অমাবস্যার রাত Omaboswar Raat by হেমেন্দ্রকুমার রায় Hemendra Kumar Roy, chapter name তেরো - আশ্চর্য কথা

তেরো - আশ্চর্য কথা

কুমারের হাত ধরে মোহনলাল ছুটতে ছুটতে একটা চৌমাথায় এসে পড়ল। বাঁ-হাতি পথটা গেছে কজলা-নদীর দিকে-যেখানে সুড়ঙ্গ-খালের সামনে ভুলু-ডাকাতের দলের সঙ্গে পুলিশের লড়াই বেধেছে।

মোহনলাল সে-পথও ছড়িয়ে এগিয়ে চলল।

কুমার বিস্মিত হয়ে বললে, একি মোহনলালবাবু! আমরা নদীর দিকে যাব যে।

--না।

--না। তবে আমরা কোথায় যাচ্ছি?

--আমার বাসায়।

- সেখানে কেন?

—দরকার আছে বলেই সেখানে যাচ্ছি। কুমারবাবু, এখন কোনো কথা কইবেন না, চুপ৷ করে আমার সঙ্গে আসুন।...বাসার দরজায় এসে ধাক্কা মেরে মোহনলাল বললে, ওরে, আমি এসেছি। শীগগির দরজা খোল।

দরজা খুলে গেল এবং ফাঁক দিয়ে দেখা গেল সেই পাকা আমের মতন বুড়ো খোট্টা দরোয়নটার মুখ।

বাড়ির দোতলায় উঠে একটা ঘরের ভিতর ঢুকে একখানা চেয়ারের উপরে ধাপ করে বসে পড়ে মোহনলাল বললে, কুমারবাবু বসুন। একটু হাঁপ ছেড়ে নিন।

খানিকক্ষণ দু-জনেই নীরব। তারপর প্রথমে কথা কইলে কুমার। বললে, মোহনলালবাবু, আপনার উদ্দেশ্য কি? যে-সময়ে আমার উচিত, চন্দ্ৰবাবুকে সাহায্য করা, ঠিক সেই সময়েই আমাকে আপনি এখানে টেনে আনলেন কেন?

মোহনলাল বললে, আপনার সাহায্য না পেলেও চন্দ্ৰবাবু হাহাকার করবেন না। আপনি না গেলেও তিনি যে আজ ভুলু-ডাকাতের দলকে গ্রেপ্তার করতে পারবেন। এ-বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহই নেই।

কুমার বললে, তবু আমার সেখানে যাওয়া উচিত।

মোহনলাল সে-কথার জবাব না দিয়ে কয়েক মুহুর্ত চুপ করে রইল। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞাসা ‘কুমারবাবু আপনি Margaret A, Murray's Witch cult in Western Europe নামে বইখানা পড়েছেন?

এ-রকম খাপছাড়া প্রশ্নের অর্থ বুঝতে না পেরে কুমার বললে, না।

--আপনি ডাইনী বিশ্বাস করেন?”

--ডাইনীদের অনেক গল্প শুনেছি বটে। সে-সব গল্পে আমার বিশ্বাস হয় না। কিন্তু আপনি এমন সব উদ্ভট প্রশ্ন করছেন কেন?

মোহনলাল আবার প্রশ্ন করলে, কুমারবাবু, hycanthroby কাকে বলে জানেন?

--য়ুরোপের ডাইনীরা নাকি hycanthroby-র মহিমায় মানুষ হয়েও নেকড়ে-বাঘের আকার ধারণ করতে পারত।

কুমার বিরক্ত হয়ে বললে, পারত। তো পারত, তাতে আমাদের কি?

কুমারের বিরক্তি আমলে না এনে মোহনলাল বললে, আমাদের দেশেও অনেকে বলেন, মন্ত্রতন্ত্র বা বিশেষ কোনো ঔষধের গুণে মানুষ নাকি বাঘের আকার ধারণ করতে পারে।

এতক্ষণে কুমারের মাথায় ঢুকল মোহনলাল কি বলতে চায়! একলাফে উঠে পড়ে কুমার উত্তেজিত স্বরে বললে, মোহনলালবাবু, মোহনলালবাবু! তবে কি আপনার মতে, এখানকার অমাবস্যার রাতের বাঘাটাও হচ্ছে সেইরকম কোনো অস্বাভাবিক জীব?

মোহনলাল গভীর স্বরে বললে, আমার কোনো মতামত নেই। মানুষ যে বাঘ হতে পারে, এ-কথা বিশ্বাস করতে আমার প্রবৃত্তি হয় না। বিজ্ঞানও তা মানে না। কিন্তু মানসপুরে এই যেসব আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল, এর মূলেই বা কি রহস্য আছে? ... গোড়া থেকে একবার ভেবে দেখুন। বাঘ দেখা দিয়েছে কেবল অমাবস্যার রাতে, ঠিক বারোটার সময়ে। সাধারণ পশুরা এমন তিথিনক্ষত্র বিচার করে ঘড়ি ধরে বেরোয় না। এই অদ্ভুত বুদ্ধিমান বাঘের কবলে যারা পড়েছে, তারা সকলেই স্ত্রীলোক, আর তাদের সকলের গায়েই অনেক টাকার গহনা ছিল। সাধারণ বাঘ কেবল গয়নাপরা স্ত্রীলোক ধরে না। ... তারপর বুঝুন, আপনি আর আমি দু-জনেই দু-বার বাঘ দেখেছি,আপনি গুলি ছুঁড়েছেন কিন্তু দু-বারেই বাঘের বদলে পাওয়া গেল মানুষকে-অৰ্থাৎ পটলবাবুকে--প্রথমবারে আহত আর দ্বিতীয়বারে মৃত অবস্থায়। দু-বারই বাঘের আবির্ভাব আমাদের চোখে পড়েছে, তার পায়ের দাগও দেখা গেছে, তার রক্তমাখা লোমও আমি পেয়েছি, কিন্তু তার দেহ অদৃশ্য হতেও আমরা দেখি-নি, অথচ তা খুঁজেও পাওয়া যায় নি। উপরন্তু দুদুবারই পটলবাবু যে কখন ঘটনাস্থলে এসেছেন, তা আমরা দেখতে পাইনি। ... ... য়ুরোপে এমনি মায়া-নেকড়ে বাঘের অসংখ্য কাহিনী আছে। সাংঘাতিক আঘাত পেয়ে যখন তারা মরেছে, তখন আবার মানুষেরই আকার পেয়েছে।

কুমার রুদ্ধশ্বাসে, অভিভূত স্বরে বলে উঠল, তাহলে আপনি কি বলতে চান যে, পটলবাবুই বাঘের আকার ধারণ করে--

মোহনলাল বাধা দিয়ে বললে, আমি ও-রকম কিছুই বলতে চাই না। আমি খালি দেখাতে চাই যে, সমস্ত প্রমাণ পরে পরে সাজালে ঠিক যেন মনে হবে, কোনো মায়া ব্যাঘ্রই মানসপুরের এই সব ঘটনার জন্য দায়ী। যাঁরা এটা কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেবেন, তাদেরও মতে আমি সায় দিতে রাজী আছি। মানুষ যে ব্যাঘ্র-মুর্তি ধারণ করতে পারে, এটা আমার বিশ্বাস হয় না-কারুকে আমি বিশ্বাস করতেও বলি না।

কুমার বললে, তবে--

মোহনলাল আবার বাধা দিয়ে বললে, কিন্তু এ বিষয়ে আমার কোনোই সন্দেহ নেই। ভুলুডাকাত আর পটলবাবু একই লোক। নিজে সকলের সামনে নিরীহ ভালো মানুষটির মতো থেকে পটলবাবু তাঁর ভাঙা বাড়ির অন্ধকূপের মধ্যে ডাকাতের দল পুষতেন। কালু সর্দার তাঁরই দলের লোক। অমাবস্যার রাতে বাঘের উপদ্রবের সুযোগে, তারই হুকুমে কালু দল নিয়ে ডাকাতি করতে বেরুত। নৌকোয় চড়ে সুড়ঙ্গ-খাল দিয়ে ডাকাতেরা দল বেঁধে বাইরে বেরিয়ে আসত-গভীর রাত্রে কাজল-নদীর বুকে তাদের নৌকা আমি স্বচক্ষে দেখেছি।

কুমার বললে, সবই যেন বুঝলুম। কিন্তু আপনি কে?

খুব সহজ স্বরেই উত্তর হলো, আমি? আমি হচ্ছি মোহনলাল। অত্যন্ত নিরীহ ব্যক্তি।

কুমার বললে, কিন্তু নিরীহ ব্যক্তির কাছে রিভলভার-বন্দুক থাকে কেন?

মোহনলাল সহাস্যে বললে, সুন্দরবনে খুব নিরীহ ব্যক্তিরও রিভলভার-বন্দুক না হলে চলে না।

—মানলুম, কিন্তু তাঁরাও রিভলভার-বন্দুকের জন্যে লাইসেন্স নেয়। আপনার কি লাইসেন্স আছে?

--না।

--লাইসেন্স না নিয়ে রিভলভার-বন্দুক রাখে কেবল গুণ্ডা, খুনে আর বদমাইসরা।

--হুঁ, এ-কথা সত্য বটে।

—তবে? কে আপনি বলুন।

মোহনলাল ঘর কাঁপিয়ে হো হো করে অট্টহাসি হেসে উঠল!

কুমার দৃঢ়স্বরে বললে, পুলিশের ভয়ে যে পালিয়ে বেড়ায়, সে কখনোই ভালো লোক নয়।

মোহনলাল কৌতুক-ভরে বললে, ও আপনার কী বুদ্ধি কুমারবাবু! আপনি ঠিক আন্দাজ করেছেন। আমি ভালো লোক নই।

কুমার বললে, বাজে কথায় ভুলিয়ে সেবারে আমাদের চোখে আপনি খুব ধুলো দিয়েছিলেন। কিন্তু এবারে সেটি আর হচ্ছে না।

মোহনলাল বললে, ঐ শুনুন, কারা আসছে!

নীচের সিঁড়িতে ধূপ-ধুপ করে অনেকগুলো দ্রুত পায়ের শব্দ শোনা গেল-যেন কারা বেগে উপরে উঠছে! এ আবার কোন শত্রুর দল আক্রমণ করতে আসছে? কুমার তাড়াতাড়ি উঠে দরজার দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াল!

ঝড়ের মতো যারা ঘরের ভিতরে এসে ঢুকল, তারা শত্রু নয়! চন্দ্ৰবাবু আর তাঁর পাহারাওয়ালারা।

চন্দ্ৰবাবু সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, আরে, এ কী! কুমার, তুমি এখানে!

কুমার বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি মোহনলালবাবুর সঙ্গে আলাপ করছিলুম!

চন্দ্ৰবাবু বললেন, মোহনলাল? কোথায় সে দুরাত্মা? আমিও তো তারই খোঁজে এখানে এসেছি! আজি আমি ভুলু-ডাকাতের দলকে গ্রেপ্তার করেছি, কেবল ভুলুকেই পাইনি। আমার বিশ্বাস, মোহনলাল ভুলু-ডাকাত ছাড়া আর কেউ নয়।

কুমার ফিরে দেখলে, মোহনলাল আর সে ঘরে নেই!