দ্বিতীয় পর্ব : দ্য মিউল - ১৬. সম্মেলন
যখন শুধুমাত্র মাদার প্ল্যানেট টার্মিনাসের প্রতি চরম অবিশ্বাসের কারণে সাতাশটা স্বাধীন বণিক বিশ্ব একত্রিত হয় নিজেদের মাঝে তারা একটা সম্মেলনের আয়োজন করে। প্রতিটা গ্রহই নিজস্ব ক্ষুদ্রতা থেকে উদ্ভূত সিমাহীন অহংকারে সমৃদ্ধ, রুক্ষ কঠিন গ্রাম্য জীবনযাপনে অভ্যস্ত, এবং জাগতিক সমস্যা মোকাবিলা করে করে তিক্ত বিরক্ত। শুরুতেই অতি তুচ্ছ একটা সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে এই মন মরা গ্রহবাসীদের টালমাটাল অবস্থায় পড়তে হয়।
সমস্যাটা ভোটাভুটির নিয়ম, প্রতিনিধিদের ধরন-গ্রহের মান অনুযায়ী নাকি জনসংখ্যা অনুযায়ী হবে-ইত্যাদি বিষয় নির্ধারণ করা নিয়ে নয়, কারণ এই বিষয়গুলোর রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। আবার সমস্যাটা কাউন্সিল এবং ডিনারে কীভাবে টেবিল সাজানো হবে সেটা নিয়েও নয়; কারণ এই বিষয়গুলোর সামাজিক গুরুত্ব রয়েছে।
সমস্যা দেখা দেয় সম্মেলনের স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে-কারণ এটা অত্যন্ত প্রবল প্রাদেশিক মানসিকতার ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত কূটনীতির সর্পিল পথ তাদের নিয়ে যায় র্যাডল নামক গ্রহে যার পক্ষে কয়েকজন বক্তা শুরু থেকেই যুক্তি দেখিয়ে বলছিলেন যে এটা মোটামুটি কেন্দ্রে অবস্থিত।
র্যাডল ক্ষুদ্র এক বিশ্ব-সামরিক গুরুত্ব বিবেচনায় যা সাতাশটা গ্রহের মাঝে সবচেয়ে দুর্বল। এবং এই গ্রহ বেছে নেওয়ার এটাও একটা কারণ।
এটা একটা রিবন ওয়ার্ল্ড-গ্যালাক্সি যাকে নিয়ে অহংকার করতে পারে, কিন্তু অধিবাসীদের অল্পসংখ্যকই শারীরিক গঠনে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। অন্য কথায় বলা যায় এটা এমন একটা বিশ্ব যেখানে দুই তৃতীয়াংশ অধিবাসী বিরামহীনভাবে অত্যধিক ঠাণ্ডা এবং অত্যধিক গরমের মোকাবেলা করতে বাধ্য হয়, যেখানে জীবনধারণের সম্ভ্যাব্য স্থিতিশীল স্থান হচ্ছে রিবন বেষ্টিত আধো আলোকিত অঞ্চল।
এমন একটা গ্রহ কারো কাছেই আকর্ষণীয় মনে হতে পারে না। কিন্তু এখানে ভূ তাত্ত্বিক কৌশলে বিশেষ ধরনের কিছু স্থান তৈরি হয়েছে-র্যাডল সিটি এমনি একটি স্থানে অবস্থিত।
একটা পর্বতের মসৃণ পাদদেশে এই শহর বিস্তৃত-যে পর্বত শীর্ষ শীতল আবহাওয়া এবং ভয়ংকর তুষারপাত থেকে রক্ষা করছে শহরটাকে। উষ্ণ এবং শুকনো বায়ু শহরটাকে আরামদায়ক করে তুলেছে, পাহাড় চূড়ার বরফ গলিয়ে পাইপের সাহায্যে পানি সরবরাহ করা হয়-এবং এ দুয়ের মাঝে র্যাডল সিটি পরিণত হয়েছে এক চিরস্থায়ী উদ্যানে, অন্তহীন ভোরের আলোয় সিক্ত।
প্রতিটা বাড়ির সামনে রয়েছে উন্মুক্ত বাগান। প্রতিটা বাগান উদ্যানবিদ্যার চমৎকার নিদর্শন, সেখানে চমৎকার প্যাটার্নে মূল্যবান উদ্ভিদ জন্মানো হয়েছে ছিল তাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একমাত্র উপায়-যতদিন না র্যাডল সাধারণ বণিক বিশ্ব থেকে উৎপাদনকারী বিশ্বে পরিণত হয়।
কাজেই ভয়ানক এক বিশ্বে র্যাডল সিটি হল কোমলতা এবং প্রাচুর্যের ক্ষুদ্র বিন্দু, এক টুকরো স্বর্গ-এবং এই গ্রহ বেছে নেওয়ার এটাও একটা কারণ।
বাকি ছাব্বিশটা বণিক বিশ্ব থেকে নানা বর্ণের লোক এসে হাজির হয়েছে: প্রতিনিধি এবং তাদের স্ত্রী, সেক্রেটারি, সাংবাদিক, স্পেসশিপ এবং সেগুলোর কু-অল্প দিনেই প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেল র্যাডলের জনসংখ্যা এবং টান পড়ল তার সীমিত সম্পদে।
হৈ হুল্লোড়ে মেতে থাকা মানুষগুলোর মাঝে অল্প কয়েকজন আছে যারা বাস্ত বিকই জানে না যে গ্যালাক্সিতে নিঃশব্দে একটা যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। এবং যারা জানে তাদের ভেতর তিনটা শ্ৰেণী আছে। প্রথমত যারা জানে কম কিন্তু প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী-
যেমন ঐ তরুণ স্পেস পাইলট, যার টুপিতে হেভেন এর ব্যাজ লাগানো এবং বিপরীত দিকের র্যাডলিয়ান তরুণীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কায়দা করে চোখের সামনে গ্লাস ধরে রেখেছে। সে বলছিল : “এখানে আসার সময় আমরা যুদ্ধক্ষেত্রের ভেতর দিয়ে এসেছি। ঠিক হোরলেগর এর ভিতর দিয়ে এক লাইট মিনিট বা একটু বেশিও হতে পারে-দূরত্ব পেরিয়ে আসতে হয়।”
“হোরলেগর?” লম্বা পায়ের স্থানীয় অধিবাসী বলল। “গত সপ্তাহে মিউল ওখানে শক্ত মার দিয়েছে, তাই না?”
“আপনি কার কাছে শুনলেন মিউল শক্ত মার দিয়েছে?” চমৎকার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল তরুণ পাইলট।
“ফাউণ্ডেশন রেডিও।”
“হ্যাঁহ? হ্যাঁ, হোরলেগর দখল করেছে। আমরা ওদের একটা কনভয়ের প্রায় মাঝখানে গিয়ে পড়ি। শক্ত মার দেওয়ার মতো কিছু না।”
খসখসে উঁচু গলায় কথা বলল কেউ একজন, “অমন কথা কইয়েন না। ফাউণ্ডেশন হগল সময়ই আগে মাইর খায়। খালি দেখতে থাহেন। ব্যাবাক ফাউণ্ডেশন জানে কহন পাল্টা মাইর দিতে অইব, তারপর-বুম!” চিকন গলা মুখে পাতলা হাসি ছড়িয়ে তার কথা শেষ করল।
“যাই হোক, কিছুক্ষণ নীরব থেকে হেভেনের পাইলট বলল, “আমরা মিউলের শিপগুলো দেখেছি, এবং বেশ ভালোই মনে হয়েছে, বেশ ভালো। সত্যি কথা বলতে কি একেবারে নতুন দেখাচ্ছিল।”
“নতুন?” চিন্তিত সুরে বলল স্থানীয় অধিবাসী, “ওরা নিজেরা তৈরি করেছে?” মাথার উপরের ডাল থেকে পাতা ছিঁড়ল একটা, নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুকল, তারপর চিবোতে লাগল। এক ধরনের কটু গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল পুরো ঘরে। “তুমি বলতে চাইছ নিজেদের তৈরি জিনিস দিয়ে ওরা ফাউণ্ডেশন-এর যুদ্ধযানগুলোকে পরাজিত করেছে? বলে যাও।”
“আমরা নিজের চোখে দেখেছি, ডক।”
সামনে ঝুঁকল স্থানীয় অধিবাসী, “জানো আমি কী ভাবছি? শোন। নিজেকে তামাশায় পরিণত করো না। সবকিছু সামাল দেওয়ার জন্য আমাদের তুখোড় লোজন আছে। তারা জানে কী করতে হবে।”
সেই খসখসে কণ্ঠস্বর আবার কথা বলল উঁচু গলায়, “খালি দেখতে থাহেন। ফাউণ্ডেশন একেবারে শেষ মুহূর্তের লাইগা অপেক্ষা করতাছে, তারপর বুম!” সামনে দিয়ে একটা মেয়ে যাচ্ছিল, তার দিকে তাকিয়ে হাসল বোকার মতো।
স্থানীয় অধিবাসী বলে চলেছে, “যেমন, তোমার কি ধারণা পরিস্থিতি মিউলের পক্ষে। না-আ-আ। আমি শুনেছি এবং বেশ গুরুত্বপূর্ণ লোকের কাছ থেকেই শুনেছি যে সে আমাদের লোক। আমরা তাকে পয়সা দিচ্ছি, এবং ঐ শিপগুলো সম্ভবত আমরাই তৈরি করে দিয়েছি। অবশ্যই ফাউণ্ডেশনকে সে পরাজিত করতে পারবে না, কিন্তু একটু নড়বড়ে অবস্থায় ফেলে দিতে পারবে, আর সেই অবস্থাতেই আমরা নিজেদের কাজ সেরে ফেলব।”
বিপরীত দিকে বসা তরুণী বলল, “যুদ্ধ ছাড়া তোমাদের আর কোনো আলোচনা নেই, ক্লেভ? বিরক্ত হয়ে গেছি।”
“বিষয় পাল্টানো যাক। মেয়েদের বিরক্ত করে লাভ নেই।” অতিরিক্ত ভদ্রতার সাথে বলল হেভেনের পাইলট।
সুযোগটা লুফে নিল একজন, একটা মগে তাল ঠুকল সে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দুজনের ছোট ছোট দলগুলো খিলখিল হাসিতে গড়িয়ে পড়ল, একইরকম আরো কয়েকটা দল বেরিয়ে এল পিছনের সান হাউস থেকে।
তারপরের আলোচনা হয়ে গেল অতি সাধারণ, বিভিন্নমুখী এবং অর্থহীন—
আর আছে তারা যারা কিছুটা কম জানে এবং কিছুটা কম আত্মবিশ্বাসী।
যেমন এক হাতঅলা ফ্র্যান, হেভেনের অফিসিয়াল প্রতিনিধি, এবং সে নতুন নতুন মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব পাতানো নিয়ে ব্যস্ত-ঠেকায় পড়ে দু-একজন পুরুষের সাথে বন্ধুত্ব করতে বাধ্য হচ্ছে।
সেরকমই একজন বন্ধুর পাহাড় চূড়ার বাড়ির সান প্ল্যাটফর্মে সে উদ্বেগ ঝেড়ে ফেলে একটু আয়েশি সময় কাটাচ্ছে এবং র্যাডলে আসার পর এটা নিয়ে মাত্র দুইবার এভাবে বিশ্রাম নিয়েছে। নতুন বন্ধুর নাম আইয়ো লিয়ন, খাঁটি র্যাডলিয়ান। আইয়োর বাড়ি লোকালয় থেকে অনেকটা দূরে, ফুলের সুবাস এবং কীট পতঙ্গের সুরেলা ঐকতানের মিলিত সমুদ্রের মাঝখানে একা। সান-প্ল্যাটফর্ম পয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে তৈরি করা ঘাস পূর্ণ একটা লন। তার উপর দাঁড়িয়ে ফ্যান সারা গায়ে সূর্যের আলো মাখছে।
“হেভেনে এরকম কিছু নেই।” বলল সে।
ঘুমজড়িত গলায় জবাব দিল আইয়ো, “ঠাণ্ডা অঞ্চলগুলো কখনো দেখেছ। এখান থেকে বিশ মাইল দূরে একটা স্পট আছে যেখানে অক্সিজেন পানির মতো প্রবাহিত হয়।”
“চালিয়ে যাও।”
“সত্যি কথা।”
“বেশ, আমি বলছি, আইয়ো-হাত হারানোর আগে আমি অনেক ঘুরে বেরিয়েছি-এবং তুমি বিশ্বাস করবে না, কিন্তু এরপর সে এক দীর্ঘ কাহিনী শোনালো এবং আইয়ো সেটা বিশ্বাস করল না। হাই তুলতে তুলতে বলল, “সবকিছু বদলে গেছে, পুরোনো দিন আর নেই এটাই সত্যি।”
“না,” রেগে উঠল ফ্র্যান, “ওই কথা বলবে না। আমার ছেলের কথা তোমাকে বলেছি, তাই না? ও অনেকটা পুরোনো ধ্যান ধারণায় শিক্ষিত। অনেক বড় একজন ট্রেডার হবে সে, বিশ্বাস করো। আপাদমস্তক বুড়ো বাপের মতো, আপাদমস্তক, পার্থক্য শুধু যে সে বিয়ে করেছে।”
“মানে লিগ্যাল কন্ট্রাক্ট? একটা মেয়ের সাথে?”
“ঠিক। আমি নিজেও এর কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না। হানিমুনের জন্য ওরা গেছে কালগানে।”
“কালগান? কালগান? গ্যালাক্সির এই পরিস্থিতিতে?”
চওড়া হাসি হাসল ফ্র্যান,অর্থবহ ভঙ্গিতে নিচু গলায় বলল, “ফাউণ্ডেশন-এর বিরুদ্ধে মিউলের যুদ্ধ ঘোষণার ঠিক কয়েকদিন আগে।”
“তাই?”
মাথা নাড়ল ফ্র্যান, ইশারায় আইয়োকে কাছে আসতে বলল, “একটা গোপন খবর দেই, কাউকে বলো না। আমার ছেলেকে একটা উদ্দেশ্য নিয়ে কালগানে পাঠানো হয়েছে। কী উদ্দেশ্য সেটা এই মুহূর্তে বলতে চাই না, তবে আমার মনে হয় তুমি অনুমান করে নিতে পারবে। যাই হোক আমার ছেলেই কাজটার জন্য উপযুক্ত ছিল। আমাদের একটা ফুটো দরকার ছিল।” কুটিল ভঙ্গিতে হাসল সে। “আমরা সেটা পেয়েছি। আমার ছেলে কালগানে গেল, এবং তার পরেই মিউল তার শিপ পাঠালো। আমার ছেলে!”
আইয়ো সত্যিই চমকৃত। “বেশ ভালো। তুমি জানো, তুমি জানো আমাদের পাঁচ শ শিপ পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে আছে।”
“সম্ভবত আরো বেশি।” কর্তৃত্বের সুরে বলল ফ্র্যান। “কৌশলটা আমার পছন্দ হয়েছে।” শব্দ করে পেটের চামড়া খামচে ধরল সে। “কিন্তু ভুলে যেয়ো না মিউল অত্যন্ত চতুর। হোরলেগরে যা ঘটেছে সেটা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে।”
“শুনলাম সে নাকি দশটা শিপ হারিয়েছে।”
“হ্যাঁ, কিন্তু আরো একশ টা আছে, এবং ফাউণ্ডেশন পরাজিত হয়েছে। ওরা হেরে যাক আমি সেটাই চাই, কিন্তু এত দ্রুত না।” মাথা নাড়ল সে।
“কিন্তু, আমার প্রশ্ন হচ্ছে, মিউল এই শিপগুলো পেল কোথায়? গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে আমরাই ওগুলো তাকে বানিয়ে দিচ্ছি।”
“আমরা? বণিকরা? হেভেনের সবচেয়ে বড় শিপ ফ্যাক্টরি স্বাধীন বিশ্বগুলোর কোনো একটাতে আছে, আর আমরা নিজেদের জন্য ছাড়া অন্য কারো জন্য কিছু তৈরি করিনি! তোমার কি মনে হয় কোনো বিশ্ব আমাদের ইউনাইটেড অ্যাকশনের কথা চিন্তা না করেই মিউলের জন্য একটা ফ্লিট তৈরি করে দেবে। এটা পুরোপুরি…কাল্পনিক গল্প।” ।
“বেশ, কোত্থেকে পাচ্ছে?”
শ্রাগ করল ফ্র্যান, “মনে হয়, তৈরি করছে নিজেই। এটাও আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে।”
পিট পিট করে সূর্যের দিকে তাকাল ফ্র্যান এবং পালিশ করা পাদানিতে পা ভাঁজ করে ঘুমিয়ে পড়ল ধীরে ধীরে। পোকামাকড়ের গুঞ্জন এবং তার নাক ডাকার শব্দ একাকার হয়ে গেল।
শেষ দলে রয়েছে সেই অল্প কয়েকজন যারা জানে অনেক বেশি কিন্তু আত্মবিশ্বাস একেবারেই নেই।
যেমন রাণ্ড, অল ট্রেডার কনভেনশন এর পঞ্চম দিনে যে কিনা সেন্ট্রাল হলে প্রবেশ করে দেখতে পেল যে দুজনকে থাকতে বলেছিল তারা অপেক্ষা করছে। পাঁচশ আসনের সবগুলো শূন্য-এবং এরকমই থাকবে।
সবার আগেই দ্রুত কথা বলল রাও, “আমরা তিন জন স্বাধীন বণিক বিশ্বের সম্ভাব্য সামরিক শক্তির প্রায় অর্ধেকের প্রতিনিধিত্ব করছি।”
“হ্যাঁ,” বলল ইজ এর ম্যানগিন, “আমি আর আমার সহকর্মী একটু আগেই এটা নিয়ে কথা বলছিলাম।”
“আমি তৈরি,” বলল রাও, “কথা বলার জন্য। তর্ক করতে বা জটিলতা বাড়াতে চাই না আমি। আমাদের অবস্থান খুবই খারাপ।”
“কারণ-” বলল, নেমন এর ওভাল গ্রী।
“গত এক ঘন্টার পরিস্থিতির পরিবর্তন। প্লিজ! প্রথম থেকেই শুরু করা যাক। প্রথমত বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা যে কিছু করতে পারব না শুধু তাই নয়, পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। শুধু মিউলকেই নয়, আরো অনেককেই আমাদের সামলাতে হবে; বিশেষ করে কালগানের প্রাক্তন ওয়ারলর্ড মিউল যাকে অসময়ে পরাজিত করে আমাদের সমস্যায় ফেলে দেয়।”
“হ্যাঁ, কিন্তু মিউল বিকল্প হিসেবে কার্যকরী,” বলল ম্যানগিন “আমি আপত্তি তুলতে চাই না।”
“পুরোটা জানলে ঠিকই তুলতে।” সামনে ঝুঁকে রাণ্ডু বাহু ঊর্ধ্বমুখী করে টেবিলে ভর দিল। “একমাস আগে আমি আমার ভাতিজা আর ভাতিজা বউকে কালগানে পাঠিয়েছিলাম।”
“তোমার ভাতিজা,” বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল ওভাল গ্রী। “আমি জানতাম না যে ও তোমার ভাতিজা।”
“কী উদ্দেশ্যে,” শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল ম্যানগিন। “এটা?” এবং বুড়ো আঙুল উঁচু করে মাথার উপরে একটা বৃত্ত রচনা করে দেখাল সে।
‘না। তুমি যদি ফাউণ্ডেশন-এর বিরুদ্ধে মিউলের যুদ্ধের কথা বুঝিয়ে থাক, তা হলে না। ছেলেটা কিছুই জানে না-আমাদের সংগঠন বা আমাদের লক্ষ্য কিছুই না। ওকে বলেছি যে আমি একটা ইন্ট্রা-হেভেন প্যাট্রিয়টিক সোসাইটির নিচু পদের সদস্য, এবং কালগানে তার কাজ হবে একটু চোখ কান খোলা রাখা। স্বীকার করছি, উদ্দেশ্য আমার নিজের কাছেও পরিষ্কার ছিল না। মূলত আমি মিউলের ব্যাপারে কৌতূহলী ছিলাম। তার ঘটনাটা অদ্ভুত এবং বিস্ময়কর-তবে সেটা পুরোনো কথা; সেদিকে আর যাব না। দ্বিতীয়ত এটা তার জন্য প্রশিক্ষণমূলক প্রজেক্ট হিসেবে কাজ করবে যার ফাউণ্ডেশন এবং ফাউণ্ডেশন আণ্ডারগ্রাউন্ডের ব্যাপারে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। তোমরা”
ওভাল গ্রি যখন দাঁত বের করে হাসে তখন অসংখ্য ভাজ পড়ে তার মুখে, “তুমি নিশ্চয়ই ফলাফল দেখে বিস্মিত হয়েছ, কারণ আমার বিশ্বাস এমন কোনো বণিক বিশ্ব নেই যারা জানে না যে তোমার ভাতিজা ফাউণ্ডেশন-এর নাম ভাঙিয়ে মিউলের একজন লোককে ভাগিয়ে এনে তাকে খেপিয়ে তুলেছে। গ্যালাক্সি, রাণ্ড, ইউ স্পিন রোমান্সেজ। এ ব্যাপারে তোমার কোনো হাত নেই এটা আমি বিশ্বাস করি না। শোন, চমৎকার দেখিয়েছ।”
সাদা চুল ভর্তি মাথা নাড়ল রাণু। “আমি কিছু করিনি। আমার ভাতিজার ইচ্ছাতেও কিছু ঘটেনি। সে এখন ফাউণ্ডেশন-এর জেলে বন্দি, এবং সম্ভবত তথাকথিত চমৎকার কাজের চূড়ান্ত ফলাফল দেখার জন্য বেঁচে থাকবে না। ওর কাছ থেকে খবর পেয়েছি। চোরাইপথে কোনোভাবে একটা পারসোন্যাল ক্যাপসুল পাঠিয়েছে, যুদ্ধ ক্ষেত্র পাড়ি দিয়ে প্রথমে পৌঁছেছে হেভেনে, সেখান থেকে এখানে, পুরো একমাস লেগেছে।”
“এবং?–”
বিষণ্ণ স্বরে রাণু বলল, “সম্ভবত আমরাও কালগানের প্রাক্তন ওয়ারলর্ডের মতো একই ভূমিকা পালন করছি। মিউল একটা মিউট্যান্ট।”
সবার পেটের ভেতরে নাড়িভূঁড়ি পাক দিয়ে উঠল, হার্টবিট মিস করল। এগুলো সবই অনুমান করতে পারছে রাণু।
ম্যানগিন অবশ্য কথা বলল স্বাভাবিক সুরে, “তুমি কীভাবে জানো?”
“আমার ভাতিজার কাছে শুনেছি।”
“কী ধরনের মিউট্যান্ট? সব ধরনেরই তো আছে।”
“হ্যাঁ, অনেক ধরনের, হ্যাঁ ম্যানগিন। ঠিকই বলেছ! কিন্তু মিউল একটাই। কী ধরনের মিউট্যান্ট শূন্য থেকে শুরু করে একটা আর্মি গড়ে তুলতে পারে, শুনেছি প্রথমে একটা পাঁচ মাইল লম্বা অ্যাস্টেরয়েডে মূলঘাঁটি স্থাপন করে সে, সেখান থেকে একটা গ্রহ দখল করে, তারপর একটা সিস্টেম, তারপর একটা রিজিওন-তারপর ফাউণ্ডেশন আক্রমণ করে এবং আমাদের পরাজিত করে হোরলেগরে এবং সবকিছুই ঘটেছে মাত্র দুই তিন বছরে!”
শ্রাগ করল ওভাল গ্রী, “তো তুমি ধরে নিচ্ছ সে ফাউণ্ডেশনকে পরাজিত করতে পারবে।”
“আমি জানি না। ধরে নাও পারল?”
“দুঃখিত, মানতে পারলাম না। ফাউণ্ডেশনকে পরাজিত করা যাবে না। দেখ, একটা… একটা অনভিজ্ঞ ছোকরার মন্তব্য শুনে আমাদের নতুন কিছু করতে যাওয়া ঠিক হবে না। বরং এই ব্যাপারটা কিছু সময়ের জন্য স্থগিত রাখা যাক। মিউল যত যুদ্ধই জয় করুক না কেন আমাদের চিন্তার কিছু নেই, তাই না?”
ভুরু কুঁচকে দুজনকেই জিজ্ঞেস করল রাণু, “এখন পর্যন্ত মিউলের সাথে আমরা কোনো যোগাযোগ করতে পেরেছি?”
“না,” দুজন একসাথে উত্তর দিল।
“সত্যি কথা, যদিও আমরা চেষ্টা করেছি, তাই না? সত্যি কথা তার কাছে পৌঁছতে না পারলে এত মিটিং করে কিছুই হবে না। সত্যি কথা যে, দেয়ার হ্যাঁজ বিন মোর ড্রিংকিং দ্যান থিংকিং, অ্যাণ্ড মোর ওয়িং দ্যান ডুয়িং-আজকের র্যাডল ট্রিবিউনে এই কথাগুলো লিখেছে-এবং সবকিছুর মূলে কারণ হচ্ছে আমরা মিউলের সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। জেন্টলম্যান, আমাদের এক হাজার শিপ প্রস্তুত হয়ে আছে, ঠিক সময়মতো উড়ে গিয়ে ফাউণ্ডেশন-এর হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেবে। আমার মতে সেই সিদ্ধান্ত এখনই বদলানো উচিত। এই মুহূর্তে এক হাজার শিপ রওয়ানা করিয়ে দেওয়া উচিত-মিউলের বিরুদ্ধে।”
“মানে স্বৈরাচারী ইণ্ডবার এবং রক্তচোষা ফাউণ্ডেশন-এর পক্ষে কাজ করতে বলছ?” চরম বিদ্বেষের সাথে জিজ্ঞেস করল ম্যানগিন।
ক্লান্ত হাত তুলল রাণু, “আমি বলেছি মিউলের বিরুদ্ধে পাঠাতে হবে, এবং অন্য সকল বিষয় আমার কাছে এখন তুচ্ছ।”
ওভাল গ্রি উঠে দাঁড়াল, “রাও, এই ব্যাপারে আমার কিছু করার নেই। যদি পলিটিক্যাল সুইসাইড করার খুব বেশি ইচ্ছা হয় তা হলে রাতের কাউন্সিলে সব খুলে বলো।”
আর একটাও কথা না বলে সে চলে গেল, নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করল ম্যানগিন। রাকে একা ফেলে রেখে গেল সমাধানহীন সমস্যার সাগরে।
রাতের কাউন্সিলে সে কিছুই বলল না।
কিন্তু পরেরদিন সকালেই হন্তদন্ত হয়ে তার কামরায় এসে হাজির হল ওভাল গ্রী। এলোমেলো পোশাক, শেভ করেনি, চুল আঁচড়ায়নি।
রাণ্ডু মাত্র ব্রেকফাস্ট শেষ করেছে। টেবিল এখনো পরিষ্কার করা হয়নি। সে এত বেশি অবাক হয়েছে যে পাইপ খসে পড়ল মুখ থেকে।
সাদামাটা কর্কশ গলায় ওভাল থ্রী বলল, “নেমন প্রতারণার শিকার। স্পেস থেকে তার উপর বোমা বর্ষণ করা হয়েছে।”
চোখ ছোট করল রাও, “ফাউণ্ডেশন?”
“মিউল!” বিস্ফারিত হল ওভাল। “মিউল!” কথা বলছে হড়বড় করে, “বিনা প্ররোচনায় উদ্দেশ্য প্রণোদিত আক্রমণ। আমাদের ফ্লিটের অধিকাংশই যোগ দিয়েছে ইন্টারন্যশনাল ফ্লোটিলার সাথে। হোম স্কোয়াড্রন হিসেবে যা ছিল খুবই অল্প, সেগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত কোনো ল্যাণ্ডিং নেই, হয়তো হবেও না, কারণ শুনেছি যে আক্রমণকারীদেরও অর্ধেকের বেশি ধ্বংস হয়ে গেছে কিন্তু এটা যুদ্ধ-এবং আমি জানতে এসেছি এই ব্যাপারে হেভেনের পদক্ষেপ কী হবে।”
“হেভেন, আমি নিশ্চিত, চার্টার অফ ফেডারেশনের প্রতি অনুগত থাকবে। কিন্তু, তুমি দেখেছ? সে আমাদের আক্রমণ করেছে।”
“মিউল একটা পাগল। মহাবিশ্বকে সে পরাজিত করতে পারবে?” হতাশভাবে বসে রাণুর হাত ধরল সে, “যারা বেঁচে ফিরতে পেরেছে তারা মিউলের…শত্রুর হাতে একটা নতুন ধরনের অস্ত্রের কথা বলেছে। নিউক্লিয়ার ফিল্ড ডিপ্রেসর।”
“কী?”
“আমাদের বেশিরভাগ শিপ পরাজিত হয়েছে কারণ তাদের আণবিক অস্ত্র কাজ করেনি। এটা দুর্ঘটনা বা স্যাবোটাজ হতে পারে না, নিঃসন্দেহে মিউলের নতুন ধরণের কোনো অস্ত্র। নিখুঁতভাবে কাজ করেনি; থেমে থেমে আঘাত করেছে; সম্ভবত নিউট্রালাইজ করার কোনো পদ্ধতি-ডেসপ্যাচার বিস্তারিত বলতে পারেনি। কিন্তু বুঝতেই পারছো এই অস্ত্র যুদ্ধের চিত্র পাল্টে দিয়েছে পুরোপুরি এবং এর সামনে আমাদের পুরো ফ্লিট একেবারে অসহায়।”
রাণু বুঝতে পারল যে সে বুড়ো হয়ে গেছে, একটা চরম হতাশা গ্রাস করল তাকে। “সম্ভবত একটা দানব তৈরি হয়েছে যা আমাদের সবাইকে গিলে নেবে। তবুও লড়াই করে যেতে হবে আমাদের।”