দ্বিতীয় পর্ব : দ্য মিউল - ১৭. দ্য ভিজি সোনার
টার্মিনাস সিটির মোটামুটি অখ্যাত অঞ্চলে অবস্থিত এবলিং মিস এর বাসস্থান ফাউণ্ডেশন-এর বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, শিক্ষিত সমাজ এবং সাধারণ পাঠকপাঠিকার কাছে বহুল পরিচিত। এর অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য নির্ভর করে মূলত কী পড়া হচ্ছে তার উপর। একজন মননশীল বায়োগ্রাফার এর মতে এটা হল “নন-একাডেমিক রিয়েলিটিতে ফিরে আসার চমৎকার নিদর্শন, একজন সোসাইটি কলামিস্ট বিরুপভাবে মন্তব্য করেছিল, “এলোমেলো এবং ভীষণরকম পুরুষালি,” বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পিএইচডি-র মতে, “বুকিশ, বাট আনঅর্গানাইজড,” বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে এক বন্ধুর মতে, “যখন তখন একটা ড্রিংক নেওয়ার জন্য আদর্শ এবং তুমি সোফার উপর পা তুলে বসতে পারবে,” হালকা মেজাজের চটকদার এক রঙিন সাপ্তাহিক পত্রিকার মতে “পাথুরে রুক্ষ এবং বামপন্থী উগ্ৰস্বভাবের এবলিং মিস এর বাসস্থান হিসেবে চমঙ্কার মানিয়ে যায়।”
বেইটার কাছে, যে প্রথমবারের মতো এখানে এসেছে তার কাছে শুধুই নোংরা।
প্রথম কয়েকটা দিন বাদ দিয়ে বন্দিদশা বেশ হালকাই মনে হয়েছে। বোধহয় এখন সাইকোলজিস্ট-এর বাড়িতে অপেক্ষা করার চাইতেও হালকা। অন্তত সেই সময় তো টোরান সাথে ছিল–
হয়তো উদ্বেগ তাকে ক্লান্ত করে তুলত যদি না বুঝতে পারত যে ম্যাগনিফিসো তার চেয়ে অনেক বেশি অস্থির হয়ে আছে।
থ্যাবড়ানো চিবুকের নিচে পাইপের মতো সরু পাগুলো ভাঁজ করে রেখেছে ম্যাগনিফিসো। যেন কুণ্ডুলী পাকিয়ে নিজেকে নেই করে ফেলার চেষ্টা করছে। নিজের অজান্তেই আশ্বস্ত করার জন্য কোমল হাত বাড়াল বেইটা। সঙ্কুচিত হয়ে গেল ম্যাগনিফিসো, তারপর হাসল।
“সত্যি, মাই লেডি, মনে মনে বুঝতে পারলেও এখনো আমার দেহ কাউকে হাত বাড়াতে দেখলে শুধু আঘাতের প্রত্যাশা করে।”
“চিন্তা করো না, ম্যাগনিফিসো। আমি যতক্ষণ আছি কেউ তোমাকে আঘাত করতে পারবে না।”
আড়চোখে তার দিকে তাকাল ক্লাউন, তারপর দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল, “কিন্তু ওরা আমাকে আপনার কাছে যেতে দেয়নি-এবং আপনার ভালোমানুষ স্বামীর কাছে–আর কথা বলতে দেয়নি আমাকে, আপনি শুনলে হয়তো হাসবেন, কিন্তু আমার খুব একা একা লেগেছে।”
“হাসব না। আমারও একই রকম লেগেছে।”
ম্যাগনিফিসোর চেহারা উজ্জ্বল হল, হাঁটু দুটো জড়িয়ে ধরল আরো শক্ত করে। “এই লোকটাকে আপনি আগে কখনো দেখেন নি?” সতর্কভাবে প্রশ্নটা করল সে।
“না। কিন্তু উনি বিখ্যাত লোক। নিউজকাস্টে আমি উনাকে দেখেছি, অনেক কথা শুনেছি। আমার মনে হয় উনি ভালোমানুষ, ম্যাগনিফিসো এবং আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না।”
“কী জানি?” ক্লাউনের চোখে অস্বস্তি। “হতে পারে, মাই লেডি, আমাকে সে আগেও অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেছে, কেমন যেন রাগী আর কর্কশ, আমার ভয় লাগে। কথা বার্তা সব অদ্ভুত ধরনের, ফলে কোনো প্রশ্নের উত্তরই আমার গলা দিয়ে বেরোয় না। যেন অনেকদিন আগে শোনা গল্পের মতোই কলিজা আটকে শ্বাসনালী বন্ধ হয়ে কথা বেরনো বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো।”
“কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। আমরা দুজন, সে একা। আমাদের দুজনকেই সে একসাথে ভয় দেখাতে পারবে না, পারবে?”
“না, মাই লেডি।”
কোথাও একটা দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেল, পুরুষালি কণ্ঠের জোরালো তর্জন গর্জন প্রবেশ করল বাড়ির ভিতরে। এই কামড়ার দরজার ঠিক বাইরে তর্জন গর্জন পরিণত হল বোধগম্য কড়া এক ধমকে, “বেরোও এখান থেকে!” এবং দরজা খোলার সময় এক ঝলক দেখা গেল যে দুজন গার্ড পিছিয়ে যাচ্ছে।
চোখ মুখ কুঞ্চিত করে ভেতরে ঢুকল এবলিং মিস, যত্নের সাথে প্যাকেট করা একটা বাণ্ডিল মেঝেতে নামিয়ে রাখল, তারপর এগোলো বেইটার দিকে, করমর্দনের সময় চেষ্টা করল বেইটার হাত গুঁড়িয়ে দেওয়ার কিন্তু বেইটাও পুরুষালি ভঙ্গিতে সমান তালে জবাব দিল। ক্লাউনের উপর প্রয়োগ করল দ্বিগুণ শক্তি।
“বিবাহিত?” বেইটাকে জিজ্ঞেস করল সে।
“হ্যাঁ। পুরোপুরি আইনগত আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে।
একটু নীরব থেকে পুনরায় জিজ্ঞেস করল, “সুখী?”
“তা বলা যায়।”
শ্রাগ করল মিস, এবং আবার ঘুরল ম্যাগনিফিসোর দিকে। প্যাকেটের মোড়ক খুলে জিজ্ঞেস করল, “এটা চিনতে পেরেছে, খোকা?”
প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে অসংখ্য চাবিযুক্ত যন্ত্রটা ছিনিয়ে নিল ম্যাগনিফিসো। আঙুল বুলাতে লাগল নবের মতো দেখতে অসংখ্য কন্টাক্টের উপর, তারপর খুশির চোটে উল্টো ডিগবাজি দিয়ে একটা চেয়ার প্রায় ভেঙে ফেলল।
“ভিজি সোনার, চেঁচিয়ে উঠল আনন্দে, “এমনকি মরা মানুষের হৃদয়কেও আনন্দিত করে তুলতে পারে।” পরম আদরে চাবিগুলোর উপর আঙুল বোলাতে লাগল, দু-একটা কন্টাক্টে চাপ দিচ্ছে হালকাভাবে, মাঝে একটা কি দুটো চাবির উপর আঙুল থামিয়ে রাখছে-এবং তাদের সামনের বাতাসে ঠিক দৃষ্টিসীমার ভেতরে একটা কোমল গোলাপি আভা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
এবলিং মিস বলল, “ঠিক আছে, খোকা, তুমি বলেছ এ ধরনের গেজেট বাজাতে পারো। তোমাকে সুযোগ দিলাম। একটু টিউন করে নাও, কারণ এটাকে জাদুঘর থেকে নিয়ে এসেছি।” তারপর বেইটার কানে কানে বলল, “ফাউণ্ডেশন-এর কেউ এটা ঠিকমতো বাজাতে পারে না।”
সামনে ঝুঁকে দ্রুত বলল, “আপনাকে ছাড়া ক্লাউন কথা বলবে না। আপনি সাহায্য করবেন?”
মাথা নাড়ল বেইটা।
“গুড। ভয় ওর মনের ভেতর পাকাঁপোক্ত আসন গেড়ে বসেছে, এবং আমার সন্দেহ ওর মেন্টাল স্ট্রেন্থ সাইকিক প্রোবের মোকাবেলা করতে পারবে না। ওর কাছ থেকে কথা আদায় করতে হলে, পুরোপুরি আশ্বস্ত করে তুলতে হবে। বুঝতে পেরেছেন?”
আবার মাথা নাড়ল বেইটা।
“ভিজি সোনার হচ্ছে প্রথম পদক্ষেপ। ও আমাকে বলেছে যে সে বাজাতে পারে; আর এখনকার উচ্ছ্বাস দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এটা ওর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের বিষয়গুলোর একটা। কাজেই ভালোমন্দ যেমনই বাজাক আমরা আগ্রহ নিয়ে শুনব এবং প্রশংসা করব। তারপর এমন ভাব দেখাবেন যে আপনি আমার বন্ধু এবং আমাকে বিশ্বাস করেন। সবচেয়ে বড় কথা প্রতিটা ক্ষেত্রে আমার কথা মেনে চলবেন।” দ্রুত একবার ম্যাগনিফিসোর দিকে তাকাল, ক্লাউন সোফার কোণা ঘেষে বসে দ্রুত হাতে যন্ত্রের ভেতরে কিছু অ্যাডজাস্টমেন্ট করছে, নিজের কাজে পুরোপুরি মগ্ন।
মিস স্বাভাবিক আলাপচারিতার সুরে বেইটাকে বলল, “ভিজি সোনার এর বাজনা কখনো শুনেছেন?”
“একবার,” একই রকম স্বাভাবিক সুরে বলল বেইটা, “দুর্লভ বাদ্যযন্ত্রের একটা কনসার্টে গিয়েছিলাম, সেখানে। খুব একটা ভালো লাগেনি।”
“আপনি ভালো বাদকের বাজনা শুনেছেন কিনা আমার সন্দেহ আছে। ভালো বাদকের সংখ্যা খুব কম। এটা বাজাতে যে খুব বেশি শারীরিক সামর্থের প্রয়োজন হয় তা না-বরং একটা মাল্টি ব্যাঙ্ক পিয়ানো বাজাতে প্রয়োজন হয় অনেক বেশি-এটার জন্য প্রয়োজন হয় বিশেষ ধরণের স্বাধীন মানসিকতা।” তারপর নিচু গলায় বলল, “সেইজন্যই মনে হয় এই জীবিত কংকাল আমাদের ধারণার চাইতে অনেক বেশি ভালো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে বাজনা ভালো বাজাতে জানলেও বুদ্ধিশুদ্ধির বেশ ঘাটতি থাকে। এই অস্বাভাবিক সেটআপের কারণেই সাইকোহিস্টোরি বিষয়টা এত আকর্ষণীয়।”
হালকা আলাপচারিতা চালু রাখার জন্য যোগ করল, “কীভাবে কাজ করে আপনি জানেন? আমি যতদুর বুঝতে পেরেছি যে রেডিয়েশন মস্তিষ্কের অপটিক নার্ভ স্পর্শ না করেই অপটিক সেন্টার উদ্দীপ্ত করে তোলে। আসলে এটা এমন একটা অনুভূতি স্বাভাবিক অবস্থায় যা আমরা কখনো বুঝতে পারি না। সত্যিই তুলনাহীন। যা শুনবেন ওতে কোনো সমস্যা নেই। একেবারেই সাধারণ। কিন্তু-শশশ! ও তৈরি। পা দিয়ে ওই সুইচটা বন্ধ করে দিন। অন্ধকারে কাজ করে ভালো।”
অন্ধকারে ম্যাগনিফিসোকে মনে হল বিন্দুর মতো, পাশে এবলিং মিস এর ভারি নিশ্বাস পতনের শব্দ হচ্ছে। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে দেখার চেষ্টা করল বেইটা, লাভ হল না। ঘরের বাতাসে একটা তীক্ষ্ণ সুর ভেসে উঠল, কেঁপে কেঁপে সুরের মাত্রা ক্রমশ বাড়ছে, টলমল করে ভেসে থাকল বাতাসে, আবার ঝপ করে নেমে গেল নিচু মাত্রায়। তারপর অকস্মাৎ বজ্রপাতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল, যেন হ্যাঁচকা টানে সামনে থেকে সরে গেল একটা পর্দা।
ছোট একটা বহুরঙা গ্লোব ভেসে উঠল বাতাসে, মাঝপথে এসে বিস্ফোরিত হয়ে আকৃতি হারালো, ভেসে উঠে গেল উপরে, ধীরে ধীরে নিচে নামল পরস্পর যুক্ত ছোট ছোট পতাকার আকৃতি নিয়ে। তারপর আকৃতি বদলে পরিণত হল ছোট ছোট বৃত্তে, প্রতিটা ভিন্ন রঙের-এবং প্রতিটা বস্তু আলাদাভাবে চিনতে শুরু করল বেইটা।
বেইটা লক্ষ্য করল চোখ বন্ধ করলে রঙের প্যাটার্ন ভালোভাবে বোঝা যায়; রঙের প্রতিটা পরিবর্তনের মূল কারণ হল শব্দের নির্দিষ্ট প্যাটার্ন; রংগুলোকে সে চিনতে পারছে না; এবং সবার শেষে গ্লোবগুলো আর গ্লোব থাকল না, হয়ে গেল ছোট ছোট আকৃতি।
ছোট ছোট আকৃতি; ছোট ছোট পরিবর্তনশীল শিখা, অগণিত অসংখ্য নেচে বেড়াচ্ছে ঝলকাচ্ছে; ছুটে বেড়িয়ে যাচ্ছে দৃষ্টিসীমার বাইরে, আবার ফিরে আসছে; ছুটে গিয়ে একটা আরেকটার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে তৈরি করছে নতুন রং।
অনেকটা সামঞ্জস্যহীনভাবেই বেইটার মনে পড়ল রাতের বেলায় জোরে চোখের পাতা চেপে বন্ধ করে রাখলে যে রঙিন ফুটকি ভেসে উঠে তার কথা। সামনে নেচে বেড়ানো পরিবর্তনশীল রঙের বিন্দুগুলো ঠিক তাই, বিন্দুগুলো হঠাৎ হঠাৎ কেঁপে উঠছে।
বিন্দুগুলো জোড়ায় জোড়ায় এগিয়ে এল তার দিকে, দম বন্ধ করে একটা হাত তুলল সে, কিন্তু দুড়দাড় করে সেগুলো ছুটে পালাল। হঠাৎ করে নিজেকে সে আবিষ্কার করল একটা উজ্জ্বল তুষার ঝড়ের মাঝে, অনুভব করল ঠাণ্ডা আলো পিছলে নেমে যাচ্ছে কাঁধ বেয়ে, চকচকে স্কি-স্লাইডের মতো বাহু ধরে নেমে এসে চুমো খেলো শক্ত হয়ে যাওয়া আঙুলে এবং ছুটে গিয়ে বাতাসের মাঝখানে ভেসে থাকল উজ্জ্বল আলোর মতো। নিচ থেকে ভেসে আসছে শত শত বাদ্যযন্ত্রের সুমধুর সঙ্গীত, বুঝতে কিছুটা সময় লাগল এই সঙ্গীত তৈরি হচ্ছে সামনের জমাট আলোর বৃত্ত থেকে।
বিস্মিত হয়ে ভাবলো এবলিং মিস কি একই জিনিস দেখছে, যদি না দেখে কী দেখছে সে। বিস্ময় দূর হয়ে গেল, এবং, তারপর–
আবার দেখছে সে। ছোট ছোট আকৃতি-আসলেই কী কোনো আকৃতি?–ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রমণী দেহ, মাথার চুল আগুনরঙা, চোখের পলক ফেলার আগেই দ্রুত কুর্নিশ করছে? পরস্পরের হাত ধরে তৈরি করল কয়েকটা নক্ষত্রের আকৃতি-সঙ্গীত পরিণত হল হাসির ধ্বনিতে-ঠিক কানের ভেতরে বেজে উঠল রমণীর খিলখিল হাসি।
নক্ষত্রগুলো কাছাকাছি হল, পরস্পরের দিকে আলো ছুঁড়ে দিয়ে খেলা করতে লাগল, ধীরে ধীরে তৈরি করল একটা কাঠামো-এবং নিচ থেকে দ্রুত গতিতে উপরে উঠতে লাগল একটা প্রাসাদ। প্রাসাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইটগুলো প্রতিটা ভিন্ন রঙের, প্রতিটা রং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিদ্যুৎ চমকের মতে, প্রতিটা বিদ্যুৎ চমক তীব্র আলোর মতো পথ দেখিয়ে দৃষ্টিকে নিয়ে গেল উপরের রত্নখচিত বিশটা মিনারের দিকে।
একটা উজ্জ্বল কার্পেট ছুটে বেরিয়ে এল, ঘুরছে, পাক খাচ্ছে, ঢেউ তুলে একটা জাল তৈরি করে ঢেকে দিল সামনের জায়গাটুকু, তার মধ্যে থেকে একটা উজ্জ্বল আভা শা করে উপরের দিকে ছুটে গিয়ে গাছ তৈরি করল, যে গাছ গাইতে লাগল সম্পূর্ণ নিজস্ব এক সঙ্গীত।
বেইটা এক ঘেরাওয়ের মাঝে বসে আছে। তাকে ঘিরে অবিরত উপচে পড়ছে সুর আর ছন্দ। হাত বাড়িয়ে ভঙ্গুর একটা গাছ ছুঁলো সে এবং সেটা ভেসে উঠে টুংটাং ধ্বনির সাথে খসে পরল।
এবার শুরু হল বিশটা মন্দিরার ঐকতান, এবং তার সামনে কিছু অংশ জুড়ে একটা অগ্নিপ্রভা জ্বলে উঠল এবং তার কোল পর্যন্ত একটা অদৃশ্য সিঁড়ি তৈরি করে অবিরত বিদ্যুৎ শিখার মতো ছলকে উঠল, অগ্নিশিখা লাফিয়ে উঠল কোমর পর্যন্ত এবং কোল ঘিরে তৈরি করল রংধনুর মতো সাতরঙা সেতু, তার উপর ছোট ছোট আকৃতি
একটা প্রাসাদ, একটা বাগান এবং সেতুর উপর যতদূর দৃষ্টি যায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নর নারী রাজকীয় ভঙ্গিতে নেচে বেড়াচ্ছে আর তার উপর আছড়ে পড়ছে সুমধুর সঙ্গীত।
এবং তারপর আবার নিকষ অন্ধকার।
একটা ভারী পা এগিয়ে গেল পেডালের দিকে; আলোতে ভেসে গেল পুরো কামরা; যেন ক্লান্ত সূর্যের নিষ্প্রভ আলো । চোখ পিট পিট করতে লাগল বেইটা, চোখে পানি না বেরনো পর্যন্ত। তার নিজের কাছে মনে হচ্ছে যেন সাত রাজার ধন হারিয়ে গেছে। আর এবলিং মিস পুরোপুরি স্তম্ভিত।
একমাত্র ম্যাগনিফিসোকে মনে হল জীবন্ত। পরমানন্দে সে তার ভিজি সোনারে হাত বোলাচ্ছে।
“মাই লেডি,” রুদ্ধশ্বাসে বলল সে, “এটার অবশ্যই জাদুকরী ক্ষমতা আছে। কল্পনাকে বাস্তব করে তোলে। এটা দিয়ে আমি আশ্চর্য সব কান্ড ঘটাতে পারি। আমার কম্পোজিশন কেমন লেগেছে, মাই লেডি?”
“এই কম্পোজিশন তোমার?” দম নিল বেইটা। “তোমার নিজের?”
তার বিস্ময় দেখে ক্লাউনের চেহারা নাকের ডগা পর্যন্ত লাল হয়ে গেল। “একেবারে আমার নিজস্ব, মাই লেডি। মিউল পছন্দ করত না, কিন্তু প্রায়ই আমি নিজের জন্য এটা বাজাতাম। অনেকদিন আগে এই প্রাচুর্যময় প্রাসাদটা দেখেছিলাম-একটা মেলার সময় অনেক দূর থেকে। কী তার মহিমা, কী তার গৌরব-আর এত চমৎকার মানুষ আমি পরে আর কখনো দেখিনি, এমনকি মিউলের কাছে থাকার সময়ও না। আমি সত্যিকারভাবে সব ফুটিয়ে তুলতে পারিনি। এটার নাম দিয়েছি, স্বর্গের স্মৃতি।”
আলাপচারিতার মাঝপথে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে নিজেকে সজীব করে তুলল মিস। “শোন,” বলল সে, “তুমি আর সবার সামনে একই রকম করে বাজাতে পারবে?”
এক মুহূর্তের জন্য সংকুচিত হয়ে গেল ক্লাউন, “আর সবার সামনে?” কেঁপে উঠল সে।
“হাজার হাজার মানুষের জন্য, চেঁচিয়ে উঠল মিস, “ফাউণ্ডেশন এর গ্রেট হলে। তুমি নিজের মাস্টার হতে চাও, অঢেল প্রাচুর্য, সম্মান, এবং…এবং-” তার কল্পনা আর বেশিদূর এগোতে পারলো না। “এবং সব কিছু? হ্যাঁহ? কী বলো?”
“কিন্তু আমি এতকিছু কীভাবে হবো, মাইটি স্যার, কারণ, আমি অসহায় এক ক্লাউন, জগতের কোনো বস্তুই আমার কাছে নেই।”
ঠোঁট গোল করে বাতাস ছাড়ল সাইকোলজিস্ট, ভুরু ঘষল হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে। “তোমার বাজনা দিয়ে। মেয়র আর তার বণিকদের এই বাজনা শোনালে জগৎ তোমার পায়ে লুটিয়ে পড়বে। কেমন মনে হচ্ছে?”
ঝট করে বেইটার দিকে একবার তাকাল ক্লাউন, “উনি আমার সাথে থাকবেন?” হাসল বেইটা “অবশ্যই। ঠিক যখন তুমি ধনি আর বিখ্যাত হতে চলেছ তখন কী আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারি?”
“কিন্তু,” সাদামাটা গলায় বলল মিস, “প্রথমে যে একটু সাহায্য করতে হয়—”
“কী রকম?”
একটু দম নিল সাইকোলজিস্ট, এবং হাসল, “একটা ছোট সারফেস পোব, মোটেও ব্যথা লাগবে না।
তীব্র আতঙ্ক ফুটে উঠল ম্যাগনিফিসোর চোখে। না, কোনো ভোব না। ওটার ব্যবহার আমি দেখেছি। মানুষের মাইণ্ড শুষে নিয়ে মাথার খুলির ভেতরটা ফাঁকা করে দেয়। বিশ্বাসঘাতকদের উপর মিউল এটা ব্যবহার করত। পাগল আর উন্মাদ বানিয়ে ছেড়ে দিত রাস্তায়। ওভাবেই বেঁচে থাকত যতদিন না দয়াপরবশ হয়ে মেরে ফেলা হত তাদের।” হাত তুলে মিসকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে সে।
“ওটা ছিল সাইকিক পোব,” ধৈর্য ধরে বোঝাতে লাগল মিস, “এবং শুধুমাত্র ভুলভাবে ব্যবহার করলেই মানুষের ক্ষতি হয়। আমারটা হচ্ছে সারফেস প্রোব, এটা দিয়ে একটা বাচ্চাকেও ব্যথা দেওয়া যাবে না।
কম্পিত একটা হাত বাড়িয়ে ধরল ম্যাগনিফিসো, “আপনি আমার হাত ধরে রাখবেন?”
দুহাত দিয়ে সেটা জড়িয়ে ধরল বেইটা, আর ক্লাউন বিস্ফোরিত চোখে দেখতে পেল বার্ণিশ করা টার্মিনাল প্লেট এগিয়ে আসছে।
.
মেয়র ইণ্ডবার এর ব্যক্তিগত কোয়ার্টারের অতিরিক্ত ব্যয়বহুল চেয়ারে এবলিং মিস নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বসে আছে। তার প্রতি যে সৌজন্য দেখানো হয়েছে ওটা নিয়ে কোনো কৃতজ্ঞতা নেই, বরং বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে আছে অস্থির ছোটখাটো মেয়রের দিকে। টোকা দিয়ে সিগারের ছাই ফেলল সে, থু করে চিবানো তামাক ফেলল মেঝেতে।
“ভালো কথা, ম্যালো হলের আগামী কনসার্টে যদি নতুন কিছু শুনতে চাও তা হলে ইলেকট্রনিক গ্যাজেটিয়ারগুলো যে নর্দমা থেকে এসেছে সেখানে ফেলে দিয়ে আমার ক্লাউনের হাতে একটা ভিজি সোনার তুলে দাও। ইবার-এই বিশ্বে ওর মতো বাজনাদার নেই।”
বিরক্ত হয়ে ইণ্ডবার বললেন, “সঙ্গীতের উপর লেকচার শোনার জন্য তোমাকে ডাকিনি। মিউলের কী হবে? বল। মিউলের কী হবে?”
“মিউল? বেশ, বলছি-সারফেস প্রোব ব্যবহার করে তেমন কিছু বের করতে পারিনি। সাইকিক ভোব ব্যবহার করা সম্ভব না, কারণ জিনিসটাকে ওই ব্যাটা অসম্ভব ভয় পায়, কাজেই কন্টাক্ট হওয়ার সাথে সাথে মেন্টাল ফিউজ উড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আমি যা পেয়েছি, ঢোল বাজানো থামাও তো—”
“প্রথমত মিউলের অতিরিক্ত শারীরিক শক্তির কথা সে বাড়িয়ে বলেছে, এবং সম্ভবত অতিরিক্ত নির্যাতনে মনের ভেতর যে ভয় গেড়ে বসেছে সেটার জন্যই তৈরি করেছে এমন কল্পিত গল্প। মিউল অদ্ভুত ধরণের চশমা পড়ে এবং চোখ দিয়েই মানুষ খুন করতে পারে, পরিষ্কার বোঝা যায় তার মেন্টাল পাওয়ার আছে।”
“প্রথম থেকেই যা আমরা জানি,” তিক্ত গলায় মন্তব্য করলেন মেয়র।
“প্রোব সেটা কনফার্ম করল, আর ঠিক এখান থেকেই আমি ম্যাথমেটিক্যালি কাজ শুরু করেছি।”
“তাই? তো কতদিন লাগবে? তোমার কথা এখনো আমার কানে ঝমঝম করছে।”
“প্রায় একমাস, তখন হয়তো তোমার হাতে কিছু দিতে পারব। আবার নাও দিতে পারতে পারি। কিন্তু তাতে কি? যদি বর্তমান সমস্যা সেলডন প্ল্যানের ভেতরে থাকে তা হলে আমাদের সুযোগ খুবই কম, (ছাপার অযোগ্য) কম।”
হিংস্র ভঙ্গিতে মিস এর দিকে ঘুরলেন ইণ্ডবার, “এইবার তোমাকে পেয়েছি, বিশ্বাস ঘাতক। মিথ্যেবাদী! তুমিও ওই বদমাশগুলোর দলে যারা গুজব ছড়িয়ে ফাউণ্ডেশন-এর ভেতর আতঙ্ক তৈরি করছে, আমার কাজ দ্বিগুণ কঠিন করে তুলছে। অস্বীকার করতে পারবে?”
“আমি? আমি?” ধীরে ধীরে রেগে উঠছে মিস।
“কারণ, বাই দ্য ডাস্ট ক্লাউডস অফ স্পেস, ফাউণ্ডেশন জিতবেই-ফাউণ্ডেশনকে অবশ্যই জিততে হবে।”
“হোরলেগরে হেরে যাবার পরেও?”
“আমরা পরাজিত হইনি। তুমিও গুজবগুলো বিশ্বাস করছ? আমরা ছিলাম সংখ্যায় কম এবং বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার”
“কারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে?” উষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করল মিস।
“নর্দমার কীট ডেমোক্র্যাটের দল।” পাল্টা চিৎকার করলেন ইণ্ডবার। “আমি বহুদিন থেকেই জানি ওই ফ্লিট চালায় ডেমোক্র্যাট সেল। বেশিরভাগই ধ্বংস হয়ে গেছে, কিন্তু যুদ্ধের মাঝখানে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই বিশটা শিপ আত্মসমর্পণ করে বসে। পরাজয় ডেকে আনার জন্য সেটাই যথেষ্ট।
“এখন বলো দেখি, ধারালো জিভঅলা, দেশপ্রেমিক, পুরোনো মূল্যবোধর ধারক, তোমার সাথে ডেমোক্র্যাটদের সম্পর্কটা কী?”
শ্রাগ করে প্রশ্নটা উড়িয়ে দিল মিস, “অর্থহীন প্রলাপ, তুমি ভালো করেই জানো। তারপরে যে ক্রমেই পিছু হটতে হচ্ছে, স্যিউয়েনার অর্ধেক ছেড়ে দিতে হল, সেক্ষেত্রে? আবারো ডেমোক্র্যাট?”
“না, ডেমোক্র্যাট না,” ছোটখাটো মানুষটা ধারালোভাবে হাসলেন। “আমরা নিজেরাই পিছিয়ে এসেছি-আক্রান্ত হলেই ফাউণ্ডেশন বরাবর যেভাবে পিছিয়ে আসে, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইতিহাসের অবশ্যম্ভাবিতা আমাদের পক্ষে এসে দাঁড়ায়। এরই মধ্যে, আমি চূড়ান্ত ফলাফল দেখতে পারছি। ইতোমধ্যে তথাকথিত আণ্ডারগ্রাউণ্ড অব দ্য ডেমোক্র্যাটস সরকারের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য এবং সহযোগিতা করার জন্য একটা বিবৃতি প্রকাশ করেছে। এটা ভান হতে পারে, আরো বড় কোনো ষড়যন্ত্র ঢেকে রাখার কৌশল হতে পারে, কিন্তু আমি সুযোগটা কাজে লাগাতে পারব, এবং যে প্রোপাগাণ্ডা চালানো হবে তাতে তাদের কোনো ষড়যন্ত্রই সফল হবে না। এবং তার চেয়েও ভালো-”
“তার চেয়েও ভালো আর কী হতে পারে, ইণ্ডবার?”
“নিজেই বিচার করো। দুইদিন আগে অ্যাসোসিয়েশন অফ ইণ্ডিপ্যাণ্ডেন্ট ট্রেডারস মিউলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং তার ফলশ্রুতিতে এক হাজার শিপ যোগ দিয়ে ফাউণ্ডেশন ফ্লিটের শক্তি বৃদ্ধি করে। বুঝতেই পারছ, মিউল বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। সে দেখল আমরা বিভক্ত, নিজেদের মাঝে ঝগড়া ফ্যাসাদ নিয়ে ব্যস্ত এবং সে আক্রমণ করতেই আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেলাম। তাকে হারতেই হবে। এটাই অবশ্যম্ভাবী-বরাবরের মতো।”
কিন্তু মিস এর চেহারা থেকে সন্দেহ দূর হল না, তা হলে তুমি বলতে চাও সেলডন এমনকি একজন ভাগ্যান্বেষী মিউট্যান্ট এর আবির্ভাবেরও পরিকল্পনা করে রেখেছেন।”
“মিউট্যান্ট! একজন বিদ্রোহী ক্যাপ্টেন, অনভিজ্ঞ এক তরুণ আর এক ক্লাউনের কথা শুনে তাকে আমরা অন্য কিছু ভাবতে পারি না। তা ছাড়া তুমি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণের কথা ভুলে গেছ-তোমার নিজের।”
“আমার নিজের?” মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠল মিস।
“তোমার নিজের?” নাক সিটকে বললেন মেয়র। “নয় সপ্তাহ পরে টাইম ভল্ট খুলবে। তখন কী হবে? একটা ক্রাইসিসের জন্য সেটা খুলবে। মিউলের আক্রমণ যদি সেই ক্রাইসিস না হয় তা হলে কোনটা, যার জন্য টাইম ভল্ট খুলছে? উত্তর দাও, ব্যাটা ষাঁড়।”
শ্রাগ করল সাইকোলজিস্ট, “ঠিক আছে। যদি বুড়ো সেলডন উল্টো কথাই বলে… তুমি বরং এ্যাণ্ড ওপেনিং-এর দিন আমাকে থাকার সুযোগ করে দাও।”
“ঠিক আছে। বেরিয়ে যাও, নয় সপ্তাহ আমি তোমার চেহারা দেখতে চাই না।”
“(ছাপার অযোগ্য) আনন্দের সাথে, ব্যাটা বুড়ো ভাম,” বেরিয়ে যাওয়ার সময় নিজের মনেই ফিসফিস করল মিস।