কঙ্কাবতী - Konkaboti by Troilokyanath Mukhopadhyay, chapter name প্রথম খণ্ড - অষ্টম পরিচ্ছেদ

প্রথম খণ্ড - অষ্টম পরিচ্ছেদ

গদাধর-সংবাদ

গদাধর ঘোষ আসিয়া উপস্থিত হইল। চৌধুরী মহাশয়কে কৃতাঞ্জলিপুটে নমস্কার করিয়া অতি দূরে সে মাটিতে বসিল।

চৌধুরী মহাশয় বলিলেন, “কেমন হে গদাধর। এ কি কথা শুনিতে পাই? শিবচন্দ্রের ছেলেটা, ওই খেতা, কি খাইয়াছিল? তুমি কি দেখিয়াছিলে? কি শুনিয়াছিলে, তাহার সহিত তোমার কি কথাবার্তা হইয়াছিল? সমুদয় বল, কোনও বিষয় গোপন করিও না।”

গদাধর বলিল, “মহাশয়। আমি মূর্খ মানুষ। অত শত জানি না। যাহা হইয়াছিল, তাহা আমি বলিতেছি।”গদাধর বলিল, “আর বৎসর আমি কলিকাতায় গিয়াছিলাম। কোথায় থাকি? তাই রামহরির বাসায় গিয়াছিলাম। সন্ধ্যাবেলা বাহিরের ঘরে বসিয়া আছি, এমন সময়ে এক মিনষে হাঁড়ি মাথায় করিয়া পথ দিয়া কি শব্দ করিতে করিতে যাইতেছিল। সেই শব্দ শুনিয়া রামহরিবাবুর ছেলেটি বাড়ীর ভিতর হইতে ছুটিয়া আসিল, আর খেতুকে বলিল, “কাকা, কাকা। ‘কুলকি’ যাইতেছে, আমাকে কিনিয়া দাও। খেতু তাহাকে দুই পয়সার কিনিয়া দিল। তাহার পর খেতু আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, গদাধর, তুমি একটা কুলকি খাইবে?” আমি বলিলাম, “না দাদাঠাকুর, আমি কুলকি খাই না”। রামহরিবাবুর ছেলে খেতুকে বলিল, “কাকা, তুমি খাইবে না?” খেতু বলিল, না, আমার পিপাসা পাইয়াছে, ইহাতে পিপাসা ভাঙে না, আমি কাঁচা বরখ খাইব। এই কথা বলিয়া খেতু বাহিরে গেল। কিছুক্ষণ পরে সাদা ধবধবে কাচের মত একটা ঢিল গামছায় বাঁধিয়া বাটি আনিল। সেই ঢিলটি ভাঙিয়া জলে দিল, পরে সেই জল খাইতে লাগিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, দাদাঠাকুর, ও কি? খেতু বলিল, ইহার নাম ‘বরখ’। এই গ্রীষ্মকালের দিনে যখন বড় পিপাসা হয়, তখন ইহা জলে দিলে জল শীতল হয়। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, দাদাঠাকুর, সকল কাচ কি জলে দিলে জল শীতল হয়? খেতু উত্তর করিল, এ কাচ নয়, এ বরখ। জল জমিয়া প্রস্তুত হয়। ইহা জল। নদীতে যে জল দেখিতে পাও, ইহাও তাহাই, জমিয়া গিয়াছে এইমাত্র। আকাশ হইতে যে শিল পড়ে, বরখ তাহাই। সাহেবেরা বরখ কলে প্রস্তুত করে। একটু হাতে করিয়া দেখ দেখি। এই বলিয়া আমার হাতে একটুখানি দিল। হাতে রাখিতে না রাখিতে আমার হাত যেন করাত দিয়া কাটিতে লাগিল। আমি হাতে রাখিতে পারিলাম না, আমি ফেলিয়া দিলাম। তাহার পর খেতু বলিল গদাধর, একটু খাইয়া দেখ না? ইহাতে কোনও দোষ নাই। আমি বলিলাম, না দাদাঠাকুর, তোমরা ইংরেজী পড়িয়াছ, তোমাদের সব খাইতে আছে, তাহাতে কোনও দোষ হয় না। আমি ইংরেজী পড়ি নাই। সাহেবেরা যে দ্রব্য কলে প্রস্তুত করে, সে দ্রব্য খাইলে আমাদের অধর্ম হয়, আমাদের জাতি যায়।”গদাধরের মুখে সকল কথা শুনিয়া, জনার্দন চৌধুরী তখন তনু রায় প্রভৃতি গ্রামের ভদ্রলোকদিগকে ডাকিতে পাঠাইলেন। সকলে আসিয়া উপস্থিত হইলে জনার্দন চৌধুরী বলিলেন, ‘আজ আমি ঘোর সর্বনাশের কথা শুনিলাম। জাতি-কুল, ধর্ম-কর্ম সব লোপ হইতে বসিল। পিতা-পিতামহদিগকে যে এক গণ্ডুষ জল দিব, তাহারও উপায় রহিল না। ঘোর কলি উপস্থিত।”

সকলে জিজ্ঞাসা করিল, “কি হইয়াছে, মহাশয়?”জনার্দন চৌধুরী উত্তর করিলেন, “শিবচন্দ্রের পুত্র, ওই যে খেতা, কলিকাতায় রামহরির বাসায় থাকিয়া ইংরেজী পড়ে, সে বরফ খায়। বরফ সাহেবরা প্রস্তুত করে, সাহেবের জল। শিরোমণি মহাশয় বিধান দিয়াছেন যে, বরফ খাইলে সাহেবত্ব প্রাপ্ত হয়। সাহেবত্ব-প্রাপ্ত লোকের সহিত সংস্রব থাকিলে সেও সাহেব হইয়া যায়। তাই, এই খেতার সহিত সংস্রব রাখিয়া সকলেই আমরা সাহেব হইতে বসিয়াছি।”

এই কথা শুনিয়া দেশ সুদ্ধ লোক একেবারে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল। সর্বনাশ। বরফ খায়? যা:। এইবার ধর্মকর্ম সব গেল।

সবার চেয়ে ভাবনা হইল ষাঁড়েশ্বরের। ডাক ছাড়িয়া সে কাঁদে নাই সত্য, কিন্তু তাহার ধর্মগত প্রাণে বড়ই আঘাত লাগিয়াছিল। কত যে সে হায় হায় করিল তাহার কথা আর কি বলিব?যাহা হউক, সর্ববাদীসম্মত হইয়া খেতুকে একঘরে করা স্থির হইল।

নিরঞ্জন কেবল ওই কথায় সায় দিলেন না। নিরঞ্জন বলিলেন, “আমি থাকিতে খেতুকে কেহ একঘরে করিতে পারিবে না। আমরা না হয় দু-ঘরে হইয়া থাকিব।”

খেতু যে একঘরে হইয়াছে নিয়মিতরূপে লোককে সেইটি দেখাইবার নিমিত্ত, স্ত্রীর মাসিক শ্রাদ্ধ উপলক্ষ্যে জনার্দন চৌধুরী সপ্তগ্রাম সমাজ নিমন্ত্রণ করিলেন। চারিদিকে হৈ হৈ পড়িয়া গেল যে, কুসুমঘাটি নিবাসী শিবচন্দ্রের পুত্র ক্ষেত্র বরফ খাইয়া ক্রিস্তান হইয়াছে।সেইদিন রাত্রিতে ষাঁড়েশ্বর চারি বোতল মহুয়ার মদ আনিল। তারিফ শেখের বাড়ী হইতে চুপি চুপি মুরগি রাঁধাইয়া আনিল। পাঁচ ইয়ার জুটিয়া পরম সুখে পান-ভোজন হইল। একবার কেবল এই সুখে ব্যাঘাত হইবার উপক্রম হইয়াছিল। খাইতে খাইতে ষাঁড়েশ্বরের মনে উদয় হইল যে, তারিফ শেখ হয় তো মুরগির সহিত বরফ মিশ্রিত করিয়াছে। তাই তিনি হাত তুলিয়া লইলেন, আর বলিলেন, “আমার খাওয়া হইল না; বরফ-মিশ্রিত মুরগি খাইয়া শেষে কি জাতিটি হারাইব?” সকলে অনেক বুঝাইল যে, মুরগি বরফ দিয়া রান্না হয় নাই। তবে সে পুনরায় আহারে প্রবৃত্ত হইল। পান-ভোজনের পর নিরঞ্জনের বাটীতে সকলে গিয়া ঢিল ও গোহাড় ফেলিতে লাগিল। এইরূপ ক্রমাগত প্রতি রাত্রিতে নিরঞ্জনের বাটিতে ঢিল ও গোহাড় পড়িতে লাগিল। আর সহ্য করিতে না পারিয়া, নিরঞ্জন ও তাঁহার স্ত্রী কাঁদিতে কাঁদিতে পৈতৃক বাস্তুভূমি পরিত্যাগ করিয়া অন্য গ্রামে চলিয়া গেলেন।খেতু বলিল, “কাকা মহাশয়, আপনি চলুন। আমিও এ গ্রাম হইতে শীঘ্র উঠিয়া যাইব।”

খেতুর মার নিকট যে ঝি ছিল, সে ঝিটি ছাড়িয়া গেল। সে বলিল, মা ঠাকুরাণী, আমি আর তোমার কাছে কি করিয়া থাকি? পাঁচজনে তাহা হইলে আমার হাতে জল খাইবে না।

আরও নানা বিষয়ে খেতুর মা উৎপীড়িত হইলেন। খেতুর মা ঘাটে স্নান করিতে গেলে, পাড়ার স্ত্রীলোকেরা দুরে দুরে থাকে। পাছে খেতুর মা তাহাদিগকে ছুঁইয়া ফেলেন।একদিন কমল ভট্টাচার্যের বিধবা স্ত্রী মুখ ফুটিয়া খেতুর মাকে বলিল, “বাছা, নিজে সাবধান হইতে জানিলে, কেহ আর কিছু বলে না। বসিতে জানিলে উঠিতে হয় না। তোমার ছেলে বরখ খাইয়াছে, তোমাদের এখন জাতিটি গিয়াছে। তা বলিয়া আমাদের সকলের জাতিটি মার কেন? আমাদের ধর্ম-কর্ম নাশ কর কেন? তা, তোমার বাছা দেখিতেছি এ ঘাটটি না হইলে আর চলে না। সেদিন, মেটে কলসীটি যেই কাঁখে করিয়া উঠিয়াছি, আর তোমার গায়ের জলের ছিটা আমার গায়ে লাগিল, তিন পয়সার কলসীটি আমাকে ফেলিয়া দিতে হইল। আমাকে পুনরায় স্নান করিতে হইল। আমরা তোমার বাছা কি করিয়াছি যে তুমি আমাদের সঙ্গে এত লাগিয়াছ?”

খেতুর মা কোন উত্তর দিলেন না। কাঁদিতে কাঁদিতে বাড়ী আসিলেন। খেতু বলিল, “মা, কাঁদিও না। এখানে আর আমরা অধিক দিন থাকিব না। এ গ্রাম হইতে আমরা উঠিয়া যাইব।”খেতুর মা বলিলেন, “বাছা, অভাগীরা যাহা কিছু বলে, তাহাতে আমি দুঃখ করি না। কিন্তু তোমার মুখপানে চাহিয়া রাত্রিদিন আমার ভিতর আগুন জ্বলিতেছে। তোমার আহার নাই, নিদ্রা নাই। একদণ্ড তুমি সুস্থির নও, শরীর তোমার শীর্ণ, মুখ তোমার মলিন। খেতু, আমার মুখপানে চাহিয়া একটু সুস্থির হও বাছা।”

খেতু বলিল, “মা আর সাতদিন। আজ মাসের হইল ১৭ই তারিখ। ২৪এ তারিখে কঙ্কাবতীর বিবাহ, হইবে। সেই দিন আমরা জন্মের মত এদেশ হইতে চলিয়া যাইব।”খেতুর মা বলিলেন, “দাসেদের মেয়ের কাছে শুনিলাম যে, কঙ্কাবতীকে আর চেনা যায় না। সে রূপ নাই, সে রং নাই, সে হাসি নাই। আহা, তবুও বাছা মার দুঃখে কাতর। আপনার সকল দুঃখ ভুলিয়া বাছা আমার মার দুঃখে দুঃখী। কঙ্কাবতীর মা রাত্রি-দিন কাঁদিতেছেন, আর কঙ্কাবতী মাকে বুঝাইতেছে।”

“শুনিলাম, সেদিন কঙ্কাবতী মাকে বলিয়াছে যে, মা তুমি কাঁদিও না, আমার এই কয়খানা হাড় বেচিয়া বাবা যদি টাকা পান, তাহাতে দুঃখ কি মা? এরূপ কত হাড় শ্মশানঘাটে পড়িয়া থাকে, তাহার জন্য কেহ একটি পয়সাও দেয় না আমার এই হাড় কয়-খানার যদি এত মূল্য হয়, বাপ-ভাই সেই টাকা পাইয়া যদি সুখী হন, তাহার জন্য আর আমরা দুঃখ কেন করি মা? তবে মা, আমি বড়ই দুর্বল হইয়াছি, শরীরে আমার সুখ নাই। পাছে এই কয়দিনের মধ্যে আমি মরিয়া যাই সেই ভয় হয়। টাকা না পাইতে পাইতে মরিয়া গেলে, বাবা আমার উপর বড় রাগ করিবেন। আমি তো ছাই হইয়া যাইব, কিন্তু আমাকে তিনি যখনই মনে করিবেন, তখনই কত গালি দিবেন।”খেতুর মা পুনরায় বলিলেন, “খেতু, কঙ্কাবতীর কথা যেরূপ আমি শুনি, তাহা তোমাকে বলি না, পাছে তুমি অধৈর্য হইয়া পড়। কঙ্কাবতীর যেরূপ অবস্থা শুনিতে পাই, কঙ্কাবতী আর অধিক দিন বাঁচিবে না।”

খেতু কোনও উত্তর দিল না, আঁচলে চক্ষু মুছিতে লাগিল।

এইরূপে দিন দিন কঙ্কাবতীর পীড়া বাড়িতে লাগিল, কিছুই কমিল না। সাতদিন হইল। বিবাহের দিন উপস্থিত হইল।

সেদিন কঙ্কাবতীর গায়ের বড় জ্বালা, কঙ্কাবতীর বড়ই পিপাসা, কঙ্কাবতী একেবারে শয্যাধরা। কঙ্কাবতীর সমূহ রোগ। কঙ্কাবতীর ঘোর বিকার। কঙ্কাবতীর জ্ঞান নাই, সংজ্ঞা নাই। লোক চিনিতে পারে না, কঙ্কাবতী এখন যায় তখন যায়।