বারো - আবার সেই রাত
সন্ধ্যা উত্তীৰ্ণ হয়ে গেছে। অমাবস্যার সেই ভয়ানক রাত আবার এসেছে--কিন্তু বারোটা বাজতে এখনো অনেক দেরি।
কুমার নিজের ঘরের জানলার ফাঁক দিয়ে দেখলে, চন্দ্রবাবু ধড়া-চুড়ো পরে পুস্তুত হচ্ছেন। সেই অজানা বন্ধুর কথামতো চন্দ্ৰবাবু যে আজ পটলবাবুর বাড়ির পিছনে কাজলা০নদীর সুড়ঙ্গ-খালের মুখে গিয়ে সদলবলে পাহারা দিতে ভুলবেন না, কুমার তা বেশ জানত। এবং এটাও সে জানত যে, যাবার আগে তারও ডাক পড়বে-চন্দ্ৰবাবু তাকেও তাঁর সঙ্গে যেতে বলবেন।
কিন্তু সেই অজানা বন্ধু তাকে ভাঙা-বাড়ির শুড়িপথের কাছাকাছি কোনো ঝোপে-ঝাপে লুকিয়ে থাকতে বলেছে। চন্দ্ৰবাবুর কাছে আবার এ-কথা প্রকাশ করতে বারণও আছে, তাই কুমার তাঁকে কোনো কথাই জানায় নি। কাজে-কাজেই পাছে চন্দ্ৰবাবু তাকে সঙ্গে যাবার জন্যে ডাকেন, সেই ভয়ে কুমার চুপি চুপি থানা থেকে আগে থাকতেই বেরিয়ে পড়ে পটলবাবুর বাড়ির দিকে রওনা হল।
কিন্তু এই অজানা বন্ধুই বা কে, আর চন্দ্ৰবাবুর কাছে এত লুকোচুরির কারণই-বাকি, অনেক মাথা ঘামিয়েও কুমার সেটা আন্দাজ করতে পারেনি। আজও সেই কথাই ভাবতে ভাবতে কুমার অন্ধকারের ভিতর দিয়ে পথ চলতে লাগল।
অন্ধকারকে আরো ঘন করে তুলে ঐ তো পটলবাবুর প্রকাণ্ড ভগ্ন অট্টালিকা সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। তার দেওয়ালকে শক্ত শিকড় দিয়ে জড়িয়ে ধরে যে সব বড়ো-বড়ো অশ্বখ-বট মাথা খাড়া করে আছে, প্রবল বাতাসে নিজেরা দুলতে দুলতে তারা যেন অন্ধকারকেও দুলিয়ে দিয়ে বলছে-সর-সর-সর, মর-মর-মর মর! কুমারের মনে হল, অন্ধকার-রাজ্যের ভিতর থেকে যেন সজাগ ভূতুড়ে পাহারাওলারা কথা কইছে!
আন্দাজে-আন্দাজে সে সেই মস্ত-বড়ো ভাঙা সিং-দরজার তলায় গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু অন্ধকারে আর তো এগোনো চলে না। কুমার কান পেতে খুব তীক্ষ্ণ চোখে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলে। কিন্তু দেখাও যায় না এবং গাছপালার মর্মর-শব্দ ছাড়া আর-কিছু শোনাও যায় না। সে তখন টর্চ-লাইটটা টিপে মাঝে মাঝে আলো জ্বেলে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে লাগল।
আবার সেই সব বিভীষিকা! মাথার উপরে উড়ন্ত প্রেতাত্মার মতো ঝটপট ঝটপট করে বাদুড়ের দল যাচ্ছে আর আসছে, যাচ্ছে আর আসছে,-দু-দুটো গোখরো সাপ ফণা তুলে ফোঁস করে উঠেই টর্চ-লাইটের তীব্র আলোয় ভয় পেয়ে বিদ্যুতের মতো এঁকেবেঁকে পালিয়ে গেল, চকমিলানো ঘরগুলোর ও দালানের আনাচ-কানাচ থেকে যেন কাদের হিংসুক, ক্ষুধিত ও জ্বলজ্বলে চোখ দেখা যায়। দিনের বেলাতেই যে নির্জন, বিপদাপূৰ্ণবাড়ির ভীষণতা মনকে একেবারে কাবু করে দেয়, অমাবস্যার কালো রাতে সে-বাড়ি যে আরো কত ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে, কুমারের আজ সেটা আর বুঝতে বাকি রইল না। তবু সেদিন মোহনলাল সঙ্গে ছিল, আর আজ সে একা! কুমারের প্রাণ খুব কঠিন, তাই এখনো সে অটল পদে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্য কেউ হলে এতক্ষণে হয়তো অজ্ঞান হয়ে পড়ত!
কুমার ভয় পেলো না বটে, কিন্তু তারও বার বার মনে হতে লাগল, এই প্ৰকাণ্ড পোড়োবাড়িটা হানাবাড়ি না হয়ে যায় না!-এ হচ্ছে নিষ্ঠুর ডাকাত-জমিদারের বাড়ি, কত মানুষ এখানে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে অপঘাতে মারা পড়েছে, কে তা বলতে পারে? নিশ্চয়ই তাদের আত্মার গতি হয় নি-নিশ্চয়ই তারা নিঃশব্দে কেঁদে কেঁদে বাতাসে বাতাসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং মাঝে মাঝে উঁকি মেরে তাকে দেখছে!
আচম্বিতে কুমার সচমকে শুনলে, ঠিক তার পিছনে কার পায়ের শব্দ। সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কান পেতে শুনলে। শব্দটব্দ কিছুই নেই! তারই শোনবার ভুল-এই ভেবে কুমার আবার এগুলো -আবার সেই পায়ের শব্দ! আবার সে দাঁড়িয়ে পড়ল-সঙ্গে সঙ্গে পায়ের শব্দও থেমে গেল!
না, তার শেনবার ভুল নয়। কেউ তাঁর পিছু নিয়েছে। কিন্তু কে সে? ভূত, না হিংস্র জন্তু? সন্তৰ্পণে কুমার অগ্রসর হল, অমনি সেই পায়ের শব্দও জেগে উঠল। হঠাৎ কুমার তীরবেগে ফিরে দাঁড়ালো-তার একহাতে জ্বলন্ত টর্চ-লাইট আর একহাতে রিভলভার!
কারুকে দেখা গেল না বটে, কিন্তু উঠানের উপরে একটা মস্ত ঝোপ দুলছে। কেউ কি ওখানে লুকিয়ে আছে? যদি সে তাকে দেখে থাকে, তা হলে তারও আর আত্মগোপন করা বৃথা!
অত্যন্ত সাবধানে, রিভলভারের ঘোড়ার উপরে আঙুল রেখে, টর্চের পূর্ণ আলো ঝোপের উপরে ফেলে কুমার পায়ে পায়ে সেই দিকে ফিরে গেল।
ঝোপের সুমুখে গিয়ে কুমার শুনিয়ে শুনিয়ে বললে, যদি কেউ এখানে থাকে, তা হলে বেরিয়ে এসো,-নইলে এই আমি গুলি করলুম।
কোনো সাড়া নেই। ভালো করে সে তখন ঝোপটা নেড়ে-চেড়ে দেখলে, কিন্তু কিছুই আবিষ্কার করতে পারলে না, কেবল খানিক তফাতের আর-একটা ঝোপ থেকে একটা শেয়াল বেরিয়ে উদ্ধর্শ্বাসে ছুটে পালাল।
হয়তো ঐ শেয়ালের পায়ের শব্দেই সে ভয় পেয়েছে-এই ভেবে কুমার আবার অগ্রসর হল। দু-পা যায়, থামে, আর শোনে। কিন্তু পায়ের শব্দ আর শোনা গেল না।
ঐ তো সেই শুড়িপথ! সে আর মোহনলাল সেদিন ওরই মধ্যে ঢুকে বিপদে পড়েছিল। আজ এখানেই তার অপেক্ষা করবার কথা।
ঝোপ-ঝাপ এখানে সর্বত্রই। শুড়িপথের একপাশে এমন একটা ঝোপ বেছে নিয়ে কুমার গা-ঢাকা দিয়ে বসল-যাতে তার পিছন দিকে থাকে বাড়ির দেওয়াল। অন্তত পিছন দিক থেকে কোনো গুপ্তশত্রুর আক্রমণের ভয় আর রইল না।
কিন্তু ঝোপের ভিতরে গিয়ে বসার সঙ্গে সঙ্গেই কুমার অবাক হয়ে শুনলে, খুব কাছেই অন্তরালে বসে কে যেন সকৌতুকে প্রবল হাসির ধাক্কা সামলাবার চেষ্টা করছে।
কিন্তু সে যেই-ই হোক, কুমারের আর খোঁজাখুঁজি করবার আগ্রহ হল না। সে কেবল বাঁধন খুলে পিঠের বন্দুক হাতে নিলে। যখন তার পিছনে রইল দেওয়াল আর হাতে রইল বন্দুক আর সামনের দিকে জেগে রইল। তার সাবধানী দুই চক্ষু, তখন কোনো শত্রুরই তোয়াক্কা সে রাখে না! জন্তু, মানুষ ও অমানুষ, অমন অনেক শক্রকেই এ-জীবনে সে দেখেছে, শত্রুর ভয়ে তার বুক কোনোদিন কাঁপে নি, আজও কাঁপবে না।
কিন্তু, শক্ৰ তবু এল! একলা নয়, চুপি চুপি নয়-দলে দলে, ভীম বিক্রমে কোলাহল করতে করতে। অমন উঁচু দেওয়াল তার পৃষ্ঠরক্ষা করতে পারলে না এবং তার গুলি-ভরা বন্দুক রিভলভারও তাদের পিছনে হটাতে পারলে না-তাদের কাছে কুমারকে আজ কাপুরুষের মতো পরাজয় স্বীকার করতে হল-হয়তো আজ তাকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে হবে!
কুমার ভ্ৰমেও সন্দেহ করে নি যে, ঝোপ-ঝাপের ভিতর এমন অসংখ্য শত্রু এতক্ষণ তারই অপেক্ষায় লুকিয়ে ছিল! তারা হচ্ছে ডাঁশ-মশা!
উঃ, কী তাদের হুলের জোর, আর তাদের বিজয়-হুঙ্কার, আর কী তাদের অশ্রান্ত আক্রমণ! দেখতে দেখতে কুমারের হাত-পা-মুখ ফুলে উঠতে শুরু করলে, নাকের ডগাটা দেখতে হল যেন দু-গুণ বড়ো একটা টোপাকুলের মতো এবং গাল ও কপাল হয়ে গেল। দাগড়া দাগড়া! মুখ ও হাত-পা পেটের ভিতরে যথাসাধ্য গুজে কুণ্ডলী পাকিয়ে কুমার ঝোপের মধ্যে পড়ে রইল, যেন একটা কুমড়ো! ময়নামতীর মায়াকাননের মাংসের মস্ত পাহাড়ের মতো ডাইনসরও তাকে বোধ হয় এতটা কাবু করে ফেলতে পারত না! কুমার ঘন ঘন ঘড়ি দেখতে লাগল-এ মশার পালের হাজার হাজার হুলের খোঁচার চেয়ে অমাবস্যার রাতের সেই ভয়াবহ ব্যাঘ্রের থাবা তার কাছে এখন ঢের বেশি আরামের বলে মনে হল।
আচম্বিতে চারিদিক কেমন যেন অস্বাভাবিক ভাবে আচ্ছন্ন হয়ে গেল! কুমার হাতের রেডিয়াম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, রাত বারোটা বাজতে মোটে আর দেড় মিনিট দেরি আছে।
কি-একটা আসন্ন আতঙ্কের সম্ভাবনায় স্তম্ভিত অন্ধকার যেন আরো কালো হয়ে উঠল! অন্ধ রাত্রির বুক পর্যন্ত যেন ভয়ে টিপ-টিপ করতে লাগল-প্যাঁচা, বাদুড় ও চামচিকের মিলিত আর্তনাদে চারিদিকের স্তব্ধতা যেন ছিঁড়ে ফালাফালা হয়ে গেল—পোড়ো-বাড়ির অলি-গলিতে এতক্ষণ যারা নিশ্চিন্ত হয়ে লুকিয়েছিল, সেই সব অজানা নানা পশুর দল পর্যন্ত কি এক দুরন্ত বিভীষিকা দেখে প্রাণভয়ে বেগে ছুটে পালিয়ে যেতে শুরু করলে! এখন এ স্থান যৌন-মানুষ তো দূরের কথা—বন্য পশুর পক্ষেও নিরাপদ নয়।
কুমার হাজার হাজার মশার কামড় পর্যন্ত ভুলে গেল-তার বাঁ-হাত ধরে আছে বন্দুকটা এবং তার ডান-হাত স্থির হয়ে আছে বন্দুকের ঘোড়ার উপরে!
হঠাৎ ও কী ও? অন্ধকারের বক্ষ ভেদ করে একটা আঁধারে-লণ্ঠন হাতে নিয়ে আচম্বিতে এক মনুষ্য-মূর্তি আবির্ভূত হল এবং এতে তাড়াতাড়ি স্যাঁৎ করে দৌড়ে সেই ভীষণ শুড়িপথের ভিতরে মিলিয়ে গেল যে, কুমার তার মুখ পর্যন্ত দেখবার সময় পেলে না! তাকে মানুষের মতন দেখতে বটে, কিন্তু সত্যিই কি সে মানুষ?
চারিদিকের জীবজন্তুর ছুটোছুটি, প্যাঁচা-বাদুড়, চামচিকের চ্যাঁচামেচি অকস্মাৎ থেমে গেল এবং পর-মুহুর্তে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতার মধ্যে পোড়োবাড়ির অস্তিত্ব পর্যন্ত যেন বিলুপ্ত হয়ে গেল।
এবং তারপরেই সেই অপার্থিব স্তব্ধতা ছুটিয়ে দিল ব্যাঘ্রের ভৈরব গর্জন! একবার, দুবার, তিনবার সেই গর্জন জেগে উঠে। পৃথিবীর মাটি থরথরিয়ে কাঁপিয়ে আকাশ-বাতাসকে থমথম করে দিলে,-তারপর সব আবার চুপচাপ।
কয়েক মুহূর্ত কাটলো। তারপর কুমারের চোখ দেখলে শুড়িপথের সামনে কি একটা ভয়ঙ্কর ছায়া তার দৃষ্টি রোধ করে দাঁড়াল। পিছন থেকে কে চুপিচুপি বললে, ঐ বাঘ!! গুলি কর--গুলি কর!
কে যে এ-কথা বললে, কুমারের তা আর দেখবার অবকাশ রইলনা, তাড়াতাড়ি সে বন্দুকের ঘোড়া টিপে দিলে এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পিছন থেকেও কে বন্দুক ছুঁড়লে!
গুড়ুম! গুডুম! পার-মুহূর্তেই প্রচণ্ড আর্তনাদের পর আর্তনাদে চতুর্দিক পরিপূর্ণ হয়ে গেল এবং এও বেশ বোঝা গেল যে খুব ভাৱী একটা দেহ মাটির উপরে পড়ে ছটফট করছে! অল্পক্ষণ পরে সব শব্দ থেমে গেল।
পিছন থেকে আবার কে বললে, “শান্তি! অমাবস্যার রাতে আর এখানে বাঘ আসবে না!
কুমার একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে টর্চাটা জ্বেলে ফেললে।
পিছনে দাঁড়িয়ে বন্দুক হাতে করে মোহনলাল।
কুমার সবিস্ময়ে বললে, আপনি?
—হাঁ আমি। খানিক আগে আমাকেই আপনি ঝোপে-ঝোপে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।
--তাহলে আমাকে আর চন্দ্ৰবাবুকে চিঠি লিখেছিলেন। আপনিই?
--হাঁ। কিন্তু সে-কথা এখন থাক, আগে দেখা যাক বাঘাট মরছে কি না।
কুমার টর্চের আলো শুড়িপথের দিকে ফেলে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। ...তারপরেই অত্যন্ত আশ্চর্য স্বরে সে বলে উঠল, কি সর্বনাশ! বাঘটা কোথায় গেল? ওখানে যে একটা মানুষের দেহ পড়ে রয়েছে।
দেহটার কাছে গিয়ে মোহনলাল কিছুই যেন হয় নি, এমন সহজ স্বরে বললে, “হ্যাঁ, এ হচ্ছে ভুলু-ডাকাতের দেহ। এর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখুন।
যা দেখা গেল, তাও কি সম্ভব? কুমারের মনে হলো সে যেন কি একটা বিষম দুঃস্বপ্ন দেখছে!
মাটির উপরে দাঁত-মুখ খিচিয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে পটলবাবুর মৃতদেহ! কুমার অভিভূত কণ্ঠে বলে উঠল, অ্যাঃ! এ তো বাঘও নয়, ভুলু-ডাকাতও নয়-এ যে আবার পটলবাবু।
মোহনলাল বললে, পটলবাবু!—কিন্তু তার মুখের কথা মুখেই রইল, হঠাৎ দূর থেকে ঘন ঘন অনেকগুলো বন্দুকের গর্জন শোনা গেল। কুমার চমকে উঠে বললে, ও আবার কি?—ভুলু-ডাকাতের দলের সঙ্গে পুলিশের যুদ্ধ হচ্ছে শীগগির আমার সঙ্গে আসুন।--বলেই কুমারকে হাত ধরে টেনে নিয়ে মোহনলাল দ্রুতপদে ছুটতে আরম্ভ করলে!