প্রথম খণ্ড - সপ্তম পরিচ্ছেদ
বিড়ম্বনা
দেখিতে দেখিতে তিন বৎসর কাটিয়া গেল। খেতুর এক্ষণে কুড়ি বৎসর বয়স। যাহা কিছু পাস ছিল, খেতু সবগুলি পাস দিল। বাহিরেরও দুই একটি পাস দিল। শীঘ্র একটি উচ্চপদ পাইবে, খেতু এরূপ আশা পাইল।রামহরি ও রামহরির স্ত্রী ভাবিলেন যে, এক্ষণে খেতুর বিবাহ দিতে হইবে। দিন স্থির করিবার নিমিত্ত তাঁহারা খেতুর মাকে পত্র লিখিলেন।
পত্রের প্রত্যুত্তরে খেতুর মা অন্যান্য কথা বলিয়া অবশেষে লিখিলেন, “তনু রায়কে বিবাহের কথা কিছু বলিতে পারি নাই। আজকাল সে বড়ই ব্যস্ত, তাহার দেখা পাওয়া ভার। জনার্দন চৌধুরীর স্ত্রী বিয়োগ হইয়াছে। মহাসমারোহে শ্রাদ্ধ হইবে, এই কার্যে তনু রায় একজন কর্তা হইয়াছে। জনার্দন চৌধুরীর স্ত্রীর ধন্য কপাল। পুত্র, পৌত্র, দৌহিত্র চারিদিকে জাজ্বল্যমান রাখিয়া অশীতিপর স্বামীর কোলে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে। ইহার চেয়ে স্ত্রীলোকের পুণ্যবল আর কি হইতে পারে? যখন তাঁহাকে ঘাটে লইয়া যায় তখন আমি দেখিতে গিয়াছিলাম। সকলে এক মাথা সিন্দুর দিয়া দিয়াছে, আর ভাল একখানি কস্তাপেড়ে কাপড় পরাইয়া দিয়াছে। আহা। তখন কি শোভা হইয়াছিল। যাহা হউক, তনু রায়ের একটু অবসর হইলে, আমি তাহাকে বিবাহের কথা বলিব।”কিছুদিন পরে খেতুর মা, রামহরিকে আর একখানি পত্র লিখিলেন। তাহার মর্ম এইঃ
“বড় ভয়ানক কথা শুনিতেছি। তনু রায়ের কথার ঠিক নাই। তাহার দয়ামায়া নাই, তাহার ধর্মাধর্মজ্ঞান নাই। শুনিতেছি, সে না কি জনার্দন চৌধুরীর সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিবে। কি ভয়ানক কথা। আর জনার্দন চৌধুরীও পাগল হইয়াছে না কি? পুত্র পৌত্র দৌহিত্র চারিদিকে বর্তমান। বয়সের গাছ পাথর নাই। চলিতে ঠক্ ঠক্ করিয়া কাঁপে। ঘাটের মড়া, তাহার আবার এ কুবুদ্ধি কেন? বিষয় থাকিলে, টাকা থাকিলে, এরূপ করিতে হয় না কি? সে বড়মানুষ, জমিদার, না হয় রাজা, তা বলিয়া কি একেবারে বিবেচনাশূন্য হইতে হয়? বৃদ্ধ মনে ভাবে না যে, মৃত্যু সন্নিকট? যেরূপ তাহার অবস্থা, তাহাতে আর কয়দিন? লাঠি না ধরিয়া একটি পা চলিতে পারে না। কি ভয়ানক কথা, আর তনু রায় কি নিকষা, দুধের বাছা কঙ্কাবতীকে কি করিয়া এই অশীতিপর বৃদ্ধের হাতে সমর্পণ করিবে? কঙ্কাবতীর কপালে কি শেষে এই ছিল? কঙ্কাবতীর সেই মধুমাখা মুখখানি মনে করিলে বুক ফাটিয়া যায়। শুনিতে পাই কঙ্কাবতীর মা নাকি রাত্রি-দিন কাঁদিতেছেন। আমি ডাকিয়া পাঠাইয়াছিলাম, কিন্তু আসেন নাই। বলিয়া পাঠাইলেন যে, দিদির কাছে আর মুখ দেখাইব না, এ কালা মুখ লোকের কাছে আর বাহির করিব না। এই বিবাহের কথা শুনিয়া আমার বুক ফাটিয়া যাইতেছে। আহা! তাঁহার মার প্রাণ, কতই না তিনি কাতর হইয়া থাকিবেন!”এই চিঠিখানি পাইয়া রামহরি খেতুকে দেখাইলেন।
খেতু বলিল, ‘দাদা মহাশয়, আমি এক্ষণে দেশে যাইব।”
রামহরি বলিলেন, “জনার্দন চৌধুরী বড়লোক, তুমি সহায়হীন বালক, তুমি দেশে গিয়া কি করিবে?”
খেতু বলিল, “আমি কিছু করিতে পারিব না সত্য, তথাপি নিশ্চিন্ত থাকা উচিত নহে। কঙ্কাবতীকে এ বিপদ হইতে রক্ষা করিবার নিমিত্ত চেষ্টা করাও কর্তব্য। কৃতকার্য না হই, কি করিব?খেতু দেশে আসিল। মার নিকট ও পাড়াপ্রতিবেশীর নিকট সকল কথা শুনিল। শুনিল যে জনার্দন চৌধুরী প্রথমে কিছুতেই বিবাহ করিতে সম্মত হন নাই। কেবল তাঁহার সভাপণ্ডিত গোবর্ধন শিরোমণি তাঁহাকে অনেক বুঝাইয়া সম্মত করিয়াছেন।
বৃদ্ধ হইলে কি হয়? জনার্দন চৌধুরীর শ্রী-ছাঁদ আছে, প্রাণে শখও আছে। দুর্লভ পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষের মাল্য দ্বারা গলদেশ তাঁহার সর্বদাই সুশোভিত থাকে। কফের ধাতু বলিয়া শৈত্য নিবারণের জন্য চুড়াদার টুপি মস্তকে তাঁহার দিন-রাত্রি বিরাজ করে। এইরূপ বেশ-ভূষায় সুসজ্জিত হইয়া নিভৃতে বসিয়া যখন তিনি গোবর্ধন শিরোমণির সহিত বিবাহ-বিষয়ে পরামর্শ করেন, তখন তাঁহার রূপ দেখিয়া ইন্দ্র চন্দ্র বায়ু বরুণকেও লজ্জায় অধোমুখ হইতে হয়।খেতু শুনিল যে, জনার্দন চৌধুরী বিবাহ করিবার জন্য এখন একেবারে পাগল হইয়া উঠিয়াছেন। আর বিলম্ব সহে না। এই বৈশাখ মাসের ২৪এ তারিখে বিবাহ হইবে। জনার্দন চৌধুরী এক্ষণে দিন গণিতেছেন। তাঁহার পুত্র-কন্যা সকলের ইচ্ছা, যাহাতে এ বিবাহ না হয়। কিন্তু কেহ কিছু বলিতে সাহস করে না। তাঁহার বড় কন্যা একদিন মুখ ফুটিয়া মানা করিয়াছিল। সেই অবধি বড় কন্যার সহিত তাঁহার আর কথা-বার্তা নাই।
জনার্দন চৌধুরীকে কন্যা দিতে তনু রায়ও প্রথমে ইতস্ততঃ করিয়া-ছিলেন। কিন্তু যখন জনার্দন চৌধুরী বলিলেন যে, “আমার নববিবাহিতা স্ত্রীকে আমি দশ হাজার টাকার কোম্পানির কাগজ দিব, একখানি তালুক দিব, স্ত্রীর গা সোনা দিয়া মুড়িব, আর কন্যার পিতাকে দুই হাজার টাকা নগদ দিব।” তখন তনু রায় আর লোভ সংবরণ করিতে পারিলেন না।কঙ্কাবতীর মুখপানে চাহিয়া তবুও তনু রায় ইতস্ততঃ করিতেছিলেন। কিন্তু তাঁহার পুত্র টাকার কথা শুনিয়া একেবারে উন্মত্ত হইয়া পড়িল। বকিয়া ঝকিয়া পিতাকে সে সম্মত করাইল। টাকার লোভে এক্ষণে পিতাপুত্র দুইজনে উন্মত্ত হইয়াছেন।
তবুও তনু রায় স্ত্রীর নিকট নিজে এ কথা বলিতে সাহস করেন নাই। তাহার পুত্র বলিল, “তোমাকে বলিতে হইবে না, আমি গিয়া মাকে বলিতেছি।”
এই কথা বলিয়া পুত্র মার নিকট গিয়া বলিল, “মা, জনার্দন চৌধুরীর সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ হইবে। বাবা সব স্থির করিয়া আসিয়াছেন”।এ কথার উপর আর কথা নাই। মা একেবারে বসিয়া পড়িলেন। অবিরল ধারায় তাঁহার চক্ষু হইতে অশ্রু বিগলিত হইতে লাগিল। মনে করিলেন যে, হে পৃথিবী, তুমি দুই ফাঁক হও, তোমার ভিতর আমি প্রবেশ করি। মেয়ে দুইটিও অনেক কাঁদিলেন; কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। কঙ্কাবতী নীরব। প্রাণ যাহার ধুধু করিয়া পুড়িতেছে, চক্ষে তাহার জল কোথা হইতে আসিবে?
মা ও প্রতিবেশীদিগের নিকট হইতে খেতু এই সকল কথা শুনিল।
খেতু প্রথম তনু রায়ের নিকট গেল। তনু রায়কে অনেক বুঝাইল। খেতু বলিল, “মহাশয়, এইরূপ অশীতিপর বৃদ্ধের সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিবেন না। আমার সহিত বিবাহ না হয় না দিবেন, কিন্তু একটি সুপাত্রের হাতে দিন। মহাশয় যদি সুপাত্রের অনুসন্ধান করিতে না পারেন, আমি করিয়া দিব।”এই কথা শুনিয়া তনু রায় ও তনু রায়ের পুত্র খেতুর উপর অতিশয় রাগান্বিত হইলেন। নানারূপ ভৎর্সনা করিয়া তাহাকে বাটি হইতে তাড়াইয়া দিলেন।
নিরঞ্জনকে সঙ্গে করিয়া খেতু তাহার পর জনার্দন চৌধুরীর নিকট গমন করিল। হাত জোড় করিয়া খেতু বিনীতভাবে জনার্দন চৌধুরীকে বিবাহ করিতে নিষেধ করিল। প্রথমতঃ জনার্দন সে কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিলেন। তাহার পর খেতু যখন তাঁহাকে দুই একবার বৃদ্ধ বলিল, তখন রাগে তাঁহার সর্বশরীর কাঁপিতে লাগিল। তাঁহার শ্লেষ্মার ধাত রাগে এমনি তাঁহার ভয়ানক কাসি আসিয়া উপস্থিত হইল যে, সকলে বোধ করিল, দম আটকাইয়া তিনি বা মরিয়া যান।কাসিতে কাসিতে তিনি বলিলেন, “গলাধাক্কা দিয়া এ ছোঁড়াকে বাড়ী হইতে বাহির করিয়া দাও।”
অনুমতি পাইয়া পারিষদগণ খেতুর গলাধাক্কা দিতে আসিল।
খেতু জনার্দন চৌধুরীর লাঠিগাছটি তুলিয়া লইল। পারিষদবর্গকে ধীরভাবে বলিল, “তোমরা কেহ আমার গায়ে হাত দিও না। যদি আমার গায়ে হাত দাও,-তাহা হইলে এই দণ্ডে তোমাদের মুণ্ডপাত করিব।”
খেতুর তখন সেই রুদ্রমূর্তি দেখিয়া ভয়ে সকলেই আকুল হইল। গলাধাক্কা দিতে আর কেহ অগ্রসর হইল না।নিরঞ্জন উঠিয়া উভয় পক্ষকে সান্ত্বনা করিয়া খেতুকে সেখান হইতে বিদায় করিলেন।
খেতু চলিয়া গেল। তবুও জনার্দন চৌধুরীর রাগও থামে না, কাসিও থামে না। রাগে থর থর করিয়া শরীর কাঁপিতে লাগিল, খক্ খক্ করিয়া ঘন ঘন কাসি আসিতে লাগিল।
কাসিতে কাসিতে তিনি বলিলেন, “ছোঁড়ার কি আস্পর্ধা। আমাকে কি না বুড়া বলে।”
গোবর্ধন শিরোমণি বলিলেন, “না না। আপনি বৃদ্ধ কেন হইবেন? আপনাকে যে বুড়া বলে, সে নিজে বুড়া।”ষাঁড়েশ্বর নামে একটি মদ্যপ পারিষদ সেখানে উপস্থিত ছিল। সে বলিল, “হয় তো ছোকরা মদ খাইয়া আসিয়াছিল। চক্ষু দুইটা যেন জবা-ফুলের মত, দেখিতে পান নাই?”
গোবর্ধন শিরোমণি বলিলেন, “ক্ষেত্রচন্দ্র মদ খায়, কি, না খায়, তাহা আমি জানি না। তবে সে যে যবনের জল খায়, তাহা জানি। সেই যারে বলে ‘বরখ’, সাহেবেরা কলে যাহা প্রস্তুত করেন, ক্ষেত্রচন্দ্র সেই বরখ খান। গদাধর ঘোষ ইহা স্বচক্ষে দেখিয়াছে।”
জনার্দন চৌধুরী বলিলেন, “কি কি? কি বলিলে?”ষাঁড়েশ্বর বলিল, “সর্বনাশ, বরফ খায়? গোরক্ত দিয়া সাহেবেরা যাহা প্রস্তুত করেন? এবার দেখিতেছি, সকলের ধর্মটি একেবারে লোপ হইল। হায় হায়। পৃথিবীতে হিন্দুধর্ম একেবারে লোপ হইল।”
নিরঞ্জন বলিলেন, “ষাঁড়েশ্বরবাবু, একবার মনে করিয়া দেখ, খেতুর বাপ তোমার কত উপকার করিয়াছেন। খেতুর অপকার করিতে চেষ্টা করিও না।”
জনার্দন চৌধুরী বলিলেন, “ও সব বাজে কথা এখন তোমরা রাখ। গদাধর ঘোষকে ডাকিতে পাঠাও।”
গদাধর ঘোষকে ডাকিতে লোক দৌড়িল।