দিল্লী চলো Delhi Chalo by নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু Netaji Subhas Chandra Bose, chapter name ভবিষ্যতের কাজ

ভবিষ্যতের কাজ

এক বৎসর পূর্ব্বে পূর্ব্ব-এশিয়ায় ভারতীয় স্বাধীনতা-আন্দোলন যখন নূতন প্রেরণা লাভ করেছিল, তখন সকল কাজের গতি হয়েছিল একটি প্রধান উদ্দেশ্যমুখী। উদ্দেশ্য ছিল, স্বাধীনতা-লাভের জন্য প্রস্তুত হয়ে সশস্ত্র সংগ্রাম আরম্ভ করা। সেই উদ্দেশ্য এখন পূর্ণ হয়েছে। আজাদ-হিন্দ কৌজ ভারত-সীমান্ত অতিক্রম করেছে এবং বর্ত্তমানে ভারতের মাটিতে স্বাধীনতার যুদ্ধ চলছে।

 এই নূতন পরিস্থিতি কাজের নূতন জগৎ খুলে দিয়েছে। পূর্ব্বে আমাদের কাজ পূর্ব্ব-এশিয়াতেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন অবস্থা বদলেছে। ভারতের মুক্তিপ্রাপ্ত অঞ্চলে শাসন ও পুনর্গঠন-ঘটিত নূতন নূতন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তা ছাড়া সাফল্যের সঙ্গে যে সব সামরিক অভিযান চালানো হয়েছে তার ফলেও নব সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, কিভাবে ভারতের অভ্যন্তরে অভিযান চালানো যাবে, কি ভাবে দেশে বিপ্লবের সৃষ্টি করা যাবে। কাজেই ভবিষ্যতে আমাদের কার্য্যক্ষেত্র হবে তিনটি— প্রথম, পূর্ব্ব-এশিয়ায়; এই স্থান আমাদের রাজনৈতিক কার্য্যকলাপ এবং সামরিক অভিযানের ঘাঁটিরূপে থাকবে। দ্বিতীয়, মুক্তিপ্রাপ্ত অঞ্চলে; এখানে প্রধানতঃ শাসনকার্য্য এবং পুনর্গঠন-ঘটিত সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে এবং নতুন অভিযানের জন্যে আয়োজন করতে হবে। তৃতীয়, ইংরেজ-অধিকৃত ভারতে; সেখানে বিপ্লবের সঞ্চার করতে হবে এবং আমাদের সৈন্যদলকে সেখানে প্রবেশ করতে হবে।

 ১৯৪৩-এর ২১শে অক্টোবর পর্য্যন্ত পূর্ব্ব-এশিয়ায় ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালিত করছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা লীগ। আজাদ-হিন্দ ফৌজ ছিল তাঁদের সমর-যন্ত্র। ১৯৪৩-এর ২১শে অক্টোবর থেকে আজাদ-হিন্দ সামরিক গবর্নমেন্ট স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছে—কাজেই সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় স্বাধীনতা লীগ এবং আজাদ-হিন্দ কৌজের নেতৃত্বও তারই উপর এসে পড়েছে। সেদিন পর্য্যন্ত সামরিক আজাদ-হিন্দ গবনমেন্টের কার্য্য সীমাবদ্ধ ছিল পূর্ব্ব-এশিয়ার মধ্যে। এখন অবস্থা পরিবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে সামরিক গবর্নমেটকে পুনর্গঠিত করতে হবে এবং তার ভবিষ্যৎ কার্য্যক্রমও বাড়াতে হবে। অন্য কথায় বলতে গেলে সামরিক গবর্নমেন্টকে তিনটি কার্য্যক্ষেত্রের দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে— পূর্ব্ব-এশিয়া, মুক্তিপ্রাপ্ত অঞ্চল এবং ইংরেজ অধিকৃত ভারতবর্ষ। সেইজন্য সামরিক গবর্নমেন্টের মন্ত্রী এবং উপদেষ্টাদের জন্যে এই তিনটি ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব নির্দ্ধারণ করে দিতে হবে। এক দলের কার্য্যক্ষেত্র হবে পূর্ব্ব-এশিয়া, অপর দলের মুক্তিপ্রাপ্ত অঞ্চল, এবং তৃতীয় দলের ইংরেজ-অধিকৃত ভারতবর্ষ। পূর্ব্ব-এশিয়ায় কর্ম্মরত প্রথম দলকে বলা হবে মন্ত্রীমণ্ডলের পূর্ব্ব-এশিয়া কমিটি, মুক্তিপ্রাপ্ত অঞ্চলে কর্ম্মরত দ্বিতীয় দলকে বলা হবে মুক্তিপ্রাপ্ত অঞ্চল কমিটি, আর তৃতীয় দলের নামকরণ হবে যুদ্ধ কমিটি।

 ভবিষ্যতে পূর্ব্ব-এশিয়ায় লােক, অর্থ এবং দ্রব্যাদি সংগ্রহের ব্যাপারে আরও বেশী উৎসাহ ও শক্তি নিয়ােগ করতে হবে। এই উদ্দেশ্যে বিশেষ মন্ত্রী-বিভাগ সৃষ্টি করতে হবে অথবা বর্ত্তমান বিভাগের সম্প্রসারণ করতে হবে—যাতে এই সব সমস্যার সহজ সমাধান হয়। বর্ত্তমান অর্থসচিবের বিভাগকে সম্প্রসারিত করতে হবে এবং তাঁর কার্য্যক্ষেত্রের সীমান্ত বাড়াতে হবে। বিভিন্ন কাজের জন্য আরও বহু নরনারী সংগ্রহ এবং তাদের শিক্ষাবিধানের জন্যে জনশক্তির মন্ত্রিবিভাগ নামে একটি নতুন বিভাগের সৃষ্টি করতে হবে। আজাদ হিন্দ ফৌজ, ঝাঁসীর রাণী বাহিনী, আজাদ-হিন্দ দল এবং ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের দৈনন্দিন কাজের জন্যে এই সব নরনারীর প্রয়োজন। সম্প্রতি যে সরবরাহ-মন্ত্রিবিভাগ সৃষ্টি করা হয়েছে তারও বিস্তৃতি-সাধন করতে হবে। যে সব মন্ত্রিবিভাগ আছে এবং ভবিষ্যতে যে গুলির সৃষ্টি করা হবে, তাদের কাজ তারা অবশ্যই করবে কিন্তু ভবিষ্যতে প্রধান দায়িত্ব পড়বে অর্থ, জনশক্তি এবং সরবরাহ বিভাগের উপর। মন্ত্রিমণ্ডলের পূর্ব্ব-এশিয়া কমিটি পূর্ব্ব-এশিয়ায় কাজ চালানোর জন্যে দায়ী থাকবেন; সেই সব মন্ত্রী এবং উপদেষ্টাদের নিয়ে এই কমিটি গঠিত হবে, যাঁরা সাধারণত পূর্ব্ব-এশিয়ায় কাজ করবেন।

 ভারতের মুক্তিপ্রাপ্ত অঞ্চলের শাসন ও পুনর্গঠনের পরিকল্পনা ইতিপূর্ব্বেই তৈরী করা হয়েছে এবং সুযোগ আসার সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলো কার্য্যকরী করা হবে। এই উদ্দেশ্যে আজাদ হিন্দ দলের প্রয়োজনীয় কর্ম্মচারীদের রাখা হয়েছে এবং আজাদ-হিন্দ দলের সদস্যরা ইতিমধ্যেই ভরতের অভ্যন্তরে কিংবা ভারত-সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। সেই সব মন্ত্রী এবং উপদেষ্টাকে নিয়ে মুক্তিপ্রাপ্ত অঞ্চল কমিটি গড়ে তোলা হবে, যাঁদের উপর মুক্তিপ্রাপ্ত অঞ্চলের কার্য্যভার দেওয়া হয়েছে, কিংবা যাঁরা সেই সময় মুক্তিপ্রাপ্ত অঞ্চলে থাকবেন। মুক্তিপ্রাপ্ত ভারতে কার্য্যপরিচালনার জন্যে মন্ত্রিমণ্ডলের মুক্তিপ্রাপ্ত অঞ্চল কমিটি দায়ী থাকবেন।

 মন্ত্রিমণ্ডলের যুদ্ধ-কমিটি গঠিত হবে সেই সব মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের নিয়ে যাঁরা ইংরেজ-অধিকৃত ভারতে সামরিক অভিযান চালনা সম্পর্কিত ব্যবস্থা এবং প্রচার, বৈপ্লবিক কার্য্যকলাপ, শাসন এবং পুনর্গঠন সম্পর্কিত বিধি ব্যবস্থা নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন।

 পরিবর্ত্তিত অবস্থার দাবী মেটানোর জন্য উল্লিখিত উপায়ে মন্ত্রিমণ্ডলকে তিন ভাগে বিভক্ত করতে হবে। এ সত্ত্বেও গবর্নমেন্টের ঐক্য বজায় রাখতে হবে যাতে সর্ব্বাধিক ফল লাভের উদ্দেশ্যে এবং প্রধান লক্ষ্য অর্থাৎ ভারতের স্বাধীনতার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে তিনটি কমিটির কার্য্য কেন্দ্রীভূত এবং তাদের মধ্যে সমন্বয়-বিধান হয়।