কতো লোকের কতো বিচের, কতো বিধেন
কোট বসত রোববারে। যতোদুর মনে হচে রোববারেই কত্তার আদালত বসত। রোববার ছুটির দিন বটে, গাঁয়ের ইশকুলেও ছুটি হতো ঐদিনে শহর-গঞ্জের মতুনই। কিন্তুক ইশকুলটো বাদ দিলে গাঁয়ে আবার ছুটি কি! সেই লেগে মনে হচে দলিজে কোট বসত রোববার-দিন। দলিজঘরের ভেতরে-বাইরের দুই উসারায়, নামোয় খামারে লোকজন গমগম গিসগিস করত। সাত গাঁয়ের লোক ঐদিন তাদের য্যাতো নালিশ-ফরিয়াদ নিয়ে আসত।
বাড়ির বউ-ঝিদের বাইরে আসার লিয়ম ছিল না। পুরুষদের কাজ আলেদা, মেয়েদের কাজ আলেদা। মেয়েরা দিনে-রেতে বাইরে যাবে না, পায়খানা-পেশাবের বেগও ধরে রাখতে হবে। কেউ শুদুবে না তো বটেই, পুরুষরা বোধায় জানেও না যি মেয়েদের ঐসব দরকার আছে। রাত হলে চোরের মতুন বাড়ির আশপাশে, পুকুরঘাটের ধারে বউ-ঝিরা চলে যেত। কারুর ছামনে উ কথা তোলাও শরমের কথা! সারাদিন বাড়িতে থাকো, চোখে ঠুলি লাগিয়ে একই জায়গায় হাজার বার পাক মারো, গুষ্টির লেগে রাঁধো, ছেলেমেয়েকে দশবার বুকের দুধ খাওয়াও, গভ্ভো থাকলে চোখ-কান বুজে বয়ে বেড়াও! মিয়ে-মোকাদিমদের বাড়িতে এই ছিল লিয়ম। তা বলে গরিব সাধারণ আবস্তার মোসলমানদের লেগে ই লিয়ম লয়, সিখানে ঘর-বার সমান। পর্দাপুশিদার বালাই নাই। সে যা-ই হোক, উয়ারই মদ্যে ই সোংসারটো একটু আলেদা ছিল আর আমি তো অ্যানেক পুরনো বউ-মানুষ, আমি নাচদুয়োরের কাছে যেয়ে বাড়ির পুরনো পাঁচিলের ফাঁক-ফোকর দিয়ে খামারের দিকে অ্যানেক সোমায় তাকিয়ে থাকতম।
আজও দেখছেলম, আশপাশের গাঁয়ের ভদরলোকেরা সব এয়েছে ক্ষারে কাচা ধুতিজামা পরে। হিঁদু-মোসলমান বেশির ভাগেরই এই পোশাক। মোসলমানদের কেউ কেউ তহ্বন পরেও এয়েছে। গরিব মানুষদের ক্ষারও জোটে নাই- শস্তা সাজিমাটিতে ধোয়া জামাকাপড় পরে এয়েছে তারা। তবে নালিশ করার লেগে বাদী-ফরিয়াদি যারা এয়েচে তাদের পেরায় সবারই খালি গা। দলিজের ভেতর-উসারায়, যেখানে চেয়ার-টেবিল পাতা আছে, সেখানে কোট বসেছে। লোকের ভিড়ে কিছুই দেখা যায় না। কোটের আর সব মেম্বররা সেখানে চেয়ারে বসে আছে, বিচের চলছে। কত্তা একদিন বলেছিল, ইখানে আর বিচের কি হবে? খুন-জখম ভায়ানক দাঙ্গা-হাঙ্গামা ডাকাতি-রাহাজানির বিচের ইখানে হয় না। ওসব আমরা সদরে মহকুমায় পাঠিয়ে দিই। ছোটখাটো নালিশ ফরিয়াদ নিয়ে যাতে লোকে শুধু শুধু শহরে না যায়, হয়রানি না হয়, টাকাপয়সা খুইয়ে না আসে, এখানে শুধু সেইসবই বিচের করি। দু-পাঁচ টাকা জরিমানা করতে আর এক দিনের জেল দিতে পারি আমি। একটু মিলিয়ে-মিটিয়ে দেওয়াই আমাদের কাজ, বুঝেছ? এলেকায় যাতে শাত্তি থাকে।
তা নালিশ-ফরিয়াদের কথা শুনলে হাসিও লাগে বটে! কে কাকে কাঠ-পিঁপড়ের গত্তর ওপর ঠেসে ধরেছে, পিঁপড়ের কামড়ের বিষে বেচারার জ্বর এসে গেয়েছে, কে মসিদে হাত দিয়ে মিছে কথা বলে পাওনা টাকা দেয় নাই— কোন্ বুড়ি বুঝিন মা-কালীর থানে এক ঘণ্টা এক পায়ে দাঁড়িয়ে থেকে ছেলে ভাত দেয় না বলে নালিশ করেছে— তা মা-কালী বেবস্থা করে নাই বলে কোটে এয়েছে কেস্ করতে। এমনি সব নানা কথা নিয়ে মামলা। মাঠ থেকে ধানের আঁটি চুরি, মরাই থেকে এক-আধ মণ ধান বার করে নেওয়া, হোক মোটা ছেঁড়া শাড়ি, শুকুইতে দেওয়া ছিল, সেই শাড়িটো চুরি করা– এইসব লিকিনি নালিশ!
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলম, লতুন ঘোড়াটো নিয়ে এল হাড়িপাড়ার সইস। ঘোড়ার হাঁটা দেখলে বিশ্বেস হয় না ঐ ঘোড়াই আমন টগবগ করে ছোটে। হটর হটর করে ঘোড়ার শুদু হাঁটা দেখলে ঘোড়াকে ঘোড়া বলেই মনে হয় না, মনে হয় অন্য কুনো জন্তু। ঘোড়াটোকে হাঁটিয়ে নিয়ে এল সইস। ইখানে আনলে ক্যানে? বোধায় সবাইকে একবার দেখাইতে চাইছে। হাঁ করে সব দেখছেও বটে। ঠিক বুঝতে পারছি না এত দূর থেকে, তবু মনে হচে চাষাভুষোদের মদ্যে থেকে দু-একজন ঘোড়ার বেশি কাছে এগিয়ে গেলে বাগদিপাড়ার দফাদার তাকে হাতে ধরে সরিয়ে দিচে। দফাদার এমনিতে ত্যানা পরে থাকে আর অ্যাকন তার সরকারি পোশাকের কি বাহার! নীল জামা, হাফ প্যান্ট- সি এমনি মোটা যি ইহজন্মে ছিঁড়তে পারবে না। সেই জামার ওপরে পেতলের ঝকঝকে তকমা আঁটা। বাউরিদের একজন জমাদারও আছে। তারও ঐ পোশাক। এমনিতে গরিব মানুষ তারা— যেমন গরিব, তেমনি বেচারা, সাত চড়ে রা কাড়ে না, গায়ে আবার অসুরের মতুন বল— অ্যাকন এই পোশাক পরে তাদেরও যেন গরবে মাটিতে পা পড়ছে না।
এই সোমায় বেরাট একটো কাজ হতে যেচে শোনলম। সি কাজটো কত্তা যেদি করতে পারে, তাইলে এলেকার লোকে তাকে দু-হাত তুলে দোয়া-আশীব্বাদ করবে। সেই কবে থেকে টেরেন চালু হয়েছে। য্যাকন ইচ্ছা লোকে জেলা শহরে, মহকুমা শহরে যেতে পারে। দিনে দিনে যেতে পারে, আবার ফিরে আসতে পারে। কিন্তুক ই গাঁ থেকে এক কোশ দূরের ইস্টিশনে যাবার কুনো রাস্তা নাই। মাঠজুড়ে শুধু ধানের জমি। ধান আর ধান, আর কিছু নাই, গাছপালাও পেরায় কিছু নাই। সেইসব জমির আল ধরে, কখনো বা শুকনো ড্যাঙার ওপর দিয়ে সাপ-খোপ ভরা কাঁটা-জঙ্গল মাড়িয়ে তবে ইস্টিশনে যেয়ে টেরেন ধরতে হয়। বর্ষাকালে মানুষের কষ্টের অবধি থাকে না। ত্যাকন আল-রাস্তার কুনো চেন্নও থাকে না। কাদায় পানিতে নাকাল হয়ে কি কষ্টই না হয় মানুষের ইস্টিশনে পৌছুইতে। গরু-মোষের গাড়িও ত্যাকন অচল হয়ে যায়। শোনলম, অ্যাকন লিকিনি ইউনিন বোড থেকে সড়ক করে দেবে। কাঁচা সড়কই হচেবটে, কুনো একদিন হয়তো পাকা হবে। শুধুই গাঁ থেকে ইস্টিশনে যাবার লেগেই এই এক কোশ সড়ক হচে না, তা যেদি হয়, তাইলে কত্তার দুর্নামের অন্ত থাকবে না। সড়ক হবে মোট পাঁচ কোশ। ইউনিনের সাতটো গাঁকেই ই রাস্তার সুবিধা দিতে হবে। পুবের গাঁগুনোর একটো থেকে ই রাস্তা বেরিয়ে আরও দু-তিনটো গাঁয়ের পাশ দিয়ে আমাদের গাঁয়ের একবারে ভেতরে এসে ঢুকবে। রাস্তা উদিকে চার কোশ, ইদিকে এক কোশ।
রাস্তা হবে, না রাস্তা হবে- যে শুনছে সেই খুশি! কত্তার নাম চারিদিকে ছড়িয়ে গেল। ত্যাকনো জানি না ইয়ার মদ্যে আবার এক বেপার আছে। কত্তা বলতেই বোঝলম। কত্তা একদিন বললে, রাস্তা তো হবে, কিন্তু জমি নষ্ট হবে অনেক। ডাঙা-ডোবা যা রাস্তার মধ্যে পড়বে তা বাদ দাও, চাষের জমি কতো নষ্ট হবে তা কি বুঝতে পারছ? এত জমি কে দেবে?
তাই তো বটে, কত্তা য্যাকন এই পাঁচ কোশ সয়রানের লেগে কতো ধানের জমি লাগবে, তার হিসেব দিলে, ত্যাকন আমার মাথা খারাপ হবার জোগাড়। যাদের জমি যাবে সরকার তাদের ক্ষেতি পুষিয়ে টাকাপয়সা কিছু দেবে। কত্তা বললে সরকারের কথা ছাড়ো। সারা দেশের কতো বিরাট বিরাট ব্যাপার নিয়ে সরকারের মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল। সরকারের কথা হলো, নিজের নিজের এলেকায় তোমাদের রাজা করে দিয়েছি, যা করবে নিজেরা টাকা-পয়সা জোগাড় করেই করবে। তা সরকার একদম কিছু দেবে না, তা নয়। যাদের যাদের জমি নেওয়া হবে, তাদের সামান্য কিছু ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
এই শুরু হলো। রাতদিন লোক আসছে। বড়লোক ছোটলোক মানামানি নাই। কি? না, তার জমিটো বাদ দিয়ে রাস্তা এট্টু সরিয়ে করতে হবে। গরিব কুনো চাষি এসে বলছে, তার মোটে দু-বিঘে জমি, রাস্তাতে চলে যেচে দশ কাঠা, তাইলে সে কি করে বাঁচবে। এই জমিটুকু ছাড়া তার আর কিছু নাই— ঐ জমিটুকুনি থেকে যে ধান সি পায়, তাই দিয়ে ভাত-কাপড়, ত্যাল, নুন, ডাল, কেরাসিন সব জোগাড় করতে হয়। দশ কাঠা গেলে সে ছেলেমেয়ে নিয়ে উপোস করে মরবে। এইরকম কথা নিয়ে কতো গরিব চাষাভুষো যি পেত্যেক দিন আসছে তার হিসেব নাই। উদিকে বড়লোক যারা তাদেরও আসার কামাই নাই। তাদেরও ঐ একই আবদার, তাদের জমি থেকে রাস্তা সরিয়ে নিতে হবে।
এই এদের নিয়েই বিপদ বেশি বুঝলে? গরিবদের তাড়িয়ে দিলেই হলো। যা, যা দিকিনি এখান থেকে, স্টেশনে যাবার রাস্তা হতে হবে, সে রাস্তা কি আসমান থেকে আসবে? রাস্তা হবে- গ্যাঁট গ্যাঁট করে হেঁটে বাবুর মতো স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরবি, তার জন্য একটু স্বাৰ্থত্যাগ করবি না? যা, ম্যাপ হয়ে গিয়েছে, সে আর কেউ বদলাতে পারবে না, ক্ষতিপূরণটা যাতে ঠিক হয় দেখব, যা। গরিব চাষিদের ইসব কথা বলে আটকাতে পারা যায়, বড় বড় জমিঅলাদের কি বলবে? এক কাঠা জমি গেলে গরিবের যতো না গায়ে লাগে, এদের লাগে তার দশগুণ। সব রাঘব বোয়াল আবার কি রকম গুণধর— জমি বাঁচাবার জন্যে পয়সা খরচ করতেও রাজি। পারলে গভমেন্টকেও ঘুষ দেয়।
আমি জানি, কত্তা পারত সিধে রাস্তা করতে। আর য্যাতোটো সম্ভব। গরিবের জমি বাঁচাবার লেগেই চেষ্টা করবে। শ্যাষ পয্যন্ত কি হলো জানি না। রাস্তা হতে সোমায় অ্যানেকটোই লাগল, চার-পাঁচ বছর
পেরায়।
রাস্তা কত্তা কিছুতেই সিধে করতে পারবে না। অবশ্যি সি একা তো আর রাস্তা করে নাই, আরও সব মেম্বররা ছিল, ম্যালা ওপরঅলা ছিল। তবু রাস্তা তো তার এলেকাতেই হচে, তার দায়িত্বই বেশি। কত্তা কখনো কখনো বলত, মুখটা ত্যাকন একটু খুশিতে ভরা, ওমুক খুব গরিব মানুষ— বেচারার মোটে দেড় বিঘে জমি, চাষবাসের শেষ দিনে গাঁয়ের লোক ব্যাগারে তার জমিটুকু আবাদ করে দেয়। সেজন্যে সারা মরশুম সে নিজেই ব্যাগার খাটে। তার ঐটুকু জমির তিন কাঠা রাস্তায় চলে যাচ্ছিল, কি করব, কোনোরকমে জমিটুকু বাঁচিয়ে দিলাম বটে, রাস্তা কিন্তু ঐ জায়গাটায় ত্যারাব্যাঁকা হয়ে গেল। দু-এক জায়গায় বড়লোকদের চাপেও ওরকম করতে হয়েছে। নাঃ, যেমন রাস্তা হবে মনে করেছিলাম, তেমন হবে না।
হবে হবে, হচে হচে করে রাস্তা হতে বেশ ক-বছর লেগে গেল। তাপর শোনলম, জেলার বড় সায়েব আসবে। বিদিশি বিটিশ শাদা সায়েব- সেই সায়েব এসে ফিতে কাটবে, তাপরে সবার লেগে রাস্তা খুলে দেবে। আমাদের জান ভয়ে কোণে কোণে লুকুইতে লাগল য্যাকন শোনলম সায়েব গাড়ি নিয়ে লতুন রাস্তা দিয়ে সোজা আমাদের বাড়িতেই আসবে, তাপর যিখানে ফিতে কাটার বেবস্থা হয়েছে সিখানে যেয়ে যা করবার করবে। সায়েবরা কেমন মানুষ, কি খায়, কি করে কিছুই জানি না। আমরা তো কুন্ ছার, কত্তারাই তার কুনো কথা বুঝতে পারবে না। একটো কথা তাকে বলতেও পারবে না। ইসব কথা কত্তাকে বলতে গেলম, তা সে রেগে ধমকে দিলে। এসব তোমাদের ভাবতে হবে না। বাড়ির কোনো খাবার সায়েব খাবে না। যেমন আসবে তেমনি সোজা গিয়ে চেয়ারে বসবে, কাগজপত্তরে সই করবে। খামারে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকবে- পাঁচ মিনিট, বড়জোর দশ মিনিট, তার বেশি সায়েব এখানে থাকবেই না। আমরা সদর থেকে দার্জিলিং-চা, বিলিতি বিস্কুট এইসব এনে রাখব, যদি কিছু খায় তখন দেখা যাবে।
সায়েব যিদিন আসবে সিদিন সারা গাঁয়ে উচ্ছব। আধাবেলায় আসবে সে। সিদিন গাঁয়ের সব্বাই সকালবেলাতেই গা ধুয়ে যার যেমন ভালো জামাকাপড় আছে তাই পরে ঘরের-মাঠের কাজকম্ম বাদ দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল কখন সায়েব আসে। হিঁদুদের সব এয়োতিরা সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে চুল আঁচুড়ে নিজের নিজের বাড়ির দুয়োর গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকলে, মোসলমান বাড়ির বউ-ঝিরাও দেউড়ি দুয়োরের আড়ালে-আবডালে দাঁড়িয়ে রইলে সায়েব এলে দেখবে বলে। ঐসব দিকে সায়েবের গাড়ি হয়তো যাবেই না তবু সব দাঁড়িয়ে রইলে আর সারা গাঁয়ের হিঁদু মোসলমান পুরুষমানুষদের পেরায় সবাই আমাদের দলিজের ছামনে খামারবাড়ির মাঠে এসে জমায়েত হলো।
ইশকুলেও সিদিন ছুটি দেওয়া হয়েছেল। মাস্টাররা সব ফরশা জামাকাপড় পরে এয়েছে। বোডের মেম্বর, আদালতের কেরানিবাবুরা, গাঁয়ের আর ভদ্দরলোকদের কেউ আসার বাকি নাই, সবাই হাজির। শুধু আমাদের বউ-ঝিদেরই একটুও বেরুনোর হুকুম নাই। এমনকি বেশি উকি-বুকি মারলেও গিন্নি রাগ করবে।
কেউ বললে না, তবু জানতে পারলম সায়েব কখন এল। সব যেন কেমন হয়ে গেল, পাখি ডাকতে ভুলে গেল, ছেলে কাঁদতে ভুলে গেল, কি জানি, বাতাস দিতেও যেন ভুলে গেল। সব চুপচাপ। কি? না সায়েব এয়েছে! আমি কত্তার ঘরে যেয়ে পরচালির দিকের দরজাটো খুলে দেখি খামার দলিজে লোকে লোকারণ্য। এক পাশে ধুলোয় ঢাকা একটো মোটরগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, লাল পাগড়ি পরা কটো সেপাইও রয়েছে ইদিক-উদিক আর দলিজে লোকজন সবাই দাঁড়িয়ে আছে। শুধু একজনা একটো চেয়ারে বসে আছে। লাল টকটকে এক সায়েব। সায়েবকে পোষ্কার দেখতে পেচি না বটে, কিন্তুক অতগুলো মানুষের মধ্যে ঐ একজনকেই শুদু চোখে পড়ছে। কি তার গাঁয়ের রঙ, কি তার পোশাক-আশাক। সায়েব থুতনিতে দু-হাত দিয়ে বসে আছে এইটুকুন শুদু দেখতে পেচি। কি যেন শুনছে। ত্যাকন দেখতে প্যালম খাটো ধুতি আর মোটা কাপড়ের পাঞ্জাবি পরা, গলায় উড়নি জড়ানো এক ভদ্দরলোক চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কি যেন একটো পড়ছে। লোকটোর চোখে চশমা, তবু পড়ার কাগজটো ধরে আছে মুখের ওপর আর কি জোরে জোরে যি পড়ছে সি কি বলব— মনে হচে যেন যাত্রা করছে। কথা কিছু কিছু শুনতে পেচি বটে। কিন্তু বুঝতে পারলম না কিছুই। কত্তার কাছে পরে শুনেছেলম, বুঝব কি, সি তো বাংলা কথা লয়, সায়েবদের নিজেদের কথা, ইঞ্জিরি।
তা বেশিক্ষণ হলো না ইসব। একটু বাদেই উঠে পড়ল সায়েব, গাড়িতে যেয়ে উঠল। গাড়ি ভোঁ করে খামার থেকে বেরিয়ে গেল আর বললে কি লোকে পেত্যয় যাবে যি এক লহমার মদ্যে অত বড় খামার দলিজ একদম ফাঁকা। যি যেমন করে পারলে দৌড়ুইলে গাড়ির পেচু পেচু। কত্তাকেও দেখলম নিজের দলবল নিয়ে বেরিয়ে গেল। কত্তা কিন্তুক তেমন সাজগোজ করে নাই, বাড়ির বাইরে গেলে যেমন পোশাকে থাকে, তেমনিই। পরনের ধুতিটো তার বরাবরই এট্টু দামি, উড়নি অবশ্য একটো নিয়েছে আজ। এলেকার য্যাতো বড় বড় সব লোক আজ সঙ্গেই আছে। পাশের গাঁয়ের গোঁসাই আছে, এমন দিনেও কিন্তুক খালি গায়ে। একটো চাদর শুধু জড়ানো, কপালে চন্দনের ফোঁটা, তিলক কাটা। গাঁয়ের ভশ্চাজ্যি, পাঠক, পাল, খান, নন্দী- এরা তো আছেই। মিয়ে-মোকাদিম ইদিকে কম, তা-ও দু-তিনজনা এয়েছে আজকের দিনে।
রাস্তা চালু হয়ে যাবার পর আমি একদিন আবদার ধরলম রাস্তা দেখতে যাব। কত্তা কিন্তুক এরকম আবদারের মান রাখত। মোষের গাড়ি এল, ইস্টিশন পয্যন্ত যেয়ে আবার ফিরে আসা হবে। বউদের আর কেউ যেতে চায় না। কত্তা মাকে শুদুলে, গিন্নি যাবে কি না। এট্টু হেসে আমার শাশুড়ি বললে, রাস্তায় আমার আর দরকার নাই বাবা, রাস্তা ধরে এখন আর কোথাও যাবার নাই। যে কদিন আছি সব রাস্তা আমার এই বাড়িতে। তোমরা যাও।
পুবদিকের গাঁগুনো থেকে রাস্তা এসে গাঁয়ে ঢুকেছে বটে তবে সি রাস্তা কিন্তুক গাঁয়ের ভেতরে এসে মিলেছে গাঁয়েরই মাঝখানের পুরনো রাস্তায়। গাঁয়ের ভেতরে ই রাস্তা তো চেরকালই ব্যবহার হচে। তাই গাঁয়ের ভেতরে আর লতুন সড়কের কুনো কথা নাই। কিন্তুক গাঁ থেকে বেরিয়েই দেখলম লতুন রাস্তা বড্ডা অ্যাঁকাব্যাঁকা। গোড়াতেই অত অ্যাঁকাব্যাঁকা ক্যানে শুদুলে কত্তা বললে, ধরো, মহারাজরা দিঘির দক্ষিণ পাড় এই পাওয়া গেল, কারুর জমি আর মারা গেল না। রাস্তা এখান থেকেই যদি সোজা করি, প্রথমে এই বড় ভাগাড়টা যাবে, তখন গাঁয়ের মরা গরু-মোষ ফেলবে কোথা লোকে? তারপর যাবে গরু-মোষ চরার এই বিরাট পগার। তারপর যাবে ছেলে-ছোকরাদের এই পেল্লাই খেলার মাঠ। এতো বড় মাঠ আশেপাশের কোনো গাঁয়ে নাই, মহারাজার সম্পত্তি, ইস্কুলের জন্যে দেওয়া, ভাগ করলে তিনটে মাঠ হবে খেলার। এই মাঠ কি নষ্ট করা যায়। যাক না, রাস্তা একটু ঘুরে! গাঁয়ের লোকের এতো কি আর তাড়া।
সত্যিই এতো জায়গা ছেড়ে দেওয়ার লেগে রাস্তা অ্যানেক ঘুর হয়েছে, কুটুর কুটুর করে গাড়ি যেচে তো যেচেই। কেউ যেদি হেঁটে ইস্টিশনে যেতে চায়, তাইলে আদ্দেক সোমায়ে যেতে পারবে। লোকে কি আর শোনে? বর্ষাকালটা বাদ দিয়ে সারা খরানির সোমায়ে ভাগাড়ের ওপর দিয়ে, পগার দিয়ে, খেলার মাঠ ধরেই সবাই গাড়ি নিয়ে যাতায়াত করত। শুদু কি তাই? লতুন সয়রানের অ্যানেক জায়গাতেই দেখলম যা-তা ঘুরুনি হয়েচে। ডাইনে ঘুরল তো ক-পা যেয়ে বাঁয়ে ঘুরল। তাপর আবার ডাইনে ঘুরল। কত্তা হেসে বললে, এসব বেশিরভাগই হয়েছে গরিবের জমি বাঁচানোর জন্যে।
বড়লোকের জমি বাঁচানোর লেগে এরকম ঘুর কি একটোও হয় নাই?
তা কি আর না হয়েছে?
হ্যাঁ, লোকে অবিশ্যি বলতে পারে রাস্তা ছিল না, রাস্তা হয়েছে, লোকের চলাচলের সুবিধে হবে- এই পর্যন্ত। এত ঢোল পিটোবার কি আছে তা নিয়ে? লোকের চাষের জমি নিয়ে আবার সেই জমিরই দু-পাশের মাটি নিয়ে কুলি-মজুর লাগিয়ে রাস্তা তৈরি হয়েছে। উঁচু মাটির সরান, দু-পাশে তার লম্বা খালের মতো নালা, সেখানে চাষের কাজ কিছু হবে না। ক্ষতি তো মানুষের হয়েছেই। তবু বলা যায়, ক্ষতির চাইতে লাভই বেশি হয়েছে। তাই বলে ততো বাহাদুরির কিছু নাই। আমিও তাই বলি– বাহাদুরির কিছু নাই- কাজটা করার দরকার ছিল, আমি না করলে একদিন না একদিন আর কেউ করত। করতে হতোই একদিন, কপালগুণে আমার ওপরেই পড়ল দায়িত্ব। এ নিয়ে বুক ফুলিয়ে আমার বলার কিছু নাই। এমন করে কথা কত্তার মুখে কুনোদিন শুনি নাই। সে কথা বলেই যেচে।
আমি ভাবি অন্য কথা। একজন মানুষ দুনিয়ায় আর কদিন থাকে? কিন্তু মানুষ চিরকাল থাকবে। একজন একজন করে ধরলে কোনো মানুষই বেশি দিন দুনিয়ায় নাই তবু দুনিয়া ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত দুনিয়ায় মানুষ থাকবে। এই যে রাস্তা হলো, ধরো আমার অছিলাতেই হলো, আমার লোভলালসা যা-ই থাকুক, হলো তো রাস্তা, না কি? আমি দুদিন বাদে দুনিয়া ছেড়ে গেলেও এই রাস্তা থাকবে। কতোদিন থাকবে? আমি বলছি বহুকাল থাকবে, আর নষ্ট হবে না। রাস্তা হয়তো অন্য-রকম হবে, পাকা হবে, কতো গাড়িঘোড়া চলবে, আমার তিনপুরুষ চারপুরুষ পরের মানুষেরা এই রাস্তা দিয়েই চলাচল করবে। কারুর মনে থাকবে না আমার নাম, আমাদের কারুর নাম। তবু রাস্তাটা থাকবে। এই মনে হলে মনে হয় আমিই চিরকাল থাকলাম।
কথাগুলি যা সে বললে সোজা কথাতেই বললে। সবকথা বুঝতে না পারলেও কিছু তো বোঝলম। যা বোঝলম তাতে আমার গা কিরকম করতে লাগল। কত্তা কেমন লোক? উকে কি আমি চিনি! উ যেদি সব সোমায়ে এমনি করে কথা বলত, তাইলে আমি হয়তো ওর সাথে ঘর করতে পারতম না, খুব ভয় হতো। কিন্তুক তা লয়, ইরকম কথা সে আর কবা বলেছে?