সারা জাহান খাঁ খাঁ— হায়রে শোধ তোলা
যিসব গাঁয়ে আমাদের আত্মীয়কুটুম জ্ঞাতিগুষ্টি থাকত, সেই রেতেই সিসব গাঁয়ে খবর দিতে লোক চলে গেল। গরমকালের দিনে লাশ বেশি সোমায় থাকবে না, য্যাতো তাড়াতাড়ি মাটি হয়ে যায় ত্যাতেই ভালো। যা গরম, মনে হচে কাল সকাল পয্যন্ত লাশ থাকে কি না সন্দ। কিন্তুক আত্মীয়কুটুম এসে না দেখলে তো মাটি দেওয়া যাবে না। তাতে খুব নিন্দে হবে। এত বড় একটো সব্বোনাশ হয়ে গেল, সেটো কিছু লয়। কিন্তুক খবর না পেলে, লাশের দাফনের সোমায় এসে হাজির হতে না পারলে নিন্দেয় কান পাতা যাবে না। দোপর পয্যন্ত লাশ রাখতেই হবে, তাতে লাশ গলুক পচুক, যা-ই হোক।
উত্তর-দুয়োরি ঘরেই রয়েছে খোঁকার লাশ একটো চাদরে ঢাকা। অ্যাকন আর ওখানে থেকে আমি কি করব? যাতোক্ষণ সে ছিল, আমি তো তার কাছেই ছেলম, কোথাও যাই নাই। অ্যাকন আর সে নাই— যে আছে সে তো লাশ। উ নিয়ে আর আমি কি করব? শরীল শুকিয়ে কঙ্কাল, সেই কঙ্কালটো চামড়া-ঢাকা পড়ে আছে। খানিক বাদে ঐ চামড়া ফুলে ঢোল হবে, রসানি গড়িয়ে পড়বে সারা শরীল থেকে, দুগ্গন্ধ ছড়াবে। লাশ বলতে তো এই! সব লাশই ঐরকম, গলে-পচে হেজে থাকে কবরের ভেতর। কবর না দিলে ঘরেও তা-ই হবে। উয়ার সাথে আমার সোনার যাদু বড় খোঁকার কি সম্পঙ্ক? আর আমি দেখতে চাই না। তার সোনার মুত্তি আমার মনেই থাক।
তবে কেঁদেছেলম বৈকি। চোখের পানি তো কবেই শুকিয়েচে। কাঁদতে কাঁদতে গলা ভেঙে গেল কিন্তুক চোখে যি আর পানি নাই! সবাই কাঁদছিল, আমিও কাঁদছেলম। বাড়িতে কাল রেতে খাওয়া-দাওয়া হয় নাই, সব বন্ধ ছিল। ই বাড়ি উ বাড়ির বউ-ঝিরা এসে চিনি নাইলে গুড়ের শরবত এক ঢোক করে সবাইকে খাইয়েছে। ঘরের ভেতর অতো লোক কতো আর খাওয়াবে? মাঝরেতের পর লোক অ্যানেক কমে গেল। তবে গিন্নি ত্যাকন আর ঘরে নাই। ননদ-দ্যাওর-জায়েরা আছে। কাঁদন ত্যাকন আর নাই। হেরিকেনের কাঁচে এমন ধূমো জমেছে যি ঘরে আলো পেরায় নাই বললেই চলে। ত্যাকন আমার বুকের ভেতরটো পাষাণ। আমি সেই আলোয় দেখলম ছায়াবাজি। কতোবার খোঁকা এল গেল, কতো কি করলে, গলা জড়িয়ে ধরলে, তার মুখে আমি চুমো খ্যালম। দেয়ালে আমি সব দেখছি।
আত্মীয়কুটুম দোপরের আগেই এসে পৌঁছুল। লাশ লাওয়ানো ধোয়ানো হলো। সবাই বললে, তেমন লিকিন খারাপ হয় নাই লাশ। সব বেবস্থা হয়ে গেলে আর একবার সবাইকে ডাকলে শ্যাষবারের মতুন মুখ দেখাবার লেগে। দেখলম বটে সবারি সাথে। খোঁকার মুখ আর কি আমার দেখবার দরকার আছে? উ মুখ যি আমি চোখ বুজে য্যাকন খুশি ত্যাকন দেখতে পারি। অ্যাকন ঐ লষ্ট হওয়া মুখ দেখে আমার কি হবে? তবু বললম, যাও বাপ, যেছো যাও, কিন্তুক মায়ের কাছ থেকে আর কোথা যাবে? যেখানেই থাকো মা ডাকলেই আসতে হবে।
দাফন করে সবাই ফিরে আসতে আসতে দোপর গড়িয়ে গেল। তাপর খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে হতে দিনই পেরায় ফুরিয়ে এল। সবাই এসে বাড়ির ভেতরে উত্তরের ঘরের উসারায় বসেছে। আত্মীয়কুটুম এয়েছে, লতুন মা তার ছেলেমেয়ে সবাইকে এনেছে। নানার বাড়ি থেকে আমার ছোট ভাইটি, মামুরা, খালারা সব এয়েছে। কত্তারও যিখানে য্যতো আত্মীয়গুষ্টি ছিল, কেউ বাদ যায় নাই, সবাই হাজির। আর এয়েছে আমার বাপজি। বাপজি বাড়ি ছেড়ে কোথাও বড় একটো যেত না, একটু অ্যাকলষেঁড়ে ঘরকুনোই ছিল মানুষটো। আমার বিয়ের পরে একবার কি হয়তো দু-বার মেয়ের বাড়ি এয়েছে- তার বেশি হবে না। তবে ই বাড়িতে যা ঘটে গেল, তাতে কি বাপজি না এসে পারে? নাতিটিকে যি বড্ড ভালোবাসত! এই গত ক-বছর বাপের বাড়ি যেতে পারি নাই, তার এণ্ড ফি বছরই গেয়েছেলম। বড় খোঁকা সবারই জান কেড়ে নিত- আমন চুপচাপ রাশভারি নানাও তার খুব বশ হয়েছিল।
সেই আমার বাপজি এয়েছে, আমাকে অ্যাকনো একটো কথা বলে নাই, বলতে পারে নাই। উত্তর-দুয়োরি ঘরের পিঁড়ের পচ্চিমধারে চুপ করে বসে রয়েছে। কাঁদতে তো পারে না মানুষটো, পব্বতের মতুন বসে আছে। শাদা গয়ের রঙ— মুখে চাপ দাড়ি, পরনে শাদা লুঙ্গি আর শাদা পিরেন।
কত্তা ত্যাকন ছিল না। কোথা থেকে এল বাড়ির ভেতরে। ই কদিন যি মানুষটোকে দেখে ভয় পেয়েছেলম, অ্যাকন দেখলম সে আবার সেই আগের মানুষ। শোক-তাপ যেন কিছুই নাই। বাড়ির উঠনে দাঁড়িয়ে সে একবার সবাইকে দেখলে। তাপর আস্তে আস্তে এগিয়ে এল বাপজির কাছে। বাপজি বটগাছের মতুন বসে আর কত্তা দাঁড়িয়েছে তার ছামনে। সে ছিল আপনার যোগ্য নাতি, আপনি বলেছিলেন আপনার ছেলেকে আপনার কাছ থেকে পর করে দিচ্ছি বলে আমার ছেলেকেও বেশি দিন স্কুলে যেতে হবে না। আপনার নাতি আপনার কথার মান রেখে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। আপনার কথাকে সে মিছে হতে দেয় নাই।।
হায়, কি বললে, হায় কি বললে, ওগো হায় কি বললে— আসমান থেকে যেন বাজ পড়ল আর যে যিখানে ছিল সাথে সাথে পাথর হয়ে গেল। কত্তার মুখের দিকে আমি তাকিয়ে রয়েছি, তাকিয়ে রয়েছি, যেন যুগ কেটে গেল। তাপর গুড়গুড় করে একটো আওয়াজ উঠল, যেন মাটির তলা থেকে আসছে। আমি শুনছি, সেই আওয়াজ হু হুঁ, হো হো, ও হো হো করে বাপজির বুকের ভেতরটো খান খান করে ভেঙে দিয়ে পেলয় বেগে বেরিয়ে আসছে। অতো বড় পব্বতের মতো মানুষটো উসারা থেকে গড়িয়ে উঠনের ওপর যেয়ে পড়ল।