চোদ্দ - মোহনলাল গ্রেপ্তার
মোহনলাল যেখানে বসে ছিল, তার পিছনেই একটি বন্ধ দরজা—এ-ঘর থেকে আর একটা ঘরে যাবার জন্যে।
কুমার বললে, মোহনলাল নিশ্চয়ই ও-ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
বাঘের মতো সেই দরজার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে চন্দ্ৰবাবু বললেন, মোহনলাল, এবারে আর তোমার বাঁচোয়া নেই! সমস্ত বাড়ি আমি ঘেরাও করে ফেলেছি, একটা মাছি পর্যন্ত এখান থেকে বেরুতে পারবে না। ভালো চাও তো দরজা খোলো।
ঘরের ভিতর থেকে সাড়া এলো, আজ্ঞে, আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন কেন? মোহনলাল তো এ-ঘরে নেই!”
চন্দ্রবাবু রাগে গরগর করতে করতে বললেন, সেদিনকার মতো আবার আজ ঠাট্টা করা হচ্ছে! তুমিই তো মোহনলাল! শীগগির বেরিয়ে এস বলছি।
—আজ্ঞে, ভুল করছেন! আমি মোহনলাল নই।
—আচ্ছা, আগে বেরিয়ে এসো তো, তারপর দেখা যাবে তুমি কোন মহাপুরুষ!
—আজ্ঞে, আবার ভুল করছেন! আমি মহাপুরুষও নই।
চন্দ্ৰবাবু গর্জন করে বললেন, তবে রে ছুঁচো! ভাঙলাম তা হলে দরজা!-- বলেই তিনি দরজার উপরে সজোরে পদাঘাত করতে লাগলেন।
—আজ্ঞে, করেন কি—করেন। কি! দরজা ভাঙলে বাড়িওয়ালা বাকবে যে! আচ্ছা মশাই, আমি দরজা খুলে দিচ্ছি, এই নিন!--হঠাৎ দরজা খুলে গেল।
চন্দ্রবাবু বিভলভার বাগিয়ে ধরে, ঘরের ভিতরে ঢুকতে গিয়ে থমেক দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর দুই চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত করে বাধো বাধো স্বরে তিনি বললেন, এ কী! কে আপনি?
কুমারও অবাক! ও-ঘরের দরজার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে তো মোহনলাল নয়,- সে যে বিমল, যার সঙ্গে কুমার দু-বার যকের ধন আনতে গিয়েছিল, মঙ্গলগ্রহের বামনাবতারদের সঙ্গে লড়াই করেছিল, ময়নামতীর মায়া-কাননের দানবদের সঙ্গে প্ৰাণ নিয়ে খেলা করেছিল। বিমল-বিমল, তার চিরবন্ধু বিমল, মানসপুরে এসে পর্যন্ত যার অভাব কুমার প্রতিদিন প্রতি পদে অনুভব করেছে, এমন হঠাৎ তারই দেখা যে আজ এখানে পাওয়া যাবে, স্বপ্নেও সে তা কল্পনা করতে পারেনি।
কুমার উচ্ছসিত কণ্ঠে বলে উঠল, বিমল, বিমল, তুমি কোথা থেকে এলে? তুমি কি আকাশ থেকে খসে পড়লে?
বিমল হাসতে হাসতে বললে,--না বন্ধু না! মোহনলাল-রূপে গোড়া থেকেই আমি তোমার সঙ্গে সঙ্গে আছি!
চন্দ্রবাবু হতভম্ভের মতো বললেন, অ্যাঁ, বলেন কি? আপনিই মোহনলাল?
--আজ্ঞে হাঁ! এখন আসুন চন্দ্ৰবাবু, আমার হাতে লোহার বালা পরিয়ে দিন!
ধাঁ করে কুমারের একটা কথা মনে পড়ে গেল, তাড়াতাড়ি সে বলে উঠল, আচ্ছা বিমল, বাঘের গর্তে ডাকাতের কবল থেকে--
বিমল বললে, আমিই তোমাকে উদ্ধার করেছিলুম। কিন্তু এ-জন্যে আমাকে ধন্যবাদ দেবার দরকার নেই! কুমার, পিছন ফিরে দেখ, ঘরের ভেতরে ও আবার কে এলো!
কুমার ফিরে দেখে, একমুখ হাসি নিয়ে, দু-পাটি দাঁত বের করে আহ্লাদে আটখানা হয়ে তার পিছনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে বিমলের পুরাতন ভৃত্য রামহরি!
কুমার বললে, কি-আশ্চর্য। তুমি আবার কোত্থেকে এলে?
রামহরি বললে, আরো দুয়ো কুমারবাবু, দুয়ো! তুমিও আমাদের চিনতে পার নি। আমি যে নিচে দরোয়ান সেজে থাকতুম! পারচুলোর দাড়ি-গোঁফ ফেলে আবার রামহরি হয়ে, এখন তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলুম! আরো দুয়ো কুমারবাবু, দুয়ো! কি ঠিকানটাই ঠকে গেলে!