয়াছেন। নাকটি টিকালো-টিকালো, চক্ষু দুটি টানা, চক্ষুর পাতা দীর্ঘ, ঘন ও ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। চক্ষু কিঞ্চিৎ নীচে করিলে পাতার উপর পাতা পড়িয়া এক অদ্ভুত শোভার আবির্ভাব হয়। এইরূপ চক্ষু দুইটির উপর যেরূপ সরু সরু, কাল কাল, ঘন ভুরুতে মানায়, কঙ্কাবতীর তাহাই ছিল। গাল দুটি নিতান্ত পূর্ণ নহে, কিন্তু হাসিলে টোল পড়ে। তখন সেই হাসিমাখা টোল খাওয়া মুখখানি দেখিলে শত্রুর মনও মুগ্ধ হয়। ঠোঁট দুটি পাতলা। পান খাইতে হয় না, আপনা-আপনি সদাই টুকটুক করে। কথা কহিবার সময় ঠোঁটের ভিতর দিয়া, সাদা দুধের মত দুই চারিটি দাঁত দেখিতে পাওয়া যায়, তখন দাঁতগুলি যেন ঝকঝক করিতে থাকে। কঙ্কাবতীর খুব চুল, ঘোর কাল। ছাড়িয়া দিলে, কোঁকড়া কোঁকড়া হইয়া পিঠের উপর গিয়া পড়ে। সম্মুখের সিঁথিটি কে যেন তুলি দিয়া ঈষৎ সাদা রেখা টানিয়া দিয়াছে। ফল কথা, কঙ্কাবতী একটি প্রকৃত সুন্দরী, পথের লোককে চাহিয়া দেখিতে হয়, বার বার দেখিয়াও আশা মিটে না। সমবয়স্কা বালিকাদিগের সহিত কঙ্কাবতী যখন দৌড়াদৌড়ি করিয়া খেলা করে, তখন যথার্থই যেন বিজলী খেলিয়া বেড়ায়।একদিন মা কঙ্কাবতীকে দেখাইয়া তনু রায়কে বলিলেন, “তোমার মেয়ের পানে একবার চাহিয়া দেখ এ সোনার প্রতিমাকে তুমি জলাঞ্জলি দিও না। কঙ্কাবতী স্বয়ং লক্ষ্মী। এমন সুলক্ষণা মেয়ে জনমে কি কখনও দেখিয়াছ? মা যদি এই অভাগার কুটীরে আসিয়াছে তো মাকে হেনস্তা করিও না। মা যেরূপ লক্ষ্মী, সেইরূপ নারায়ণ দেখিয়া মার বিবাহ দিও। এবার আমার কথা শুনিও।”

কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া তনু রায় বলিলেন, “আচ্ছা, আমি না হয় কঙ্কাবতীর বিবাহ দিয়া টাকা না লইলাম, কিন্তু ঘর হইতে টাকা তো আর দিতে পারিব না? আজ কাল যেরূপ বাজার পড়িয়াছে, টাকা না দিলে সুপাত্র মিলে না। তাহার কি করিব?”স্ত্রী উত্তর করিলেন, “আচ্ছা, আমি যদি বিনা টাকায় সুপাত্রের সন্ধান করিয়া দিতে পারি, তুমি তাহার সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিবে কি না, তাহা আমাকে বল?”

তনু রায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায়? কে?”

স্ত্রী বলিলেন, “বৃদ্ধ হইলে চক্ষুর দোষ হয়, বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ হয়। চক্ষুর উপর দেখিয়াও দেখিতে পাও না?”

তনু রায় বলিলেন, “কে বল না শুনি?”

স্ত্রী উত্তর করিলেন “কেন, খেতু?”তনু রায় বলিলেন, “তাহা কি কখনও হয়? বিষয় নাই, বন্ধু নাই, বান্ধব নাই। এরূপ পাত্রে আমি কঙ্কাবতীকে কি করিয়া দিই?― ভাল, আমি না হয় কিছু না লইলাম, মেয়েটি যাহাতে সুখে থাকে, দুখানা গহনা-গাঁটি পরিতে পায়, তাহা তো আমাকে করিতে হইবে?”

তনু রায়ের স্ত্রী উত্তর করিলেন, “খেতুর কি কখনও ভাল হইবে না? তুমি নিজেই না বল যে, খেতু ছেলেটি ভাল, খেতু দু-পয়সা আনিতে পারিবে? যদি কপালে থাকে তো খেতু হইতেই কঙ্কাবতী কত গহনা পরিবে। কিন্তু গহনা হউক আর না হউক, ছেলেটি ভাল হয়, এই আমার মনের বাসনা। খেতুর মত ছেলে পৃথিবী খুঁজিয়া কোথায় পাইবে বল দেখি? মা কঙ্কাবতী,আমার যেমন লক্ষ্মী, খেতু তেমনি দুর্লভ সুপাত্র। এক বোঁটায় দুইটি ফুল সাধ করিয়া বিধাতা যেন গড়িয়াছেন।”তনু রায় বলিলেন, “ভাল, সে কথা তখন পরে বুঝা যাইবে। এখন তাড়াতাড়ি কিছু নাই।”

আরও কিছুদিন গত হইল। কলিকাতা হইতে খেতুর মার নিকট একখানি চিঠি আসিল। সেই চিঠিখানি তিনি তনু রায়কে দিয়া পড়াইলেন। পত্রখানি রামহরি লিখিয়াছিলেন। তাহার মর্ম এইঃ

“খেতুর বিবাহের জন্য অনেক লোক আমার নিকট আসিতেছে। আমাকে তাহারা বড়ই ব্যস্ত করিয়া তুলিয়াছে। আমার ইচ্ছা যে লেখাপড়া সমাপ্ত হইলে, তাহার পর খেতুর বিবাহ দিই। কিন্তু কন্যাদায়গ্রস্ত ব্যক্তিগণ সে কথা শুনিবে কেন? তাহারা বলে, কথা স্থির হইয়া থাকুক, বিবাহ না হয় পরে হইবে। আমি অনেকগুলি কন্যা দেখিয়াছি। তাহাদিগের মধ্যে জন্মেঞ্জয়বাবুর কন্যা আমার মনোনীত হইয়াছে। কন্যাটি সুন্দরী, ধীর ও শান্ত। বংশ সৎ, কোনও দোষ নাই। মাতাপিতা, ভাই-ভগিনী বর্তমান। কন্যার পিতা সংগতিপন্ন লোক। কন্যাকে নানা অলংকার ও জামাতাকে নানা ধন দিয়া বিবাহকার্য সমাধা করিবেন। এক্ষণে আপনার কি মত জানিতে পারিলে; কন্যার পিতাকে আমি সঠিক কথা দিব।”পত্রখানি পড়িয়া তনু রায় অবাক। দুঃখী বলিয়া যে খেতুকে তিনি কন্যা দিতে অস্বীকার করেন, আজ নানা ধন দিয়া সেই খেতুকে জামাতা করিবার নিমিত্ত লোকে আরাধনা করিতেছে।

খেতুর মা রামহরিকে উত্তর লিখিলেন, “আমি স্ত্রীলোক, আমাকে আবার জিজ্ঞাসা করা কেন?” তুমি যাহা করিবে, তাহাই হইবে। তবে আমার মনে একটি বাসনা ছিল, যখন দেখিতেছি, সে বাসনা পূর্ণ হইবার নহে, তখন সে কথায় আর আবশ্যক নাই।

এই পত্র পাইয়া রামহরি খেতুকে সকল কথা বলিলেন, আর এ বিষয়ে খেতুর কি মত, তাহা জিজ্ঞাসা করিলেন।খেতু বলিল, “দাদা মহাশয়। মার মনের বাসনা কি, তাহা আমি বুঝিয়াছি। যতদিন মার সাধ পূর্ণ হইবার কিছুমাত্রও আশা থাকিবে, ততদিন কোনও স্থানে আপনি কথা দিবেন না।”

রামহরি বলিলেন, “হাঁ, তাহাই উচিত। তোমার বিবাহ বিষয়ে আমি এক্ষণে কোনও স্থানে কথা দিব না।”

খেতুর অন্য স্থানে বিবাহ হইবে, এই কথা শুনিয়া কঙ্কাবতীর মা একেবারে শরীর ঢালিয়া দিলেন। স্বামীর নিকট রাত্রি-দিন কান্নাকাটি, করিতে লাগিলেন। এদিকে তনু রায়ও কিছু চিন্তিত হইলেন। তিনি ভাবিলেন, আমি বৃদ্ধ হইয়াছি। দুইটি বিধবা গলায়, পুত্রটি মূর্খ। এখন একটি অভিভাবকের প্রয়োজন। খেতু যেরূপ বিদ্যাশিক্ষা করিতেছে, খেতু যেরূপ সুবোধ, তাহাতে পরে তাহার নিশ্চয় ভাল হইবে। আমাকে সে একেবারে এখন কিছু না দিতে পারে, না পারুক। পরে, মাসে মাসে আমি তাহার নিকট হইতে কিছু কিছু লইব।”এইরূপ ভাবিয়া চিন্তিয়া তনু রায় স্ত্রীকে বলিলেন, “তুমি যদি খেতুর সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ স্থির করিতে পার, তাহাতে আমার আপত্তি নাই। কিন্তু আমি খরচ-পত্র কিছু করিতে পারিব না।”

এইরূপ অনুমতি পাইয়া তনু রায়ের স্ত্রী তৎক্ষণাৎ খেতুর মার নিকট গেলেন, আর খেতুর মার পায়ের ধূলা লইয়া তাঁহাকে সকল কথা বলিলেন।

খেতুর মা বলিলেন, “কঙ্কাবতী আমার বউ হইবে, চিরকাল আমার এই সাধ। কিন্তু বোন, দুইদিন আগে যদি বলিতে? অন্য স্থানে কথা স্থির করিতে আমি রামহরিকে চিঠি লিখিয়াছি। রামহরি যদি কোনও স্থানে কথা দিয়া থাকে, তাহা হইলে সে কথা আর নড়িবার নয়। তাই আমার মনে বড় ভয় হইতেছে।”তনু রায়ের স্ত্রী বলিলেন, “দিদি। যখন তোমার মত আছে, তখন নিশ্চয় কঙ্কাবতীর সহিত খেতুর বিবাহ হইবে। তুমি একখানি চিঠি লিখিয়া রাখ। চিঠিখানি লোক দিয়া পাঠাইয়া দিব।”

তাহার পরদিন খেতুর মা ও কঙ্কাবতীর মা দুই জনে মিলিয়া কলিকাতায় লোক পাঠাইলেন। খেতুর মা রামহরিকে একখানি পত্র লিখিলেন।

খেতুর মা লিখিলেন : “কঙ্কাবতীর সহিত খেতুর বিবাহ হয়, এই আমার মনের বাসনা। এক্ষণে তনু রায় ও তাঁহার স্ত্রী, সেই জন্য আমার নিকট আসিয়াছেন অন্য কোনও স্থানে যদি খেতুর বিবাহের কথা স্থির না হইয়া থাকে, তাহা হইলে তোমরা কঙ্কাবতীর সহিত স্থির করিয়া তনু রায়কে পত্র লিখিবে।”এই চিঠি পাইয়া রামহরি, তাঁহার স্ত্রী ও খেতু, সকলেই আনন্দিত হইলেন।

খেতুর হাতে পত্রখানি দিয়া রামহরি বলিলেন, “তোমার মার আজ্ঞা, ইহার উপর আর কথা নাই।”

খেতু বলিল, “মার যেরূপ অনুমতি, সেইরূপ হইবে। তবে তাড়াতাড়ি কিছুই নাই। তনু কাকা তো মেয়েগুলিকে বড় করিয়া বিবাহ দেন। আর দুই তিন বৎসর তিনি অনায়াসেই রাখিতে পারিবেন। তত দিনে আমার সব পাসগুলিও হইয়া যাইবে। তত দিনে আমিও দুপয়সা আনিতে পারিব। আপনি এই মর্মে তনু কাকাকে পত্র লিখুন।”রামহরি তনু রায়কে সেইরূপ পত্র লিখিলেন। তনু রায় সে কথা স্বীকার করিলেন। বিলম্ব হইল বলিয়া তাঁহার কিছুমাত্র দুঃখ হইল না, বরং তিনি আহ্লাদিত হইলেন।

তিনি মনে করিলেন, স্ত্রীর কান্নাকাটিতে আপাততঃ এ কথা স্বীকার করিলাম, দেখি না, খেতুর চেয়ে ভাল পাত্র পাই কি না? যদি পাই― । আচ্ছা, সে কথা তখন পরে বুঝা যাইবে।

খেতুর মা নিরঞ্জনকে সকল কথা বলিয়াছিলেন। নিরঞ্জন মনে করিলেন, বৃদ্ধ হইয়া তনু রায়ের ধর্মে মতি হইতেছে।কঙ্কাবতী আজ কয়দিন বিরস-বদনে ছিল। সকলে আজ কঙ্কাবতীর হাসি-হাসি মুখ দেখিল। সেই দিন মেনিকে কোলে লইয়া বিরলে বসিয়া কত যে তাহাকে মনের কথা বলিল, তাহা আর কি বলিব। মেনি এখন আর শিশু নহে, বড় একটি বিড়াল। সুতরাং কঙ্কাবতী যে তাহাকে মনের কথা বলিবে, তাহার আর আশ্চর্য কি?