কঙ্কাবতী - Konkaboti by Troilokyanath Mukhopadhyay, chapter name প্রথম খণ্ড-দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

প্রথম খণ্ড-দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

খেতু

 

তনু রায়ের পাড়ায় একটি দুঃখিনী ব্রাহ্মণী বাস করেন। লোকে তাঁহাকে “খেতুর মা, খেতুর মা” বলিয়া ডাকে। খেতুর মা আজ দুঃখিনী বটে, কিন্তু এক সময়ে তাঁহার অবস্থা ভাল ছিল। তাঁহার স্বামী শিবচন্দ্র মুখোপাধ্যায় লেখাপড়া জানিতেন কলিকাতায় কর্ম করিতেন, দুপয়সা উপার্জন করিতেন।কিন্তু তিনি অর্থ রাখিতে জানিতেন না। পরদুঃখে তিনি নিতান্ত কাতর হইয়া পড়িতেন ও যথাসাধ্য পরের দুঃখ মোচন করিতেন। অনেক লোককে অন্ন দিতেন ও অনেকগুলি ছেলের তিনি লেখাপড়ার খরচ যোগাইতেন।, এরূপ লোকের হাতে পয়সা থাকে না।

অধিক বয়সে তাঁহার স্ত্রীর একটি পুত্র সন্তান হয়। ছেলেটির নাম ক্ষেত্র রাখেন, সেই জন্য তাঁহার স্ত্রীকে সকলেই খেতুর মা বলে।

যখন পুত্র হইল, তখন শিবচন্দ্র মনে করিলেন, এইবার আমাকে বুঝিয়া খরচ করিতে হইবে। আমার অবর্তমানে স্ত্রী পুত্র যাহাতে অন্নের জন্য লালায়িত না হয়, আমাকে সে ব্যবস্থা করিতে হইবে ।মানস হইল বটে, কিন্তু কার্যে পরিণত হইল না। পৃথিবী অতি দুঃখময়। এ দুঃখ যিনি নিজ দুঃখ বলিয়া ভাবেন, চিরকাল তাঁহাকে দরিদ্র থাকিতে হয়।

খেতুর যখন চারি বৎসর বয়স, তখন হঠাৎ তাহার পিতার মৃত্যু হইল। স্ত্রী ও শিশু সন্তানটিকে একেবারে পথে দাঁড় করাইয়া গেলেন। খেতুর বাপ অনেকের উপকার করিয়াছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ এখন বড়লোক হইয়াছেন। কিন্তু এই বিপদের সময় কেহই একবার উঁকি মারিলেন না। কেহই একবার জিজ্ঞাসা করিলেন না যে, খেতুর মা। তোমার হবিষ্যের সংস্থান আছে কি না? এই দুঃখের সময় কেবল রামহরি মুখোপাধ্যায় ইহাদের সহায় হইলেন।রামহরি ইহাদের জ্ঞাতি, কিন্তু দুরসম্পর্ক। খেতুর বাপ তাঁহার একটি সামান্য চাকরি করিয়া দিয়াছিলেন। দেশে অভিভাবক নাই, সে জন্য কলিকাতায় তাঁহাকে পরিবার লইয়া থাকিতে হইয়াছে। যে কয়টি টাকা পান, তাহাতেই কষ্টে সৃষ্টে দিনপাত করেন। তিনি কোথায় পাইবেন? তবুও যাহা কিছু পারিলেন, বিধবাকে দিলেন ও চাঁদার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরিলেন। খেতুর বাপের খাইয়া যাহারা মানুষ, আজ তাহারা রামহরিকে কতই না ওজর আপত্তি অপমানের কথা বলিয়া দুই এক টাকা চাঁদা দিল। তাহাতেই খেতুর বাপের তিল-কাঞ্চন করিয়া শ্রাদ্ধ হইল। চাঁদার টাকা হইতে যাহা কিছু বাঁচিল, রামহরি তাহা দিয়া খেতুর মা ও খেতুকে দেশে পাঠাইয়া দিলেন।দেশে পাঠাইয়া দুঃখিনী বিধবাকে তিনি চাউলের দামটি দিতেন। অধিক আর দিতে পারিতেন না। ব্রাহ্মণী পইতা কাটিয়া কোনো মতে কুলান করিতেন। দেশে বান্ধব কেহই ছিল না। নিরঞ্জন কবিরত্ন কেবল মাত্র ইহাদের দেখিতেন শুনিতেন। বিপদে আপদে তিনিই বুক দিয়া পড়িতেন। খেতুর মার এইরূপ কষ্টে দিন কাটিতে লাগিল। ছেলেটি শান্ত সুবোধ অথচ সাহসী ও বিক্রমশীল হইতে লাগিল। তাহার রূপ-গুণে, স্নেহ-মমতায়, মা সকল দুঃখ ভুলিলেন। ছেলেটি যখন সাত বৎসরের হইল, তখন রামহরি দেশে আসিলেন।

খেতুর মাকে তিনি বলিলেন, “খেতুর এখন লেখাপড়া শিখিবার বয়স হইল, আর ইহাকে এখানে রাখা হইবে না। আমি ইহাকে কলিকাতায় লইয়া যাইতে ইচ্ছা করি। আপনার কি মত?”খেতুর মা বলিলেন, “বাপরে। তাহা কি কখনও হয়? খেতুকে ছাড়িয়া আমি কি করিয়া থাকিব? নিমিষের নিমিত্তও খেতুকে চক্ষুর আড় করিয়া আমি জীবিত থাকিতে পারিব না। না বাছা। এ প্রাণ থাকিতে আমি খেতুকে কোথাও পাঠাইতে পারিব না।”

রামহরি বলিলেন, “দেখুন, এখানে থাকিলে খেতুর লেখাপড়া হইবে না। মথুর চক্রবর্তীর অবস্থা কি ছিল জানেন তো? গাজনের শিবপূজা করিয়া অতি কষ্টে সংসার প্রতিপালন করিত। ‘গাজুনে বামুন’ বলিয়া সকলে তাহাকে ঘৃণা করিত। তাহার ছেলে আপনার বাসায় দিন কতক রাঁধুনী বামুন থাকে। অল্পবয়স্ক বালক দেখিয়া শিবকাকার দয়া হয়, তিনি তাহাকে স্কুলে দেন। এখন সে উকিল হইয়াছে। এখন সে একজন বড়লোক। পুরুষ মানুষে লেখা-পড়া না শিখিলে কি চলে?”খেতুর মা বলিলেন, “হাঁ সত্য কথা। তবে বুঝিয়া দেখ, আমার মার প্রাণ, আমি অনাথিনী সহায়হীনা বিধবা। পৃথিবীতে আমার কেহ নাই, এই এক রতি ছেলেটিকে লইয়া সংসারে আছি। খেতুকে আমি নিমেষে হারাই। খেলা করিয়া ঘরে আসিতে খেতুর একটু বিলম্ব হইলে, আমি যে কত কি কু ভাবি, তাহা আর কি বলিব?”

রামহরি বলিলেন, “খুড়ী-মা। ভয় করিবেন না। আমার নিজের ছেলের চেয়েও আমি খেতুর যত্ন করিব। শিবকাকার আমি অনেক খাইয়াছি। তাঁহার অনুগ্রহে আজ পরিবারবর্গকে এক মুঠা অন্ন দিতেছি। আজ তাঁহার ছেলে যে মূর্খ হইয়া থাকিবে, তাহা প্রাণে সহ্য হইবে না। খেতু কেমন আছে কেমন লেখাপড়া করিতেছে, সে বিষয়ে আমি সর্বদা আপনাকে পত্র লিখিব। আবার, খেতু যখন চিঠি লিখিতে শিখিবে, তখন সে নিজে আপনাকে চিঠি লিখিবে। পূজার সময়ও গ্রীষ্মের ছুটির সময় খেতুকে দেশে পাঠাইয়া দিব। বৎসরের মধ্যে দুই তিন মাস সে আপনার নিকট থাকিবে। আজ আমি এখন যাই আজ শুক্রবার। বুধবার ভাল দিন। সেইদিন খেতুকে লইয়া কলিকাতায় যাইব।”