প্রথম খণ্ড-তৃতীয় পরিচ্ছেদ
নিরঞ্জন
তনু রায়ের সহিত নিরঞ্জন কবিরত্নের ভাব নাই। নিরঞ্জন তনু রায়ের প্রতিবেশী।
নিরঞ্জন বলেন, “রায় মহাশয়। কন্যার বিবাহ দিয়া টাকা লইবেন না, টাকা লইলে ঘোর পাপ হয়।”
তনু রায় তাই নিরঞ্জনকে দেখিতে পারেন না, নিরঞ্জনকে তিনি ঘৃণা করেন। যে দিন তনু রায়ের কন্যার বিবাহ হয়, নিরঞ্জন সেই দিন গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া অপর গ্রামে গমন করেন। তিনি বলেন, “কন্যাবিক্রয় চক্ষে দেখিলে, কি সে কথা কর্ণে শুনিলেও পাপ হয়।”নিরঞ্জন অতি পণ্ডিত লোক। নানা শাস্ত্র তিনি অধ্যয়ন করিয়াছেন। বিদ্যা-শিক্ষার শেষ নাই, তাই রাত্রিদিন তিনি পুঁথি-পুস্তক লইয়া থাকেন।
লোকের কাছে আপনার বিদ্যার পরিচয় দিতে তিনি ভালবাসেন না। তাই জগৎ জুড়িয়া তাঁহার নাম হয় নাই। পূর্বে অনেকগুলি ছাত্র তাঁহার নিকট বিদ্যা-শিক্ষা করিত। দিবারাত্রি তাহাদিগকে বিদ্যা শিক্ষা দিয়া তিনি পরম পরিতোষ লাভ করিতেন। আহার পরিচ্ছদ দিয়া ছাত্রগুলিকে পুত্রের মত প্রতিপালন করিতেন। লোকের বাড়ি নিমন্ত্রণে গিয়া বিদায়ের জন্য তিনি মারামারি করিতেন না। কারণ, তাঁহার অবস্থা ভাল ছিল। পৈতৃক অনেক ব্রহ্মোত্তর ভূমি ছিল।গ্রামের জমিদার জনার্দন চৌধুরীর সহিত এই ভূমি লইয়া কিছু গোলমাল হয়। একদিন দুই প্রহরের সময় জমিদার এক জন পেয়াদা পাঠাইয়া দেন। পেয়াদা আসিয়া নিরঞ্জনকে বলে, “ঠাকুর। চৌধুরী মহাশয় তোমাকে ডাকিতেছেন, চল।”
নিরঞ্জন বলিলেন, “আমার আহার প্রস্তুত, আমি আহার করিতে যাইতেছি। আহার হইলে জমিদার মহাশয়ের নিকট যাইব। তুমি এক্ষণে যাও।”
পেয়াদা বলিল, “তাহা হইবে না, তোমাকে এই ক্ষণেই আমার সহিত যাইতে হইবে”।নিরঞ্জন বলিলেন, “বেলা দুই প্রহর অতীত হইয়া গিয়াছে, ঠাঁই হইয়াছে, ভাত প্রস্তুত ভাত দুইটি মুখে দিয়া, চল, যাইতেছি। কারণ, আমি আহার না করিলে গৃহিণী আহার করিবেন না, ছাত্রগণেরও আহার হইবে না। সকলেই উপবাস থাকিবে।”
পেয়াদা বলিল, “তাহা হইবে না, তোমাকে এক্ষণেই যাইতে হইবে।”
নিরঞ্জন বলিলেন, “এই ক্ষণেই যাইতে হইবে, বটে? আচ্ছা, তবে চল যাই।”পেয়াদার সহিত নিরঞ্জন গিয়া জমিদারের বাটীতে উপস্থিত হইলেন। জনার্দন চৌধুরী বলিলেন, “কখন আপনাকে ডাকিতে পাঠাইয়াছি, আপনার যে আর আসিবার বার হয় না।”
নিরঞ্জন বলিলেন, “আজ্ঞা, হাঁ মহাশয়, আমার একটু বিলম্ব হইয়াছে।”
জমিদার বলিলেন, “বামুনমারীর মাঠে আপনার যে পঞ্চাশ বিঘা ব্রহ্মোত্তর ভূমি আছে, জরিপে তাহা পঞ্চান্ন বিঘা হইয়াছে। আপনার দলিলপত্র ভাল আছে, সে জন্য সবটুকু ভূমি আমি কাড়িয়া লইতে বাসনা করি না, তবে মাপে যেটুকু অধিক হইয়াছে, সেটুকু আমার প্রাপ্য।”নিরঞ্জন উত্তর করিলেন, “আজ্ঞা, হাঁ মহাশয়, দলিলপত্র আমার ভাল আছে। দেখুন দেখি, এই কাগজখানি কি না।”
জনার্দন চৌধুরী কাগজখানি হাতে লইয়া বলিলেন, “হাঁ এই কাগজখানি বটে, ইহা আমি পূর্বে দেখিয়াছি, এখন আর দেখিবার আবশ্যক নাই।”
এই কথা বলিয়া নিরঞ্জনের হাতে তিনি কাগজখানি ফিরাইয়া দিলেন। নিরঞ্জন কাগজখানি তামাক খাইবার আগুনের মালসায় ফেলিয়া দিলেন। দেখিতে দেখিতে কাগজখানি জ্বলিয়া উঠিল।
জমিদার বলিলেন, “হাঁ হাঁ, করেন কি, করেন কি?”নিরঞ্জন বলিলেন, “কেবল পাঁচ বিঘা কেন? আজ হইতে আমার সমুদয় ব্রহ্মোত্তর আপনার। যিনি জীব দিয়াছেন, নিরঞ্জনকে তিনি আহার দিবেন।”
পাছে ব্রহ্মশাপে পড়েন, সেজন্য জনার্দন চৌধুরীর ভয় হইল। তিনি বলিলেন, “দলিল গিয়াছে গিয়াছে, তাহাতে কোনও ক্ষতি নাই। আপনি ভূমি ভোগ করুন, আপনাকে আমি কিছু বলিব না।”
নিরঞ্জন উত্তর করিলেন, “না মহাশয়। জীব যিনি দিয়াছেন, আহার তিনি দিবেন। সেই দীনবন্ধুকে ধ্যান করিয়া তাঁহার প্রতি জীবন সমর্পণ করিয়া কালাতিপাত করাই ভাল। আমার ভূমি ছিল বলিয়াই তো আজ দুই প্রহরের সময় আপনার পেয়াদার নিষ্ঠুর বচন আমাকে শুনিতে হইল? সুতরাং সে ভূমিতে আর আমার কাজ নাই।” এই কথা বলিয়া নিরঞ্জন প্রস্থান করিলেন।নিরঞ্জনের সেই দিন হইতে অবস্থা মন্দ হইল। অতি কষ্টে তিনি দিনাতিপাত করিতে লাগিলেন। ছাত্রগণ একে একে তাঁহাকে ছাড়িয়া গোবর্ধন শিরোমণির চতুষ্পাঠিতে গেল।
গোবর্ধন শিরোমণি জনার্দন চৌধুরীর সভা-পন্ডিত। অনেকগুলি ছাত্রকে তিনি অন্নদান করেন। বিদ্যাদান করিবার তাঁহার অবকাশ নাই। চৌধুরী মহাশয়ের বাটিতে সকাল সন্ধ্যা উপস্থিত থাকিতে হয়, তাহা ব্যতীত অধ্যাপকের নিমন্ত্রণে সর্বদা তাঁহাকে নানা স্থানে গমনাগমন করিতে হয়। সুতরাং ছাত্রগণ আপনা-আপনি বিদ্যা শিক্ষা করে।সে জন্য কিন্তু কেহ দুঃখিত নয়। গোবর্ধন শিরোমণির উপর রাগ হয় না, অভিমানও হয় না। কারণ, তিনি অতি মধুরভাষী, বাক্যসুধা দান করিয়া সকলকেই পরিতুষ্ট করেন। বিশেষতঃ ধনবান লোক পাইলে শ্রাবণের বৃষ্টিধারায় তিনি বাক্যসুধা বর্ষণ করিতে থাকেন। তৃষিত চাতকের ন্যায় তাহারা সেই সুধা পান করেন।
একদিন জনার্দন চৌধুরীর বাটিতে আসিয়া তনু রায় শাস্ত্রবিচার করিতেছিলেন। নিরঞ্জন, গোবর্ধন প্রভৃতি সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
তনু রায় বলিলেন, “কন্যাদান করিয়া বংশজ কিঞ্চিৎ সম্মান গ্রহণ করিবে। শাস্ত্রে ইহার বিধি আছে”।নিরঞ্জন জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোন শাস্ত্রে আছে? এরূপ, শুল্ক গ্রহণ করা তো ধর্মশাস্ত্রে একেবারেই নিষিদ্ধ”।
গোবর্ধন চুপি চুপি বলিলেন, “বল না, মহাভারতে আছে।”
তনু রায় তাহা শুনিতে পাইলেন না। ভাবিয়া চিন্তিয়া বলিলেন, “দাতাকর্ণে আছে”।
এই কথা শুনিয়া নিরঞ্জন একটু হাসিলেন। নিরঞ্জনের হাসি দেখিয়া তনু রায়ের রাগ হইল।
নিরঞ্জন বলিলেন, রায় মহাশয়, “আপনি শাস্ত্র জানেন না, শাস্ত্র পড়েন নাই।”তনু রায় আর রাগ সংবরণ করিতে পারিলেন না। নিরঞ্জনের প্রতি নানা কটু কথা প্রয়োগ করিয়া অবশেষে বলিলেন, “আমি শাস্ত্র পড়ি নাই? ভাল, কিসের জন্য আমি পরের শাস্ত্র পড়িব? যদি মনে করি তো আমি নিজে কত শাস্ত্র করিতে পারি। যে নিজে শাস্ত্র করিতে পারে, সে পরের শাস্ত্র কেন পড়িবে?”
নিরঞ্জনকে এইবার পরাস্ত মানিতে হইল। তাঁহাকে স্বীকার করিতে হইল যে, যে লোক নিজে শাস্ত্র প্রণয়ন করিতে পারে, পরের শাস্ত্র তাহার পড়িবার আবশ্যক নাই।