দ্বিতীয় পর্ব : দ্য মিউল - ২০. ষড়যন্ত্রকারী
মেয়রের প্রাসাদ-
-একসময় যা ছিল মেয়রের প্রাসাদ, এখন কালি গোলা অন্ধকারে অস্পষ্ট অবয়বের মতো মনে হচ্ছে। কারফিউর জন্য পুরো শহর নীরব নিথর। ধোয়াটে দুধ সাদা সুবিশাল গ্যালাকটিক লেন্স, এখানে সেখানে দুই একটা নিঃসঙ্গ তারা বিপুল বিক্রমে আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে ফাউণ্ডেশন-এর আকাশে।
মাত্র তিন শতাব্দীতে ফাউণ্ডেশন ক্ষুদ্র একদল বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত প্রজেক্ট থেকে ধীরে ধীরে পরিণত হয় বহুমুখী সুবিশাল এক বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যে, যার শাখাপ্রশাখা বাড়তে বাড়তে ছড়িয়ে পড়ে গ্যালাক্সির গভীর থেকে গভীরে। অর্ধবছর আগেই সেটা আবার পূর্বের মর্যাদা হারিয়ে পরিণত হয়েছে পরাজিত এক প্রাদেশিক রাজ্যে।
ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচার এই কথা মানতে রাজি না।
শহরের অস্বাভাবিক নীরব রাত, অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রাসাদ এখন অনুপ্রবেশকারীর দখলে, উকটভাবে আসল সত্য প্রকাশ করছে, কিন্তু ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচার প্রাসাদের প্রবেশ পথের ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে জিভের নিচে অতি ক্ষুদ্র একটা নিউক্লিয়ার বোমা নিয়েও এটা বুঝতে চাইছে না।
ছায়ার মতো একটা শরীর এগিয়ে আসছে-মাথা নিচু করল ক্যাপ্টেন।
অতিরিক্ত নিচু গলায় ফিসফিস শব্দ ভেসে এল, “অ্যালার্ম সিস্টেম আগের মতোই আছে, ক্যাপ্টেন। এগিয়ে যান। কোনো সমস্যা হবে না।”
মৃদু পায়ে নিচু আর্চওয়ের ভিতর দিয়ে দুপাশে সারি সারি ঝর্না বসানো পথ ধরে প্রিচার যেখানে এসে দাঁড়াল সেটা এক সময় ছিল ইণ্ডবারের বাগান।
চার মাস আগের টাইম ভল্টের সেই ঘটনা এখনো তার মনে দগদগে ঘায়ের মতন জ্বলজ্বল করছে। এক এক করে সেই ভয়ংকর অনুভূতি রাতের দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে আসে প্রতিদিন।
বুড়ো সেলডন তার বংশধরদের যে সুদিনের কথা শোনাচ্ছিলেন সেটা ছিল রক্ত হিমকরা ভুল-তালগোল পাকানো দ্বন্দ্ব-ইবার, অস্বাভাবিক জাঁকজমকপূর্ণ মেয়রাল পোশাক। তার অচেতন মুখ-দ্রুত বেড়ে উঠা ভয় বিহ্বল জনতার ভিড়, নিঃশব্দে অবধারিত আত্মসমর্পণের নির্দেশ শোনার অপেক্ষা, মিউলের ক্লাউনকে কাঁধে ফেলে টোরানের পালানোর দৃশ্য, সব দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে আসে বারবার।
নিজেও কিছুক্ষণ পরে পালাতে সক্ষম হয়, যদিও তার গাড়ি বিকল হয়ে পড়েছিল। নেতাহীন বিশৃঙ্খল জনতার দল পালাতে শুরু করে শহর ছেড়ে-গন্তব্য অজানা। তাদের সাথে মিশে যায় সে।
অন্ধের মতো সে খুঁজতে থাকে অগণিত র্যাট হোল যেগুলো ছিল-বা এক সময়ে ছিল ডেমোক্র্যাটিক আণ্ডারগ্রাউণ্ড সদর দপ্তর-আশি বছর চেষ্টা করেও যারা কিছু করতে পারেনি।
কিন্তু র্যাট হোলগুলো ছিল ফাঁকা শূন্য।
পরের দিন শত্রুর অচেনা কালো শিপগুলো আকাশে মাঝে মাঝে দেখা দিয়েই হারিয়ে যেতে লাগল নিকটবর্তী শহরের বহুতল কাঠামোর আড়ালে। ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচার ডুবে যেতে লাগল সীমাহীন অসহায়ত্ব এবং হতাশার সাগরে।
দৃঢ় সংকল্পে পথ চলা শুরু করে সে।
ত্রিশ দিনে সে পাড়ি দেয় প্রায় দুশ মাইল পথ। পথের পাশে পড়ে থাকা হাইড্রোলিক কারখানার এক শ্রমিকের মৃতদেহ থেকে পোশাক খুলে নিজের সামরিক পোশাক পাল্টে নেয়, মুখে গজিয়ে উঠতে দেয় দাড়ি গোঁফের জঙ্গল।
এবং খুঁজে পায় আণ্ডারগ্রাউণ্ড-এর অবশিষ্ট।
শহরের নাম নিউটন। এক সময়ের অভিজাত জনপদ ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে আবর্জনার স্তূপে। দলের নিচু পদের একজন সদস্যের বাসস্থান, যার চোখগুলো ছোট ছোট, চওড়া হাড়, বিশাল দেহী, এমনকি পকেটের ভেতর থেকেও আঙুলের সবল গিটগুলো পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। প্রবেশ পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে।
“আমি এসেছি মিরান থেকে।” অস্ফুটে বলল ক্যাপ্টেন।
লোকটা জবাব দিল হাসিমুখে, “মিরান এই বছরের শুরুতেই শেষ হয়ে গেছে।”
ক্যাপ্টেন বলল, “না, গত বছরেরও আগে শেষ হয়েছে।”
কিন্তু লোকটা দরজা থেকে না সরেই জিজ্ঞেস করল, “কে আপনি?”
“আপনি ফক্স?”
“আপনি কী প্রশ্নের জবাব প্রশ্নের মাধ্যমে দেন?”
বুক ভরে শ্বাস নিল ক্যাপ্টেন, তারপর শান্ত সুরে বলল, “আমি হ্যান প্রিচার, ফ্লিটের একজন ক্যাপ্টেন এবং আণ্ডারগ্রাউণ্ড ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্য। ভেতরে আসতে পারি?”
একপাশে সরে দাঁড়িয়ে ফক্স বলল, “আমার আসল নাম ওরাম পালি।” তারপর হাত বাড়াল হ্যাঁণ্ডশেকের জন্য।
ঘরের ভেতর আভিজাত্যের ছোঁয়া কিন্তু তা পরিমিত। এক কোণায় চমৎকার একটা বুক ফিল্ম প্রজেক্টর। ক্যাপ্টেনের সামরিক দৃষ্টিতে মনে হল ওখানে একটা শক্তিশালী ব্লাস্টার লুকানো থাকতে পারে। প্রজেক্টিং লেন্স প্রবেশ পথের পুরোটাই কভার করছে এবং হয়তো রিমোটের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
দাড়িঅলা অতিথির দৃষ্টি অনুসরণ করে কঠিনভাবে হাসল ফক্স। “হা! কিন্তু তা শুধু ইবার এবং তার রক্তচোষাদের জন্য। মিউলের বিরুদ্ধে এটা কোনো কাজই করবে না, করবে? কোনো অস্ত্রই মিউলের বিরুদ্ধে সাহায্য করবে না। আপনি ক্ষুধার্ত?”
মাথা নাড়ল ক্যাপ্টেন।
“এক মিনিট অপেক্ষা করতে হবে।” ফক্স কাপবোর্ড থেকে ক্যান নামিয়ে দুটো রাখল ক্যাপ্টেন প্রিচারের সামনে। “এটার উপরে আঙুল রাখবেন তারপর যথেষ্ট গরম হলে ভেঙে ফেলবেন। আমার হিট কন্ট্রোল ইউনিট কাজ করছে না। মনে করিয়ে দেয় একটা যুদ্ধ চলছে-বা চলছিল, এহ?”
তার কথাবার্তা হাসিখুশি, কণ্ঠস্বর আমুদে এবং চোখদুটো শীতল চিন্তাযুক্ত। বসল ক্যাপ্টেনের বিপরীত দিকের সোফায়, যেখানে বসেছেন সেখানে একটা পোড়া দাগ ছাড়া কিছুই থাকবে না, যদি আপনার কোনো কিছু আমার পছন্দ না হয়। মনে রাখবেন।”
কিছু বলল না ক্যাপ্টেন। ক্যান খুলে খেতে শুরু করল।
“স্ট্যু। দুঃখিত, খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।”
“আমি জানি,” বলল ক্যাপ্টেন। খাওয়া শেষ করল দ্রুত।
“আপনাকে একবার দেখেছিলাম। কিন্তু দাড়ি গোঁফের কারণে চিনতে পারছিলাম না।”
“ত্রিশ দিন শেভ করা হয় নি,” তারপর রাগত সুরে, “আপনি কী চান? আমি সঠিক পাসওয়ার্ড বলেছি। আমার আইডেন্টিফিকেশন আছে।”
হাত নাড়ল ফক্স “ওহ্, আপনি প্রিচার এটা আমি মেনে নিচ্ছি। কিন্তু পাসওয়ার্ড অনেকেই জানে, এবং আইডেন্টিফিকেশন আর আইডেনটিটি এখন মিউলের পক্ষে। লিভোর নাম শুনেছেন?”
“হ্যাঁ।”
“সে মিউলের দলে যোগ দিয়েছে।”
“কী? সে-”
“হ্যাঁ। তাকে সবাই বলত, ‘নো সারেণ্ডার’।” হাসির ভঙ্গিতে ঠোঁট বাঁকালো ফক্স, রসকষহীন নিষ্প্রাণ হাসি। “তারপর উইলিগ। মিউলের দলে! গ্যারি আর নথ। মিউলের দলে! তা হলে প্রিচারও যাবে না কেন, শুনি? আমি কীভাবে জানব?”
কোনোমতে শুধু মাথা নাড়ল ক্যাপ্টেন।
“কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না,” মসৃণ গলায় বলল ফক্স। “ওরা অবশ্যই আমার নাম জানে যদি নর্থ দলবদল করে থাকে-কাজেই আপনি বৈধ হলেও আমার চাইতে অনেক বেশি বিপদে আছেন।”
“এখানে কোনো সংগঠন না থাকলে কোথায় পাবো? ফাউণ্ডেশন হয়তো আত্মসমর্পণ করেছে, কিন্তু আমি করিনি।”
“তাই! আপনি আজীবন পালিয়ে বেড়াতে পারবেন না, ক্যাপ্টেন। ফাউণ্ডেশন এর নাগরিকদের এক শহর থেকে অন্য শহরে যেতে বর্তমানে অনুমতি নিতে হয়। আপনি জানেন? এবং আইডেন্টিটি কার্ড। আপনার তা আছে? এ ছাড়া পুরোনো নেভির সকল অফিসারকে নিকটস্থ সদর দপ্তরে রিপোর্ট করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আপনি করেছেন, এহ?”
“হ্যাঁ।” ক্যাপ্টেনের গলা কঠিন। “আপনার ধারণা আমি ভয়ে পালিয়ে এসেছি। মিউলের হাতে পতনের কিছুদিন পরেই আমি কালগানে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখলাম যে প্রাক্তন ওয়ারলর্ডের একটা অফিসারেরও কোনো অস্তিত্ব নেই। কারণ তারাই যে-কোনো বিদ্রোহের সামরিক নেতৃত্ব দেয়। আন্ডারগ্রাউন্ড সবসময়ই মনে করত যে নেভির সামান্যতম অংশও যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তা হলে কোনো বিপ্লবই সফল হবে না। মিউল অবশ্যই কথাটা জানে।”
চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ল ফক্স, “যুক্তির কথা। মিউলের বুদ্ধি আছে।”
“যত দ্রুত সম্ভব ইউনিফর্ম ত্যাগ করি। দাড়ি গোঁফ গজাতে দেই। ধরে নিচ্ছি অনেকেই আমার মতো একই কৌশল বেছে নিয়েছে।”
“আপনি বিবাহিত?”
“স্ত্রী মারা গেছে, ছেলেমেয়ে নেই।”
“তা হলে আপনার পরিবারকে জিম্মি করা হতে পারে, এই ভয় থেকে মুক্ত আপনি?”
“হ্যাঁ।”
“আমি একটা উপদেশ দেই?”
“যদি দেওয়ার মতো কিছু থাকে।”
“মিউলের পলিসি বা কী উদ্দেশ্য আমি জানি না, কিন্তু দক্ষ শ্রমিকদের পারতপক্ষে কোনো ক্ষতি করা হচ্ছে না। বরং মজুরি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সব ধরনের নিউক্লিয়ার ওয়েপন্স এর উৎপাদন এখন আকাশ ছোঁয়া।”
“তাই? অর্থাৎ আক্রমণ চলতেই থাকবে।”
“জানি না। মিউল কোনো বেশ্যার পেটে জন্ম নেওয়া চতুর বদমাশ এবং সে হয়তো শ্রমিকদের শান্ত রাখতে চাইছে। যদি সেলডন সাইকোহিস্টোরির মাধ্যমে তার ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করতে ব্যর্থ হন, আমি চেষ্টা করতে চাই না। কিন্তু আপনার পরনে শ্রমিকের পোশাক। বুঝতে পারলেন কিছু?”
“আমি দক্ষ শ্রমিক না।”
“নেভিতে নিউক্লিয়িকস্-এর উপর কোর্স করেছেন, তাই না?”
“অবশ্যই।”
“ওতেই চলবে। নিউক্লিয়ার-ফিল্ড বিয়ারিং করপোরেশন নামে একটা প্রতিষ্ঠান আছে এই শহরে। ওদেরকে গিয়ে বলবেন আপনি অভিজ্ঞ। যে হারামজাদাগুলো ইণ্ডবারের জন্য ফ্যাক্টরিটা চালাত এখনো তারাই চালায়-তবে মিউলের জন্য। দক্ষ শ্রমিক পেলে কোনো প্রশ্ন করবে না। ওরা আপনাকে আইডি কার্ডের ব্যবস্থা করে দেবে এবং আপনি করপরেশনের হাউজিং এস্টেটে বাসস্থানের আবেদন করতে পারবেন। আমার মনে হয় এখনই শুরু করে দেওয়া উচিত।”
এভাবেই ন্যাশনাল ফ্লিট-এর ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচার পরিচয় বদলে পরিণত হয় নিউক্লিয়ার ফিল্ড বিয়ারিং করপোরেশনের ৪৫নং শাখার শিল্ড ম্যান লো মোয়রা। এবং ইন্টেলিজেন্স এজেন্ট-এর সামাজিক মর্যাদা হ্রাস করে আবির্ভূত হয় একজন ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে-যে কারণে মাসখানেক পরে সে দাঁড়িয়ে আছে ইণ্ডবারের ব্যক্তিগত উদ্যানে।
বাগানে দাঁড়িয়ে হাতের র্যাডোমিটারের দিকে তাকাল ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচার। ভিতরের ওয়ার্নিং সিস্টেম এখনো সচল, কাজেই অপেক্ষা করতে হবে। মুখের ভেতরের নিউক্লিয়ার বোমার মেয়াদ আর মাত্র আধাঘন্টা। জিভ দিয়ে বোমাটা নাড়তে লাগল সতর্কভাবে।
র্যাডোমিটারের আলো নিভে অশুভ কালো বর্ণ ধারণ করল এবং দ্রুত এগোতে শুরু করল ক্যাপ্টেন।
সে ভালোভাবেই জানে যে বোমার জীবন যতটুকু তার জীবনও ততটুকু; ওটার মৃত্যু মানে তার মৃত্যু এবং মিউলেরও মৃত্যু।
চার মাসের এক ব্যক্তিগত লড়াইয়ের চূড়ান্ত পরিণতি আসন্ন; যে-লড়াই এর মূল অংশ শুরু হয় নিউটন ফ্যাক্টরি থেকে।
দুই মাস ক্যাপ্টেন হ্যান কাটিয়েছে সীসাযুক্ত অ্যাপ্রন এবং ভারী ফেস শিল্ড পরে তার সামরিক পরিচয় লুকানোর জন্য। তখন সে একজন দিনমজুর, কাজ শেষে বেতন নেয়, সন্ধ্যা অতিবাহিত করে শহরে এবং রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করে না কখনো।
দুই মাস ফক্সের সাথে একবারও দেখা হয়নি।
তারপর একদিন তার বেঞ্চের সামনে একটা লোক হোঁচট খায়। লোকটার পকেটে ছোট এক টুকরো কাগজ, তাতে লেখা “ফক্স” কাগজটা সে ফেলে দেয় নিউক্লিয়ার চেম্বারে, এনার্জি আউটপুট এক মিলিমাইক্রোভোল্ট বৃদ্ধি করে সেটা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তারপর ঘুরে চলে যায় নিজের কাজে।
ওই রাতটা সে অতিবাহিত করে ফক্সের বাড়িতে আরো দুজনের সাথে তাস খেলে। দুজনের একজনকে সে নামে চেনে, অন্যজনকে নাম এবং চেহারা দুভাবেই চেনে।
তাস খেলার সাথে সাথে তাদের আলোচনা চলছিল।
“ভুলটা শুরুতেই হয়েছে,” বলল ক্যাপ্টেন। “আমরা জঘন্য অতীত নিয়ে বাস করছি। আশি বছর আমাদের সংগঠন অপেক্ষা করেছে সঠিক ঐতিহাসিক মুহূর্তের জন্য। সেলডনের সাইকোহিস্টোরি আমরা অন্ধভাবে অনুসরণ করেছি, যার প্রথম অনুমিতিতে বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তির কোনো গুরুত্ব নেই, একজন ব্যক্তি ইতিহাস তৈরি করে না এবং এই জটিল সামাজিক, অর্থনৈতিক উপাদান তাকে ভুল পথে পরিচালিত করে।” সাবধানে হাতের কার্ডগুলো সাজিয়ে সেগুলোর মূল্য পরখ করে নেয় সে, তারপর একটা টোকেন ফেলে বোর্ডে, “মিউলকে খুন করছি না কেন?”
“তাতে কী লাভটা হবে?” ঝগড়া বাধানোর সুরে বলে বাঁ পাশের জন।
“দেখলে,” দুটো কার্ড নামিয়ে রেখে ক্যাপ্টেন বলে, “সবার আচরণ একই রকম। কোয়াড্রিলিয়ন মানুষের মাঝে-একজন মানুষের মূল্য কি। একজন মানুষ মারা গেলে গ্যালাক্সির আবর্তন থেমে যাবে না। ন্তুি মিউল একজন মানুষ না, একটা মিউট্যান্ট। এরইমধ্যে সে সেলডন প্ল্যান নষ্ট করে ফেলেছে। একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে যে সে-একজন মানুষ-একটা মিউট্যান্ট-সেলডনের পুরো সাইকোহিস্টোরি এলোমেলো করে ফেলেছে একাই। যদি সে না থাকত ফাউণ্ডেশন কখনো পরাজিত হত না। সে বেঁচে না থাকলে, বেশিদিন এমন পরাজিত থাকবে না।
“আশি বছর ধরে ডেমোক্র্যাটরা মেয়র এবং বণিকদের সাথে লড়াই করেছে পরোক্ষভাবে। এবার গুপ্ত হত্যার চেষ্টা করে দেখা যাক।”
“কীভাবে?” শীতল যুক্তির সুরে আলোচনায় যোগ দেয় ফক্স।
ধীরে ধীরে ক্যাপ্টেন তার পরিকল্পনা বোঝাতে থাকে, “তিন মাস এটা নিয়ে ভেবে আমি কোনো সমাধান বের করতে পারিনি। কিন্তু এখানে আসার পাঁচ মিনিটের মধ্যে সমাধান বেরিয়ে আসে।” ডানদিকের লোকটার দিকে তাকায় সে। আপনি ইণ্ডবার-এর চেম্বার লেইন ছিলেন। জানতাম না যে আণ্ডারগ্রাউণ্ড-এর সাথে জড়িত।
“আপনাদের কথাও আমি জানতাম না।”
“যাই হোক, চেম্বারলেইন হিসেবে আপনি প্রাসাদের এলার্ম সিস্টেম চেক করতেন প্রায়ই।”
“করতাম।”
“আর মিউল এখন ঐ প্রাসাদে বাস করছে।”
“সেরকমই শোনা যায়-যদিও মিউল দখলদার হিসেবে বেশ ভদ্র। কোনো বক্তৃতা দেয়নি, যুদ্ধজয়ের কোনো ঘোষণা দেয়নি এমনকি মানুষের সামনেও আসে না।”
“পুরোনো গল্প বলে লাভ নেই। আপনাকে আমাদের দরকার।”
কার্ড শো করে ফক্স পুরো স্টেক নিজের দিকে টেনে নেয়। তারপর নতুন তাস বাটতে থাকে।
প্রাক্তন চেম্বারলেইন কার্ড তুলে বলে, “দুঃখিত ক্যাপ্টেন। এলার্ম সিস্টেম চেক করতাম ঠিকই, কিন্তু সেটা ছিল রুটিন। ভিতরের খবর কিছুই জানি না।”
“কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যথেষ্ট গভীরে ছেদ করতে পারলে আপনার মাইণ্ড থেকে এলার্ম কন্ট্রোলের স্মৃতি বের করে আনা যাবে সাইকিক প্রোবের সাহায্যে।”
চেম্বারলেইনের গোলাপি মুখ মুহূর্তেই ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করে। হাত শক্তভাবে চেপে ধরায় তাসগুলো দুমড়ে মুচড়ে যেতে থাকে, “সাইকিক প্রোব?”
“ভয়ের কিছু নেই। জিনিসটা কীভাবে ব্যবহার করতে হয় আমি জানি। কয়েকদিন অসুস্থতাবোধ ছাড়া আর কোনো ক্ষতি হবে না। আমাদের মাঝে এমন অনেকেই আছে, যারা এলার্ম কন্ট্রোলের বিস্তারিত বিবরণ পেলে ওয়েভলেংথ কম্বিনেশন তৈরি করে দিতে পারবে। আমাদের মাঝে অনেকেই আছে, যারা একটা ক্ষুদ্র টাইম বোমা বানিয়ে দিতে পারবে, আমি নিজে সেটা নিয়ে মিউলের কাছে যাব।”
লোকগুলো টেবিলের আরো কাছাকাছি ভিড় জমায়।
“একটা নির্দিষ্ট সন্ধ্যায় টার্মিনাস সিটিতে প্রাসাদের কাছাকাছি একটা দাঙ্গা শুরু করতে হবে। সত্যিকার দাঙ্গা না, সামান্য গোলমাল। চলতে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত
প্রাসাদ রক্ষীদের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়।”
সেদিন থেকে পরবর্তী এক মাস প্রস্তুতির কাজ এগিয়ে চলে, এবং ন্যাশনাল ফ্লিটের ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচার এর আগে যে নিজেকে নামিয়ে এনেছে ষড়যন্ত্রকারীর পর্যায়ে, এবার সামাজিক মর্যাদা আরো ক্ষুণ্ণ করে পরিণত হয় গুপ্তঘাতকে।
ক্যাপ্টেন প্রিচার, গুপ্তঘাতক, প্রাসাদে দাঁড়িয়ে নিজের সাইকোহিস্টোরির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ব্যাপক এলার্ম সিস্টেমের অর্থ ভিতরে গার্ডের সংখ্যা কম। এই ক্ষেত্রে বোধ হয় একজনও নেই।
প্রাসাদের ভিতরে কামড়ার বিন্যাস তার মুখস্থ। নিঃশব্দে কালো একটা বিন্দুর মতো কার্পেট বিছানো র্যাম্প বেয়ে উপরে উঠে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল।
তার সামনে একটা শয়ন কক্ষের দরজা। মিউট্যান্ট নিশ্চয়ই ওই দরজার পিছনে আছে, যে অপরাজেয়কে করেছে পরাজিত। একটু আগেই এসে পড়েছে সে-বোমার মেয়াদ দশ মিনিট বাকি।
পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেল, এখনো পুরো বিশ্ব নীরব। মিউল বেঁচে থাকবে আর মাত্র পাঁচ মিনিট-ক্যাপ্টেন প্রিচারও তাই।
হঠাৎ অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই সামনে এগোল সে। বোমা বিস্ফোরিত হলে পুরো প্রাসাদ উড়ে যাবে-পুরো প্রসাদ। দশ গজ দূরে যে দরজা আছে সেটা কোনো বাধাই না। কিন্তু মিউলকে সে দেখতে চায়, যেহেতু দুজন একসাথেই মরবে।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে সে পাগলা ষাঁড়ের মতো ছুটে গিয়ে বিদ্যুৎবেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল দরজার উপর।
এবং দরজাটা খুলে গিয়ে উজ্জ্বল আলো তার চোখ ধাঁধিয়ে দিল। টলমল পায়ে কিছুদূর ছুটে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল ক্যাপ্টেন। কামরার ঠিক মাঝখানে পায়াঅলা মাছ জিইয়ে রাখার একটা পাত্রের সামনে এক লোক, গম্ভীর। চোখ তুলে তাকাল স্বাভাবিক ভঙ্গিতে।
লোকটার পরনে গভীর কালো ইউনিফর্ম এবং অন্যমনস্কভাবে পাত্রে একটা টোকা দেওয়াতে বৃত্তাকার তরঙ্গ তৈরি হল ভিতরের পানিতে, পালকের মতো ডানা অলা এবং সিঁদুর বর্ণের মাছগুলো ছুটোছুটি শুরু করে দিল।
“আসুন, ক্যাপ্টেন!” লোকটা বলল।
ক্যাপ্টেনের সঞ্চরণশীল জিভের নিচে ধাতুর ক্ষুদ্র গোলকটা অশুভ গতিতে এগিয়ে চলেছে শেষ মুহূর্তের দিকে। জানে এখন আর থামানোর কোনো উপায় নেই, কারণ শেষ মিনিটও শেষ হতে চলেছে।
“আপনি বরং মুখের ওই ঘোড়ার ডিম বস্তুটা বের করুন। ওটা ফাটবে না।” বলল ইউনিফর্ম।
এক মিনিট পেরিয়ে গেল এবং হঠাৎ কিন্তু ধীর গতিতে ক্যাপ্টেন মাথা নিচু করে রুপোলি গোলকটা হাতের তালুতে ফেলল। প্রচণ্ড জোড়ে ছুঁড়ে দিল দেয়ালে, মৃদু একটা ধাতব শব্দ করে জিনিসটা গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে, পড়ে থাকল নির্দোষ ভালো মানুষের মতো। শ্রাগ করল ইউনিফর্ম। “যাই হোক, ওটা ফাটলেও কোনো লাভ হত না, ক্যাপ্টেন। আমি মিউল নই। আপনাকে তার ভাইসরয়ের সাথে দেখা করেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।”
“আপনি কীভাবে জানলেন?” হতাশ গলায় ফিসফিস করল ক্যাপ্টেন।
“দোষটা আপনি চাপাতে পারেন দক্ষ কাউন্টার এসপিওনাজ সিস্টেমের উপর। আপনাদের ছোট দলটার প্রত্যেকের নাম আমি জানি, প্রতিটা পদক্ষেপের উপর নজর ছিল-”
“আর তারপরেও এতদূর আসতে দিয়েছেন?”
“কেন নয়? আমার মূল উদ্দেশ্যই ছিল আপনাকে সহ আরো কয়েকজনকে ধরা। বিশেষ করে আপনাকে। কয়েক মাস আগেই ধরতে পারতাম, যখন নিউটন বিয়ারিংস-এ কাজ করতেন, কিন্তু এটা বরং আরো ভালো হয়েছে। পরিকল্পনার মূল কাঠামো যদি আপনি নিজে থেকে বলতে না পারতেন আমারই কোনো এজেন্ট এই ধরনেরই কিছু একটা আপনাকে সরবরাহ করত। ফলাফল বেশ নাটকীয় এবং অনেকখানি হাস্যকর।”
ক্যাপ্টেনের দৃষ্টি কঠিন। “আমার কাছেও সেরকমই মনে হয়েছে। তো, এখানেই সব শেষ?”
“মাত্র শুরু। বসুন, ক্যাপ্টেন। নায়ক হওয়ার সুযোগ আমরা নির্বোধদের জন্য ছেড়ে দেই। ক্যাপ্টেন, আপনি দক্ষ লোক। আমার প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ফাউণ্ডেশনে আপনিই সর্বপ্রথম মিউলের প্রকৃত ক্ষমতা বুঝতে পারেন। আপনি তাদেরই একজন যে তার ক্লাউনকে সরিয়ে আনে, ঘটনাক্রমে এই ক্লাউন এখনো ধরা পড়েনি। স্বাভাবিকভাবেই আপনার দক্ষতা চোখে পড়ে আমাদের এবং মিউল সেই ধরনের মানুষ যে তার শত্রুর দক্ষতাকে ভয় পায়না যেহেতু সে শত্রুকে কনভার্ট করে বন্ধু বানাতে পারে।”
“আপনারা সেটাই করতে চাইছেন? ওহ!”
“ওহ্ হ্যাঁ! এই উদ্দেশ্যেই আজকে রাতের প্রহসন। আপনি বুদ্ধিমান, যদিও মিউলের বিরুদ্ধে আপনার ষড়যন্ত্রটা হাস্যকরভাবে ব্যর্থ হয়েছে। অবশ্য এটাকে ঠিক ষড়যন্ত্রের পর্যায়েও ফেলা যাবে না। অর্থহীন উদ্দেশ্যে শিপ ধ্বংস করা কী আপনার সামরিক প্রশিক্ষণের অংশ?”
“প্রথমেই একজনকে বুঝতে হবে কোনটা অর্থহীন।”
“বোঝা যাবে,” নরম সুরে নিশ্চয়তা দিল ভাইসরয়। “মিউল ফাউণ্ডেশন দখল করেছেন। এটাকেই ধীরে ধীরে আরো বৃহৎ উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ারে পরিণত করা হবে।”
“কোন বৃহৎ উদ্দেশ্য?”
“পুরো গ্যালাক্সি দখল। বিচ্ছিন্ন বিশ্বগুলোকে জোড়া দিয়ে নতুন এম্পায়ার গড়ে তোলার পরিকল্পনা। স্বপ্ন পূরণ, মোটা মাথার দেশপ্রেমিক, আপনাদের সেলডন সেটা পূরণের জন্য যে সাত শ বছর বেঁধে দিয়েছেন, তার অনেক আগেই। এবং এই স্বপ্ন পুরণে আপনি আমাদের সাহায্য করতে পারেন।”
“নিঃসন্দেহে পারি। এবং নিঃসন্দেহে করব না।”
“বুঝতে পেরেছি,” যুক্তি দেখাল ভাইসরয়, “মাত্র তিনটা স্বাধীন বণিক বিশ্ব এখনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আর বেশিদিন টিকতে পারবে না। আর ফাউণ্ডেশন-এর শেষ ভরসা এখন এটাই। তারপরেও আপনি নিজের জেদ বজায় রাখবেন?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু পারবেন না। স্বেচ্ছায় মত পাল্টালে ভালো। অন্যভাবে হলেও অসুবিধা নেই। দুর্ভাগ্যক্রমে, মিউল এখানে নেই। অবশিষ্ট বণিকদের সাথে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে সর্বদা যোগাযোগ রেখেছেন আমাদের সাথে। আপনাকে বেশিক্ষণ
অপেক্ষা করতে হবে না। “কিসের জন্য?”
“আপনার কনভার্সনের জন্য।”
“মিউলের জন্য,” শীতল গলায় বলল ক্যাপ্টেন, “কঠিন হবে কাজটা।”
“হবে না। আমার বেলায় হয়নি। আমাকে চিনতে পারেননি আপনি? আপনি কালগানে গিয়েছিলেন, কাজেই অবশ্যই আমাকে দেখেছেন। আমার চোখে ছিল মনোকল,* ফারের তৈরি নকশা খচিত রোব, উঁচু চূড়াঅলা মুকুট-”।
বিতৃষ্ণায় পুরো শরীর শক্ত হয়ে গেল ক্যাপ্টেনের। “কালগানের ওয়ারলর্ড।”
“হ্যাঁ, এখন আমি মিউলের অনুগত ভাইসরয়। দেখলেন তো, মিউল কেমন পারসুয়েসিভ।”
———-
[*একচোখের জন্য চশমা বিশেষ, যা চোখের চারপাশের মাংসপেশিকে যথাস্থানে রাখে।]
*