অমাবস্যার রাত Omaboswar Raat by হেমেন্দ্রকুমার রায় Hemendra Kumar Roy, chapter name সাত - বাঘের গর্তে

সাত - বাঘের গর্তে

নিচে কল কল করে জলের বন্যা ছুটে চলেছে, উপরেও ঝড়ের তোড়ে নিবিড় গাছপালার ভিতর দিয়ে যেন শব্দের বন্যা ডেকে ডেকে উঠছে এবং এ-সমস্তকেই গ্রাস করে নীরবে বয়ে যাচ্ছে যেন অন্ধকারের বন্যা!

এরই মধ্যে কুমার কখন জ্ঞান ফিরে পেলে।

অনুভবে বুঝলে, তার দেহটা দুমড়ে কার কাঁধের উপরে পড়ে রয়েছে।

সে একটু নড়বার চেষ্টা করতেই একখানা লোহার মতো শক্ত হাতে তাকে টিপে ধরে কে কর্কশ স্বরে বললে, চুপ। ছটফট করলেই টুঁটি টিপে মেরে ফেলব।--তার হাতের চাপেই কুমারের কোমরটা বিষম ব্যথায় টনটনিয়ে উঠল!

ভীমের মতো গায়ের জোর-কে এই ব্যক্তি? কাঁধে করে কোথায় তাকে নিয়ে যাচ্ছে? কুমারের ইচ্ছা হল, তার মুখখানা একবার দেখে নেয়। কিন্তু যা ঘুটফুটে অন্ধকার!

পায়ের শব্দে বুঝলে, তার আশে-পাশে আরো অনেক লোক আছে। কে এরা? ভুলু ডাকাতের দল? কিন্তু এত লোক থাকতে এরা-তাকে বন্দী করলে কেন? তাকে নিয়ে এরা কি করতে চায়?

অন্ধকারের ভিতর থেকে কে বললে, বাপরে বাপ, এত অন্ধকার তো কখনো দেখি-নি! পথ চলা যে দায় হয়ে উঠল, আলো জ্বালব নাকি?

যে তাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল সে বললে, খবরদার নিশে, আলো জ্বালবার নাম মুখেও আনিস নে! পুলিশের লোক যদি পিছু নিয়ে থাকে, তাহলে আলো জ্বললেই ধরা পড়বি! তার ওপরে এই ছোকরাকে আমি আমার মুখ দেখাতে চাই না।

আর একজন বললে, ওকে মুখই বা দেখাবে কেন, আর অমন করে বয়েই বা মরছ কেন? দাও না এক আছড়ে সাবাড় করে।

—ভোদা ব্যাটার বাপ ছেলের ঠিক নামই রেখেছিল। ভোদা। নইলে অমন বুদ্ধি হয়! ওরে গাধা, আমি কি শখ করে এ ছোড়াটাকে ঘাড়ে করে বয়ে মরছি?

--ওকে নিয়ে গিয়ে তোমার কি লাভ হবে?

--ওরে ব্যাটা ভোদা, তোর চেয়ে ভোঁদড়ও চালাক দেখছি! এ ছোড়াকে নিয়ে কি করব, এতক্ষণে তাও বুঝিস নে? শোন তবে! আপাতত এ ছোড়া আমাদের আড্ডায় বন্দী থাকবে। আসছে অমাবস্যায় ডাকাতি করতে বেরুবার আগে মা-কালীর সামনে একে বলি দেব। মা বোধহয় আমাদের ওপরে রেগেছেন। তিনি মুখ ফিরিয়েছেন বলেই এ যাত্রা আমাদের কাদা ঘেঁটে মরাই সার হল। এমন তো কখনো হয় না। মা নিশ্চয় নরবলি চান!

লোকটার মুখের কথা শেষ হতে-না হতেই ভীষণ এক ব্যাঘ্রের গর্জনে আকাশের মেঘ আর অরণ্যের অন্ধকার যেন থর থর করে কেঁপে কেঁপে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে মানুষের তীক্ষ্ন আর্তনাদ-বার বার তিনবার! তারপরেই সব চুপচাপ।

মহা-আতঙ্কে কম্পিত্যকণ্ঠে কে বললে, সর্দার!”

-- বাঘ!

—না, আমাদের মা বাঘাই চণ্ডী! বললুম তো, মায়ের ক্ষিদে পেয়েছে, মা নরবলি চান!

তোরা তো মাকে খেতে দিলি-নে, মা তাই নিজেই ক্ষিধে মেটাতে এসেছেন!

--কিন্তু মা যে আমাদেরই কাকে ধরে নিয়ে গেলেন! এ কি-রকম মা, নিজের পেটের ছেলেকে পেটে পুরবেন।

—ক্ষিধের সময়ে আত্ম-পর জ্ঞান থাকে না রে ভোদা, আত্ম-পরজ্ঞান থাকে না! আর কে-ই বা মায়ের ছেলে নয়, -মা তো জগৎজননী, সবাই তো মায়ের ছেলে!

কুমার চুপ করে সব কথা শুনে যাচ্ছিল। নিজের পরিণামের কথাও শুনলে। বলির পশুর মতো তাকে মরতে হবে! তাঁর মনটা যে খুব খুশি হয়ে উঠল না, সে-কথা বলাই বাহুল্য।

সর্দার বলে যাকে ডাকা হচ্ছে, তাকে যে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, কে এই লোকটা? কি ভুলু-ডাকাত? না তার প্রধান অনুচর কালু সর্দার?

বিমলের কথা তার মনে হলো। সে এখন কলকাতায়। তার বন্ধু যে আজ মরণের পথে এগিয়ে চলেছে, এ-কথা সে জানেও না। কুমারের মনে এখন অনুতাপ হতে লাগল, কেন সে বিমলের জন্যে অপেক্ষা করেনি? কেন সে একলা এই বিপদের রাজ্যে এল? বিমল যদি আজ এখানে থাকত, তাহলে নিশ্চয় সে প্রাণপণে তাকে উদ্ধার করবার চেষ্টা করত-আর খুবসম্ভব তাকে উদ্ধার করতে পারতও  হয়তো
--

আচম্বিতে কি যে হল, কেবল এইটুকুই তার মনে হল অন্ধকারের ভিতর দিয়ে হুস করে সে নিচের দিকে নেমে গেল, তারপরেই ঝপাং করে একটা শব্দ-সঙ্গে সঙ্গে বুঝলে, সে আর মাটির উপরে নেই, জলের ভিতরে গিয়ে পড়েছে!

--একেবারে এক গলা জল! যে লোকটার কাঁধে চড়ে এতক্ষণ সে যাচ্ছিল, সেও এখন জলের মধ্যে! ...নিজেকে সামলে নিয়ে হাতড়ে সে বুঝলে, তার সঙ্গের লোকটা একেবারে অজ্ঞান হয়ে গেছে!

উপরপানে তাকিয়ে দেখলে খালি ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। তা ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না।

আবার চারিদিক হাতড়ে হাতড়ে সে বুঝলে, তারা একটা গভীর গর্তের ভিতরে গিয়ে পড়েছে। সুন্দরবনের বাসিন্দারা বাঘ ধরবার জন্যে বনের মাঝে মাঝে গর্ত খুঁড়ে গর্তের মুখটা ঘাস-পাতা-গাছপালা দিয়ে ঢেকে রাখে। এটা নিশ্চয়ই সেই রকম কোনো গর্ত।

কুমার কান পেতে শুনতে লাগল। ডাকাতের কোনো সাড়াশব্দ নেই। তাদের সর্দার যে মা বাঘাই-চণ্ডীর বলি নিয়ে গর্তের মধ্যে কুপোকাৎ, এ-কথা নিশ্চয়ই তারা বুঝতে পারেনি। অন্ধকারে অন্ধ হয়ে নিশ্চয়ই তারা এগিয়ে গিয়েছে।

কিন্তু একটু পরেই তো তারা নিজেদের ভ্ৰম বুঝতে পারবো! তখন আবার তারা সদলবলে ফিরে আসবে!

যদি পালাতে হয় তো এই হচ্ছে পালাবার সময়। কিন্তু চারিদিককার দেওয়ালে হাত বুলিয়ে কুমার বুঝলে, দেওয়াল খাড়াভাবে উপরে উঠেছে-সাপ আর টিকটিকি না হলে তা বেয়ে উপরে ওঠা অসম্ভব।

সে হতাশ হয়ে পড়ল। ...হঠাৎ উপরে কার দ্রুত পায়ের শব্দ হল,-মাত্র একজনের পায়ের শব্দ ! কে এ? ডাকাতরা কি আবার ফিরে এল? কিন্তু তারা এলে তো দল বেঁধে ফিরে আসবে! তবে কি এ পুলিশের চর? ডাকাতদের পিছু নিয়েছে? যা থাকে কপালে-এই ভেবে কুমার চেচিয়ে ডাকলে, “কে যায়? আমি গর্তের ভেতরে পড়ে গেছি, আমাকে বাঁচাও!

কোনো জবাব পাওয়া গেল না। কুমার আবার চেঁচিয়ে বললে, আমি গর্তের মধ্যে পড়ে গেছি।---আমাকে বাঁচাও!

তখনো জবাব নেই।

কিন্তু হঠাৎ কুমারের মুখের উপরে কি একটা এসে পড়ল,--ঠিক একটা সাপের মতো। কুমার সভয়ে চমকে উঠল—কিন্তু তার পরেই বুঝলে, উপর থেকে গর্তের ভিতরে একগাছা মোটা দড়ি ঝুলছে!

কুমার বিস্মিত হবারও অবকাশ পেলেনা--তাড়াতাড়ি দড়িগাছা চেপে ধরতেই উপর থেকে কে তাকে টেনে তুলতে লাগল।

পাতাল ছেড়ে পৃথিবীর উপরে এসে দড়ি ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে কুমার উল্লসিত কণ্ঠে বললে, কে তুমি ভাই, আমাকে যমের মুখ থেকে বাঁচালে?

কারুকে দেখা গেল না-খালি অন্ধকার! কোনো জবাব এল না—খালি শোনা গেল। কার দ্রুত পায়ের শব্দ। কে যেন সেখান থেকে চলে গেল। যেন ভৌতিক কাণ্ড।

কে এই অজ্ঞাত ব্যক্তি? কেন সে তার সঙ্গে কথা কইলে না, কেন সে পরিচয় দিলে না, কেন সে তাকে বাঁচিয়ে এমন করে চলে গেল? এ কী আশ্চর্য রহস্য!

খানিক তফাৎ থেকে অনেক লোকের গলার আওয়াজ শোনা যেতে লাগল।...ডাকাতরা ফিরে আসছে! তারা বুঝতে পেরেছে, সর্দার আর তাদের দলে নেই!

কুমার বেগে অন্য দিকে দৌড় দিলে।