অমাবস্যার রাত Omaboswar Raat by হেমেন্দ্রকুমার রায় Hemendra Kumar Roy, chapter name নয় - মরণের সামনে

নয় - মরণের সামনে

মোহনলাল যে একজন বিশেষ বুদ্ধিমান ও রহস্যময় ব্যক্তি, আজকে তার সঙ্গে ভালো করে কথা কয়ে কুমার এটা তো বেশ বুঝতে পারলেই, তার উপরে তার বুকের পটা দেখে সে অত্যন্ত অবাক হয়ে গেল।

কুমার আর একজন মাত্র লোককে জানে, এরকম মরিয়ার মতো সে এমনই মৃত্যুভয়-ভরা অজানা বিপদের মধ্যে ঝাঁপ দিতে ভালোবাসে। সে হচ্ছে তার বন্ধু বিমল। ছেলেবেলা থেকেই বিপদের পাঠশালায় সে মানুষ।

কিন্তু মোহনলাল কেন যে যেচে এই মৃত্যু খেলায় যোগ দিয়েছে, কুমার সেটা কিছুতেই আন্দাজ করতে পারছে না। সেও কি তাদেরই মতো সখ করে নিরাপদ বিছানার আরাম ছেড়ে চারিদিকে বিপদকে খুঁজে খুঁজে বেড়ায়, না নিজের কোনো স্বার্থসিদ্ধির জন্যেই অমাবস্যার রাতের এই ভীষণ গুপ্তকথাটা সে জানতে চায়?

কিন্তু এখন এ-সব কথা ভাববার সময় নয়। কী ভয়ানক শুড়িপথ-এ? কয়েক পা এগিয়েই কুমার দেখলে, গলির মুখ দিয়ে বাইরের একটুখানি যে আলোর আভা আসছিল, তাও অদৃশ্য হয়ে গেছে! এখন খালি অন্ধকার আর অন্ধকার-সে নিবিড় অন্ধকারের প্রাচীর ঠেলে কোনো মানুষের চোখই কোনো দিকে অগ্রসর হতে পারে না।

 

শুড়িপথের দু দিকের এবড়ো-খেবড়ো দেওয়াল এত বেশি স্যাঁৎসেঁতে যে, হাত দিতেই কুমারের হাত ভিজে গেল! আর সেই জানোয়ারি বোঁটকা গন্ধ! নাকে খুব কষে কাপড়-চাঁপা দিয়েও কুমারের মনে হতে লাগল, তার পেট থেকে অন্নপ্রাশনের ভাত পর্যন্ত আজ বোধ হয় উঠে আসবে!

মোহনলালের হাতে, সেই অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে হঠাৎ একটা ছোটো ইলেকট্রিক লন্ঠনের উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠল। কুমার বুঝলে, মোহনলাল রীতিমতো প্রস্তুত হয়েই এসেছে।

মোহনলাল বললে, কুমারবাবু, আপনার কাছে কোনো অস্ত্ৰ-টস্ট্র আছে?

--না।

—আপনি দেখচি আমার চেয়েও সাহসী! নিরস্ত্র হয়ে এই ভীষণ স্থানে ঢুকতে ভয় পেলেন না?

—আপনিও তো এখানে ঢুকেছেন, আপনিও তো বড়ো কম সাহসী নন।

—কিন্তু আমার কাছে রিভলভার আছে। বলেই মোহনলাল ফস করে হাতের আলোটা নিবিয়ে ফেললে।

--ও কি, আলো নেবালেন কেন?

—একবার খালি দেখে নিলুম, পথটা কিরকম। অজানা পথ নাহলে এখানে আলো জ্বালতুম না—শত্রুর দৃষ্টির আকর্ষণ করে লাভ কি?

—শত্রু?

—হাঁ। এই পথের মাটির ওপর আলো ফেলে এই মাত্র দেখলুম যে, এখানে খালি বাঘের পায়ের দাগই নেই, মানুষের পায়ের দাগও রয়েছে।

—একসঙ্গে বাঘের আর মানুষের পায়ের দাগ? বলেন কি!

—চুপ! আর কথা নয়। হয়তো কেউ আমাদের কথা কান পেতে শুনছে।

অত্যন্ত সতর্কভাবে পা টিপে টিপে দুজনে এগুতে লাগল-অন্ধকার যেন হাজার হাত বাড়িয়ে ক্রমেই বেশি করে তাদের চেপে ধরছে, বদ্ধ-বাতাস দুর্গন্ধে যেন ক্রমেই বিষাক্ত হয়ে উঠছে, কি-একটা প্রচণ্ড আতঙ্ক যেন তাদের সর্বাঙ্গ আচ্ছন্ন করে দেবার জন্যে চেষ্টা করছে! কুমারের মনে হল, সে যেন পৃথিবী ছেড়ে কোনো ভুতুড়ে জগতের ভিতরে প্রবেশ করছে।-- এ পথ যেন যমালয়ের পথ, প্ৰেতাত্মা ছাড়া আর কেউ যেন এ পথে কোনোদিন পথিক হয় নি! আচম্বিতে মাথার উপর দিয়ে বদ্ধ-বাতাসের মধ্যে ঠাণ্ডা হাওয়ার চঞ্চল তরঙ্গ তুলে ঝাটপট করে কারা সব চলে গেল! সমাধির নিঃশব্দতার মধ্যে হঠাৎ সেই শব্দ শুনে কুমারের বুকের কাছটা ধড়ফড়িয়ে উঠল,—কিন্তু তার পরেই বুঝলে, এই মৃত জগতে জীবন্তের সাড়া পেয়ে বাদুড়েরা দলে দলে উড়ে পালাচ্ছো!

আরো কিছুদূর এগিয়েই মোহনলাল চুপি চুপি বললে, এখানে একটা দরজা আছে বোধ হয়-বলেই সে আবার এগিয়ে গেল।

অন্ধকারে হাত বুলিয়ে কুমারও বুঝলে, দরজাই বটে! তার পাল্লা দুটো খোলা। সেও চৌকাঠ পার হয়ে গেল। তার পর দুদিকে হাত বাড়িয়েও আর দেওয়াল খুঁজে পেলে না। শুড়িপথ তা হলে শেষ হয়েছে!

কিন্তু তারা কোথায় এসেছে? এটা ঘর, না অন্য-কিছু? এখানেও দুর্গন্ধের অভাব নেই, উপরপানে চাইলে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না-কিন্তু কুমার অনুভব করলে যে শুড়িপথের থমথমে বদ্ধ-বাতাস আর এখানে স্তম্ভিত হয়ে নেই।

তারা দুজনেই সেখানে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে সন্দিগ্ধ ভাবে খানিকক্ষণ কান পেতে রইল এবং অন্ধকারের মধ্যে দেখবার কোনো-কিছু খুঁজতে লাগল। কিন্তু কিছু দেখাও যায় না, কিছু শোনাও যায় না! ফেন দেহশূন্য মৃতের রাজ্য!

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর মোহনলাল আবার তার ইলেকট্রিক লণ্ঠনটা জ্বালালে। এটা প্ৰকাণ্ড একটা হল-ঘরের মতো, কিন্তু এটা ঘর নয়, কারণ ঘর বলতে যা বোঝায়, এ-জায়গাটাকে তা বলা যায় না। এটা একটা প্ৰকাণ্ড উঠোনের চেয়েও বড়ো জায়গা, কিন্তু মাথার উপরে রয়েছে ছাদ। মাঝে মাঝে থাম-ছাদের ভার রয়েছে তাদের উপরেই।

হঠাৎ মোহনলাল সবিস্ময়ে একটা অব্যক্ত শব্দ করে উঠল! তার পরেই কুমারের একখানা হাত চেপে ধরে বললে, দেখুন কুমারবাবু, দেখুন!

কী ভয়ানক! -- কুমার রুদ্ধশ্বাসে আড়ষ্ট নেত্ৰে দেখলে, তাদের কাছ থেকে হাত-দশেক তফাতেই পড়ে রয়েছে একটা মড়ার মাথা। এবং সেই মাথাটার পাশেই মাটির উপরে এলানো রয়েছে স্ত্রীলোকের মাথার একরাশি কালো চুল!

খানিকক্ষণ একদৃষ্টিতে সেইদিকে তাকিয়ে থেকে, একটা নিঃশ্বাস ফেলে মোহনলাল বললে, ঐ মড়ার মাথা থেকেই ও চুলগুলো খসে পড়েছে। ও-মাথাটা নিশ্চয়ই কোনো স্ত্রীলোকের।

কুমার বললে, হাঁ। এখনো ও-মাথাটার আশে-পাশে কিছু কিছু চুল লেগে রয়েছে। যার ঐ মাথা, নিশ্চয়ই সে বেশিদিন মরে নি।

মোহনলাল দুঃখিত স্বরে বললে, অভাগীর মৃত্যু হয়েছে হয়তো কোনো অমাবস্যাররাতেই!

কুমার সচমকে প্রশ্ন করলে, কী বলছেন আপনি?

আপনার এখানে আসা উচিত হয় নি! আপনি নিজের চোখকে যখন ব্যবহার করতে শেখেন নি, তখন এ রহস্যের কিনারা করবার শক্তিও আপনার নেই! আপনি জানেন যে, বাঘের কবলে পড়ে এখানে অনেক স্ত্রীলোকের প্রাণ গিয়েছে। আমাদের সামনে যে মড়ার মাথাটা পড়ে রয়েছে, ওটা যে কোনো স্ত্রীলোকের মাথা, সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই।--- তার উপরে, আপনি কি এও দেখতে পাচ্ছেন না যে, এ জায়গাটার নরম মাটির উপরে চারিদিকেই রয়েছে বাঘের থাবার দাগ? দুইয়ে দুইয়ে যোগ করলে কি হয় তা জানেন তো ? চার! এ মড়ার মাথাটা হচ্ছে, দুই! আর বাঘের থাবার দাগ হচ্ছে, দুই! এই দুই আর দুইয়ে যোগ করুন, চার ছাড়া আর কিছুই হবে না। অমাবস্যার রাতে এখানে বাঘের উপদ্রব না হলে আমরা আজ ঐ মড়ার মাথাটাকে কখনোই এ জায়গায় দেখতে পেতুম না!

অপ্ৰতিভ কুমার মাথা হেঁট করে মোহনলালের এই বক্তৃতা নীরবে সহ্য করলে। মোহনলালের সূক্ষ্ম বুদ্ধি ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টির কাছে আজ সে হার না মেনে পারলে না।

মোহনলাল লণ্ঠনটা সামনের দিকে এগিয়ে আবার বললে, কুমারবাবু, ওদিকটাও দেখেছেন খানিক তফাতে দেখা গেল, একরাশ হাড়ের স্তুপ! মানুষের হাতের হাড়, পায়ের হাড়, বুকের হাড়, মাথার খুলি! কত মানুষের হাড় যে ওখানে জড় করা আছে, তা কে জানে!— দেখলেই বুক ধড়াস করে ওঠে। —এ যে মড়ার হাড়ের দেশ! যাদের ঐ হাড়, তাদের অশান্ত প্রেতাত্মারাও কি আজ এই অন্ধকার কোটরের আনাচে কানাচে আনাগোনা করছে, নিজেদের দেহের শুকনো হাড়গুলোকে আবার ফিরে পাবার জন্যে ?

কেন সে জানে না, কুমারের বার বার মনে হতে লাগল, ইলেকট্রিক লন্ঠনের আলোকরেখার ওপারে গাঢ় কালো অন্ধকার যেখানে এই চিররাত্রির আলোকহীন গর্তের মধ্যে থমথম করছে, সেখানে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে মানুষের চোখে অদৃশ্য হয়ে কারা সব প্রেতলোকের নিঃশব্দ ভাষায় ফিসফিস করে কথা কইছে আর ঘন ঘন দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করছে!—

—এতক্ষণ ঐ বীভৎস অস্থি-স্তুপের চার পাশে সার বেঁধে বসে যেন তারা নিজেদের মৃতদেহের হাড়গুলো খুঁজে বার করবার জন্যে হাতড়ে দেখছিল, এখন মানুষের হাতের আলোর ছোঁয়া লাগবার ভয়ে তারা সবাই অন্ধকারের ভিতরে গিয়ে লুকিয়েছে!

কুমার আর থাকতে না পেরে, দুই হাতে মোহনলালের দুই কাঁধ প্ৰাণপণে চেপে ধরে বললে, মোহনবাবু! আর নয়, এখানে আর আমি থাকতে পারছি না—আকাশের আলোর জন্যে প্রাণ আমার ছটপট করছে, চলুন-- বাইরে যাই চলুন!

মোহনলাল বললে, কুমারবাবু, আমারও মনটা কেমন ছৎ-ছাৎ করছে! মনে হচ্ছে যেন ভগবানের চোখ কখনো এই অভিশপ্ত অন্ধকারের ভিতরে সদয় দৃষ্টিপাত করে নি, জ্যান্ত মানুষ যেন কখনো এখানে আসতে সাহস করে নি! - আমিও আপনার মতো বাইরে যেতে পারলেই বাঁচি-কিন্তু তার আগে, একবার ওদিকটায় কি আছে, দেখে যেতে চাই। ...আসুন!

কুমারের হাত ধরে মোহনলাল আবার সামনের দিকে এগিয়ে গেল। তার পর, হাত-ত্রিশ জমি পার হয়েই হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

কুমার আশ্চর্য নোত্রে দেখলে, সেখানেও উপরে ছাদ রয়েছে, কিন্তু সামনের দিকে নিচে আর মাটি নেই, থই থই করছে জল আর জল!

বাঁ দিকে দেওয়াল এবং সামনের দিকেও প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ ফুট পরে আর-একটা খাঁড়া দেওয়াল। তারই ভিতরে একটা জলে পরিপূর্ণ দীর্ঘ খাল ডান দিকে সমান চলে গিয়ে অন্ধকারের ভিতরে কোথায় যে হারিয়ে গিয়েছে, তার কোনো পাত্তা পাবার জো নেই!

কুমার অবাক হয়ে জলের দিকে তাকিয়ে আছে, হঠাৎ পিছন দিকে কেমন একটা অস্ফুট শব্দ হল।

মোহনলাল বিদ্যুতের মতো ফিরে হাতের লণ্ঠনটা সুমুখে এগিয়ে ধরলে! এবং তার পরেই লণ্ঠনের আলোটা নিবিয়ে দিল!

সে কী দৃশ্য! অনেক দূরে-শুড়িপথের যে-দরজা দিয়ে তারা এখানে এসেছে, সেই দরজার ভিতর দিয়ে দলে দলে কারা সব হলঘরের ভিতর এসে ঢুকছে! তাদের অনেকের হাতে হ্যারিকেন লণ্ঠন, কারুর হাতে বন্দুক এবং কারুর কারুর হাতে চকচক করছে বর্শা বা তরোয়াল! তাদের চেহারা কালো-কালো, গা আদুড় এবং চোখ দিয়ে ঝরিছে যেন হিংসার অগ্নিশিখা!

কিন্তু মোহনলাল ইলেকট্রিক লণ্ঠন নিবিয়ে ফেলবার আগেই আগন্তুকরা তাদের দেখে ফেললে এবং সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও হাতের সমস্ত আলো নিভে গেল! তারপরেই বন্দুকের আওয়াজ হল-গুড়ুম গুড়ুম গুডুম!

কুমার ও মোহনলালের আশপাশ দিয়ে তিন-চারটে বন্দুকের গুলি সোঁ-সোঁ করে চলে গেল! মোহনলাল বলে উঠল, কুমারবাবু, লাফিয়ে পড়ুন-লাফিয়ে পড়ুন!

--কোথায়?

--এই খালের জলে! বাঁচতে চান তো লাফিয়ে পড়ুন—বলেই মোহনলাল লাফ মারলে, সঙ্গে সঙ্গে কুমারও দিলে মস্ত এক লাফ।

ঝপাং, ঝপাং করে দুজনেই জলের ভিতর গিয়ে পড়ল! মোহনলাল ইলেকট্রিক লণ্ঠনটা আর একবার জ্বলিয়ে বললে, এ জলে দেখছি স্রোতের টান। নিশ্চয়ই কোনো নদীর সঙ্গে এর যোগ আছে! সাঁতার দিয়ে স্রোতের টানের সঙ্গে ভেসে চলুন!

মোহনলালের মুখের কথা শেষ হতে-না-হতেই হাত কয়েক তফাতে জল তোলপাড় করে প্ৰকাণ্ড কি-একটা ভেসে উঠল!

কুমার সভয়ে বললে, কুমির কুমির