অমাবস্যার রাত Omaboswar Raat by হেমেন্দ্রকুমার রায় Hemendra Kumar Roy, chapter name আট - পটলবাবুর বাড়ি

আট - পটলবাবুর বাড়ি

অমাবস্যার রাতে সেই রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের পর কুমারের গায়ের ব্যথা মরতে গেল এক হাপ্তারও বেশি।

সেদিন সকাল-বেলায় থানার সামনের মাঠে পায়চারি করতে করতে কুমার নানান কথা ভাবছিল।

নানান ভাবনার মধ্যে তার সবচেয়ে-বড় ভাবনা হচ্ছে, বাঘের গর্তের ভিতর থেকে যে তাকে সেদিন উদ্ধার করলে, কে সেই ব্যক্তি? নিশ্চয়ই সে ডাকাতদের দলের কেউ নয়। গাঁয়ের ভিতরও কুমারের এমন কোনো বন্ধু নেই(একমাত্ৰ চন্দ্ৰবাবুছাড়া), তার জন্যে যার এতটা মাথাব্যথা হবে! এই রহস্যময় ব্যক্তি তার প্রাণরক্ষা করলে, অথচ তাকে দেখাই বা দিলে না কেন?

সে-রাতের সব ব্যাপারের সঙ্গেই গভীর রহস্যের যোগ আছে! সে স্বচক্ষে বাঘ দেখলে, বন্দুক ছুড়লে, অথচ জখম হলেন পটলবাবু! বাঘের পায়ের দাগ রয়েছে, অথচ পটলবাবু বলেন, সেখানে বাঘ আসেনি।

কুমার মনে মনে এমনি সব নাড়াচাড়া করছে, এমন সময়ে দেখতে পেলে, পথ দিয়ে হন। হন করে এগিয়ে চলেছে মোহনলাল।

মোহনলালও তাকে দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বললে, এইযে কুমারবাবু, নমস্কার! শুনলাম নাকি আপনি মস্ত বিপদে পড়েছিলেন?

—হাঁ। কিন্তু হঠাৎ যেমন বিপদে পড়েছিলুম, তেমনি হঠাৎ উদ্ধারও পেয়েছি।

মোহনলাল বললে,আমি বরাবরই দেখে আসছি কুমারবাবু বিপদের যারা তোয়াক্কা রাখে না, বিপদও যেন তাদের এড়িয়ে চলে।

কুমার একটু হেসে বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ, অন্তত আমার জীবনে বারবার তাইই হয়েছে বটে। ...কিন্তু এত সকালে আপনি যাচ্ছেন কোথায়?”

মোহনলাল বললে, একবার পটলবাবুকে দেখতে যাচ্ছি। সেদিন আর একটু হলেই তো পটলবাবু আপনার হাতেই পটল তুলেছিলেন। নিতান্ত পরমায়ু ছিল বলেই বেচারী এ-যাত্রা বেঁচে গেলেন। ভদ্রলোক কেমন আছেন সেই খোঁজ নিতেই চলেছি।

কুমার লজ্জিতভাবে বললে, চলুন, আমিও আপনার সঙ্গী হব। আমার জন্যে তাঁর এই দুৰ্দশা, তার খবর নেওয়া আমার কর্তব্য।

মোহনলালের সঙ্গে খানিকদূর অগ্রসর হয়ে কুমার শুধোলে, আচ্ছা মোহনবাবু, সেদিন যে আমি সত্যি-সত্যিই বাঘ দেখে বন্দুক ঝুঁড়েছি, এ-বিষয়ে আপনার কোনো সন্দেহ আছে কি?

প্রবলভাবে মাথা নেড়ে মোহনলাল বললে, একটুও না—একটুও না! তারপ্রমাণও দেখুন --বলেই সে পকেট থেকে কাগজের ছোট এক মোড়ক বার করলে।

মোড়কের ভিতরে রয়েছে একগোছা লোম। বাঘের লোম। কুমার বিস্মিতভাবে বললে, এ লোম আপনি কোথায় পেলেন?

“আপনার গুলি খেয়ে পটলবাবু যেখানে পড়ে ছটফট করছিলেন, সেইখানে।

—লোমগুলোতে এখনো শুকনো রক্তও লেগে রয়েছে দেখছি।

--হ্যাঁ, এ-থেকে বোঝা যাচ্ছে, আপনার গুলি বাঘের গায়েও লেগেছে!

কুমার বললে, তা না হতেও পারে। হয়তো পটলবাবুর আহত পায়ের রক্তই, লোমগুলোতে লেগে আছে।

--না কুমারবাবু, এ মানুষের রক্ত নয়।

--কি করে জানলেন আপনি?

মোহনলাল গম্ভীরস্বরে বললে, আমি পরীক্ষা করে দেখেছি!

--পরীক্ষা? শুকনো রক্তের দাগে কি লেখা থাকে যে তা মানুষ না পশুর রক্ত ?

থাকে কুমারবাবু, থাকে। আপনি কি "Bordet Reaction"-এর কথা শোনেন নি? Bordet সাহেব একরকম পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন, যার সাহায্যে শুকনো রক্তের দাগ পেলেই বলে দেওয়া যায়, তা মানুষ কি পশুর রক্ত!

--আর সে পদ্ধতি আপনি জানেন?

—আজ্ঞে হাঁ। সেই পদ্ধতিতেই পরীক্ষা করে বুঝেছি, এ রক্ত মানুষের রক্ত নয়।

কুমার বিস্ময়ে ও নিজের অজ্ঞতায় নির্বাক হয়ে রইল। তার চোখে মোহনলাল আজি নূতন রূপে ধরা দিলে! সে বেশ বুঝলে, এ ব্যক্তি তো সাধারণ লোক নয়-নিশ্চয়ই এ অনেক ব্যাপারই জানে এবং বোঝে; এবং এ যে এখানে এসেছে, নিশ্চয়ই তার মধ্যে কোনো গুঢ় কারণ আছে! খানিকক্ষণ পরে কুমার বললে, বাঘের ডাক শুনলুম, তাকে দেখলুম, গুলি করলুম, সে আহত হল, তার রক্তও পাওয়া গেল,--কিন্তু তার পর? কাপুরের মতো সে বাঘ কোথায় উবে গেল?

মোহনলাল চিন্তিত মুখে বললে, সেইটেই তো হচ্ছে আসল প্রশ্ন। একটা মস্ত বাঘ তার আস্ত দেহ নিয়ে একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল কোথায়?

—আর তাঁর সেই খোঁড়া ঠ্যাং নিয়ে পটলবাবুই বা চোখের নিমিষে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন কেমন করে ?

হো হো করে হেসে উঠে মোহনলাল বললে, প্ৰাণের দায়ে অসম্ভবও সম্ভব হয়— কচ্ছপও দৌড়ে হরিণকে হারিয়ে দিতে পারে! তবে পটলবাবু হয়তো ডাকাতদের ভয়ে পিটটান দেন নি।

--তবে?

--আপনার ভয়েই তিনি বোধ হয় একটিমাত্ৰ ঠ্যাঙে ভর দিয়েই লম্বা দিয়েছিলেন।

--আমার ভয়ে ?

-- হ্যাঁ। আপনার লক্ষ্যভেদ করবার শক্তির ওপরে হয়তো তার মোটেই বিশ্বাস নেই। একবার বাঘ বধ করতে গিয়ে আপনি তার পা খোঁড়া করে দিয়েছিলেন, তারপর আবার ডাকাত মারতে গিয়ে আপনি যে তারই প্ৰাণপাখিকে খাঁচাছাড়া করতেন না, সেটা তিনি ভাবতে পারেন নি। কাজে কাজেই ‘যঃ পলায়তি স জীবতি’। পটলবাবু বুদ্ধিমানের কাজই করেছিলেন।

কুমার অপ্রতিভা হয়ে মাথা হেঁট করলে। মোহনলাল তার পর যেন নিজের মনে-মনেই বললে, কিন্তু এ কিরকম কথা? বাঘের গায়ে লাগল গুলি, বাঘ হল জখম, তবে পটলবাবুর পা কেমন করে, খোঁড়া হল?

তাই তো, এ কথাটা তো কুমার এতক্ষণ ভেবে দেখেনি! এও বা কেমন করে সম্ভব হয়? এখানকার সমস্ত কাণ্ডই যেন আজগুবি, এ বিপুল রহস্যের সমুদ্রে যেন কিছুতেই থই পাবার জো নেই!

তারা পটলবাবুর বাড়ির মুখে এসে হাজির হল।

পটলবাবুকে প্রথম দেখে কুমারের যেমন মনে হয়েছিল—শ্মশানের চিতার আগুনের ভিতর থেকে একটা মড়া যেন দানোয় পেয়ে জ্যান্ত পৃথিবীর পানে মিটমিট করে তাকিয়ে দেখছে, তেমনি পটলবাবুর বাড়িখানাকেও দেখে কুমারের মনে হল-- এ যেন কার বিজন সমাধিভবন!

চারি ধারে ঝোপঝাপ, ঘন বাঁশঝাড়, পোড়ো জমি; এক-কোণে একটা পচা ডোবা; মাঝখানে একটা পানা-ধরা পুকুর-এক সময়ে তার সব দিকেই বাঁধানো ঘাট ছিল, এখন তার একটাও টিকে নেই। সেই পুকুরেরই পূর্বদিকে পটলবাবুর জীর্ণ পুরোনো ও প্রকাণ্ড বাড়িখানা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যেন ভাবছে, এইবারে কবে সে একেবারে হুড় মুডু করে ভেঙে পড়বে। এ বাড়িকে কেবল বাড়ি বললেই ঠিক বলা হবে না, একে অট্টালিকা বলাই উচিত—সাত-মহলা অট্টালিকা! কিন্তু তার এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত চোখ চালিয়ে খালি দেখা যায়, নোনা-ধরা, ক্ষয়ে-যাওয়া, বালি-খসা ইটগুলো যেন ছাল-ওঠা ঘায়ের মতন লাল হয়ে আছে! অজগর সাপের মতন শিকড় দিয়ে দেওয়ালকে জড়িয়ে বড়ো-বড়ো সব গাছ হাওয়ার ছোঁয়ায় শিউরে আর্তনাদ করে উঠছে-- এক-একটা গাছ এত বড়ো যে, তার ডাল বেয়ে আট-দশজন মানুষ উঠলেও তারা নুয়ে পড়বে না!

কুমার সবিস্ময়ে বললে, এ তো বাড়ি নয়, এ যে শহর। পটলবাবুর পূর্বপুরুষরা নিশ্চয় খুব ধনী ছিলেন?

 

মোহনলাল বললে, জানি না। তবে এইটুকু জানি যে, এ বাড়ি পটলবাবুর পূর্বপুরুষের নয়। পটলবাবু এ গাঁয়ে এসে বাসা বেঁধেছেন মোটে তিন বছর। এই পোড়ো বাড়ি আর জমি তিনি জলের দরে কিনে নিয়েছেন।

--বাড়িখানাকে কিনে এর এমন অবস্থা করে রেখেছেন কেন ?

—এত বড়ো বাড়ি মেরামত করতে গেলেও ক'ত হাজার টাকার দরকার, তা কি বুঝতে পারছেন না? বাড়িখানার একটা মহলাই পটলবাবুর পক্ষে যথেষ্ট। সেই অংশটুকু মেরামত করে নিয়ে পটলবাবু সেইখানেই থাকেন।

—কিন্তু এ বাড়ি আগে কার ছিল, আপনি কি জানেন?

—সে খোঁজও আমি নিয়েছি। বাংলা দেশের অনেক বড়ো-বড়ো জমিদারের পূর্বপুরুষ ডাকাত ছিলেন। প্রায় তিনশো বছর আগে এমনি এক ডাকাত-জমিদার এই বাড়িখানা তৈরি করিয়েছিলেন। এরকম সেকেলে বাড়ির ভেতরে অনেক রহস্য থাকে। আমরা খোঁজ নিলে আজও তার কিছু কিছু পরিচয় পেতে পারি।

বাড়ির সদর দরজা। এমন মস্ত যে তার ভিতরে অনায়াসেই হাতি ঢুকতে পারে। এতকাল পরেও দরজার লোহার-কিল-মারা পুরু পাল্লা দুখানা একটুও জীর্ণ হয়ে পড়ে নি!

মোহনলালের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ভিতরে ঢুকে কুমার বললে, পটলবাবু কোন অংশে থাকেন, আপনি জানেন তো?

--জানি। কিন্তু তার আগে বাড়ির অন্য অন্য মহলগুলো একবার বেড়িয়ে এলে আপনার কষ্ট হবে কি?

কুমার পরম উৎসাহিত হয়ে বললে, কিছু না-কিছু না! বলতে কি, আমিও সেই কথাই ভাবছিলুম। কিন্তু, পটলবাবুকে আগে তো সেটা একবার জানানো দরকার?

--কোনো দরকার নেই; পটলবাবুর মহল একেবারে আলাদা, তার দরজাও অন্য দিকে। এ মহলগুলোয় জনপ্রাণী বাস করে না, এগুলো এমনি খোলাই পড়ে থাকে, এর মধ্যে যে কেউ ঢুকতে পারে-কত শেয়াল-কুকুর আর সাপ যে এর ভেতরে বাসা বেঁধে আছে, কে তা বলতে পারে?

একে একে তারা তিন-চারটে মহল পার হল-বাড়ির ভেতরের অবস্থাও তথৈবচ! বড়োবড়ো উঠান, দালান, চক-মিলানো ঘর, কারুকাজ করা খিলান, কার্নিশ, থাম ও দরজা-কিন্তু বহুকালের অযত্নে আর কোথাও কোনো শ্ৰী নেই। ঘরে ঘরে বাদুড় দুলছে, চামচিকে উড়ছে, কোলাব্যাঙ লাফাচ্ছে, পথ দিয়ে চলতে গেলে জংলা গাছপালা হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা দেয়, ঘুমন্ত সাপ জেগে রেগে ফোঁস করে ওঠে, তফাতে তফাতে পলাতক জানোয়ারদের দ্রুত পদশব্দ শোনা যায়!... মাঝে মাঝে সব অলিগলি, শুড়িপথ—তাদের ভেতরে কষ্টিপাথরের মতো জমাট-বাঁধা ঘুটুঘুটে অন্ধকার! কুমারের বারবার মনে হতে লাগল, সেই সব অন্ধকারের মধ্যে থেকে থেকে যেন ভীষণ সব চোখের আগুন জ্বলে জ্বলে উঠছে—সে হিংসুক, ক্ষুধিত দৃষ্টিগুলো যেন মানুষের রক্তপান করবার জন্যে দিবারাত্র সেখানে জাগ্রত হয়ে আছে।--আর সে কী স্তব্ধতা! সে স্তব্ধতাকে যেন হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করা যায়।

হঠাৎ কুমার বলে উঠল, দেখুন মোহনবাবু, মাটির দিকে চেয়ে দেখুন!

 

মাটির পানে তাকিয়েই একটি লাফ মেরে মোহনলাল বলে উঠল,অ্যাঁ! আমি কি চোখের মাথা খেয়েছি যে, এটা দেখতে না পেয়ে বোকার মতো এগিয়ে চলেছি! ভাগ্যিস আপনি দেখতে পেলেন। -বলেই সে আগ্ৰহ-ভরে মাটির উপরে হেঁট হয়ে পড়ল!

মাটির উপর দিয়ে বরাবর এগিয়ে চলেছে বাঘের বড়ো-বড়ো থাবার চিহ্ন! সেই পায়ের দাগ ধরে অগ্রসর হয়ে মোহনলাল আর কুমার গিয়ে দাঁড়াল একটা শুড়িপথের সামনে। সেখানে আবার নূতন ও পুরাতন অসংখ্য পায়ের দাগ—দেখলেই বেশ বোঝা যায়, ব্যাঘ্র মহাশয় সেখানে প্রায়ই বেড়াতে আসেন।

মোহনলাল বললে, পটলবাবুর এই রাজপ্রাসাদে যে এত-বেশি বাঘের আনাগোনা, গাঁয়ের কেউ তো সে খবর জানে না।

চিড়িয়াখানার বাঘের ঘরে যেরকম দুৰ্গন্ধ হয়, শুড়িপথের গাঢ় অন্ধকারের ভিতর থেকে ঠিক সেইরকম একটা বিশ্ৰী, বোটকা গন্ধ বাইরে বেরিয়ে আসছে!

মোহনলাল একবার সেই ভয়াবহ শুড়িপথের ভিতর দিকে দৃষ্টিপাত করলে, তারপর ফিরে কুমারের দিকে তাকিয়ে বললে, কুমারবাবু, এর ভেতরে ঢোকবার সাহস আপনার আছে?

কুমার তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললে, পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।

—তা হলে আমার সঙ্গে আসুন--বলেই মোহনলাল বিনা দ্বিধায় সেই অন্ধকারে অদৃশ্য বিপদ ও রহস্যে পূর্ণ শুড়িপথের ভিতরে প্রবেশ করল এবং তার সঙ্গে সঙ্গে এগুলি কুমার--অটল পদে, নির্ভীক প্ৰাণে।