আগুনপাখি by হাসান আজিজুল হক, chapter name পিথিমির পের্জা আর কতো বাড়াব

পিথিমির পের্জা আর কতো বাড়াব

এবারের সন্তানটি পেটে নিয়ে আমি খুব পেরেশান। কি আর বলব! নিজের ওপরেই নিজের রাগ হয়। কতো মনে হয় আর চাই না, আর বোঝা বইতে পারি না, কিন্তু জন্মের পরে তার শুদু মুখটি দেখা বাকি! কার কারসাজি জানি না, একবার যেই মুখটির ওপর চোখ পড়ল, একদিকে সারা দুনিয়া আর একদিকে ঐ নাড়িছেঁড়া সস্তান। কিন্তুক য্যাতো দিন জন্ম না হচে, পেটের ভারে সমদম, খালি মনে হয় আর দরকার নাই, আর কতো পেটে ধরতে হবে! নিস্তার কি কুনোদিন মিলবে না?

বাড়ির ছেলেমেয়েদের আর কতো হিশেব দোব! আমার দুটি আর একটি এল বলে। ল-বউ, ছোট বউয়ের একটি একটি খোঁকা হয়েছে।

সেজ বউ দুটি খোঁকা রেখে চোখ বুজেছিল তবে বছর দুই আগে তার ছোটটি দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে চলে গেয়েছে। আট-ল বছরের হয়েছিল। একদিন দোপরবেলায় দুবার শুকনো বমি হলো, মুখ হয়ে গেল নীলবন্ন। তার মা নাই, লতুন মা কেবল ঘরে এয়েছে। সব কাজ বাদ দিয়ে সেই ছেলের সেবা গিন্নি একা করলে। আমার ননদকেও কাছে আসতে দিলে না। শাশুড়ি বুঝলে, এই মা-হারানো ছেলেটিকে তাকেই দেখতে হবে। অবশ্যি বেশি সোমায় লাগল না, দু-তিন দিনের মধ্যেই সে চলে গেল। এক-একজনার অমনি কপাল হয়, দুনিয়ায় আসে, কেউ তাকায় না, দেখে না, আদর-ভালোবাসাও তেমন জোটে না। তাপর হুট করে একদিন চলে যায়। চলে যাওয়াটোও তেমন কেউ খেয়াল করে না। ঐ ছেলেও অমনি কপাল করে এয়েছিল।

যাকগো, ত্যাকন আমি খুব পেরেশান, চলাফেরা করতে কষ্ট হয়। ভোগাবে মনে হচে পেটের এই সন্তানটি। এই সোমায় একদিন দোপরবেলায় হিঁদুপাড়ায় লাগল আগুন। এই এলেকায় আগুন লাগাটো যি কি বেপার তা মানুষে চিন্তা করতে পারবে না। শুকনোর সোমায়, ঝাড়া পনেরো দিন আসমান থেকে আগুন ঝরছে। দু-একটো বাদে সব বাড়িরই মাটির দেয়াল আর খড়ের চাল। খুব কম, একটি-দুটি বাড়ির চাল টিনের। তা মাটির বাড়ির বাহার কম হয় না, ই দ্যাশে এমন মাটি পাওয়া যায় যি তা দিয়ে ঘরের ভেতরের দেয়ালে চুনকামের কাজও হয়। আমাদেরই কটো ঘরের দেয়াল এমনি চুনকাম করা আছে। আর বাড়ির বাইরের দেয়ালগুনোয় মাটির মিহিন কাজ করে আলকাতরা লেপে এমন করা হয় যি শতেক বর্ষাতেও কিছু হয় না। কিন্তুক এত সৌন্দর্য হলে কি হবে, চাল যি সব খড়ের! কতো বাহার করে ছাঁচ কাটা! শালকাঠ, তালগাছের কাঁড়ি, বাঁশ– এইসব দিয়ে চালের তলার কাঠামো এমন দবজ করে তৈরি যি বোশেখ জষ্টি আশিন কাত্তিকের ঝড়েও কিছু হবে না। কিন্তুক আগুনের কাছে সব জাদ। আগুন লাগলেই মনে হয় সারা বাড়ি যেন ঠিক বারুদের গাদা। সিদিন দোপরে কোথা থেকে আগুন ধরল কে জানে? কামারশালা থেকে, না মোড়লবাড়ির চুলো থেকে, নাকি অন্য কুনো বাড়ি থেকে, নাকি আপনাআপনিই লাগল কেউ বলতে পারলে না। উত্তরপাড়ায় লাগল আর লহমার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এগুইতে লাগল দখিন-পুব দিকে। ই তল্লাটে গাঁয়ের রাস্তার দু-পাশে একটোর পর একটো বাড়ি, চালে চালে লাগানো। ঠিক শহরের মতুন। খুব কাছে কাছে বাড়ি, দু-বাড়ির মাঝে একটোই পাঁচির কিংবা কুনো পাঁচিরই নাই। আগুন যি লাগল, ধুঁয়োইল, দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল তা কি কেউ দেখতে পেলে? দোপরবেলার আগুন কেউ দেখতে পায় না। শাদা ধুঁয়ো হয়তো একটু দেখতে পায় কিন্তুক দিনের আলোর সাথে আগুন এমন মিশে যায় যি কিছু বোঝা যায় না। তাই বলে আগুন লাগলে কাউরির জানতে বাকি থাকে না বরং আগুনের খবরই সবচাইতে তাড়াতাড়ি জানতে পারে লোকে। কি করে জানে, জানি না। হু হু করে একটো শব্দ ওঠে। সি শব্দও আবার তেমন শোনা যায় না। তবে হ্যাঁ, হঠাৎ করে চারদিক থেকে বাতাস ছুটে আসে, সি বাতাসের শন শন আওয়াজ পাওয়া যায়। তাপর দাঁড়িয়ে থাকলে গরম বাতাস এসে গায়ে লাগে, ছাই উড়ে বেড়ায় আর মাটি, বাঁশ, খড়, সোংসারের জানের জান সব জিনিশ পোড়ার গন্ধ পাওয়া যায়।

আগুন লাগার খবর ঠিকই জানতে পারলম। এগ্‌নেয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলম আগুন উত্তর থেকে দখিন দিকে যেচে, পট পট ধুমধাম আওয়াজ হচে। পেথম যি লোক দেখেছিল, সে চেঁচাতে যেয়েও চেঁচাতে পারে নাই। তাকে বোবায় ধরেছিল। আগুন পেথমে যি দেখে সে লিকিনি গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারে না। বুকে বিশমণি পাথর চাপানো আছে মনে হয়। অ্যাকন অবশ্যি অ্যানেক মানুষ, সারা গাঁয়ের মানুষ আগুন নেভাইতে লেগে গেয়েছে। সবাই চেঁচাইচে, হৈ-হুল্লা-চিচ্‌কার কানে আসছে। কি আচ্চয্যি, এত পুড়ছে, সব পুড়ে যেচে তবু মানুষের চেঁচানি শুনেই ভয় অ্যানেকটো কম লাগছে। কিন্তুক য্যাকন আগুনটো লেগেছিল, যি পেথম দেখেছিল তার দম আটকে গেয়েছিল, শব্দ বার করতে পারে নাই। আগুন লাগলে মানুষের যেন কেয়ামতের ভয় লাগে!

সেইদিনই সাঁঝ-লাগার কোলে কোলে বামুনপাড়ায় পোড়া আঁতুড়ঘরের মদ্যে ভশ্চায্যি-গিন্নির একটি খোঁকা হলো আর মাঝ -রেতের পরে আমারও গভ্‌ভের সন্তানটির জরমো হলো। সি-ও একটি খোঁকা। মনে হয় ঐ মাহা লঙ্কাকাণ্ড না হলে ঐদিন ভশ্চায্যি-গিন্নির ছেলে হতো না। আমার ছেলেটিও ঐ রেতে দুনিয়ায় আসত না। পরের দিন সকালেই ভশ্চায্যি এল বাড়িতে।

প্রলয় হলো হে প্রলয় হলো। প্রলয়ের মধ্যে পুত্রলাভ, আমারও হলো, তোমারও হলো। আমি ঐ হতভাগার নাম রেখে দিয়েছি ‘ভণ্ডুল’– তাই বলে তুমি ওরকম রেখো না। একটা ভালো সোজাসুজি নাম রেখে দিয়ো ছেলের।

সে তো হলো— এদিকে গাঁয়ের যে সর্বনাশ হয়ে গেল ভট্‌চাজ!

তার আর কি করা যাবে বলো? নিয়তি কেউ খণ্ডাতে পারে না। তবে কথা হচ্ছে তুমি ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট, আমি একজন মেম্বার। তোমার সময়েই এমন আগুন লেগে আন্দেক গাঁ পুড়ে ছাই হয়ে গেল, তোমাকেই এখন লোকের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে হবে।

ঐ শুরু হলো। সত্যিই আন্দেক গাঁ পুড়েছিল। ঘরের সব জিনিশ লষ্ট হয়েছিল তো বটেই, বেশিরভাগ বাড়ির খড়ের চাল পুড়ে এমন দশা হয়েছিল যি দেখলে চোখের পানি রাখা যেছিল না। খালি পোড়া কালো কালো দেয়ালগুনো দাঁড়িয়ে আছে। আঁদার রেতে সিদিকে গেলে গাঁ ছমছম করে। ঠিক যেন সার সার ভূত দাঁড়িয়ে রয়েছে— মুখে রা নাই, সি যি কি আবস্তা বলা যেচে না। ছেলেমেয়ে নিয়ে রেতে থাকে কোথা? অ্যানেক ভদ্দরলোক গেরস্থ কি করবে, উঠনে বিছেনা পেতে খোলা আসমানের তলায় থাকতে লাগল।

আর এইবার দেখলম কত্তাকে। সে দিনকে দিন মানলে না, রাতকে রাত মানলে না। আশেপাশের বিশটো গাঁয়ে ছুটে বেড়াতে লাগল। এক দণ্ড বাড়িতে থাকত না।

কোনো কথা নয়, মানুষকে একটু মাথা গোঁজার ঠাই করে দিতে হবে। তারপর অন্য কথা। গাড়ি গাড়ি নতুন বাঁশ লাগবে, কাঠ লাগবে, খড় লাগবে, দড়ি, পেরেক, গজাল— মোট কথা হচ্ছে বাড়ি করতে যা যা লাগে সব জোগাড় করতে হবে। মানুষের জন্যে ভিখিরি সাজতে, ভিক্ষে করতে দোষ কি? নিজের জন্যে তো নয়, হীন হবার কিছু নাই।

কত্তা হাত জোড় করে গাঁয়ে গাঁয়ে যেয়ে আবস্তাপন্ন চাষি গেরস্তদের কাছে বাঁশ-খড়-কাঠ এইসব যাচেঙ্গা করতে লাগল। চারিদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল— হ্যাঁ, একটো মানুষের মতুন মানুষ বটে! হিঁদু-মোসলমান বলে কথা লয়, একজন মানুষ। কতো সুনাম তার হতে লাগল। লতুন রাস্ত হবার পরেও তেমন হয় নাই।

অসাধ্য কিত্তি করলে মানুষটো! একা করে নাই বটে, সবাইকে সাথে নিয়েই করেছিল এই কাজ– ইউনিনের মান্যগণ্য কত্তারা সবাই ছিল। তবু সবাইকে একসাথেই বা করতে পারে কজন? সারা গাঁ যেন ঘুমিয়ে ছিল, মিশমার হয়ে ছিল, কত্তার ডাকে গা ঝাড়া দিয়ে জেগে উঠল। কেউ বসে নাই, সবাই কাজে লেগে গেয়েছে, যাদের কুনো ক্ষেতি হয় নাই আগুনে, তারাও সবাই কাজে লাগল। নিজের নিজের কাজটুকু করে আবার ঐ সাজারের কাজে হাত লাগাল। দরকার হলে লতুন করে মাটির দেয়াল করে দিচে, বাঁশ কাটছে, কাঠ চিড়ছে, ঘরামিরা এসে চালা তুলছে, বাঁশ-কাঠের কাঠামো তৈরি করে দিচে, তাপর খড় দিয়ে ছাইয়ে দিয়ে তবে ছুটি। টাকাপয়সা যেখান থেকে যা জোগাড় হয়েছিল, কত্তা সেখান থেকে যাকে যা দেবার, যাকে না দিলেই নয়, তাকে তেমনি করে মজুরি দিচে!

সত্যিই অবাক বটে। আষাঢ়-শাওনের বর্ষা-বাদল আসার আগেই আমাদের এই পোড়া গাঁ আবার লতুন হয়ে গেল। আগের চেয়ে লতুন। দূর থেকে দেখা যেতে লাগল সব লতুন ঘরের চাল। খড়ের রঙ তো সোনার মতুন! পুরনো কালো হয়ে যাওয়া চালগুনোর বদলে এই লতুন ছাওয়ানো চালগুনো দূর থেকে সোনার মতুনই ঝকঝক করতে লাগল।

সব কাজ হয়ে গেলে কত্তা একদিন ভশ্চায্যিকে বললে, ছেলের ভঙুল নামটি বাদ দিয়ে আর একটি নাম দাও ভট্‌চাজ। ভঙুল কিছুই হয় নাই।

তা আর ভশ্চায্যি করে নাই। ছেলের নাম ভণ্ডুলই রইল। সোনার ছেলে, তবু সারা জেবন ভণ্ডুল নামই বয়ে বেড়াইলে।