অমাবস্যার রাত Omaboswar Raat by হেমেন্দ্রকুমার রায় Hemendra Kumar Roy, chapter name দশ - রহস্য বাড়ছে

দশ - রহস্য বাড়ছে

অন্ধকার!

সামনে দপদপ করে দু-টুকরো আগুন জ্বলছে! সে দুটো কুমিরের চোখ, না সাক্ষাৎ মৃত্যুর চোখ?

ওপাশ থেকে মোহনলালের স্থির, গভীর অথচ দ্রুত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, কুমারাববু! টপ করে ডুব দিন। ডুব-সাঁতার দিয়ে যতটা পারেন ভেসে যান। আবার ভেসে উঠে নিঃশ্বাস নিয়ে ডুব দিয়ে অন্য দিকে এগিয়ে যান। এইভাবে একবার ভেসে উঠে নিঃশ্বাস নিয়ে আবার ডুব দিয়ে একেবেঁকে এগিয়ে চলুন!

মোহনলালের মুখের কথা শেষ হতে-না-হতেই সামনের আগুন-চোখদুটো নিবে গেল। কুমার বুঝলে, কুমির শিকার ধরবার জন্যে ডুব দিলে। সঙ্গে সঙ্গে সেও দিলে ডুব। নিঃশ্বাস বন্ধ করে জলের তলা দিয়ে ডান দিকে যতটা পারলে সাঁতরে এগিয়ে গেল। তারপর ভেসে উঠে নিঃশ্বাস নিয়েই আবার ডুব দিয়ে ডান দিকে এগিয়ে গেল। এমনি করেই বারংবার ভেসে এবং বারংবার ডুবে এঁকেবেঁকে কুমার অনেকক্ষণ সাঁতার দিলে। সঙ্গে সঙ্গে সে ভাবতে লাগল, মোহনলাল বিপদেও কী অটল! কী তার স্থির বুদ্ধি। সামনে ভীষণ কুমির দেখে সে যখন ভয়ে ভেবড়ে পড়েছে, মোহনলালের মাথা তখন বিপদ থেকে মুক্তিলাভের উপায় চিন্তা করছে! মোহনলাল যে-কৌশল তাকে শিখিয়ে দিলে সেটা সেও জানত, কিন্তু কুমিরের মুখে পড়ে তার কথা সে স্রেফ ভুলে গিয়েছিল!

 

কুমিররা লক্ষ্য স্থির করে জলের উপরে ভেসে উঠেই তার পর ডুব দিয়ে ঠিক লক্ষ্য স্থলে গিয়ে শিকার ধরে। কিন্তু ইতিমধ্যে যাকে সে ধরবে, সে যদি স্থান-পরিবর্তন করে, তা হলে কুমির তাকে আর ধরতে পারে না!

খানিকক্ষণ পরেই কুমার দেখলে যে সামনের দিকে দূরে দিনের ধবধবে আলো দেখা যাচ্ছে! তা হলে ঐটেই হচ্ছে সুড়ঙ্গখালের মুখ?

কিন্তু পিছনে কালো জল তোলপাড় করে যে নির্দয় মৃত্যু তখনো এগিয়ে আসছে, তার কবল থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে তাকে তখনি আবার ডুব দিতে হল, আলো দেখে খুশি হবার বা মোহনলালের খোঁজ নেবার অবসর কুমারের এখন নেই!

সুড়ঙ্গ-খাল শেষ হল, কুমার বাইরের উজ্জ্বল সূর্য কিরণে এসে দেখলে, অদূরেই মোহনলালও নদীর উপরে ভেসে উঠল! ...কুমার বুঝলে, খাল কেটে গাঁয়ের কাজল-নদীর জলই সেই প্ৰকাণ্ড সুড়ঙ্গের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই এ-সব হচ্ছে সেকেলে ডাকাতদের কাণ্ড।

পিছনে তাকিয়েই দেখলে, সেই একগুয়ে কুমিরটাও জলের উপরে জেগে উঠল, মোহনলালের খুব কাছেই।

মোহনলাল ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত স্বরে চেঁচিয়ে বললে, ভারি তো জ্বালালে দেখছি! এ আপদ যে কিছুতেই আমাদের সঙ্গ ছাড়তে চায় না! কুমির ও মোহনলাল আবার জলের তলায় অদৃশ্য হল।

এবারে কুমার আর ডুব দিলে না, কারণ সে বুঝে নিলে, কুমিরের লক্ষ্য এখন মোহনলালের দিকেই।

আবার মোহনলাল খানিকটা তফাতে গিয়ে ভেসে উঠল এবং কুমিরটাও ভেসে উঠল। ঠিক সেইখানেই, একটু আগেই মোহনলাল যেখান থেকে ডুব মেরেছিল! আবার শিকার ফসকেছে দেখে কুমিরটা নিৰ্ম্মফল আক্ৰোশে জলের ওপরে ল্যাজ আছড়াতে লাগল-মানুষ খেতে এসে তাকে এমন বিষম পরিশ্রম বোধ হয় আর কখনো করতে হয় নি!

মোহনলাল বললে, না, এ লুকোচুরি খেলা আর ভালো লাগছে না-দেখি, এতেও ব্যাটা ভয় পায় কি না।--বলেই সে কুমিরের চোখ টিপ করে উপরি-উপরি তিনবার রিভলভার ছুঁড়ে সাৎ করে জলের তলায় নেমে গেল-সঙ্গে সঙ্গে কুমিরও অদৃশ্য!

রিভলভারের গুলিতে কুমির যে মরবে না, কুমার তা জানত। যত বড়ো জানোয়ারই হোক সাধ করে কেউ রিভলভারের গুলি হজম করতে চায় না। তাই এবার মোহনলাল ভেসে ওঠবার পরেও কুমিরটার ল্যাজের একটুখানি ডগা পর্যন্ত দেখা গেল না।

মোহনলাল বললে, মানুষ খাবার চেষ্টা করলে যেসব সময়ে আরাম পাওয়া যায়না, কুমিরটা বোধ হয় তা বুঝতে পেরেছে। অন্তত তার একটা চোখ যে কণা হয়ে যায় নি, তাই বা কে বলতে পারে?...চলুন, কুমারবাবু, আমরা ডাঙায় গিয়ে উঠি।

তীরে উঠে মোহনলাল বললে, এসেছিলুম পটলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে কিন্তু আপনি কি বলেন কুমারবাবু, এ-অবস্থায় আমাদের কি আর কোনো ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া উচিত?

কুমার বললে, পটলবাবুর সঙ্গে আর একদিন দেখা করলেই চলবে। আর সত্যিকথা বলতে কি, পটলবাবুর ওপরে আমার অত্যন্ত সন্দেহ হচ্ছে।

--কেন?

--পটলবাবুর বাড়ির ভেতরে আজ যা দেখলুম, তার সঙ্গে তাঁর যে যোগ নেই—এটা কি বিশ্বাস করা যায়?

--না, বিশ্বাস করা যায়না। কিন্তু পটলবাবুতো অনায়াসেই বলতে পারেন যে, এই সেকেলে প্রকাণ্ড অট্টালিকার ভাঙা ইটের রাশির ভেতরে কোনো মানুষ ভরসা করে পা বাড়ায় না। তিনি এর বার মহলটাই মেরামত করে নিয়েছেন, এর ভেতরে তিনিও কোনদিন ঢোকেননি, সুতরাং এর মধ্যে কি হচ্ছে না-হচ্ছে তা তিনি কেমন করে জানবেন?

—তিনি বললেই আমরা কি মেনে নেব?

--অগত্যা। না মেনে উপায় কি? আমাদের প্রমাণ কোথায়? বাড়ির ভাঙা মহলগুলো তো দিন রাতই খোলা পড়ে থাকে, বাইরের যে কোনো লোক যখন খুশি তার ভেতরে ঢুকতে পারে- যেমন আজ আমরা ঢুকেছিলুম, অথচ পটলবাবু কিছুই টের পান নি। ডাকাত বা অন্য কোনো বদমাইসের দল কোনো অজানা গুপ্তপথ দিয়ে তার মধ্যে ঢুকে কখন কোথায় আস্তানা পাতে, সে কথা তিনি কি করে জানবেন? ভাঙা বাড়ির ভেতরে যে বাঘের আডডা আছে, এটাও তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। আর বুনো বাঘ যদি মানুষ ধরে খায়, সেজন্যে কেউ পটলবাবুর ঘাড়ে দোষ চাপাতে পারে না। আর এ হচ্ছে আশ্চর্য বুনো বাঘ-পোড়ো-বাড়িতে থাকে, তিথি-নক্ষত্রের খবর রাখে, অমাবস্যার রাত না হলে তার ক্ষিদে হয় না, গয়না-পরা স্ত্রীলোক ছাড়া আর কারুকে সে ধরে না, আবার সঙ্গে করে আনে ডাকতের দল।

কুমার সন্দেহ পূর্ণ কণ্ঠে বললে, ‘প্তি অমাবস্যার রাতে এখানে এসে যে দেখা দেয়, সে কি সত্যি সত্যিই বাঘ, না আর কিছু?”

—আপনি তো স্বচক্ষেই বাঘটাকে দেখেছেন। আমিও দেখেছি। এ যে আসল বাঘই বটে, তারও প্রমাণ আজ পেয়েছি। পোড়োবাড়ির অন্ধকার গহ্বরে মানুষের হাড়ের স্তুপ তো দেখেছেন। যাদের রক্ত-মাংস গেছে বাঘের জঠরে, সেই অভাগাদেরই হাড়ের রাশি সেখানে পড়ে রয়েছে।

কুমার ভাবতে ভাবতে বললে, এ বাঘ কি মায়া-বাঘ, না এ-সব ভুতুড়ে কাণ্ড?--গায়ের লোকেরাও বলে, এ-সব ভুতুড়ে কাণ্ড। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর ইংরেজ আইনের কাছে ভূতুড়ে কাণ্ড বলে কোনো কাণ্ডই নেই। আমরা একালের সভ্য লোক, ভূত তো কোন ছার, ভগবানকেই আমরা উড়িয়ে দিতে পারলে বেঁচে যাই! কিন্তু যাক সে কথা। এখন আপনি কি করবেন?

--থানায় ফিরে যাব?

--কিন্তু সাবধান, আজ যা দেখেছেন, থানার কারুর কাছে তা প্রকাশ করবেন না। অমাবস্যার রাতের রহস্য যদি জানতে চান, তাহলে একেবারে মুখ বন্ধ করে রাখবেন। পুলিশের কাছে এখন কিছু জানালেই তারা বোকার মতো গোলমাল করে সব গুলিয়ে দেবে। আজ যা দেখলুম। তাতে মনে হয়, আপনি চুপচাপ থাকলে আসছে অমাবস্যাতেই সব রহস্যের কিনারা হয়ে যাবে। আজ আর এর বেশি কিছু বলব না। নমস্কার।’ মোহনলাল তার বাসার দিকে চলে গেল।

কুমার চিন্তিত মুখে থানার দিকে এগিয়ে চলল। বাসার কাছ বরাবর এসেই সে দেখলে, চন্দ্রবাবু একদল পাহারাওয়ালা নিয়ে থানার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছেন।

কুমারকে দেখেই তাড়াতাড়ি তার কাছে এসে বললেন, এই যে কুমার! তোমার জন্যে আমার বড়ো ভাবনা হয়েছিল।

--কেন চন্দ্রবাবু?

—আমি শুনলুম তুমি আর মোহনলাল নাকি নদীতে কুমিরের মুখে পড়েছ! এখন তোমাকে দেখে আমার সকল ভাবনা দূর হল।-যাক এ যাত্রা তা হলে তুমি বেঁচে গিয়েছ।

—এ যাত্রা কেন চন্দ্ৰবাবু, অনেক যাত্রাই এমনি আমি বেঁচে গেছি। তবে একদিনের যাত্রায় মরণকে যে আর ফাঁকি দিতে পারব না, সে বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই।

—কুমিরটা কি মোহনলালের রিভলভারের গুলি খেয়েই পালিয়ে গেছে? গাঁয়ের চারিদিকেই আমার গুপ্তচর আছে, এ-কথা তো তুমি জানো! ...কিন্তু মোহনলাল কোথায়?

--তিনি বাসায় গিয়েছেন।

—তুমি থানায় গিয়ে ভিজে কাপড়-চোপড়গুলো বদলে ফেল, ততক্ষণে আমি মোহনলালের বাড়িটা একবার ঘুরে আসি।

—কেন, সেখানে আবার কি দরকার ?

চন্দ্ৰবাবু এগুতে এগুতে বললেন, আমি মোহনলালকে গ্রেপ্তার করতে যাচ্ছি।”