ফাউণ্ডেশন অ্যাণ্ড এম্পায়ার by আইজাক আসিমভ, chapter name দ্বিতীয় পর্ব : দ্য মিউল - ১৯. অনুসন্ধান শুরু

দ্বিতীয় পর্ব : দ্য মিউল - ১৯. অনুসন্ধান শুরু

নিঃসঙ্গ গ্রহ হেভেন-কোনো এক গ্যালাকটিক সেক্টরের একমাত্র সূর্যের একমাত্র গ্রহ, ভেসে চলেছে অনন্তকাল-এই মুহূর্তে অবরুদ্ধ।

সামরিক বিচারে, অবশ্যই অবরুদ্ধ, কারণ মহাকাশের চারপাশের কোনো অঞ্চলই মিউলের অ্যাডভান্স বেজ এর বিশ মাইলের বাইরে না। মাকড়সার জালের উপর ক্ষুরের ধারালো প্রান্ত ধরলে যেভাবে ছিঁড়ে যায়, ফাউণ্ডেশন-এর পতনের পর গত চার মাসে হেভেনের যোগাযোগ ব্যবস্থা ঠিক সেভাবেই ভেঙে পড়েছে। শিপগুলো পিছু হটে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে হোম ওয়ার্ল্ডে এবং ফাইটিং বেজ হিসেবে এখনো টিকে আছে একমাত্র হেভেন।

অন্যান্য দিক দিয়ে এই অবরোধ আরো স্পষ্ট, কারণ একটা অসহায় নিরাপত্তাহীনতার বোধ চেপে বসছে তাদের উপর-

মধ্যবর্তী সরু পথের দুপাশে সারি সারি টেবিল, রং দুধ সাদা, উপরের পৃষ্ঠতল গোলাপি। অনেকটা অন্ধের মতোই নিজের আসন খুঁজে নিল বেইটা। হাতল বিহীন চেয়ারে বসতে বসতে দু’একটা সম্ভাষণের জবাব দিল যান্ত্রিকভাবে। ক্লান্ত হাতে ক্লান্ত চোখ ডলে হাত বাড়িয়ে ম্যেনু টেনে নিল। হাইলি-কালচারড-ফাংগাস, হেভেনের সেরা খাদ্য, অথচ ফাউণ্ডেশন-এর স্বাদে অভ্যস্ত বেইটার কাছে মনে হয় একেবারে জঘন্য।

এমন সময় পাশে কারো ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ পেয়ে সেদিকে তাকাল বেইটা।

জুডির সাথে এর আগে তার সামান্য পরিচয় হয়েছিল। সেই জুডিই কাঁদছে। ভেজা রুমাল মুখে চাপা দিয়ে ধরে চেষ্টা করছে কান্না দমন করার। ফলে মুখের রং বদলে লাল হয়ে গেছে। আকৃতিহীন রেডিয়েশন প্রুফ পোশাক কাঁধের উপর যেমন তেমনভাবে ফেলে রাখা। স্বচ্ছ ফেস শিল্ড পড়ে আছে টেবিলের খাবারের উপর।

আরো তিনটা মেয়ে আছে তার সাথে, যারা অনন্তকাল ধরে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে, কোমল সান্তনা দিয়ে তাকে থামানোর চেষ্টা করছে। যদিও বরাবরের মতোই তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। বেইটা তাদের কাছে গেল।

“কী হয়েছে?” ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল সে।

একজন ঘুরে কাঁধ নাড়ল, “আমি জানি না, তারপর কাঁধের ইশারায় কিছু পরিষ্কার হয়নি বুঝতে পেরে টেনে একপাশে সরিয়ে আনল বেইটাকে।

“বোধহয়, সারা দিনে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। তা ছাড়া স্বামীর জন্য দুঃশ্চিন্তা।”

“ওর স্বামী স্পেস পেট্রোলে গেছে?”

“হ্যাঁ।”

জুডির দিকে হাত বাড়াল বেইটা।

“তুমি বাড়ি যাচ্ছ না কেন, জুডি?” অনেকটা অবাঞ্চিত পরামর্শ দেওয়ার মতো করে বলল।

কিছুটা বিরক্ত হয়ে মাথা তুলল জুডি, “এই সপ্তায় একবার যাওয়া হয়ে গেছে।”

“তা হলে আরেকবার যাবে। প্রয়োজন হলে সামনের সপ্তায় তিনবার যাবে-বাড়ি যাওয়ার সাথে দেশ প্রেমের কোনো সম্পর্ক নেই। তোমাদের কেউ ওর ডিপার্টমেন্টে কাজ করো? বেশ, তোমরা তা হলে ওর কার্ডের দায়িত্ব নিতে পারবে, তবে সবার আগে তোমাকে ওয়াসরুমে যেতে হবে, জুডি। মুখের মেক আপ ঠিক করে নাও। যাও! যাও!”

বিষণ্ণ অনুভূতি নিয়ে নিজের টেবিলে ফিরল বেইটা। বিষণ্ণতা সংক্রামক ব্যাধির মতো। আর এখন যেরকম কঠিন দুর্দিন পাড়ি দিতে হচ্ছে তাতে একজনের চোখের পানি পুরো ডিপার্টমেন্টকে হতাশ করে তুলবে।

অনীহার সাথে খাবার বাছাই করল সে। কনুইয়ের কাছে একটা বোতামে চাপ দিয়ে অর্ডার দিল তারপর ম্যানুটা রেখে দিল আগের জায়গায়।

“আমাদের কান্না ছাড়া আর কিছু করার নেই, আছে?” বিপরীত দিকের টেবিলে বসা লম্বা কালো মেয়েটা জিজ্ঞেস করল। অস্বাভাবিক মোটা ঠোঁটের কোণে সামান্য বাঁকা হাসি।

কঠিন দৃষ্টিতে কথাটার ভেতরে যে কটাক্ষ আছে সেটা ওজন করার চেষ্টা করল বেইটা। এই সময় খাবার চলে আসায় একটু সামলে নিল। টেবিলের উপরের অংশ ভিতরের দিকে সরে গিয়ে নিচ থেকে উঠে এল খাবারের ডিশ। মোড়ক সরিয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগল ঠাণ্ডা হওয়ার জন্য।

“আর কোনো কিছু করার কথা তোমার মাথায় আসছে না, হেলা?” জিজ্ঞেস করল সে।

“হ্যাঁ, অবশ্যই।” বলল হেলা। “আসছে!” নিখুঁতভাবে টোকা দিয়ে সিগারেটের টুকরো ছুঁড়ে দিল একটা ছোট কুলঙ্গির দিকে, মাটি স্পর্শ করার আগেই আগুনের চিকন লকলকে শিখা টেনে নিল সেটাকে।

“যেমন,” চিকন কিন্তু সবল হাতদুটো ভাজ করে তার উপর চিবুক রাখল হেলা, “আমার মনে হয়, মিউলের সাথে চমৎকার একটা চুক্তি করে আমরা সব ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে পারি। মিউল হামলা করলে যেখানে কাজ করি সেখান থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসার কোনো উপায় নেই।”

বেইটার মসৃণ কপালে কোনো ভাঁজ পড়ল না, কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক, “নিশ্চয়ই ব্যাটল শিপে তোমার স্বামী বা ভাই নেই, তাই না?”

“না। আর সেই কারণেই অন্যের ভাই বা স্বামীর ত্যাগ স্বীকারের ব্যাপারটা আমি বুঝি না।”

“আত্মসমর্পণ করলে আরো বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।”

“ফাউণ্ডেশন আত্মসমর্পণ করে এখন নিরাপদে আছে। আর আমরা বাধা দেওয়াতে পুরো গ্যালাক্সি দাঁড়িয়ে গেল আমাদের বিরুদ্ধে।”

শ্রাগ করল বেইটা, মিষ্টি সুরে বলল, “মনে হয় প্রথম ব্যাপারটাই তোমাকে ভাবাচ্ছে।” তারপর মনযোগ দিল খাওয়ার দিকে। একই সাথে অনুভব করছে তার চারপাশে একটা স্যাঁতস্যাঁতে নীরবতা। হেলা যে হতাশাবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে সেটা নিয়ে অন্যদের কিছু বলার কোনো আগ্রহ নেই।

খাওয়া শেষ করে আরেকটা বোম চাপল টেবিল সাফ করার জন্য। তারপর বেরিয়ে গেল দ্রুত।

তিন টেবিল পরে খেতে বসা অন্য একটা মেয়ে জিজ্ঞেস করল ফিসফিস করে, “মেয়েটা কে?”

একই ভঙ্গিতে ঠোঁট বাঁকা করে জবাব দিল হেলা, “আমাদের কো-অর্ডিনেটরের ভাস্তি। তুমি চেন না?”

“তাই?” প্রশ্নকারীর দৃষ্টিতে বিরূপভাব। “কেন এসেছে?”

“এমনি দেখতে এসেছে। জান না, দেশপ্রেমিক হওয়া এখন ফ্যাশনে দাঁড়িয়েছে। ডেমোক্র্যাটিকদের কথা মনে হলেই আমার বমি আসে।”

“শোন, হেলা,” গোলগাল মেয়েটা বলল, যে তার ডান দিকে বসেছে, “ও তো ওর চাচাকে আমাদের পেছনে লাগায়নি। তুমি কেন লাগতে যাচ্ছ?”

সঙ্গিনীর কথায় কোনো গুরুত্ব দিল না হেলা, আরেকটা সিগারেট ধরাল।

নতুন মেয়েটা এখন বিপরীত দিকের টেবিলে বসা অ্যাকাউন্টেন্ট-যে কথা বলে খুব দ্রুততার কথা গোগ্রাসে গিলছে। “জানো, ও না টাইম ভল্টে ছিল-সত্যি সত্যি টাইম ভল্ট-যখন সেলডন কথা বলছিলেন-আর শুনেছি ঠক ঠক করে নাকি কাঁপছিলেন মেয়র। তারপর যেরকম দাঙ্গা হাঙ্গামা শুরু হয়, কী বলব। বেশ ঝুঁকি নিয়ে ও পালিয়ে আসে, শক্রদের চোখে ধুলো দিয়ে। ভাবছি ও একটা বই লিখছে না। কেন? যুদ্ধের গল্প উপন্যাস এখন বেশ জনপ্রিয়। আর মেয়েটা নাকি মিউলের গ্রহ-কালগান-সেখানেও গেছিল-এবং-”

টাইম বেল বেজে উঠার পর ধীরে ধীরে খালি হতে লাগল ডাইনিং রুম। অ্যাকাউন্টেন্ট এর মুখ এখনো চলছে, আর নতুন মেয়েটা ঠিক জায়গামতো চোখ বড় বড় করে যোগ করছে, “সত্যিই-ই-ই?”

বেইটা যখন বাড়ি ফিরল তখন বিশাল গুহার স্থানে স্থানে আলো নিভে গিয়ে অন্ধকার ক্রমশ গাঢ় করে তুলছে। অর্থাৎ এখন নীতিবান এবং কঠোর পরিশ্রমী মানুষগুলোর ঘুমানোর সময়।

দরজা খুলে দিল টোরান, হাতে মাখন লাগানো এক স্লাইস রুটি।

“কোথায় ছিলে তুমি?” চিবুতে চিবুতে জিজ্ঞেস করল, তারপর খাবার গলা দিয়ে নামিয়ে আরো পরিষ্কারভাবে, “ডিনার বানাতে গিয়ে সব বরবাদ করে ফেলেছি। আমাকে দোষ দিতে পারবে না।”

কিন্তু বেইটা তাকে ঘিরে চক্কর দিচ্ছে, চোখ বিস্ফারিত, “তোমার ইউনিফর্ম কোথায়, টোরান? সিভিল পোশাক পড়ে আছ কেন?”

“অর্ডার, বে। রাণু এই মুহূর্তে এবলিং মিস এর সাথে আলোচনা করছে, কী বিষয়ে, আমি জানি না।”

“আমিও যাচ্ছি?” স্বামীকে জড়িয়ে ধরল বেইটা। জবাব দেওয়ার আগে চুমো খেল টোরান, “বোধহয়। বিপদ হতে পারে।”

“কোথায় বিপদ নেই?

“ঠিকই বলেছ। ও ভালো কথা, ম্যাগনিফিসোকে আনার জন্য লোক পাঠিয়েছি। চলে আসবে।”

“তার মানে এনজাইন ফ্যাক্টরির কনসার্ট বাতিল।”

“অবশ্যই।”

পাশের ঘরে গেল বেইটা। খাবারের সামনে বসল, যা দেখে কোনো সন্দেহই থাকল না যে ওগুলো বরবাদ হয়ে গেছে। অনায়াস দক্ষতায় স্যাণ্ডউইচ কেটে দুভাগ করল সে।

“কনসার্টের জন্য খারাপ লাগছে। ফ্যাক্টরির মেয়েগুলো অনেকদিন থেকে অপেক্ষা করছে। ম্যাগনিফিসো নিজেও।” মাথা নাড়ল সে, “অদ্ভুত একটা মানুষ।”

“শুধু তোমার মাতৃভাব জাগিয়ে তোলে, বে, আর কিছু না। কোনোদিন আমাদেরও সন্তান হবে, তখন ম্যাগনিফিসোর কথা ভুলে যাবে তুমি।”

মুখ ভর্তি স্যান্ডউইচ নিয়ে কিছু একটা বলল বেইটা।

তারপর স্যাণ্ডউইচ নামিয়ে রেখে মুহূর্তের মধ্যেই গুরুগম্ভীর হয়ে উঠে।

“টোরি।”

“উম্‌-ম-ম?”

“টোরি, আজকে সিটি হলে গিয়েছিলাম-ব্যুরো অফ প্রডাকশন এ। সেজন্যই ফিরতে দেরি হয়েছে।”

“কেন গিয়েছিলে?”

“আসলে…” বেইটা কেমন যেন দ্বিধাগ্রস্থ, অনিশ্চিত। “আগেই বুঝতে পেরেছিলাম, কিন্ত ফ্যাক্টরিতে কাজ করার সময় মেনে নিতে পারিনি। নৈতিকতা-জিনিসটার কোনো অস্তিত্বই নেই। মেয়েগুলো বিনা কারণেই অস্থির হয়ে পড়ে, কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। অসুস্থ না হলেও কেমন যেন পাগলাটে আচরণ করে। আমি যে সেকশনে কাজ করি সেখানে উৎপাদন আমি যখন হেভেনে আসি তখন যে উৎপাদন হত তার সিকিভাগও হয় না। প্রতিদিনই দেখা যায় কর্মী সংখ্যা– আগের দিনের চেয়ে কমছে।”

“বুঝলাম, তুমি ওখানে গিয়ে কী করেছ সেটা বল।”

“একটু খোঁজ খবর করলাম। একই অবস্থা, টোরি, পুরো হেভেনে একই অবস্থা। উৎপাদন কমে যাচ্ছে, ক্ষোভ আর অসন্তোষ বাড়ছে। ব্যুরো চিফের সাথে দেখা হওয়ার আগে এক ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। আর সে দেখা করে শুধু এই কারণে যে আমি কো-অর্ডিনেটরের আত্মীয়। লোকটা শুধু কাঁধ নেড়ে জানায় যে বিষয়টা ওর আয়ত্তের বাইরে। আমার মনে হয় এই অবস্থায় ব্যুরো চিফের কিছু আসে যায় না।”

“শোন, ভিত্তিহীন কথা বলো না।”

“ওর কোনো মাথা ব্যথা নেই,” ভীষণ রেগে উঠল বেইটা। “আমি বলছি কোথাও একটা ভুল হয়েছে। সেই একইরকম ভয়ংকর হতাশা গ্রাস করছে আমাকে, টাইম ভল্টে যেমন হয়েছিল, সেলডন যখন আমাদের হতাশ করলেন। তুমি নিজেও সেটা অনুভব করেছ।”

“হ্যাঁ, করেছি।”

“বেশ, সেটা আবার ফিরে এসেছে,” এখনো রেগে আছে সে। “আমরা মিউলকে কখনোই থামাতে পারব না। এমনকি আমাদের হাতে প্রয়োজনীয় অস্ত্র থাকলেও পারব না। কারণ এখন আমাদের সেই সাহস, উদ্যম এবং সদিচ্ছা নেই-টোরি, যুদ্ধ করে কোনো লাভ হবে না-”

বেইটাকে কখনো কাঁদতে দেখেছে টোরানের মনে পড়ে না। এখনো কাঁদছে না। কিন্তু হালকাভাবে তাকে জড়িয়ে ধরল টোরান, ফিস ফিস করে বলল, “ভুলে যাও, লক্ষ্মী। তোমার কথা আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কিছু-”

“হ্যাঁ, আমাদের কিছু করার নেই, সবাই বলছে একই কথা-আর আমরা ছুরির ডগার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছি কখন সেটা নেমে এসে আমাদের বুক এফোড় ওফোঁড় করে দেয়।”

বিষণ্ণ চিত্তে আবার খাওয়ার দিকে মনযোগ দিল বেইটা। টোরান নিঃশব্দে শোয়ার আয়োজনে ব্যস্ত। বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে ভালোমতোই।

রাণু, নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত কো-অর্ডিনেটর-যুদ্ধকালীন প্রয়োজনে হেভেনের কনফেডারেশন অফ সিটিজ তার অনুরোধে এই পদ সৃষ্টি করেছে। বাড়ির সবচেয়ে উপর তলায় নিজের কামরায় জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে। এখানে দাঁড়িয়ে শহরের সবুজ আর ঘরবাড়ির ছাদের উপর উঁকি মারতে পারে সে। কেভ লাইট কমে আসায় মনে হচ্ছে শহরটা পিছিয়ে এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে ছায়া আর কায়ার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। রাণ্ডু অবশ্য এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না।

এবলিং মিস-যার পরিষ্কার ছোট ছোট চোখ দেখে মনে হচ্ছে হাতের পানপাত্র ছাড়া জগতে আর কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। তাকে উদ্দেশ্য করে রাণু বলল, “হেভেনে একটা কথা খুব প্রচলিত। সেটা হচ্ছে, যখন কেভ লাইট নিভে যায় তখন নিষ্ঠাবান পরিশ্রমী মানুষদের ঘুমানোর সময়।”

“আপনি রাত করে ঘুমান?”

‘না। আপনাকে এত রাতে ডেকে আনার জন্য দুঃখিত, মিস। আসলে কেন যেন দিনের চেয়ে রাতে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। কেমন অদ্ভুত, তাই না? হেভেনের মানুষ একটা বিশেষ অবস্থার সাথে কঠিনভাবে নিজেদের অভ্যস্ত করে তুলেছে। সেটা হল আলো কমার অর্থ এখন ঘুমাতে হবে। আমিও ব্যতিক্রম নই। কিন্তু এখন সব যেন কেমন উল্টো হয়ে যাচ্ছে

“আপনি লুকোচ্ছেন,” পরিবর্তনহীন গলায় বলল মিস। “জেগে থাকার সময়ে আপনি অনেক মানুষের মাঝে থাকেন। বুঝতে পারেন তারা আপনার দিকে অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে। মনে হয় যেন এক জগদ্দল পাথরের বোঝা আপনার কাঁধে চেপে আছে। ঘুমানোর সময় নিজেকে মনে হয় ভারমুক্ত।”

“আপনিও বুঝতে পেরেছেন, তা হলে? পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ?”

আস্তে মাথা নাড়ল মিস, “পেরেছি। একধরনের গণমনোবৈকল্য, (ছাপার অযোগ্য) ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণহীণ আতঙ্ক। গ্যালাক্সি! রাণু, আর কী আশা করতে পারেন। সম্পূর্ণ একটা সভ্যতা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই অন্ধবিশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠেছে যে অতীতের কোনো এক ফোক হিরো তাদের জন্য সব পরিকল্পনা করে রেখেছেন এবং তিনি তাদের (ছাপার অযোগ্য) জীবনের সব বিষয়ের দায়িত্ব নেবেন। তাদের ধ্যান ধারণা গড়ে উঠেছে ধর্মীয় অনুভূতির মতন করে। এবং তার অর্থ কী আপনি ভালোভাবেই জানেন।”

“মোটেই না।”

মিস ব্যাখ্যা করার ধার দিয়েও গেল না। কখনোই তা করে না। দুআঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, “ক্যারেকটারাইজড বাই স্ট্রং ফেইথ রিঅ্যাকশন্স। বড় ঝাঁকুনি দিয়েও রক্তে মিশে যাওয়া বিশ্বাস নাড়ানো যায় না। যার ফলশ্রুতিতে দেখা দেয় মনোবৈকল্য। মাইল্ড কেসেস-হিস্টিরিয়া, নিরাপত্তাহীনতাবোধ। অ্যাডভান্সড কেসেস-পাগলামি এবং আত্মহত্যা।”

বুড়ো আঙুলের নখ কামড়ালো রাণ্ডু। “যখন সেলডন আমাদের নিরাশ করেন, অন্য কথায় বলা যায় আমাদের খুঁটি সরে যায়, যার উপর দীর্ঘদিন ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, তখন দেখা গেল যে আমাদের পেশি ক্ষয় হয়ে গেছে, আমরা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।”

“ঠিকই বলেছেন। আনাড়ি উপমা হলেও মোটামুটি ঠিকই বলেছেন।”

“আর আপনি এবলিং মিস, আপনার পেশির খবর কী?”

সিগারেটের ধোঁয়ায় বুক ভরে নিল সাইকোলজিস্ট, ছাড়ল ধীরে ধীরে। “একটু জং ধরেছে কিন্তু ক্ষয় হয়ে যায়নি। আমার পেশায় অনেক বেশি মুক্ত চিন্তা করতে হয়।”

“আর আপনি এই গোলকধাঁধা থেকে বেরনোর একটা পথ পেয়েছেন?”

“না, কিন্তু একটা পথ থাকতে বাধ্য। হয়তো সেলডন তার পরিকল্পনায় মিউলের জন্য কোনো প্রভিশন রাখেননি। হয়তো এই পরিস্থিতিতে আমাদের বিজয়ের নিশ্চয়তা তিনি দেননি। কিন্তু তিনি একথাও বলেননি যে আমরা হেরে যাব। তিনি শুধু খেলাটা কিছুক্ষণের জন্য আমাদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। মিউলকে ঠেকানো যাবে।”

“কীভাবে?”

“একমাত্র যে উপায়ে কাউকে ঠেকানো যায়-সবচেয়ে দুর্বল জায়গায় সর্বশক্তি নিয়ে আক্রমণ করে। রাণু, মিউল কোনো সুপারম্যান না। শেষ পর্যন্ত তাকে পরাজিত করতে পারলে, সবাই সেটা বুঝতে পারবে। ব্যাপারটা হচ্ছে সে আমাদের কাছে অপরিচিত, এবং দ্রুত কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। মনে করা হয় সে একটা মিউট্যান্ট। বেশ, তাতে কী? মানুষ জানে না বলেই একটা মিউট্যান্টকে ‘সুপারম্যান মনে করে। আসলে সেইরকম কিছু না।

“ধারণা করা হয় যে গ্যালাক্সিতে প্রতিদিন কয়েক মিলিয়ন মিউট্যান্ট এর জন্ম হয়। এই কয়েক মিলিয়ন এর ভেতর এক বা দুই পার্সেন্ট বাদ দিয়ে বাকি সবগুলোর মিউট্যাশন খালি চোখেই ধরা পড়ে, সেগুলো হয় অদ্ভুত গড়নের। বিনোদন কেন্দ্র বা গবেষণা কেন্দ্রের উপযোগী এক বা দুই পার্সেন্ট ম্যাক্রোমিউট্যান্ট এর ভিতর আবার খুব অল্প কয়েকটার মিউটেশন হয় ভালো নিরীহ কৌতূহলোদ্দীপক, কোনো একটা ক্ষেত্রে হয়তো অস্বাভাবিক, অন্যান্য ক্ষেত্রে হয় নরম্যাল-বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাবনরম্যাল। বুঝতে পারছেন, রা?”

“পারছি। কিন্তু মিউলের ব্যাপারটা কী?”

“মিউল একটা মিউট্যান্ট, এটা ধরে নিয়ে আমরা অনুমান করতে পারি যে নিঃসন্দেহে তার মেন্টাল পাওয়ারের উৎস আছে, যা সে বিশ্বগুলো দখল করার কাজে লাগাচ্ছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে তার অসম্পূর্ণতা আছে। সেটাই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। সেই অসম্পূর্ণতা যদি স্পষ্ট এবং হাস্যকর না হত, তা হলে নিজেকে গোপন করে রাখত না। যদি সে একটা মিউট্যান্ট হয়।”

“কোনো বিকল্প পথ আছে?”

“থাকতে পারে। মিউটেশন এর কিছু প্রমাণ ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচার-যে ফাউণ্ডেশন ইন্টেলিজেন্স এ কাজ করত-সগ্রহ করেছে। মিউল-বা মিউল নামে কোনো একজনের শৈশবের কিছু তথ্য থেকে সে নিজের উপসংহারে পৌঁছেছে। প্রিচার সেখানে গিয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রমাণ সংগ্রহ করে। কিন্তু মিউল সেগুলো নিজের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য রোপণ করে রেখেছিল হয়তো, কারণ নিঃসন্দেহে মিউট্যান্ট-সুপারম্যান হিসেবে মিউলের পরিচিতি রয়েছে।”

“ইন্টারেস্টিং। কতদিন থেকে এই লাইনে চিন্তা করছেন?”

“না, বিশ্বাস করার মতো করে কখনো চিন্তা করিনি। এটা শুধুই একটা বিকল্প যা বিবেচনা করা উচিত। ধরুন, রাণু, মিউল যে যন্ত্র দিয়ে নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশন দমন করতে পারে সেটার মতোই যদি তার কাছে এমন কোনো রেডিয়েশন ফর্ম থাকে যা দিয়ে মেন্টাল এনার্জি দমন করা যায়, তখন কী হবে, এহ? এর থেকে কী ব্যাখ্যা পাওয়া যায় আমাদের উপর কিসের আক্রমণ হচ্ছে-এবং ফাউণ্ডেশন-এর উপর কিসের আক্রমণ হয়েছিল?”

“মিউলের ক্লাউন নিয়ে আপনি যে রিসার্চ করলেন, তার ফলাফল কী?”

এখানে এসে একটু দ্বিধায় পড়ল এবলিং মিস, “এখন পর্যন্ত তেমন কিছু পাইনি। ফাউণ্ডেশন-এর পতনের আগের দিন মেয়রকে অনেক কিছু বলেছিলাম, প্রধানত তার মনোবল অটুট রাখার জন্য কিছুটা নিজের মনোবল অটুট রাখার জন্যও। কিন্তু, রা, যদি আমি গণিতের পুরো সাহায্য নেই তা হলে এই ক্লাউনকে দিয়েই মিউলের সম্পূর্ণ এনালাইসিস করতে পারব। তখন তাকে ফাঁদে ফেলা যাবে। আর যে

অস্বাভাবিক সমস্যা আমাকে ভাবাচ্ছে সেটারও সমাধান পাওয়া যাবে।”

“কী রকম?”

“থিংক, ম্যান। ইচ্ছা শক্তি দিয়েই ফাউণ্ডেশন নেভিকে পরাজিত করে মিউল, অথচ তার চাইতে দুর্বল ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট ট্রেডারদের ফ্লিটকে সরাসরি যুদ্ধে পিছু হটাতে পারেনি। প্রথম ধাক্কাতেই ফাউণ্ডেশন-এর পতন ঘটে; ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট ট্রেডাররা তার পুরো শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। নেমনের বণিকদের নিউক্লিয়ার ওয়েপনস নিষ্ক্রিয় করার জন্য সে প্রথম একটা এক্সটিংগুইশিং ফিল্ড ব্যবহার করে। বিস্ময়ের কারণেই বণিকরা ওই যুদ্ধে হেরে যায়, কিন্তু ফিল্ডটাকে তারা প্রতিহত করতে পারে। ইণ্ডিপেণ্ডেন্টস দের বিরুদ্ধে মিউল আর এটাকে সফলভাবে ব্যবহার করতে পারেনি।

“কিন্তু ফাউণ্ডেশন ফোর্সের বিরুদ্ধে এটা কাজ করেছে। কেন? এখন পর্যন্ত কোনো কারণ বের করা যায়নি। কাজেই এমন কোনো ফ্যাক্টর আছে যা আমরা জানি না।”

“বিশ্বাসঘাতকতা?”

“অল্প বুদ্ধির লোকের মতো কথা; (ছাপার অযোগ্য) মুখামি। ফাউণ্ডেশন-এর এমন কেউ নেই যে বিজয় সম্বন্ধে নিশ্চিত ছিল না। তা হলে বেঈমানি করবে কেন?”

হেঁটে বাঁকানো জানালার সামনে দাঁড়াল রাণু, ফাঁকা দৃষ্টি মেলে দিল বাইরের অদৃশ্যমানতার দিকে। “আমরা এখন নিশ্চিতভাবেই হেরে যাচ্ছি। যদি মিউলের হাজার কয়েক দুর্বলতা থাকে, যদি সে হয় অনেক গুলো ফুটোর একটা নেটওয়ার্ক”

যেন তার পৃষ্ঠদেশ, অস্থিরভাবে পরস্পরকে আঁকড়ে ধরা হাত দুটো কথা বলছে। ‘টাইম ভল্ট থেকে আমরা খুব সহজে পালাতে পেরেছি, এবলিং। অন্যরাও হয়তো পালিয়েছে। অল্প কয়েক জন পেরেছে। বেশিরভাগই পারেনি। এক্সটিংগুইশিং ফিল্ড হয়তো ব্যর্থ করা হয় কোনোভাবে। যার জন্য ব্যয় করতে হয় অপরিসীম মেধা এবং শ্রম। ফাউণ্ডেশন নেভির অধিকাংশ শিপ পালিয়ে হেভেন বা কাছাকাছি গ্রহগুলোতে চলে যায় এবং লড়াই চালাতে থাকে। মাত্র এক পার্সেন্ট সেটা পারেনি, ফলে শত্রুর হাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

“ফাউণ্ডেশন আণ্ডারগ্রাউণ্ড-যার উপর মানুষের আশা ছিল অনেক বেশিঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো ভূমিকাই পালন করেনি তারা। যথেষ্ট রাজনৈতিক বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে মিউল ধনী বণিকদের নিশ্চয়তা দেয় যে তাদের সম্পদ এবং ব্যবসা বাণিজ্য সে রক্ষা করবে, ফলে তারা যোগ দেয় মিউলের পক্ষে।”

“ধনিক গোষ্ঠী সবসময়ই আমাদের বিপক্ষে ছিল।” কাষ্ঠ গলায় বলল মিস।

“ক্ষমতাও সবসময়ই ওদের হাতে ছিল। শুনুন এবলিং। বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে মিউল বা তার কোনো প্রতিনিধি ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট ট্রেডারদের ক্ষমতাশালী লোকদের সাথে যোগাযোগ করেছে। আমার জানামতে সাতাশটা বণিক বিশ্বের দশটা মিউলের সাথে যোগাযোগ করেছে। আমার জানামতে সাতাশটা বণিক বিশ্বের দশটা মিউলের পক্ষে চলে গেছে। সম্ভবত আরো দশটা যাবো যাবো করছে। হেভেনে এমন অনেক লোক আছে যারা মিউলের শাসনেও সুখেই থাকবে। যদি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নিজের আধিপত্য বজায় রাখা যায় তা হলে বিপজ্জনক রাজনৈতিক ক্ষমতা ছেড়ে দিতে আগ্রহী হবে অনেকেই।”

“আপনার ধারণা হেভেন মিউলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবে না?”

“আমার ধারণা হেভেন সেই পথেই যাবে না।” দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখ নিয়ে সাইকোলজিস্টের দিকে ফিরল রাও। “আমার ধারণা হেভেন আত্মসমর্পণ করার জন্য অপেক্ষা করছে। সেইজন্যই আপনাকে ডেকেছি। আমি চাই আপনি হেভেন ত্যাগ করবেন।”

মিস এর মোটা চিবুক আরো মোটা দেখাল বিস্ময়ের কারণে, “এখনই!”

নিজেকে ভীষণরকম ক্লান্ত মনে হল রাঙ্গুর। “এবলিং, আপনি ফাউণ্ডেশন-এর সেরা সাইকোলজিস্ট। সত্যিকার মাস্টার সাইকোলজিস্টরা সেলডনের সাথেই হারিয়ে গেছেন। সেরা হিসেবে আপনাকেই আমরা পেয়েছি। মিউলকে হারাতে হলে আপনিই আমাদের একমাত্র ভরসা। এখানে বসে আপনি সেটা পারবেন না; যেতে হবে এম্পায়ার এর যে অবশিষ্ট অংশ এখনো টিকে আছে সেখানে।”

“ট্রানটরে?”

“ঠিক। এক সময়ে যা ছিল এম্পায়ার এখন তা নগ্ন কঙ্কাল, কিন্তু কেন্দ্রে এখনো কিছু না কিছু আছে। ওখানে প্রচুর রেকর্ড আছে, এবলিং। হয়তো আপনি আরো বেশি বেশি ম্যাথমেটিক্যাল সাইকোহিস্টোরি শিখতে পারবেন। সম্ভবত ক্লাউনের মাইণ্ড ব্যাখ্যা করার মতো যথেষ্ট। সেও অবশ্যই আপনার সাথে যাবে।”

শুকনো গলায় জবাব দিল মিস, “আমার সন্দেহ আছে। মিউলের ভয় বাদ দিলেও আপনার ভাস্তিকে ছাড়া সে যাবে না।”

“আমি জানি। সেজন্য টোরান এবং বেইটা আপনার সাথে যাবে। আর, এবলিং আরেকটা বড় উদ্দেশ্য আছে। তিন শ বছর আগে হ্যারি সেলডন দুটো ফাউণ্ডেশন তৈরি করেন; ওয়ান অ্যাট ইচ এণ্ড অব দ্য গ্যালাক্সি। ইউ মাস্ট ফাইণ্ড দ্যাট সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন।”

*