দ্বিতীয় পর্ব : দ্য মিউল - ২১. মহাকাশে অবকাশ
অবরোধ ভেদ করে বেরিয়ে আসা গেল নির্বিঘ্নে। স্পেস এর বিস্তৃতি এত সীমাহীন যে অনন্তকাল ধরে যত নেভি ছিল বা হতে পারত সবগুলো মিলেও পুরো স্পেস এর উপর নজরদারি করতে পারবে না। মাত্র একটা শিপ, একজন দক্ষ পাইলট এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাগ্যের সহায়তা পেলে বেরিয়ে আসার একটা পথ হয়তো তৈরি করে নেওয়া যাবে।
শীতল দৃষ্টি এবং শান্ত দৃঢ়তার সঙ্গে টোরান তার মহাকাশযান এক নক্ষত্রের সন্নিহিত অঞ্চল থেকে আরেক নক্ষত্রের দিকে নিয়ে গেল। নক্ষত্রের এত কাছে থাকায় অতিরিক্ত মধ্যাকর্ষণ ইন্টারস্টেলার জাম্প কঠিন এবং জটিল করে তুললেও, একই সাথে শত্রুর ডিটেকশন ডিভাইস ও অকার্যকর হয়ে পড়বে।
এবং নিপ্রাণ মহাকাশের ভিতরের বৃত্ত পেরিয়ে এসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল টোরান। তিন মাসের ভিতর এই প্রথম তার মনে হচ্ছে যেন নিঃসঙ্গতা কেটে গেছে। কারণ এখান থেকে সাব ইথারিক সংবাদ আদানপ্রদান শত্রু পক্ষ ধরতে পারবে না মোটেই।
এক সপ্তাহে ফাউণ্ডেশন-এর উপর ক্রমশ প্রভাব বিস্তারের নীরস আর প্রশংসায় ভরপুর সংবাদ ছাড়া আর কিছু ছিল না, সপ্তাহটা ছিল যখন টোরান একটা তৃরিত জাম্প দিয়ে পেরিফেরি থেকে বেরিয়ে আসছে।
এবলিং মিস এর ডাক শুনে সে চার্ট থেকে চোখ তুলে তাকাল শূন্য দৃষ্টিতে।
“কী হয়েছে?” মাঝখানের ছোট চেম্বারে নেমে এল টোরান, বেইটা এটাকে পরিণত করেছে লিভিং রুমে।
মাথা নাড়ল মিস, “জানি না। মিউলের সংবাদ পাঠক একটা স্পেশাল বুলেটিনের ঘোষণা দিয়েছে। ভাবলাম তুমিও হয়তো শুনতে চাইবে।”
“ভালো। বেইটা কোথায়?”
“ডিনারের ব্যবস্থা করছে।”
ছোট কট-ম্যাগনিফিসো যাতে ঘুমায়-তার কিনারে বসে অপেক্ষা করছে টোরান। মিউলের আপ্রচার মূলক স্পেশাল বুলেটিন বরাবরই একঘেয়ে। প্রথমে সামরিক বাদ্যযন্ত্র তারপর ঘোষকের তেলতেলে মুখ। শুরুতেই থাকে গুরুত্বহীন খবরগুলো। একটার পর একটা। তারপর একটু বিরতির পরে ট্রাম্পেটের বাজনা ধীরে ধীরে শ্রোতার উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলে।
কষ্ট করে সহ্য করল টোরান। আপন মনে বিড় বিড় করছে মিস।
সংবাদপাঠক প্রচলিত শব্দ ব্যবহার কবে যুদ্ধের সংবাদ পরিবেশন শুরু করল। মহাকাশে সংগঠিত এক লড়াইয়ে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া ইস্পাত এবং রক্তপাতের ঘটনা শব্দে রূপান্তর করে চলেছে।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্যামিল এর অধীনস্থ র্যাপিড ক্রুজার স্কোয়াড্রন আজ ইজ এর টাস্ক ফোর্স এর উপর প্রবল হামলা চালায়-” ঘোষকের ছবি মুছে গিয়ে কালো মহাশূন্যে মরণ পণ লড়াইয়ে ব্যস্ত যুদ্ধযানগুলোর ছুটোছুটির দৃশ্য ফুটে উঠল। নিঃশব্দ বিস্ফোরণের দৃশ্যের মাঝেই ঘোষকের কণ্ঠ বেজে চলেছে।
লড়াই এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল হেভি ক্রুজার ক্লাস্টার এর সাথে শত্রুপক্ষের ‘নোভা’ শ্রেণীর তিনটি শিপের বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ।
স্ক্রিনের দৃশ্য পাল্টে ফুটে উঠল বিশাল এক যুদ্ধযানের ছবি আর চকচকে শিপ নিয়ে উন্মাদ আক্রমণকারী চলে গেল দৃষ্টিসীমার বাইরে, বাঁক নিয়ে আবার ফিরে এল গোত্তা মেরে ছুটল আক্রমণের উদ্দেশ্যে এবং ক্লাস্টারের তীক্ষ্ণ অগ্রভাগে আক্রমণ চালিয়ে বিস্ফোরিত হল। প্রজ্বলিত শক্রযান এড়ানোর জন্য সামনের দিকে কিছুটা নিচু হল দানবের মতো যুদ্ধযানটা।
সংঘর্ষের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মসৃণ নিরাবেগ গলায় বর্ণনা করে গেল সংবাদ পাঠক।
কিছুক্ষণ বিরতির পর একই কণ্ঠস্বর বর্ণনা করে চলল নেমনের যুদ্ধের। তবে এবার আরো উদ্দীপক শব্দ এবং বিস্তারিত বর্ণনা ব্যবহার করল ঘোষক। স্ক্রিনে দেখা গেল একটা বিধ্বস্ত নগরী-হাত বাধা ক্লান্ত বন্দিদের দৃশ্য।
নেমন সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত হয়েছে।
আবার নীরবতা-এবং প্রত্যাশিত কর্কশ বাদ্যযন্ত্র। স্ক্রিনে দেখা গেল একটা লম্বা করিডর, দু পাশে সারিবাধা সৈনিক, তার শেষ মাথায় দ্রুত পায়ে একজন সরকারি মুখপাত্র এসে দাঁড়াল, পরনে কাউন্সিলরের ইউনিফর্ম।
নীরবতা অসহ্য ঠেকল দুই শ্রোতার কাছে।
তারপর যে কণ্ঠস্বর শোনা গেল সেটা গম্ভীর ধীরস্থির এবং কঠিন :
“আমাদের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী শাসকের নির্দেশে ঘোষণা করা হচ্ছে। যে, হেভেন নামক গ্রহ, যুদ্ধে বিরতি দিয়ে পরাজয় বরণ করে নিয়েছে স্বেচ্ছায়। এই মুহূর্তে আমাদের শাসকের সৈনিকেরা অবস্থান নিয়েছে গ্রহের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানগুলোতে। সকল ধরনের বিরোধীতা দমন করা হয়েছে শক্ত হাতে।”
মূল সংবাদপাঠককে আবার দেখা গেল স্ক্রিনে। জানিয়ে দিল গুরুত্বপূর্ণ কোনো সংবাদ পাওয়া গেলেই সেটা প্রচার করা হবে। তারপর শুরু হল একটা সঙ্গীতানুষ্ঠান। পাওয়ার অফ করে দিল মিস!
এলোমেলো পদক্ষেপে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেল টোরান। তাকে থামানোর কোনো চেষ্টাই করল না সাইকোলজিস্ট।
বেইটা কিচেন থেকে বেরিয়ে আসার পর খবরটা তাকে জানাল মিস “ওরা হেভেন দখল করে নিয়েছে।”
“এত জলদি?” অবিশ্বাসে চোখ দুটো গোলাকার হয়ে গেছে বেইটার, কিছুটা অসুস্থ মনে হল তাকে।
“বিনা যুদ্ধে (বিনা ছাপার…)-” থেমে কথাগুলো পেটের ভেতর নামিয়ে দিল আবার। “টোরানকে একা থাকতে দাও। ওর মন ভালো নেই। ওকে ছাড়াই খেতে বসব।”
একবার পাইলট রুমের দিকে তাকাল বেইটা “ঠিক আছে!”
ম্যাগনিফিসোর দিকে ওরা খুব একটা মনযোগ দিল না। সে অবশ্য চুপচাপ খাচ্ছেও খুব কম। শুধু ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে সামনে, মনে হচ্ছে যেন তার প্রতিটি রোমকূপ দিয়ে আতঙ্কের প্রবাহ চুঁইয়ে পড়ছে।
অন্যমনস্কভাবে বরফ দেওয়া ফুট-ডেজার্টের বাটিটা সরিয়ে কর্কশ গলায় এবলিং মিস বলল, “দুটো বণিক বিশ্বযুদ্ধ করে গেছে শেষ পর্যন্ত। তারা যুদ্ধ করল, রক্ত ঝরালো, পরাজিত হল, কিন্তু আত্মসমর্পণ করেনি। শুধু হেভেন-ঠিক ফাউণ্ডেশন-এর মতো-”
“কিন্ত কেন? কেন?”
মাথা নাড়ল সাইকোলজিস্ট। এখানেই আসল সমস্যা। প্রতিটি অস্বাভাবিক ঘটনা মিউলের চরিত্রের নিদর্শন। প্রথম সমস্যা, মাত্র এক হামলাতে বিনা রক্তপাতে মিউল কীভাবে ফাউণ্ডেশন দখল করল-যেখানে স্বাধীন বণিক বিশ্বগুলো তখনো প্রতিরোধ করে চলছিল। নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশনের উপর আবরণ তৈরি করা একটা নিচু মানের অস্ত্র-আমরা অনেকবার এটা নিয়ে আলোচনা করেছি, যতক্ষণ না ব্যাপারটা আমাকে অসুস্থ করে তোলে। কিন্তু চালাকিটা শুধু কাজ করে ফাউণ্ডেশন এর বেলায়।
“রাণুর ধারণা ছিল,” এবলিং মিস এর গ্রিজলি ভালুকের মতো ভুরু জোড়া ঘনিষ্ঠ হল, “জিনিসটা সম্ভবত রেডিয়্যান্ট-উইল-ডিপ্রেসর। হেভেনে হয়তো কাজ করেছে। কিন্তু ইজ বা নেমন এর বেলায় কেন ব্যবহার করা হয়নি-যারা এখন ফাউণ্ডেশন-এর প্রায় অর্ধেক ফ্লিট নিয়ে এখন পর্যন্ত মিউলের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ বজায় রেখেছে। হ্যাঁ, খবরে দেখা দৃশ্যে আমি ফাউণ্ডেশন শিপ চিনতে পেরেছি।”
“ফাউণ্ডেশন, তারপর হেভেন,” ফিসফিস করে বলল বেইটা। “বিপদ মনে হয় আমাদের পিছু পিছু ধেয়ে আসছে, কিন্তু স্পর্শ করছে না। প্রতিবারই মাত্র চুল পরিমাণ সময়ের আগেই বিপদ থেকে বেরিয়ে এসেছি। বরাবরই কী এমন ঘটবে?”
কিন্তু এবলিং মিস শুনছে না তার কথা, নিজের চিন্তাতেই কথা বলে চলেছে,”কিন্তু আরেকটা সমস্যা আছে-আরেকটা সমস্যা, বেইটা। মনে আছে খবরে বলা হয়েছিল যে মিউলের ক্লাউনকে টার্মিনাসে পাওয়া যায়নি; ধারণা করা হচ্ছে সে হেভেনে চলে গেছে বা অপহরণকারীরা তাকে সেখানে নিয়ে গেছে। ওর নিশ্চয়ই কোনো গুরুত্ব আছে, বেইটা, আমরা এখনো সেটা ধরতে পারিনি। ম্যাগনিফিসো নিশ্চয়ই এমন কিছু জানে মিউলের জন্য যা বিপজ্জনক। আমি নিশ্চিত।”
ম্যাগনিফিসো, চেহারা ফ্যাকাশে, ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছে, প্রতিবাদের সুরে বলল, “সায়ার…নোবল লর্ড…অবশ্যই, আমার অনেক কিছুই মনে নেই, আপনাদের সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারিনি। আমার ক্ষমতা অনুযায়ী যদুর সম্ভব বলেছি, এবং আপনি প্রোব দিয়ে আমার ভেতর থেকে আমি যা জানি, কিন্তু জানতাম না যে আমি জানি সেগুলোও বের করে এনেছেন।”
“জানি…জানি। ব্যাপারটা অনেক ছোট। এতই ছোট যে আমি বা তুমি কেউই চিনতে পারছি না। অথচ আমাকে বের করতেই হবে-নেমন আর ইজ এব পতন ঘটবে খুব শিগগিরই এবং তারপর শুধু অবশিষ্ট থাকব আমরা, স্বাধীন ফাউণ্ডেশন এর সর্বশেষ বিন্দু।”
গ্যালাক্সির মূল অংশ পাড়ি দেওয়ার সময় নক্ষত্রের ঝাঁক আরো ঘন হতে লাগলো। গ্র্যাভিটেশনাল ফিল্ড বাড়তে লাগলো লাফিয়ে লাফিয়ে আন্তনাক্ষত্রিক জাম্পের ক্ষেত্রে জটিলতা বাড়িয়ে তুলল। সতর্ক না হলেই বিপদ।
টোরান সতর্ক হল যখন একটা জাম্পের পর তাদের শিপ গিয়ে পড়ল একটা রেড জায়ান্টের শক্তিশালী মধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রের মাঝে এবং নিদ্রাহীন বারো ঘণ্টা কঠোর পরিশ্রমের পরই সেখান থেকে ধীরে ধীরে মুক্ত হতে পারল।
চার্টের অসম্পূর্ণতা, নিজের অদক্ষতা, অপারেশন এবং ম্যাথমেটিক্যাল অভিজ্ঞতার অভাবের কারণেই টোরান বাধ্য হয়ে ফিরে গেল পুরোনো যুগের জাম্পগুলোর মধ্যবর্তী অবস্থান প্লট করে করে এগোনোর পদ্ধতিতে।
ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে গেল একটা সম্মিলিত প্রচেষ্টার মতো। এবলিং মিস টোরানের হিসাবগুলো আবার পরীক্ষা করে দেখে, বেইটা বিভিন্ন পদ্ধতিতে একটা সম্ভাব্য পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। এমনকি ম্যাগনিফিসোকেও একটা কাজ দেওয়া হল। মেসিন থেকে শুধু হিসাবগুলো বের করা, একবার বুঝিয়ে দেওয়ার পরই প্রচুর আনন্দ পেল কাজটাতে এবং নিজের দক্ষতা প্রমাণ করল বিস্ময়করভাবে।
ফলে এক মাসের ভেতর বেইটা শিখল কীভাবে গ্যালাকটিক লেন্সের কেন্দ্র থেকে অর্ধেক দূরে শিপের ত্রিমাত্রিক মডেলের সাহায্যে চলার পথের উত্তপ্ত লাল রেখাটাকে পর্যবেক্ষণ করতে হয়, এবং বিদ্রুপারক সুরে বলতে পারে, ‘জানো জিনিসটা দেখতে কেমন? একটা দশ পাওয়ালা কেচোর মতো, যেন বদহজমের রোগে ধরেছে কেচোটাকে। আসলে তুমি আমাদেরকে আবার হেভেনেই ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।”
“নিয়ে যাব” হাতের চার্টে একটা জোরালো ঘুসি মেরে গজ গজ করল ট্র্যাভিজ “তুমি মুখ বন্ধ না করলে সেটাই করতে হবে।”
“এবং,” বলে চলেছে বেইটা, “সম্ভবত দ্রাঘিমাংশের ঠিক মাঝ দিয়ে সোজা এগোলে একটা পথ পাওয়া যাবে।”
“তাই, বোকা, আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ার মতো করে ওভাবে পথ বের করতে হলে পাঁচ শ শিপের পাঁচ শ বছর লাগবে। তা ছাড়া সোজা রাস্তাগুলো এড়িয়ে চলাই উচিত ওই পথে সম্ভবত শত্রুপক্ষের শিপ গিজ গিজ করছে। তা ছাড়া-”।
“ওহ, গ্যালাক্সি, কচি খোকার মতো ভয় দেখানো বন্ধ করো।” খপ করে টোরানের চুল টেনে ধরল সে।”
“আউচ! ছাড়ো!” আর্তনাদ করে উঠলো টোরান, তারপর বেইটার কবজিতে টান মেরে দুজনেই পড়ে গেল মেঝেতে, সেখানে বেইটা টোরান আর চেয়ার গুলো মিলে একটা জট পাকানো অবস্থা সৃষ্টি করেছে। যেন রুদ্ধশ্বাস কোনো রেসলিং ম্যাচ চলছে, যাতে কুস্তির কোনো চিহ্ন নেই, আছে শুধু খিলখিল হাসি আর হাত পায়ের দাপাদাপি।
হন্তদন্ত হয়ে ম্যাগনিফিসে ঢোকার পর নিজেকে আলাদা করে নিল টোরান।
“কী ব্যাপার?”
উদ্বেগে ক্লাউনের মুখের প্রতিটি রেখা টান টান। বিশাল নাকের ডগাটা সাদা হয়ে গেছে। “যন্ত্রগুলো কেমন যেন অস্বাভাবিক আচরণ করছে, স্যার। আমি কিছু জানি না বলে কোনোটাতে হাত দিইনি-”
দুই সেকেন্ডের ভেতর পাইলট রুমে হাজির হল টোরান। শান্ত সুরে ম্যাগনিফিসোকে নির্দেশ দিল, “এবলিং মিস কে ঘুম থেকে উঠাও। এখানে আসতে বল।”
বেইটা আঙুল চালিয়ে এলোমেলো চুল ঠিক করার চেষ্টা করছে। তাকে বলল টোরান, “আমরা ধরা পড়ে গেছি, বে?”
“ধরা পড়ে গেছি?” হাত দুটো দুপাশে ঝুলে পড়ল শিথিলভাবে। “কার কাছে?”
“গ্যালাক্সি জানে”, বিড়বিড় করল টোরান, “তবে আমার ধারণা ওদের কাছে ব্লাস্টার আছে এবং সেটা চালাতে জানে।”
চেয়ারে বসে এরই মধ্যে সে শিপ এর আইডেন্টিফিকেশন সাব-ইথারে পাঠানো শুরু করেছে।
যখন একটা বাথ রোব গায়ে চাপিয়ে ঘুম জড়ানো চোখে এবলিং মিস প্রবেশ করল, অতিরিক্ত শান্ত গলায় তাকে বলল টোরান, “মনে হচ্ছে ফিলিয়া নামক কোনো এক স্বাধীন রাজ্যের সিমান্তে ঢুকে পড়েছি।”
“কখনো নাম শুনিনি,” কাটাকাটা গলায় বলল মিস।
“আমি ও না,” জবাব দিল টোরান, “কিন্তু একটা ফিলিয়ান শিপ আমাদের থামিয়েছে, কেন, আমি জানি না।”
ফিলিয়ান শিপ এর ক্যাপ্টেন ইন্সপেক্টরের সাথে এল ছয় জন সশস্ত্র সৈনিক। লোকটা বেটে, পাতলা চুল, পাতলা ঠোঁট। চামড়া খসখসে। চেয়ারে বসে হাতের ফোলিও খুলে সাদা একটা পৃষ্ঠা বের করার আগে কাশল কর্কশভাবে।
“আপনাদের পাসপোর্ট এবং শিপ আইডেন্টিফিকেশন, প্লিজ।”
“নেই।” জবাব দিল টোরান।
“নেই?” বেল্ট থেকে মাইক্রোফোন খুলে কথা বলল দ্রুত, “তিন জন পুরুষ, একজন মহিলা। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই।” সেইসাথে নোট লিখল খোলা পৃষ্ঠায়।
“কোত্থেকে এসেছেন?” পরবর্তী প্রশ্ন।
“কোথায় সেটা?”
“ত্রিশ হাজার পারসেক, ট্রানটরের আশি ডিগ্রি পশ্চিমে। চল্লিশ ডিগ্রি-”
“নেভার মাইণ্ড, নেভার মাইণ্ড!” টোরান দেখল তার প্রশ্নকারী লিখছে পয়েন্ট অফ অরিজিন-পেরিফেরি।
“কোথায় যাচ্ছেন?” প্রশ্ন করা থামায়নি ফিলিয়ান।
“ট্রানটর সেক্টর।”
“উদ্দেশ্য?”
“আনন্দ ভ্রমণ।”
“কার্গো?”
“নেই।”
“হুম্-ম্-ম্। ঠিক আছে, চেক করতে হবে।” মাথা নাড়তেই সশস্ত্র দুজন লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল কাজে। বাধা দেওয়ার কোনো চেষ্টা করল না টোরান।
“ফিলিয়ান টেরিটোরিতে কেন এসেছেন?” ফিলিয়ানের দৃষ্টিতে বন্ধুত্বের কোনো ছোঁয়া নেই।
“কোথায় এসেছি জানতাম না। ভালো চার্ট নেই আমাদের কাছে।”
“না থাকার জন্য একশ ক্রেডিট জরিমানা-সেই সাথে অন্যান্য ফী দিতে হবে।”
আবার মাইক্রোফোনে কথা বলল-তবে বলার চেয়ে শুনল বেশি। তারপর টোরানকে জিজ্ঞেস করল, “নিউক্লিয়ার টেকনোলজি সম্বন্ধে কিছু জানেন?”
“সামান্য,” সতর্কভাবে জবাব দিল টোরান।
“তাই? পেরিফেরির লোকদের এ ব্যাপারে যথেষ্ট সুনাম আছে। একটা স্যুট পরে আমার সাথে আসুন।”
সামনে বাড়ল বেইটা। “ওকে নিয়ে কী করবেন আপনারা?”
হালকা টানে তাকে সরিয়ে আনল টোরান, ঠাণ্ডা সুরে জিজ্ঞেস করল, “আমাকে কোথায় যেতে হবে?”
“আমাদের পাওয়ার প্ল্যান্টের সামান্য মেরামতের প্রয়োজন। ও যাবে আপনার সাথে।” লোকটা আঙুল তুলল সরাসরি ম্যাগনিফিসোর দিকে, আর আতঙ্কে ছানা বড়া হয়ে উঠল ম্যাগনিফিগোর চোখ।
“ও গিয়ে কী করবে?” আক্রমণের ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল টোরান।
শীতল দৃষ্টি তুলে তাকাল অফিসার। “এই অঞ্চলে দস্যুতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এক কুখ্যাত দস্যুর চেহারার বর্ণনা আছে আমাদের কাছে। শুধু একটু মিলিয়ে দেখা আর কিছু না।”
ইতস্তত করছে টোরান, কিন্তু ছয়টা ব্লাস্টারের বিরুদ্ধে তর্ক করার কিছু নেই। কাপবোর্ডের দিকে হাত বাড়াল স্যুট বের করার জন্য।
এক ঘণ্টা পর, ফিলিয়ান শিপে প্রচণ্ড রাগ নিয়ে উঠে দাঁড়াল টোরান “মোটরের কোনো সমস্যা আমার চোখে পড়ছে না। বাসবার, এলটিউব, সব ঠিক মতো কাজ করছে। এখানের ইনচার্জ কে?”।
“আমি,” শান্তভাবে জবাব দিল হেড ইঞ্জিনিয়ার।
“আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যান-”
পথ দেখিয়ে তাকে অফিসারস লেভেলে নিয়ে আসা হল। ছোট এন্টি রুমে একজন মাত্র কেরানি বসে আছে।
“আমার সাথে যে লোক এসেছিল, সে কোথায়?”
“একটু অপেক্ষা করুণ,” জবাব দিল কেরানি।
ম্যাগনিফিসোকে নিয়ে আসা হল ঠিক পনের মিনিট পর।
“ওরা তোমাকে কী করেছে?” দ্রুত জিজ্ঞেস করলো টোরান।
“কিছু না। কিছু না।” না বোধক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ম্যাগনিফিসো।
দুই শ পঞ্চাশ ক্রেডিট দিয়ে ফিলিয়ানদের দাবি মেটানো হল-তারমধ্যে পঞ্চাশ ক্রেডিট দ্রুত ছাড়া পাওয়ার জন্য এবং আবার তারা বেরিয়ে এল মুক্ত মহাকাশে।
ওরা ফেরার পর জোর করে একটু হাসল বেইটা, আর দাঁত বের করা হাসি দিয়ে টোরান বলল, “ওটা ফিলিয়ান শিপ না-আরও কিছুক্ষণ নড়ছি না এখান থেকে। এদিকে এসো।”
ওর চারপাশে সবাই ভিড় জমাল।
“ওটা ফাউণ্ডেশন শিপ আর লোকগুলো মিউলের চামচা।”
হাত থেকে পড়ে যাওয়া সিগারটা তুলে এবলিং বলল, “এখানে? আমরা ফাউণ্ডেশন থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার পারসেক দূরে।”
“এবং আমরা এখানে এসেছি। ওদের আসতে বাধা কোথায়। গ্যালাক্সি, এবলিং আপনার ধারণা একটা শিপ দেখলে আমি চিনতে পারব না। আমি বলছি ওটা ফাউণ্ডেশন শিপ, ফাউণ্ডেশন ইঞ্জিন।”
“ওরা এখানেই কীভাবে আসল?” যুক্তিবোধ জাগিয়ে তোলার সুরে জিজ্ঞেস করল বেইটা। মহাকাশে দুটো নির্দিষ্ট শিপের দেখা হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?”
“ওসব ভেবে কী হবে?” গরম হয়ে উঠল টোরান। “পরিষ্কার বোঝা যায় আমাদের অনুসরণ করা হচ্ছে।”
“অনুসরণ?” অবজ্ঞার সুরে জিজ্ঞেস করল বেইটা। “হাইপার স্পেসের মধ্য দিয়ে?”
ক্লান্তভাবে বাধা দিল এবলিং মিস, “সম্ভব-দক্ষ একজন পাইলটের হাতে খুব ভালো একটা শিপ থাকলে সম্ভব। কিন্তু সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।”
“আমি তো ট্রেইল লুকানোর কোনো চেষ্টা করিনি।” বুঝানোর সুরে বলল টোরান। “টেক অফ করে একেবারে সোজা পথে এগিয়েছি। একটা অন্ধও আমাদের যাত্রা পথ হিসাব করে নিতে পারবে।”
“চলার পথের অল্প কয়েকটা চিহ্ন সে ধরতে পারবে।” চেঁচিয়ে বলল বেইটা। “যেরকম উদ্ভটভাবে তুমি জাম্প করেছ, তাতে প্রাথমিক গন্তব্য পর্যবেক্ষণ করে কিছুই বোঝা যাবে না। একাধিকবার জাম্প শেষে ভুল জায়গায় বেরিয়ে এসেছি।”
“সময় নষ্ট হচ্ছে,” দাঁতে দাঁত চেপে বলল টোরান। “ওটা মিউলের দখল করা ফাউণ্ডেশন শিপ। আমাদের সার্চ করেছে। ম্যাগনিফিসোকে নিয়ে আমার কাছ থেকে আলাদা রেখেছে। তোমাদের সন্দেহ হলেও যেন কিছু করতে না পারো জিম্মি হিসেবে নিয়ে গেছে আমাকে। আর এই মুহূর্তে আমরা ওটাকে মহাকাশেই জ্বালিয়ে দিতে যাচ্ছি।”
“দাঁড়াও, দাঁড়াও” হাত টেনে ধরে তাকে থামাল মিস। “তোমার ধারণা ওটা শত্রুদের শিপ। আর শুধু মনে করেই তুমি আমাদের সবার মরার ব্যবস্থা করবে? থিংক, ম্যান, ওই মরামাসগুলো বিপদসংকুল গ্যালাক্সির অসম্ভব পথ পাড়ি দিয়ে এতদূর এসেছে শুধু আমাদের চেহারা দেখে ছেড়ে দেওয়ার জন্য।”
“হয়তো আমরা কোথায় যাই সেটা জানার প্রতিই ওদের আগ্রহ।”
“তা হলে আমাদের থামালো কেন, কেন মনের ভেতর সন্দেহ ঢুকিয়ে দিল? তুমি এভাবে দুপথেই চলতে পারো না।”
“আমি আমার পথেই চলব। ছাড়ন, এবলিং, অন্যথায় আপনাকে আমার আঘাত করতে হবে।”
উঁচু আসন বিশিষ্ট প্রিয় চেয়ারে বসা অবস্থাতেই সামনে ঝুকল ম্যাগনিফিসো উত্তেজনায় তার লম্বা নাক লাল হয়ে আছে। “কথার মাঝখানে কথা বলার জন্য ক্ষমা করবেন, কিন্তু আমার ছোট মনে হঠাৎ করেই এক অস্বাভাবিক ভাবনার উদয় হয়েছে।”
টোরানের বিরক্তি বুঝতে পেরেই বেইটা এবলিং এর সাথে যোগ দিল তাকে শক্ত করে ধরে রাখার কাজে। “বলো, ম্যাগনিফিসো। আমরা সবাই তোমার কথা শুনছি।”
“ওদের শিপ এ থাকার সময় গোলকধাঁধার মতো বিভ্রান্তিকর কোনো ঘটনায় মানুষ যেমন জড়পদার্থের মতো হতবুদ্ধি হয়ে যায় আমিও ভয়ে তেমনি হতবুদ্ধি হয়ে পড়ি। আসলে কী ঘটেছে পুরোপুরি মনে নেই আমার। অনেক লোক আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, কথা বলছিল। কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। শেষে-যেন মেঘের ফাঁক দিয়ে একটুকরো রোদ এসে পড়ল-একটা মুখ আমি চিনতে পারলাম। মাত্র এক নজর, ক্ষণিকের জন্য-অথচ পুরো স্মৃতি এখনো আমার মনে জ্বলজ্বল করছে।”
“কে সে?” জিজ্ঞেস করল টোরান।
“ঐ সেই ক্যাপ্টেন, অনেকদিন আগে যে আমাদের সাথে ছিল, যখন আপনি আমাকে প্রথম বিপদ থেকে রক্ষা করেন।”
নিঃসন্দেহে ম্যাগনিফিসোর উদ্দেশ্য ছিল সবার ভেতরে চাঞ্চল্য তৈরি করা এবং লমুখের বাঁকানো হাসিতে পরিষ্কার বোঝা গেল সে সফল হয়েছে।
“ক্যাপ্টেন…হ্যান…প্রিচার?” কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করল মিস। “তুমি নিশ্চিত, কোনো ভুল হয়নি?”
“স্যার, আমি কসম খেয়ে বলছি,” এবং একটা কঙ্কালসার হাত রাখল পাতলা বুকের উপর। “এই সত্যি কথাটা আমি মিউলের সামনেও এমনভাবে কসম খেয়ে বলতে পারবো যে সে তার সমস্ত ক্ষমতা দিয়েও সেটা অস্বীকার করতে পারবে না।”
বেইটার মুখে নিখাদ বিস্ময়, তা হলে এত সবকিছু কেন ঘটছে?”
অধীর আগ্রহ নিয়ে তার মুখোমুখি হল ক্লাউন, “মাই লেডি, আমার একটা ধারণা আছে। ধারণাটা আমার মাথায় এসেছে একেবারে তৈরি অবস্থায়, যেন গ্যালাকটিক স্পিরিট সেটা আমার মনে ঢুকিয়ে দিয়েছে।” টোরানের তারস্বর প্রতিবাদ ছাপিয়ে তাকে কথা বলতে হচ্ছে উচ্চস্বরে।
“মাই লেডি,” সে শুধু মাত্র বেইটাকে উদ্দেশ্য করে কথা বলছে, “যদি এই ক্যাপ্টেনের আমাদের মতোই নিজের কোনো উদ্দেশ্য থাকে; হঠাৎ করে আমাদের মুখোমুখি হয়ে সেও ভাবতে পারে যে আমরা তাকে অনুসরণ করছি। ছোট্ট যে প্রহসনটা সে করল তাতে অবাক হওয়ার কী আছে?”
“তা হলে তার শিপে আমাদের নিয়ে গেল কেন?” জিজ্ঞেস করল টোরান। “ওটার কোনো অর্থ নেই।”
“কেন, অবশ্যই আছে,” প্রচণ্ড উৎসাহে উঁচু গলায় বলল ক্লাউন। “সে পাঠিয়েছে তার অধীনস্থদের যারা আমাদের চেনে না কিন্তু মাইক্রোফোনে আমাদের বর্ণনা দিয়েছে। যে ক্যাপ্টেন এসেছিল। সে আমার কিম্ভুত কিমাকার চেহারা দেখে অবাক হয়েছে, কোনো সন্দেহ নেই-কারণ, এই বিশাল গ্যালাক্সিতে আমার চেহারার সাথে মিলবে এমন লোক বলতে গেলে নেই। আপনাদের পরিচয়ের ব্যাপারে আমি ছিলাম প্রমাণ।”
“আর তাই সে আমাদের ছেড়ে দিল?”।
“ওর উদ্দেশ্য কি, সেটা কতখানি গোপনীয়, আমরা জানি? সে শুধু নিশ্চিত হতে চেয়েছে যে আমরা শত্রু নই। সেটা হওয়ার পরই বুঝতে পেরেছে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলে তার মিশনেরই ক্ষতি হবে।”
“গোয়ার্তুমি করো না, টোরি। ওর কথায় ঘটনার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে।” ধীরগলায় বলল বেইটা।
“এরকমটা হতে পারে,” একমত হল মিস।
সবার সম্মিলিত বিরোধীতার মুখে নিজেকে অসহায় মনে হল টোরানের। ক্লাউনের ব্যাখ্যায় কিছু একটা আছে যা তাকে খোঁচাচ্ছে। কোথাও একটা গলদ আছে। একটু বিভ্রান্ত এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও দমে এল ভেতরের রাগ।
“মুহূর্তের জন্য, ফিস ফিস করল সে, “আমার মনে হয়েছিল মিউলের একটা শিপ আমরা পেয়েছি।”
এবং মাতৃভূমি হেভেনের অপমানে বিশ্ন হয়ে উঠল তার চোখ দুটো।
বাকিরা সেটা ধরতে পারল।
*
নিওট্রানটর…ডেলিকাস এর ছোট্ট গ্রহ, মহাবিপর্যয়ের পর নতুনভাবে নামকরণ করা হয়, প্রায় এক শতাব্দী এটা ছিল ফার্স্ট এম্পায়ার এর সর্বশেষ রাজবংশের কেন্দ্রবিন্দু। এটা ছিল এক অপরিচিত অখ্যাত বিশ্ব এবং অখ্যাত সাম্রাজ্য এবং তার অস্তিত্ব ছিল কয়েকটা আইনের বলে। প্রথম নিওট্রানটোরিয়ান রাজ বংশের অধীনে…
এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাকটিকা—
*