আগুনপাখি by হাসান আজিজুল হক, chapter name সোংসার কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না

সোংসার কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না

আমার বড় খোঁকা চলে গেল। দুনিয়াদারিতে আর আমার মন নাই— নাই নাই নাই– তবু কি মওত এল? সোংসার কি ক্ষ্যামা দিলে? ছুটি কি প্যালম? বড় খোঁকা গেল তো পরের খোঁকাটি বড় খোঁকার জায়গায় চলে এল। কবে এল তা জানিও না। দেখতে দেখতে সে-ও বড় হয়ে গেল। মোটেই বড় খোঁকার মতুন লয়, গড়ন-পেটন একদম আলাদা। তারও খুব রূপ। কাঁচা সোনার মতুন গাঁয়ের রঙ। এতদিন কিছুই খেয়াল করি নাই, একদিন হঠাৎ দেখি ওমা, ও-ও তো বারো-তেরো বছরের ছেলে হয়ে গেয়েছে। তাপর, মেয়েটি বাড়ির পেথম মেয়ে, সি-ও তিন-চার বছরের হয়ে গেল। মাজা-মাজা রঙ, আঁকা-আঁকা চোখমুখ, এইটুকুনি কপাল, মাথাভত্তি এলোমেলো কালো চুল— ওমা, আমার কি হবে মা— গা থেকে যেন ননী গলচে! অ্যাকন এদের নিয়ে কি করব? পোড়া সোংসার কি জিনিস কে বলতে পারে বলো! শুদু কি তাই? সোংসার ইদিকে আপনা-আপনি বড় হচে। তা সোংসার বড় হবে কি চোট হবে তাতে তো কারুর হাত নাই। ছেলেমেয়ে কম হোক, বেশি হোক, সবই আল্লার ইচ্ছায়। অ্যাকন যেমন নিজের ইচ্ছায়, তেমন লয়। আট-দশ-বারো-তেরোটা করে ছেলেমেয়ে হচে, কিছুই করার নাই। আল্লা দিচে তা কে কি করবে? খেতে না পেয়ে, রোগে ভুগে কুকুর-বেড়ালের ছানার মতুন এন্ডি-গেন্ডিগুনো মরে যেচে। ফল পাকার পরে যেমন কলাগাছ মরে, তেমনি করে এঁদুরি-পেঁদুরি ছেলেমেয়ে প্যাটে ধরতে ধরতে মা-গাছটো মরে যেচে। ছেলে হতে যেয়ে মরছে, কি অন্য অসুখে মরছে, কিছুই করার নাই— দুখ-দরদও কিছু নাই। পুরুষমানুষ আবার একটো বিয়ে করে আনছে— আবার এক পাল জন্মাইচে। ই বাড়িতেও তাই হলো। সেজ বউয়ের দুটি খোঁকা, ঐ দুটি খোঁকাকে রেখে সে একদিন চোখ বুজলে। কি রোগ তার হয়েছিল তা কেউ বলতে পারলে না। চিকিচ্ছে আর কি হবে?

গাঁয়ের ডাক্তার ওষুধ দিলে, টোটকা-মোটকা যে যেমন পারলে দিতে কসুর করলে না। ঝাড়ফুঁক পানিপড়া কিছুই বাদ পড়ল না। তা, সেজ বউ বেশি সোমায় নিলে না। কুনো কিছু গেরাহ্যি না করে সে সব ফেলে চলে গেল। খোঁকাদুটিকে অ্যাকন কে দেখে– এই কথা বলে সেজ দ্যাওর ছ-মাস যেতে না যেতে আবার একটি কচি মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে আনলে। যে দুই দ্যাওরের বিয়ে বাকি ছিল এইবার তাদেরও বিয়ে হলো আর বিয়ের পর বেশিদিন যেতে না যেতে তাদেরও ছেলেপুলে আসতে শুরু হলো। সোংসারে কখনো কখনো একজন-দুজনা করে কমছে বটে কিন্তুক বাড়ছে অনেক বেশি। হাতে-পায়ে গলায়-মাথায় লেয়ালির দড়ি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে জড়িয়ে যেচে।

কিন্তুক যাই হোক আর তাই হোক, কত্তার খেয়াল সব দিকে। আগের মতুন অ্যাকন আর তাকে সবকিছু নিজেকে দেখতে হয় না, সোংসারের দায়দায়িত্ব এমন করে সে ভাগ করে দিয়েছে যে সব আপন মনেই ঠিকঠাক চলছে, পান থেকে চুন খসবার জো থাকছে না। সবাই নিজের নিজের কাজের দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে। সেজ দ্যাওর এট্টু আবরের মতুন, ঠিক গোঁয়ারগোবিন্দ লয়, তবে নিজের বুদ্ধিতে কিছু করার ক্ষ্যামতা তার নাই। সোজা মানুষ, কারুর সাথে লাগল তো মারামারি করে নিজে জখম হলো, কি আর কাউকে জখম করে ফেললে। চাষবাস, আবাদের দায়দায়িত্ব ছিল এই সেজ ভাইয়ের ঘাড়ে। মাঝে মাঝে এর তার সাথে গোলমাল-ফ্যাসাদ করে ফেললেও সবকিছু দেখা-শোনাটা সে ভালোই করত। তবে খুব বুদ্ধি ছিল ল-দ্যাওরের, সে দেখতে যেমন সুপুরুষ ছিল, বুদ্ধিসুদ্ধিও তেমনি ভালো ছিল আর কাজে-কম্মেও ছিল চালাক। জমির খবর, আবাদের খবর, ফসলের খবর তার চেয়ে ভালো ই গাঁ তো ই গাঁ, আশপাশের চৌদ্দ গাঁয়ের কেউ ভালো জানত না। সেজকে বুদ্ধি পরামশ্য সব তার কাছেই নিতে হতো।

রাতদিন টেনে করে শহরে যেতে হতো বলে কত্তা ইস্টশনের কাছে— এক কোশ দূরে ছিল ইস্টিশন— দু-বিঘে জমি কিনে সিখানে একটো ভিটে আর বেরাট একটো মুদিখানার দোকান করা হলো। গঞ্জে একটো বাড়িও হলো, ব্যাবসার লেগে একটে দোকানও হলো। কত্তা এই কাজটো দেখার ভার দিলে ভাশুর আর ল-দ্যাওরের ওপর। নামেই থাকল বড় কত্তা, আসল দায়িত্ব ল-দ্যাওরকেই নিতে হলো। আমি য্যাকন বিয়ে হয়ে ই বাড়িতে আসি, এই মানুষটি ত্যাকন একেবারেই ছেলেমানুষ। আমার চেয়েও বয়েসে ক-বছরের ছোট তো! বড় খোঁকা য্যাতোদিন বেঁচে ছিল, সে ছিল এই দ্যাওরের চোখের মণি। সে চলে গেলে তার বুকে যি কেমন বেজেছিল তা আমি জানি। তারপর থেকে এমন করে সে ব্যাভার করত যেন সেই আমার বড় খোঁকা। অ্যাকন যি তার বিয়ে দেওয়া হয়েছে, অ্যাকনও সে তেমনিই আছে।

এই সিদিন ছোট দ্যাওরের-ও বিয়ে হয়ে গেল। উ আর কিছুতেই কলেজে ল্যাখাপড়া করলে না। কত্ত কতো বুজুইলে—সে খালি কাঁদতে লাগলে, বড় খোঁকাই চলে গেয়েছে, আর কিসের ল্যাখাপড়া! চাকরি-বাকরি একটো খুঁজে নিয়ে কত্তার পাশে দাঁড়ানো দরকার। তা বিয়ের আগেই চাকরি একটো পেলে সে। কত্তা আর আপত্তি করলে না। শহরে বাসা করে দিয়ে ছোট বউকে সেখানে পাঠিয়ে দিলে। আমাকে বললে, এই প্রথম গাঁ ছেড়ে শহরে বাড়ির একজন বসবাস করবে। তা করতে হবে না? চিরকাল কি সবাই কুয়োর ব্যাঙ হয়ে থাকবে? দুনিয়াটাকে দেখে-শুনে নিতে হবে না?

সোংসার যাকে বলে ভরা-ভত্তি। চাষের জমি একশো বিঘের ওপর। চারজনা কাজের মুনিষ সারা বছর আছে। সোম্‌বছরের রাখাল আছে। একটো গোয়ালে গরু-ছাগলের জায়গা হয় না, আর একটো করতে হয়েছে। বাড়ি সব সোমায় গমগম করছে।

তবে যতো বড়ই হোক সোংসার, গিন্নি কিন্তুক সেই আমাদের শাশুড়ি। কত্তা সেই যি বলেছে, মা, সব হবে তোমার হুকুমে— সেই কথাটির নড়াচড় হবার উপয় নাই। আমি জানি, এতটো বয়েস হয়ে গেল— অ্যাকনো যেদি গিন্নির কথার এতটুকুনি আগেরাজ্যি করি, নতিজার অবদি থাকবে না। কত্তা ঠিক হাত ধরে বাড়ির বাইরে দিয়ে আসবে। ভিন্‌ ভিন্‌ গাঁ থেকে লতুন বউ-ঝিরা আসছে। তারাও ছেলেপুলের মা হয়ে যেচে, তবু তাদের কেউ যেদি গিন্নির ছামনে হাতের বালা ঘোরাইছে, একটু ঠোসক কি গরব দেখাইছে, কত্তা ঠিক তাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেবে।

অ্যাকন আমার মনে হয়, কত্তার সারা জেবনের কাজ যেন আগের থেকে বাঁধা। বেঁধেছে সে নিজেই, কারু কথা শুনে লয়। কারু কথা শোনার লোক সে লয়। বোধায় পেথমেই ঠিক করে নিয়েছিল, বাপ মরার পরে ভাইবুনদের কেউ যেন বুঝতে না পারে যি বাপ মরেছে, মা যেন না মনে করতে পারে যি, বাপ চলে যাবার পরে এতিম ছেলেমেয়েগুনো পানিতে ভেসে যাবে আর লোকের দয়ায় বেঁচে থাকবে। আরও একটো কথা কত্তা ভেবে রেখেছিল যি, সোংসার যতো খুশি বড় হোক, বরং যাতো বড় হবে তাতেই ভালো- সবাই একসাথে থাকবে, লোকজনে আত্মীয়কুটুমে বাড়ি সব সোমায় গমগম করবে। কিন্তুক সে নিজে থাকবে দূরে, নিজে থাকবে একা। সত্যিই, কিছুতেই বাড়ির ভেতর আসত না। মা ডেকে পাঠাইলে আসত, খুব বড় বেপদ-আপদ, রোগ-শোক বা খুশির খবরে আসত, আবার খানিকক্ষণ বাদেই যেত তার বাইরের ঘরে। বাইরের ঘরে, মানে বৈঠকখানা নয়, দলিজ তো আলাদা, বাড়িরই একটো ঘর এট্টু অ্যাকানে ছিল, কত্তা সেই ঘরে থাকত, শুত। এই ঘরেরই বাইরের দিকে একটো পরচালি ছিল, সেখানে চেয়ার পেতে বসে থাকত বেরাট খামারের দিকে মুখ করে। সি জায়গাটো খুব ঠান্ডা ছেঁয়া, কুনো মানুষজন সিদিকে যেত না, বোধায় গরুছাগলও সিদিকে যেতে ভয় করত।

এত বড় সোংসারের কত্তা, বাড়ির ভেতরে এত লোক, এত কাচ্চা-বাচ্চার চ্যাঁ ভ্যাঁ— কত্তা নিজেই এত বড় সোংসার গড়েছে, তবু সে নিজে থাকত দূরে। মানুষজন তেমন পছন্দ করত না। মজা-ফুত্তি করে অনেক মানুষের সাথে তাকে কুনোদিন গল্প-গুজব করতে দেখি নাই। তার ছামনে গেলেই, সে যে-ই হোক, তার পা কাঁপত, কথা আটকে যেত। পথেঘাটে, বাড়ির ছেলেই হোক আর পাড়ার ছেলেমেয়েই হোক, কত্তাকে দেখলেই ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ত। কিন্তুক কত্তা ঘরের কিংবা বাইরের কুনো ছোট ছেলেমেয়েকে বকেছে বলে আজ পয্যন্ত মনে করতে পারি না। এমনিই রাশভারি মানুষ ছিল সে। ঐ যি ঘরে থাকত, সকালে দোপরে রেতে তার খাবার বয়ে নিয়ে যেতে হতো ঐ ঘরে। তার খাবার সামান্য, এই এতটুকু, কিন্তু সে যা বলে দিত তাই রাঁধতে হতো। এইসব লেগে মনে হতো কত্তার সবকিছুই আগে থেকে বাঁধা। সোংসারের সব বিলি-বেবস্থা করে দিয়ে, যার যেমন কাজ তাকে তেমন ভার দিয়ে কত্তা য্যাকন দেখলে আর কুনো গোলমাল হবে না, সোংসার ঠিকমতো চলবে, ত্যাকনই সোংসার থেকে দূরে গেল। মন দিলে সারা এলেকার মানুষের কাজে।

তা অ্যাকন মনে হয় বৈকি যি কত্তা আর একটি জিনিশ চাইত— সেই জিনিশটি হলো খ্যামতা। সোংসারের খ্যামতা তো সে পেয়েই ছিল, তা নিয়ে কারু কুনো কথা ছিল না। তার সোংসারের বাইরেও খ্যামতা পাবার লেগে সে জেনে হোক না জেনে হোক, আমি ঠিক বুঝতে পারি, অ্যানেকদিন থেকে অ্যানেক চেষ্টাই করছিল। যি মানুষ কুনো কথা বলতেই চাইত না, আমি ইস্ত্রী বলে আমারও কুনো আলেদা খাতির ছিল না, সেই মানুষ মন-মেজাজ ভালো থাকলে আমাকেও দু-একটো না বলে পারত না। বাইরের কতো আন্‌কা লোক কবে থেকে বাড়িতে আসে, কি কাজে কত্তা পেরায় পেত্যেকদিন গাঁয়ের বাইরে যায় আবার সাঁঝবেলায় ফিরে আসে, বাড়িতে কতো কাগজ-বই আসে, দ্যাশের ভেতরে কতো কি হচে তা নিয়ে কত্তা আজকাল কথা দু-একটো বলে। ইসব কথায় ত্যাকন তেমন কিছু মনে হতো না। কিন্তুক একদিন রেতে কত্তা আমাকে যখন বললে সাতটো গাঁ নিয়ে যি ইউনিন, সেই ইউনিন নিয়ে সে নিব্বাচন করবে, ত্যাকন মুখ ফুটে বলেই ফেললম।

তোমার বুজিন অ্যাকন খুব খ্যামতার পেয়োজন? দ্যাশে কতো রকম হানাহানি হচে, তুমিই তো বলো, হিঁদু-মোসলমানে হানাহানি, বিটিশ তাড়ানোর লেগে হানাহানি– সব জায়গায় হানাহানি। গাঁ-ঘরও বাদ যেচে না। এই হানাহানিতে তুমিও ঢুকবে? খ্যামতার লেগে?

ক্ষমতার জন্যে কি লোকে ক্ষমতা চায় – আমার কথা শুনে কত্তা রাগলে না,– ক্ষমতা চায় কিছু কাজ করার জন্যে। ক্ষমতা পেলেই তবে কিছু করা যায়— নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়া যায়— আবার দেশের কাজও করা যায়। ক্ষমতা না পেলে কিছুই করা যায় না। নিজেরও না, পরেরও না। শোনো! হানাহানি কিছু হবে না, আর যদি হয় তো হবে। ইউনিয়ন নির্বাচন আমাকে করতে হবে। ক্ষমতা পেলে নিজের জন্যে কিছু করব না, শুধু দেশের কাজই করব, এই কথাটি আমাকে বলতে হবে বটে তবে তা সত্যি নয়। দুটিই করতে হবেনিজের জন্যে কিছু করব, দেশের মানুষের জন্যেও কিছু করব। তোমাকে বলি, যদি একটা নিজের কাজ করি, দশটা সমাজের কাজ করব। কথার কথা বলছি না, যা বলছি তাই করব।

এই কত্তা লোকটিকে আমি য্যাতোদূর চিনি— আমার ছেলেমেয়ের বাপ, বাড়ির কত্তা বলে লয়- অন্য একটো লোক মনে করেই বলছি, এই লোকটিকে বিশ্বেস করা যায়। ওর যি কথা সেই কাজ। তা নাইলে কেউ বলতে পারে, খ্যামতা পেলে নিজের লেগেও কিছু করব, পরের লেগেও করব? এমন হিশেব করে কেউ বলতে পারে নিজের একটো করলে দ্যাশের দশটো কাজ করবে?

আমি জানি উ যেদি জানে মরেও যায়, তবু তা-ই করবে। উ কি কম কঠিন পাষাণ! সারা তল্লাটের লোককেও উ বোধায় বিশ্বেস করাতে পেরেছিল ই কথা। ইটি হিঁদুদের এলেকা, সাত গাঁয়ের মদ্যে মাত্তর একটি ছোট গাঁ মোসলমানদের, আর দুটি গাঁয়ে দু-চার ঘর আছে, বাকি সবই হিঁদু। কত্তার বিরুদ্দে নিব্বাচনে দাঁড়িয়েছিল সব বাঘা বাঘা হিঁদু। সব হেরে গেল তার কাছে। কতো কথাই না বললে তার লেগে! উ মোসলমান, ভিন জাত, উ হিঁদুদের মাথায় পা দিয়ে শাসন করবে। ই হিঁদুদের এলেকা, কতো বামুন-বদ্যি ইখানে বাস করে, কতো শিক্ষিত হিঁদু ই তল্লাটে রয়েছে, সব বাদ দিয়ে একটো মোসলমানকে ইউনিনের পেসিডেন করতে হবে ক্যানে? কতো কথাই না বললে! কিন্তুক কিছুতেই কিছু হলো না। হিঁদুরা, কত্তার শত্ত্বর হিঁদুদের কথা ঘাড়াইলে না। কত্তাই জিতলে। কত্তা জিতলে যি আনন্দ-ফুত্তি হতে লাগল তাতে ভালোই বোঝলম, কত্তা হিঁদু-মোসলমান সক্কলেরই নয়নমণি। তাপরেও মানুষের ভ্যাদ পাওয়া কি কঠিন দ্যাখো! কত্তামার সেই ছেলেদুটি, সেই দুটিকে তো কত্তাই নিজের হাতে মানুষ করেছে, তারা তার আপন ভাইদের বাড়া, কি না করেছে কত্তা তাদের লেগে আর তারাও কত্তাকে দাদা বলতে অজ্ঞান, আমাকেও বউদিদি বউদিদি করে এমন সোম্মান করে অথচ কত্তা একদিন ভোটের সোমায় কোন্‌ গাঁ থেকে অ্যানেক রেতে ফিরে এমন একটো কথা বললে যি আমার মুখের রা-কথা বন্ধ হয়ে গেল।

পাশের গাঁয়ের ভদ্রলোকদের সাথে কথা বলতে বলতে অ্যানেকটে রাত হয়েছে। ফেরার সোমায় সঙ্গে যারা ছিল- গাঁয়ের হিঁদু-মোসলমান দু-রকম মানুষই ছিল— তারা সব নিজের নিজের বাড়ির দিকে গেলে হিঁদুপাড়া দিয়ে কত্তা একাই আসছিল। আঁদার তেঁতুলতলাটো পেরুতে যেতেই দেখতে পেলে কে একজন জুবুথুবু হয়ে গায়ে চাদর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভয়-ডর বলে কুনোকিছু তো কত্তার কুনোদিন নাই। কে রে ওখানে— বলে কত্তা তার কাছে যেতেই দেখতে পেলে কামারপাড়ার মদন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। এখানে তুই কি করছিস রে— বলতেই মদন তেমনি কাঁপতে কাঁপতেই কত্তার পায়ের কাছে বসে পড়ল। চাদরের তলা থেকে বেরিয়ে পড়ল এই বড় পাঁটা কাটার এক চকচকে খাঁড়া। মদন, একি রে— আমি একথা বলতেই কালিপ্রসাদের নাম করে বললে, ছোড়দা আমাকে বললে আপনি যখন তেঁতুলতলা দিয়ে বাড়ি যাবেন, তখন চোখ বুঝে আপনার ঘাড়ে যেন একটা কোপ বসিয়ে দি।

তা কোপ বসাতে পারলি না তো? যা বাড়ি যা।

কি পাপ আমি করতে যাচ্ছিলাম, আমার যে নরকেও জায়গা হবে না। মদন হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। - যা বাড়ি যা, শুধু শুধু কখনো খাড়া বার করিস না।

কত্তা জিতলে কিন্তুক বাড়িতে কুনো হৈ চৈ হলো না। একবার শুদু সে বাড়িতে মা আর বুনের কাছে এল। মা বলে একবার শুদু দাঁড়াইলে, আর কিছু বললে না। গিন্নিও একটো কথাই বললে, বাবা, আমার সব আশা পুরেছে, আর কিছু চাই না।

বাড়িতে একটু জাঁকজমক, একটু বড়লোকি ঠাট-ঠমক হলো বৈকি। ঘোড়াটো বদলানো হলো, যেটো ছিল সেটো বিক্রি করে লতুন ভালো জেতের বড় একটো ঘোড়া কেনা হলো। পালকিটো লতুন করে ছাওয়ানো, রঙ করা হলো। গরুর গাড়ির ছইটোকেও আবার রঙ করা হলো, নাঙল বোধায় আর একটো বাড়ল, হাতির মতুন আরও এক জোড়া মোষ এল বাড়িতে। ঘর-দুয়োর সব ল্যাপা-মোছা হলো, খামারের ঘাস লতা-পাতা পোস্কার করা হলো। দলিজ ঘরটোকে সাফ-সুতোর করে লতুন করে সাজানো হলো। খামার থেকে দলিজে ওঠার সিঁড়িটো রাজমিস্ত্রি এনে পাকা করা হলো। দলিজ ঘরের মাটির দেয়ালের পেছন দিকটো যাতে পানির ছাঁটে লষ্ট না হয়, সেই লেগে লতুন করে আলকাতরা ল্যাপা হলো। তাপর এল অ্যানেকগুলিন কাঠের চেয়ার আর টেবিল। পাড়াগাঁয়ে উসব ত্যাকন কে দেখেছে? সারা গাঁ খুঁজলে একটো-দুটো দবজ শালকাঠের চেয়ার হয়তো মিলত, টেবিল আর কোথা? কিন্তুক আমাদের দলিজটিকে চেয়ার টেবিলে সাজাতেই হলো কত্তাকে। এটি যি অ্যাকন কোট হবে। তাই নানা আসবাব আসছে- আপিসের কতোরকম জিনিশপত্তর কতোরকম কাগজখাতা। সবশ্যাষে এল একটি একনলা বন্দুক। এই জিনিশটি য্যাকন এল, একমাত্তর তখুনি দেখলম গিন্নি আপত্তি করলে। কেন বাবা— মানুষ মারার এই অস্তরটি আনতে গেলে? কত্তা তার জবাবে বললে, মানুষ মারার জন্য নয়, মানুষের ধন-প্রাণ বাঁচানোর জন্যেই এটি কেনা হলো মা। এখন থেকে তোমার ছেলের দায়িত্ব শুধু তোমার সংসারটিই নয়, বহু সংসারের দায়িত্বই এখন তার। তাছাড়া— আরও কি একটো কথা কত্তা বলতে গিয়েও বললে না।

যা বলছেলম, একটু বেশি জাঁকজমক, একটু বড়লোকি হলে আর কি করা যাবে? ধনে-জনে ফলে-ফসলে ফেটে পড়ছে সোংসার। হবে না-ই বা ক্যানে? দিনকে তো একবার দোপর হতেই হয়, চড়তে চড়তে সুয্যিকে একবার উঠতে হয় আসমানের মাথায়। এ-ই লিয়ম। ই সোংসারের অ্যাকন তা-ই।