দ্বিতীয় পর্ব : দ্য মিউল - ২২. নিও ট্রানটরে মরণ থাবা
নাম নিওট্রানটর! নিওট্র্যানটর! এবং মাত্র এক নজরেই মহা গৌরবান্বিত আসল ট্র্যানটরের সাথে নতুনটার পার্থক্য পরিষ্কার ধরা পড়বে। মাত্র দুই পারসেক দূরে এখনো জ্বলছে পুরোনো ট্রানটরের সূর্য এবং বিগত শতাব্দীর গ্যালাক্সির ইম্পেরিয়াল ক্যাপিটাল এখনো মহাকাশ ভেদ করে নিজ কক্ষপথে নিঃশব্দে তার অনন্ত ঘূর্ণন অব্যাহত রেখেছে।
পুরোনো ট্রানটরে মানুষ বাস করে এখনো। খুব বেশি না-এক শ মিলিওন সম্ভবত, যেখানে মাত্র পঞ্চাশ বছর আগেই চল্লিশ বিলিওন মানব সন্তানের কোলাহলে মুখর ছিল এই গ্রহ। পুরো গ্রহটাকে ছাদের মতো ঢেকে রাখা ধাতব আবরণের ভিত্তি হিসেবে বহুতল ভবনগুলো এখন ছিন্নভিন্ন ফাঁকা-এখনো ব্লাস্টারের আঘাতে তৈরি হওয়া গর্ত আর পোড়া দাগ চোখে পড়ে-চল্লিশ বছর আগের মহাবিপর্যয়ের নিদর্শন।
সত্যি অদ্ভুত যে, যে বিশ্ব নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে দুই হাজার বছর ছিল গ্যালাক্সির কেন্দ্রবিন্দু-শাসন করেছে সীমাহীন মহাকাশ, ছিল এমন সব শাসক আর আইন প্রণেতার বাসস্থান যাদের অদ্ভুত খেয়ালের মূল্য দিতে হত বহু পারসেক দূরের মানুষকেও-তা মাত্র একমাসের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে। সত্যি অদ্ভুত যে, যে বিশ্ব প্রায় এক সহস্রাব্দ আগ্রাসী দখলদারদের হাত থেকে বেঁচে যায় এবং আরো এক সহস্রাব্দ অবিরাম বিদ্রোহ আর প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা পায়-শেষ পর্যন্ত ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়বে। সত্যি অদ্ভুত যে, গ্যালাক্সির গৌরব এভাবে পচা শবদেহে পরিণত হবে।
এবং মর্মান্তিক
মানুষের পঞ্চাশটা প্রজন্মের এই সুবিশাল কর্মযজ্ঞ পুরোপুরি ক্ষয় হতে আরো এক শতাব্দী লাগবে। শুধু ক্ষমতাহীন কিছু মানুষ সেগুলোকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে ফেলে রেখেছে।
বিলিওন বিলিওন মানুষের মৃত্যুর পর যে কয়েক মিলিওন মানুষ বেঁচে থাকে তারা গ্রহের ধাতব আবরণ সরিয়ে উন্মুক্ত করে মাটি, যে মাটির বুকে বহু সহস্র বছর পৌঁছেনি সূর্যের আলো।
মানব জাতির অসীম প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা যান্ত্রিক উৎকর্ষতা, প্রকৃতির খামখেয়াল থেকে মুক্ত অতি উন্নত শিল্পায়নের মাঝে আবদ্ধ উন্মুক্ত এবং বিস্তীর্ণ প্রান্তরে এখন জন্মায় গম আর অন্যান্য শস্য। সুউচ্চ টাওয়ারগুলোর ছায়ায় চড়ে বেড়ায় ভেড়ার পাল।
কিন্তু নিওট্রানটর ছিল-মহান ট্রানটরের ছায়ায় বেড়ে উঠা অখ্যাত এক সুশীতল গ্রাম্য গ্রহ, অন্তত মহাবিপর্যয়ের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখা থেকে পালিয়ে একটা রাজ পরিবার সেখানে না পৌঁছানো পর্যন্ত এবং পৌঁছেই সব রকম প্রতিরোধ এবং বিদ্রোহ তারা দমন করে শক্ত হাতে, নিষ্ঠুর গর্বে। সেখানে তারা এক আবছায়া গৌরবের মহিমা বুকে আঁকড়ে রেখে ইম্পেরিয়াল এর শেষ টুকরো হিসেবে বিবর্ণ শাসন চালাতে থাকে।
বিশটা কৃষিভিত্তিক বিশ্ব মিলে তৈরি হয় গ্যালাকটিক এম্পায়ার।
ড্যাগোবার্ট নবম, বিশটা বিশ্বের অবাধ্য জমিদার এবং গোমড়ামুখো কৃষকদের হর্তাকর্তা বিধাতা, গ্যালাক্সির সম্রাট, লর্ড অব দ্য ইউনিভার্স।
সেই রক্ত ঝরানো দিনে নিজের পিতৃদেবের সাথে যখন এখানে আসে তখন ড্যাগোবার্ট নবম পঁচিশ বছরের এক টগবগে তরুণ, স্মৃতিতে তখনো এম্পায়ারের অসীম গৌরব আর মহিমা জাজ্বল্যমান। কিন্তু তার পুত্র, যে হয়তো একদিন হবে ড্যাগোবার্ট দশম জন্মেছে এই নিওট্রানটরে।
জর্ড কোম্যাসনের উন্মুক্ত এয়ার কার এই শ্রেণীর বাহন হিসেবে নিওট্রানটরে প্রথম এবং সর্বশেষ। কোম্যাসন নিওট্র্যানটরের সবচেয়ে বড় ভূ-স্বামী, ঘটনা এখানেই শেষ হয় না। বরং শুরু। কারণ প্রথমে সে ছিল মধ্য বয়সী সম্রাটের শাসনের বেড়াজালে আটকে থাকা তরুণ ক্রাউন প্রিন্স এর সহচর এবং কুমন্ত্রণা দাতা। এখন সে মধ্যবয়সী ক্রাউন প্রিন্স-যে বর্তমানে সম্রাটকে শাসন করে-তার সহচর এবং কুমন্ত্রনা দাতা।
জর্ড কোম্যাসনের এয়ার কার বহুমূল্য রত্ন খচিত, সোনার গিল্টি করা, মালিকের পরিচয় আর আলাদা করে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। এয়ারকারে বসে সে পর্যবেক্ষণ করছে সামনের বিস্তীর্ণ ভূমি যার সবটাই তার, মাইলের পর মাইল ছড়ানো গমের ক্ষেত যার সবটাই তার, বড় বড় মাড়াইকল এবং ফসল কাটার যন্ত্র যার সবগুলোই তার, কৃষক এবং যন্ত্রপাতির চালক যাদের সবাই তার-এবং সতর্কতার সাথে নিজের সমস্যা বিবেচনা করল।
পাশেই তার একান্ত অনুগত বাধ্য শোফার। শিপটাকে মসৃনভাবে বাতাসের উপর ভাসিয়ে রেখেছে আর হাসছে মৃদু মৃদু।
এয়ার কার, বাতাস এবং আকাশকে উদ্দেশ্য করে কথা বলল জর্ড কোম্যাসন, “আমি কী বলেছি তোমার মনে আছে, ইচনী?”
ইচনীর পাতলা বাদামি চুল প্রবল বাতাসে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বারবার। চিকন ঠোঁটের ভেতর দিয়ে ফোকলা দাঁতে এমনভাবে হাসলো যেন মহাবিশ্বের রহস্য লুকিয়ে রেখেছে নিজের কাছে। দাঁতের ফাঁক দিয়ে শিসের মতো শব্দ করে তার কথাগুলো বেরিয়ে এল।
“মনে আছে, সায়ার, এবং আমি অনেক ভেবেছি।”
“ভেবে কী বের করলে, ইচনী?” প্রশ্নের ভেতর একটা অধৈর্যের ছাপ। ইচনীর মনে পড়ল যে একসময় সে ছিল তরুণ, সুদর্শন, পুরোনো ট্র্যানটরের একজন লর্ভ। নিওট্রানটরে সে অসহায় বৃদ্ধ, বেঁচে আছে শুধুমাত্র জমিদার জর্ড কোম্যাসনের দয়ায়। মৃদু দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।
পুনরায় ফিসফিস করে বলল, “ফাউণ্ডেশন থেকে যারা আসছে, সায়ার, ওদেরকে হাতে রাখা খুব সহজ। আসছে মাত্র একটা শিপ নিয়ে, লড়াই করার মতো আছে মাত্র একজন। ভাবছি কীভাবে ওদের স্বাগত জানানো যায়।”
“স্বাগত?” হাস্যোজ্জ্বল চেহারা নিয়ে বলল কোম্যাসন। “হয়তো। কিন্তু ওই লোকগুলো জাদুকর এবং সম্ভবত ক্ষমতাবান।”
“ফুহ্। দূরত্বের কারণেই আসলে রহস্য তৈরি হয়েছে। ফাউণ্ডেশন একটা বিশ্ব ছাড়া আর কিছু না। নাগরিকরা শুধুই সাধারণ মানুষ। আপনি গুলি করলে ওরা মরে যাবে।”
শিপটাকে সোজা পথে ফিরিয়ে আনলো ইচনী । নিচে একটা নদীর পানি চিকচিক করছে। “আর সবাই একটা লোকের কথা বলছে যে পেরিফেরির বিশ্বগুলোকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে, তাই না?”
হঠাৎ একটা সন্দেহ দানা বাঁধল কোম্যাসনের মনে, “এ ব্যাপারে কী জানো তুমি?”
শোফারের মুখের হাসি মুছে গেছে। “কিছুই না, সায়ার। এমনি জিজ্ঞেস করলাম।”
জমিদারের ইতস্তত ভাব বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। কঠিন গলায় বলল, “কোনো কিছুই তুমি এমনি এমনি জিজ্ঞেস করো না, আর খবর সংগ্রহ করার তোমার যে পদ্ধতি সেটার কারণেই তোমার ঘাড় এখনো জায়গামতো আছে। যাই হোক-ওটা যখন তখন কেটে নেওয়া যাবে। এই লোকটা যার কথা শোনা যাচ্ছে-তার নাম মিউল। এক মাস আগে ওর এক প্রতিনিধি এসেছিল…জরুরি কাজে। আমি আরেকজনের অপেক্ষা করছি…এখন…কাজটা শেষ করার জন্য।”
“আর এই আগন্তক? সম্ভবত ওদেরকে আপনি আশা করেননি?”
“যে আইডেন্টিফিকেশন থাকার কথা ওদের তা নেই।”
“শোনা যাচ্ছে যে ফাউণ্ডেশন-এর পতন হয়েছে।”
“আমি তোমাকে এটা জানাইনি।”
“শোনা যাচ্ছে,” শীতল গলায় বলল ইচনী, “আর কথাটা যদি সত্যি হয় তা হলে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে ফাউণ্ডেশনারদের আটক করে মিউলের লোকদের জন্য অপেক্ষা করা যায়।”
“তাই?” কোম্যাসন কিছুটা দ্বিধান্বিত।
“আর, সায়ার, এটা জানা কথা যে, একজন কনকোয়ারার এর বন্ধু হচ্ছে সর্বশেষ শিকার। এটা হচ্ছে আররক্ষার উপায়। যেহেতু সাইকিক প্রোব নামে একটা জিনিস আছে, আর আমরা চারটা ফাউণ্ডেশন মস্তিষ্ক পেতে যাচ্ছি। ফাউণ্ডেশন সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় অনেক কিছু জানা যাবে, এমনকি মিউলের ব্যাপারেও। তখন আর মিউল আমাদের উপর ক্ষমতার দাপট দেখাতে পারবে না।”
উপরের শান্ত নীরবতায় একটু ঝাঁকুনি দিয়ে নিজের প্রথম চিন্তায় ফিরে এল কোম্যাসন। “কিন্তু যদি ফাউণ্ডেশন-এর পতন না ঘটে। কথাটা যদি মিথ্যে হয়। ভবিষ্যদ্বাণী আছে যে ওরা কখনো পরাজিত হবে না।”
“সায়ার, সেইসব যুগ আমরা অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছি যখন আশার বাণী শুনিয়ে মানুষকে শান্ত রাখা হতো।”
“তারপরেও যদি পতন না ঘটে। চিন্তা করে দেখো! যদি পতন না ঘটে। মিউল অবশ্য আমাকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে-” বেশি কথা বলা হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে মুখের লাগাম টেনে ধরল সে। “সবই দম্ভোক্তি। কিন্তু দম্ভোক্তি হচ্ছে বাতাস আর একটা চুক্তি হল শক্ত পাথরের মতো।”
নিঃশব্দে হাসল ইচনী। “অবশ্যই চুক্তি শক্ত পাথরের মতো, তবে শুরু না হওয়া পর্যন্ত। গ্যালাক্সির শেষ মাথায় ফাউণ্ডেশন-এর চাইতে ভয়ের আর কিছু আছে বলে মনে হয় না।
“প্রিন্স ঝামেলা করবে,” নিজের মনেই বিড়বিড় করল কোম্যাসন।
“সেও তা হলে মিউলের সাথে যোগাযোগ করেছে?”
নিজের আরতৃপ্তির অভিব্যক্তি গোপন রাখতে পারল না কোম্যাসন। “আমি যেভাবে করেছি ঠিক সেভাবে যোগাযোগ করতে পারেনি। কিন্তু আজকাল খুব বেশি অস্থির। সামলানো কঠিন হয়ে উঠছে দিনে দিনে। যেন শয়তান ভর করেছে। আমি যদি লোকগুলোকে আটক করি আর সে নিজের উদ্দেশ্যে তাদেরকে ছিনিয়ে নেবে-কারণ ওর সূক্ষ্ম বুদ্ধির বড় অভাব। আমি এখন ওর সাথে বিবাদে জড়াতে চাই না।” ভুরু কুঁচকালো বিরক্তিতে।
“আগন্তুকদের গতকাল এক নজর দেখেছিলাম। মেয়েটা অদ্ভুত। পুরুষদের মতোই স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে। মাথাভর্তি কালো চুল, ফর্সা চামড়া।” শোফারের কণ্ঠে এমন একটা উষ্ণতা যে বিস্মিত হয়ে তাকাতে বাধ্য হল কোম্যাসন।
“বাকি সবাইকে আপনি নিজের কাছে রাখতে পারবেন, যদি মেয়েটাকে প্রিন্সের হাতে তুলে দেন।”
কোম্যাসনের মুখের অভিব্যক্তি উজ্জ্বল হয়ে উঠল, “দারুণ বুদ্ধি! সত্যিই দারুণ! গাড়ি ঘোরাও। আর ইচনী সব কিছু ভালোয় ভালোয় শেষ হলে আমরা তোমার মুক্তির ব্যাপারে আরো কথা বলব।”
অনেকটা নিজের কুসংস্কারকে আরো দৃঢ় করার জন্যই যেন ফিরে এসে কোম্যাসন দেখতে পেল তার জন্য একটা পারসোন্যাল ক্যাপসুল অপেক্ষা করছে। ক্যাপসুলটা এমন ওয়েভলেংথে এসেছে যা খুব অল্প কয়েকজনই জানে। চওড়া হাসি ছড়িয়ে পড়ল কোম্যাসনের মুখে। মিউলের প্রতিনিধি আসছে এবং ফাউণ্ডেশন-এর পতন হয়েছে সত্যি সত্যি।
.
ইম্পেরিয়াল প্যালেস সম্বন্ধে বেইটার যে ধারণা ছিল তার সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই, এবং সে খানিকটা হলেও হতাশ। কামরাটা ছোট, অতি সাধারণ এবং প্রায় নিরাভরণ। ফাউণ্ডেশনে মেয়রের বাসস্থানের তুলনায় এই প্রাসাদ কুঁড়েঘরের মতো।
একজন সম্রাট দেখতে কেমন হবে সেই সম্বন্ধে বেইটার মনে কোনো সন্দেহ নেই। নিশ্চয়ই তাকে দেখাবে না কারো বুড়ো দাদুর মতো। নিশ্চয়ই তিনি হবেন না দুর্বল, অসমর্থ, ফ্যাকাশে বৃদ্ধ- অথবা নিজের হাতে চা পরিবেশন করবেন না এবং অতিথির আরাম আয়েশ নিয়ে উদ্বিগ্ন হবেন না।
কিন্তু হচ্ছে ঠিক তাই।
ড্যাগোবার্ট নবম পেয়ালাগুলো শক্ত করে ধরে চা ঢালার সময় জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালেন।
“আমার বেশ ভালো লাগছে, মাই ডিয়ার। এই সময়টা আমি দরবারের আনুষ্ঠানিকতা থেকে মুক্ত থাকতে পারি। বহুদিন আমার আউটার প্রভিন্স থেকে আসা সাক্ষাৎ প্রার্থীদের খেদমত করার সুযোগ পাই না। আমার পুত্র এখন বিষয়গুলো দেখাশোনা করে। কারণ আমার বয়স হয়েছে। আমার পুত্রের সাথে তোমাদের পরিচয় হয়নি? চমৎকার ছেলে। শুধু মাথা গরম, তবে ওটা বয়সের দোষ। স্বাদবর্ধক ক্যাপসুল লাগবে কারো? না?”
কথার তোড় থামানোর চেষ্টা করল টোরান, “ইওর ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টি”
“বলো?”
“ইওর ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টি, অনাহুত ভাবে আপনাকে বিরক্ত করার উদ্দেশ্য। আমাদের ছিল না।”
“মূর্খ, বিরক্ত করার কিছু নেই। আজকে রাতে অফিসিয়াল রিসিপশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তার আগে পুরো সময়টা আমাদের। তোমরা যেন কোত্থেকে এসেছো? বহুদিন অফিসিয়াল রিসিপশনের ব্যবস্থা হয় না। তুমি বলেছিলে তোমরা অ্যানাক্রন প্রদেশ থেকে এসেছে।”
“ফাউণ্ডেশন থেকে, ইওর ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টি!”
“হ্যাঁ, ফাউণ্ডেশন। মনে পড়েছে। চিনতে পেরেছি। অ্যানাক্রন প্রদেশে অবস্থিত। ওখানে কখনো যাইনি। চিকিৎসক আমাকে দীর্ঘ পথ ভ্রমণ করতে নিষেধ করেছে। অ্যানাক্রনের ভাইসরয় এর কাছ থেকে সম্প্রতি কোনো রিপোর্ট পেয়েছি বলে তো মনে পড়ে না। ওখানকার অবস্থা কেমন?” উদ্বিগ্নভাবে শেষ করলেন তিনি।
“সায়ার,” বিড়বিড় করল টোরান, “আমরা কোনো অভিযোগ নিয়ে আসিনি।”
“খুশির কথা। আমার ভাইসরয়ের প্রশংসা করতে হবে।”
অসহায় ভঙ্গিতে মিস এর দিকে তাকাল টোরান, আর মিস এর ভারী গলা গমগম করে উঠল কামরার ভেতর, “সায়ার, আমাদের বলা হয়েছে যে ট্রানটরের ইম্পেরিয়াল ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে যেতে হলে আপনার অনুমতি লাগবে।”
“ট্রানটর?” হালকা গলায় প্রশ্ন করলেন সম্রাট ‘ট্রানটর?”
তারপর বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল তার মুখ। “ট্রানটর?” ফিসফিস করলেন তিনি। “এখন মনে পড়েছে। আমি ওখানে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছি, পিছনে থাকবে ঝাঁকে ঝাকে শিপ, তোমরা আমার সাথে যাবে। আমরা সবাই মিলে বিদ্রোহী গিলমারকে পরাজিত করব। আমরা সবাই মিলে আবার গড়ে তুলব এম্পায়ার।”
তার পেছন দিকে হেলানো মাথা সোজা হল, কণ্ঠে ভর করল তারুণ্যের সজীবতা, দৃষ্টিতে কাঠিণ্য। তারপর আবার নেতিয়ে পড়লেন, দুর্বল গলায় বললেন, “কিন্তু গিলমার মারা গেছে, বোধহয় মনে পড়ছে আমার-হ্যাঁ। হা! গিলমার মৃত! ধ্বংস হয়ে গেছে ট্রানটর-মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল-তোমরা যেন কোত্থেকে এসেছো?”
বেইটার কানের কাছে মুখ নিয়ে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল ম্যাগনিফিসো, “উনি কী আসলেই সম্রাট। আমার ধারণা ছিল সত্যিকারের সম্রাট হবেন সাধারণ মানুষের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং জ্ঞানী।”
ইশারায় তাকে চুপ থাকার নির্দেশ দিল বেইটা। তারপর বলল, “ইওর ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টি যদি আমাদের ট্র্যানটরে যাওয়ার একটা অনুমতি পত্রে সই করে দেন তা হলে সবারই লাভ হবে।”
“ট্রানটরে?” সম্রাটের অভিব্যক্তি আবারো নির্বোধ জড়বুদ্ধির পাগলের মতো।
“সায়ার, অ্যানাক্রনের ভাইসরয় আপনাকে জানাতে বলেছে যে, গিলমার এখনো বেঁচে আছে।”
“বেঁচে আছে, বেঁচে আছে!” বজ্রপাতের মতো গর্জে উঠলেন ড্যাগোবার্ট। কোথায়? আবার যুদ্ধ হবে!”
“ইওর ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টি, সেটা এখনো জানা যায়নি। ভাইসরয় শুধু ব্যাপারটা আপনার নজরে দিতে বলেছে, এবং একমাত্র ট্রানটরে যেতে পারলেই তাকে খুঁজে বের করা যাবে এবং একবার বের করতে পারলেই-”
“হ্যাঁ হ্যাঁ-অবশ্যই বের করতে হবে- বৃদ্ধ সম্রাট স্খলিত পদক্ষেপে দেয়ালের কাছে গিয়ে কাঁপা কাঁপা আঙুলে ছোট ফটোসেলটা স্পর্শ করলেন। কিছুক্ষণ নীরব থেকে ফিস ফিস করে বললেন, “আমার চাকর বাকররা আসেনি। ওদের জন্য অপেক্ষা করা যাবে না।”
একটা সাদা কাগজে আঁকাবাঁকা করে কিছু লিখলেন তিনি, শেষ করলেন উজ্জ্বল “ডি” দিয়ে। “গিলমার এবার বুঝবে তার সম্রাটের ক্ষমতা কতখানি। তোমরা যেন কোত্থেকে এসেছো? অ্যানাক্ৰণ? কী অবস্থা ওখানে? এখনো কী ম্রাটের নাম ওখানে যথেষ্ট শক্তিশালী?”
শিথিল আঙুল থেকে নির্দেশপত্রটা নিল বেইটা, “ইওর ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টিকে জনগণ জান দিয়ে ভালবাসে। জনগণের প্রতি আপনার ভালবাসা সর্বজনবিদিত।”
“অ্যানাক্রনে আমার এই জনগণদের একবার দেখতে যাবো। কিন্তু চিকিৎসক বলেছে… কী বলেছে আমার মনে নেই, কিন্তু চোখ তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি, “তোমরা কী গিলমারের ব্যাপারে কিছু বলছিলে?”
“জি না, ইওর ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টি।”
“ওকে আর এগোতে দেওয়া যাবে না। যাও তোমার লোকদের গিয়ে বলল ট্র্যানটর প্রতিরোধ করবে। ফ্লিটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আমার পিতা এবং নর্দমার কীট বিদ্রোহী গিলমারকে মহাকাশেই তার বিদ্রোহ সমেত নিকেশ করা হবে।”
টলমল পায়ে হেঁটে গিয়ে তিনি একটা চেয়ারে বসলেন, চোখে আবারো সেই বোধবুদ্ধিহীন জড় দৃষ্টি। “কী বলছিলাম যেন?”
দাঁড়িয়ে মাথা সামান্য নিচু করে কুর্নিশ করল টোরান। ইওর ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টির অনেক দয়া। কিন্তু সাক্ষাতের জন্য আমাদের যে সময় বেধে দেওয়া হয়েছিল তা শেষ হয়েছে।
যখন ড্যাগোবার্ট দৃঢ় ভঙ্গিতে দাঁড়ালেন তখন তাকে মনে হল সত্যি সত্যি সম্রাট, আর সাক্ষাৎপ্রার্থীরা পিছিয়ে একে একে বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে।
–বেরোতোই বিশজন সশস্ত্র লোক তাদেরকে ঘিরে ফেলল। একজনের হাতে ছোট একটা অস্ত্র শোভা পাচ্ছে।
ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে পেল বেইটা, কিন্তু আমি কোথায়? এই অনুভূতি ছাড়াই। বৃদ্ধ সম্রাট, বাইরের অস্ত্রধারী লোকগুলো-সব তার পরিষ্কার মনে আছে। আঙুলের জোড়াগুলোর শিরশিরানি ভাব থেকে বুঝতে পারছে স্টান্ট পিস্তল ব্যবহার করা হয়েছে।
চোখ বন্ধ রেখেই সে দুটো কণ্ঠস্বরের প্রতি মনযোগ দিল।
দুটো কণ্ঠস্বরের একটা ধীর স্থির সতর্ক, কিছুটা কৌতুকপূর্ণ। অন্যটা চিকন, কর্কশ এবং অনেকটা চটচটে তরল পদার্থ নির্গত হওয়ার মতো করে সবেগে ছুটে বেরোচ্ছে। চিকন কণ্ঠস্বরটাই কর্তৃত্বপূর্ণ।
শেষ কথাগুলো শুনতে পেলো বেইটা, “বুড়ো পাগলটা মরবে না। আমাকে ক্লান্ত করে তুলেছে, আর ধৈর্য রাখতে পারছি না, কোম্যাসন। আমাকে পেতেই হবে। আমার ও তো বয়স হচ্ছে।”
“ইওর হাইনেস, প্রথমেই দেখতে হবে এই লোকগুলোর কাছ থেকে আমরা কী উপকার পেতে পারি। হয়তো আপনার বাবার কাছে এই মুহূর্তে যত ক্ষমতা আছে তার চেয়ে বেশি ক্ষমতা আমাদেরকে পাইয়ে দিতে পারে।”
চিকন কণ্ঠস্বরটা ফিসফিসানিতে পরিণত হল, শুধু একটা শব্দ শুনতে পেল বেইটা, “-মেয়েটা-” কিন্তু অন্য কণ্ঠস্বরটা নিচু হলেও শোনা যাচ্ছে। তোষামোদ করছে, “ড্যাগোবার্ট, আপনার বয়স হয়নি। যারা বলে আপনার বয়স বিশের বেশি তারা মিথ্যে কথা বলে।”
দুজন হেসে উঠল এক সাথে। আর বেইটার রক্ত জমে বরফ হয়ে গেছে। ড্যাগোবার্ট-ইওর হাইনেস-বৃদ্ধ সম্রাট তার মাথা গরম ছেলের কথা বলেছিলেন, এবং ওদের ফিসফিসানির অর্থ এখন পরিষ্কার বুঝতে পারছে। কিন্তু মানুষের বাস্তব জীবনে এমন ঘটনা ঘটে না-
টোরানের গলার আওয়াজ পেয়ে চোখ খুলল সে। টোরানের মুখ ঝুঁকে ছিল তার উপর। চোখ খুলতে দেখে সেই মুখে স্বস্তি ফুটে উঠল। হিংস্র স্বরে বলল টোরান, “সম্রাটের কাছে এই হঠকারিতার জবাব দিতে হবে। ছেড়ে দাও আমাদের।”
চিকন কণ্ঠস্বর এগোল টোরানের দিকে। লোকটা চর্বি সর্বস্ব, নিচের চোখের পাপড়ি গভীরভাবে পাফ করা, মাথার চুল ক্রমশ পাতলা হয়ে আসছে। টুপিতে একটা ধূসর পালক, এবং পোশাকের প্রান্তগুলোতে রুপোলী ধাতব স্পঞ্জের নকশা করা।
ভীষণ আমোদে নাক কুঁচকালো সে। “সম্রাট? পাগল সম্রাট?”
“তার নির্দেশ পত্র আছে আমার কাছে। কেউ আমাদের আটকে রাখতে পারবে না।”
“কিন্তু আমি সাধারণ কেউ না। আমি রিজেন্ট এবং ক্রাউন প্রিন্স, এবং সেভাবেই সম্বোধন করবে। আমার বাবা মাঝে মাঝে দর্শনার্থীদের সাক্ষাৎ দিয়ে আনন্দ পান। আমরা ওটা নিয়ে অনেক রসিকতা করি। এ ছাড়া অন্য কোনো গুরুত্ব নেই।”
এবার দাঁড়াল বেইটার সামনে। তার নিশ্বাসে তীব্র ঝাঝালো গন্ধ পেল বেইটা।
“ওর চোখ দুটো খুব সুন্দর, কোম্যাসন-বাইরে নিয়ে গেলে আরো ভালো লাগবে। আমার মনে হয় চলবে। সুস্বাদু খাবারের চমৎকার এক ডিশ, কী বলো?”
নিষ্ফল আক্রোশে ছটফট করে উঠল টোরান। পাত্তা দিল না ক্রাউন প্রিন্স আর বেইটা টের পেল তার চামড়ার উপরে কেমন ঠাণ্ডা প্রবাহিত হচ্ছে। এবলিং মিস এখনো অচেতন, মাথা ঝুলে পড়েছে বুকের উপর। কিন্তু এই বিপদের মাঝে একটা জিনিস খেয়াল করে অবাক হল বেইটা। ম্যাগনিফিসোর চোখ দুটো খোলা, দৃষ্টি ধারালো, যেন জেগে আছে অনেকক্ষণ থেকেই। তাকাল বেইটার দিকে।
মাথা নেড়ে ক্রাউন প্রিন্সকে দেখিয়ে করুণ সুরে বলল, “ও আমার ভিজি-সোনার নিয়ে গেছে।”
ঝট করে নতুন কণ্ঠের দিকে ঘুরল প্রিন্স, “এটা তোর, রাক্ষসের বাচ্চা।” কাঁধে ঝোলানো বাদ্যযন্ত্রটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল। অদক্ষভাবে আঙুল চালিয়ে সুর তোলার চেষ্টা করছে, “তুই এটা বাজাতে পারিস, রাক্ষস?”
মাথা নাড়ল ম্যাগনিফিসো।
“আপনি ফাউণ্ডেশন-এর একটা শিপ দখল করেছেন, হঠাৎ বলল টোরান। সম্রাট কোনো ব্যবস্থা না করলেও ফাউণ্ডেশন ঠিকই ব্যবস্থা করবে।”
ধীরস্থিরভাবে জবাব দিল কোম্যাসন, “কিসের ফাউণ্ডেশন? মিউল কী মরে গেছে?”
কোনো জবাব নেই। হাসির সাথে প্রিন্স এর অসমান দাঁত বেরিয়ে পড়ল। ক্লাউনের বাঁধন খুলে, টেনে হিঁচড়ে দাঁড় করিয়ে হাতে তুলে দেওয়া হল ভিজি-সোনার।
“বাজা রাক্ষস” আদেশ দিল প্রিন্স। “এই বিদেশী মহিলার সম্মানে একটা প্রেমের সঙ্গীত বাজা। ওকে বলে দে, যে আমার বাবার জেলখানাটা কোনো প্রাসাদ না, কিন্তু সে চাইলে তাকে আমি এমন জায়গায় নিয়ে যেতে পারি যেখানে প্রতিদিন সাঁতার কাটবে গোলাপজলে-এবং বুঝতে পারবে একজন প্রিন্স এর ভালবাসা কী জিনিস।”
একটা মার্বেল পাথরের টেবিলে বসে অলসভাবে পা দোলাতে লাগল প্রিন্স। ছাড়া পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে টোরান নিজের কষ্ট আরো বাড়িয়ে তুলল। জ্ঞান ফিরে এসেছে এবলিং মিস এর। চোখ খুলে গোঙাচ্ছে।
ঢোক গিলল ম্যাগনিফিসো, “আমার আঙুল নাড়াতে পারছি না-”
“বাজা রাক্ষস!” ধমকে উঠল প্রিন্স, নির্দেশ পেয়ে আলো কমিয়ে দিল কোম্যাসন, তারপর বুকের উপর হাত বেধে অপেক্ষা করতে লাগল।
বাদ্যযন্ত্রের উপর ম্যাগনিফিসোর আঙুল নেচে বেড়াতে শুরু করল, দ্রুত নাচের ছন্দে-একটা তীক্ষ্ণ, ধারালো রং ধনু তৈরি হল কামরার ভেতর। একটা নিচু লয়ের সুর ধ্বনি বাজতে লাগল-দম বন্ধ করা, গা শিউরে উঠা। সুরটা চড়া হতে হতে পরিণত হল বিষণ্ণ হাসিতে, এবং তার সাথে শোনা যাচ্ছে একরকম নীরস ঘণ্টাধ্বনি।
ধীরে ধীরে পাতলা হতে লাগলো অন্ধকার। ভাঁজ করা অনেকগুলো অদৃশ্য কম্বলের মাঝ দিয়ে সঙ্গীতের শব্দ বেইটার কানে পৌঁছল। আলোর দীপ্তি দেখে মনে হল কোনো গর্তের মাথায় মাত্র একটা মোমবাতি জ্বলছে।
আপনা আপনিই চোখ দুটো টান টান করল বেইটা। আলো বাড়লে ও সবকিছু কেমন অস্পষ্ট হয়ে থাকল। অলসভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে চোখ ধাঁধানো সব রঙে এবং হঠাৎ করেই সঙ্গীতটা খসখসে হয়ে উঠল-ক্রমশ চড়া হচ্ছে। অশুভ সুর । মূৰ্ছনার তালে তালে আলোটা দ্রুত কমছে বাড়ছে। যেন বিষাক্ত কোনো কিছু ব্যথায় মোচড়াচ্ছে, চিৎকার করছে।
একটা অদ্ভুত আবেগের সাথে লড়াই করে হাঁপিয়ে গেল বেইটা। টাইম ভল্ট এবং হেভেনে শেষ দিনে যে রকম অনুভূতি হয়েছিল, ঠিক একই অনুভূতি। সেই ভয়ংকর, বিরক্তি কর, আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলার মতো চরম হতাশা। আপ্রাণ চেষ্টা করছে নিজেকে এই হতাশায় ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে।
তারপর হঠাৎ করেই থেমে গেলো সঙ্গীত। মাত্র পনের মিনিট স্থায়ী হয়েছে। থেমে যাওয়াতে আনন্দের এক আরামদায়ক প্রবাহ বয়ে গেল তার শরীরে। আলো জ্বলে উঠার পর দেখল তার মুখের কাছে ম্যাগনিফিসোর মুখ।
“মাই লেডি, আপনি কেমন আছেন?”
“ভালো, তুমি এই ধরনের বাজনা বাজালে কেন?”
কামরার অন্যদের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠল সে। টোরান আর মিস অসহায় ভাবে আটকে আছে দেয়ালের সাথে। কিন্তু এই দুজনকে ছাড়িয়ে তার দৃষ্টি চলে গেল আরো সামনে। টেবিলের পায়ের কাছে এলোমেলো ভঙ্গিতে পড়ে আছে প্রিন্স। কোম্যাসন মুখ হাঁ করে বন্য উন্মাদের মতো আর্তনাদ করছে।
ম্যাগনিফিসো তার দিকে এক পা এগোতেই কুঁকড়ে গেল কোম্যাসন, চেঁচিয়ে উঠল পাগলের মতো। ফিরে এসে অন্যদের বাধন খুলে দিল ম্যাগনিফিসো। ভূ স্বামীর ঘাড় ধরে তাকে টেনে তুলল টোরান। “তুমি আমাদের সাথে যাবে-যেন শিপে ফিরতে কোনো সমস্যা না হয়।”
দুই ঘণ্টা পর, শিপের কিচেনে ম্যাগনিফিসের সামনে ঘরে তৈরি বিশাল এক পাই এনে রাখল বেইটা, আর ম্যাগনিফিসো মহাকাশে ফিরে আসা উদযাপন করার জন্য ভদ্রতার ধার না ধেরেই ঝাঁপিয়ে পড়ল সেটার উপর।
“ভালো হয়েছে, ম্যাগনিফিসো?”
“উম্-ম্-ম্-ম্!”
“ম্যাগনিফিসো?”
“জি, মাই লেডি?”
“ওখানে তুমি কী বাজিয়েছিলে?”
গুঙিয়ে উঠল ক্লাউন, “আপনার…আপনার না শোনাই ভালো। অনেকদিন আগে শিখেছিলাম, আর নার্ভাস সিস্টেমের উপর ভিজি সোনার নিখুঁতভাবে কাজ করে। খারাপ জিনিস সন্দেহ নেই। এবং অবশ্যই আপনার মতো নিষ্পাপ মানুষের জন্য না।”
“ওহ, ম্যাগনিফিসো, তোষামোদ করো না। তুমি যতটা ভাবছ আমি ততো নিষ্পাপ না। ওরা যা দেখেছে আমিও কী তাই দেখেছি।”
“বোধ হয় না। বাজিয়েছি শুধু মাত্র ওদের জন্য। আপনি যদি কিছু দেখে থাকেন দেখেছেন শেষ প্রান্তগুলো-অনেক দূর থেকে।”
“সেটাই যথেষ্ট। তুমি জানো ম্যাগনিফিসো, প্রিন্সকে তুমি একেবারে নক আউট করে দিয়েছ?”
বড় একটুকরো পাই মুখে দিয়ে হাসিমুখে বলল ম্যাগনিফিসো, “আমি ওকে মেরে ফেলেছি, মাই লেডি।”
“কি?” বিষম খেলো বেইটা।
“যখন থামাই তখনই সে মরে গেছে, নইলে বাজিয়েই যেতাম। কোম্যাসনকে নিয়ে মাথা ঘামাইনি। ওর সবচেয়ে বড় ভয় ছিল মৃত্যু অথবা নির্যাতন। কিন্তু, মাই লেডি, এই প্রিন্স আপনার দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকিয়েছে, আর-” ক্রুদ্ধ এবং বিব্রত ভাব দিয়ে চুপ করল সে।
একটা অদ্ভুত চিন্তা গ্রাস করল বেইটাকে, কিন্তু জোড় করে সেটা তাড়িয়ে দিল। “ম্যাগনিফিসো, তোমার অনেক সাহস।”
“ওহ, মাই লেডি।” লজ্জায় পাইয়ের ভেতর লাল হয়ে উঠা নাক ডোবালো সে।
এবলিং মিস পোর্ট হোলের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে। ট্রানটরের অনেক কাছে চলে এসেছে ওরা-গ্রহটার চকচকে ধাতব আবরণ ভীষণ রকম উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে। টোরান পাশেই দাঁড়ানো।
খানিকটা তিক্ততা মিশ্রিত সুরে বলল সে, “আমরা খামোখাই এসেছি, এবলিং। মিউল আমাদের চাইতে এগিয়ে আছে।”
কপাল ঘষল এবলিং মিস। তার মোটা শরীর অনেক শুকিয়ে গেছে। আপন মনেই বিড় বিড় করল।
বিরক্ত হল টোরান। “আমি বলছি ওই লোকগুলো জানে ফাউণ্ডেশন-এর পতন ঘটেছে। আমি বলছি-”
“অ্যাঁ?” তাকাল মিস, কিংকর্তব্যবিমুঢ়, তারপর আলতোভাবে টোরানের কব্জি ধরল, একটু আগের আলোচনার ব্যাপারে পুরোপুরি অচেতন, “টোরান…আমি ট্র্যানটরের দিকে তাকিয়েছিলাম। তুমি জানো…কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি…নিওট্রানটরে আসার পর থেকেই। কেমন যেন এক ধরনের ব্যাকুলতা ভেতর থেকে আমাকে ঠেলছে, চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। টোরান, আমি পারব, আমি জানি আমি পারব। আমার মনে এখন সবকিছুই পরিষ্কার-আগে কখনো এত পরিষ্কার ছিল না।”
টোরান শ্রাগ করল, কথাগুলো তার আরবিশ্বাস বাড়াতে পারেনি।
“মিস?”
“বলো?”
“নিওট্রানটর থেকে বেরুনোর সময় ওদের কোনো শিপ পিছু নিতে দেখেছেন?”
ভাবতে হল না বেশিক্ষণ, “না।”
“আমি দেখেছি। হয়তো কল্পনা, কিন্তু মনে হল যেন ওটা সেই ফিলিয়ান শিপ।”
“ক্যাপ্টেন প্রিচার যেটাতে ছিল?”
“স্পেস জানে কে ছিল। ম্যাগনিফিসো কী দেখেছে সেই জানে-কিন্তু ওটা আমাদের অনুসরণ করে এখানে এসেছে, মিস।”
এবলিং মিস নীরব।
কঠিন গলায় বলল টোরান, “কী হয়েছে আপনার, অসুস্থ?”
মিস এর দৃষ্টি চিন্তামগ্ন উজ্জ্বল, অস্বাভাবিক। কোনো জবাব দিল না সে।
*