প্রথম খণ্ড- প্রথম পরিচ্ছেদ
তনু রায়
শ্রীযুক্ত রামতনু রায় মহাশয়ের বাস কুসুম-ঘাটী। রামতনু রায় বলিয়া কেহ তাঁহাকে ডাকে না, সকলে তাঁহাকে “তনু রায়” বলে। ইনি ব্রাহ্মণ, বয়স হইয়াছে। ব্রাহ্মণের যাহা কিছু কর্তব্য, তাহা ইনি যথাবিধি করিয়া থাকেন। ত্রিসন্ধ্যা করেন, শ্রাদ্ধতর্পণাদি করেন, দেবগুরুকে ভক্তি করেন, দলাদলি লইয়া আন্দোলন করেন। এখনকার লোকে ভাল করিয়া ধর্মকর্ম করে না বলিয়া রায় মহাশয়ের মনে বড় রাগ।
রায় মহাশয় নিজে বংশজ ব্রাহ্মণ। তিনি বলেন, “বিধাতা যখন আমাকে বংশজ করিয়াছেন, তখন বংশজের ধর্মটি আমাকে রক্ষা করিতে হইবে। যদি না করি, তাহা হইলে বিধাতার অপমান করা হইবে, আমার পাপ হইবে, আমাকে নরকে যাইতে হইবে। যদি বল বংশজের ধর্মটি কি? বংশজের ধর্ম এই যে কন্যাদান করিয়া পাত্রের নিকট হইতে কিঞ্চিৎ ধন গ্রহণ করিবে। বংশজ হইয়া যিনি এ কার্য না করেন, তাঁহার ধর্মলোপ হয়, তিনি একেবারেই পতিত হন।”
তনু রায় প্রকৃতই অতি উচ্চদরের বংশজ। তবে, তাঁহার বংশের বিবাহাদি সম্পর্কে কিছু কিছু পরিহাস প্রচলিত আছে। শোনা যায়, ইহার নিজের বিবাহের সময়ও কিছু গোলযোগ হইয়াছিল। “পাঁচ শত টাকা পণ দিব” বলিয়া একটি কন্যা স্থির করিলেন। পৈতৃক ভূমি বিক্রয় করিয়া সেই টাকা সংগ্রহ করিলেন। বিবাহের দিন উপস্থিত হইলে সেই টাকাগুলি লইয়া বিবাহ করিতে গেলেন। কন্যার পিতা টাকাগুলি গণিয়া ও বাজাইয়া লইলেন। বিবাহের লগ্ন উপস্থিত হইল কিন্তু তবুও তিনি কন্যা-সম্প্রদান করিতে তৎপর হইলেন না। কেন বিলম্ব করিতেছেন, কেহ বুঝিতে পারে না। অবশেষে, তিনি নিজেই খুলিয়া বলিলেন, “পাত্রের এত অধিক বয়স হইয়াছে, তাহা আমি বিবেচনা করিতে পারি নাই। এক্ষণে আর এক শত টাকা না পাইলে কন্যাদান করিতে পারি না।”
কন্যাকর্তার এই কথায় বিষম গোলযোগ উপস্থিত লইল। সেই গোলযোগে লগ্ন অতীত হইয়া গেল, রাত্রি প্রায় অবসান হইল। যখন প্রভাত হয় হয়, তখন পাঁচজনে মধ্যস্থ হইয়া এই মীমাংসা করিয়া দিলেন যে, রায় মহাশয়কে আর পঞ্চাশটি টাকা দিতে হইবে। খত লিখিয়া তনু রায় আর পঞ্চাশ টাকা ধার করিলেন ও কন্যার পিতাকে তাহা দিয়া বিবাহ-কার্য সমাধা করিলেন। বাসর-ঘরে গাহিবেন বলিয়া,তনু রায় অনেকগুলি গান শিখিয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু সব বৃথা হইল। কারণ, বাসর হয় নাই, রাত্রি প্রভাত হইয়া গিয়াছিল। এ দুঃখ তনু রায়ের মনে চিরকাল ছিল।
এক্ষণে তনু রায়ের তিনটি কন্যা ও একটি পুত্রসন্তান। কুলধর্ম রক্ষা করিয়া দুইটি কন্যাকে তিনি সুপাত্রে অর্পণ করিয়াছিলেন। জামাতারা তনু রায়ের সম্মান রাখিয়াছিলেন। কেহ পাঁচ শত, কেহ হাজার গণিয়া দিয়াছিলেন। কাজেই সুপাত্র বলিতে হইবে।
সম্মান কিছু অধিক পাইবেন বলিয়া রায় মহাশয় কন্যা দুইটিকে বড় করিয়া বিবাহ দিয়াছিলেন। তিনি বলিতেন, অল্প বয়সে বিবাহ দিলে কন্যা যদি বিধবা হয়, তাহা হইলে সে পাপের দায়ী কে হইবে? কন্যা বড় করিয়া বিবাহ দিবে। কুলীন ও বংশজের তাহাতে কোন দোষ নাই। ইহা শাস্ত্রে লেখা আছে।
তনু রায়ের জামাতা দুইটির বয়স নিতান্ত কচি ছিল না। ছেলে মানুষ বরকে তিনি দুটি চক্ষু পাড়িয়া দেখিতে পারেন না। তাহারা একশত কি দুই শত টাকায় কাজ সারিতে চায়। তাই একটু বয়স্ক পাত্র দেখিয়া কন্যা দুইটির বিবাহ দিয়াছিলেন। এক জনের বয়স হইয়াছিল সত্তর, আর এক জনের পঁচাত্তর।
জামাতাদিগের বয়সের কথায় পাড়ার মেয়েরা কিছু বলিলে, তনু রায় সকলকে বুঝাইতেন “ওগো। তোমরা জান না, জামাইয়ের বয়স একটু পাকা হইলে মেয়ের আদর হয়।” জামাতাদিগের বয়স কিছু অধিক পাকিয়াছিল। কারণ, বিবাহের পর বৎসর ফিরিতে না ফিরিতে দুইটি কন্যাই বিধবা হয়।
তনু রায় জ্ঞানবান লোক। জামাতাদিগের শোকে একেবারে অধীর হন নাই। মনকে তিনি এই বলিয়া প্রবোধ দিয়া থাকেন, বিধাতার ভবিতব্য। কে খণ্ডাতে পারে? কত লোক যে বার বৎসরের বালকের সহিত পাঁচ বৎসরের বালিকার বিবাহ দেয়, তবে তাহাদের কন্যা বিধবা হয় কেন? যাহা কপালে থাকে, তাহাই ঘটে। বিধাতার লেখা কেহ মুছিয়া ফেলিতে পারে না!
তনু রায়ের পুত্রটি ঠিক বাপের মত। এখন তিনি আর নিতান্ত শিশু নন, পঁচিশ পার হইয়াছেন। লেখাপড়া হয় নাই, তবে পিতার মত শাস্ত্রজ্ঞান আছে। পিতা কন্যাদান করিয়া অর্থসঞ্চয় করিতেছেন, সে জন্য তিনি আনন্দিত, নিরানন্দ নন। কারণ পিতার তিনিই একমাত্র বংশধর। বিধবা কয়টা আর কে বল?
তনু রায়ের স্ত্রী কিন্তু অন্য প্রকৃতির লোক। এক-একটি কন্যার বিবাহ হয়, আর পাত্রের রূপ দেখিয়া তিনি কান্নাকাটি করেন। তনু রায় তখন তাহাকে অনেক ভৎর্সনা করেন, আর বলেন, “মনে করিয়া দেখ দেখি, তোমার বাপ কি করিয়াছিলেন?” এইরূপ নানা প্রকার খোঁটা দিয়া তবে তাঁহাকে সান্ত্বনা করেন। কন্যাদিগের বিবাহ লইয়া স্ত্রীপুরুষের চিরবিবাদ। বিধবা কন্যা দুইটির মুখপানে চাহিয়া সদাই চক্ষের জলে মায়ের বুক ভাসিয়া যায়। মেয়েদের সঙ্গে মাও এক প্রকার একাদশী করেন। একাদশীর দিন কিছুই খান না, তবে স্বামীর অকল্যাণ হইবার ভয়ে, কেবল একটু একটু জল পান করেন।
প্রতিদিন পূজা করিয়া একে একে সকল দেবতাদিগের পায়ে তিনি মাথা খুঁড়েন, আর তাঁহাদের নিকট প্রার্থনা করেন যে, হে মা কালী। হে মা দুর্গা। হে ঠাকুর। যেন আমার কঙ্কাবতীর বরটি মনের মত হয়। কঙ্কাবতী তনু রায়ের ছোট কন্যা। এখনও নিতান্ত শিশু।