জাতীয় বাহিনী
এক বৎসর পূর্ব্বে এই দিনটিতে শোনান থেকে (Syonan) আমি বিশ্বের সামনে সগৌরবে ঘোষণা করেছিলাম, আজাদ হিন্দ ফৌজ জন্ম গ্রহণ করেছে। আমার পক্ষে সেদিনটি ছিল পরম গৌরবের। তার কারণ, ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামে আমি আজাদ হিন্দ ফৌজে সার্থকতা উপলব্ধি করি। অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছিল, ভারতের সীমার মধ্যে জাতীয় বাহিনী সংগঠন অসম্ভব। অনিচ্ছুক হাত থেকে শুধু অস্ত্রের সাহায্যেই স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া যায় এ সম্বন্ধে আমার দৃঢ়বিশ্বাস জন্মায়। বৃটিশরা যেখানে শত্রু বিবেচিত হয় এমন কোন দেশেই শুধু জাতীয় বাহিনী গঠন সম্ভব, একথা আমি বুঝতে পারি। তাই আমাদের স্বাধীনতা লাভের সকল আশা নির্ভর করছিল একটি বিশ্বসংগ্রামের উপর। কাজেই ১৯৩৯ অব্দে বর্ত্তমান যুদ্ধের সূত্রপাত আমাদের কাছে রাত্রিশেষের বার্ত্তা বয়ে এনেছিল। শেষ পর্য্যন্ত ১৯৪১-এর ডিসেম্বর মাসে যুদ্ধ যখন পূর্ব্ব-এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল, যখন নিপ্পনের অজেয় শক্তির বলে পূর্ব্ব-এশিয়া থেকে ইঙ্গ-মার্কিণ শক্তি ও প্রভাব বিলুপ্ত হয়ে গেল, তখন ভারতীয় জনগণের সম্মুখে বহুযুগের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের অপূর্ব্ব সুযোগ এসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব্ব-এশিয়ার অধিবাসী তিরিশ লক্ষ ভারতীয়ের মনে জাগল নতুন চেতনা। তাঁরা অচিরে ভারতীয় স্বাধীনতা লীগ বা আজাদ হিন্দ সঙ্ঘ নামে নিজেদের রাজনৈতিক দিক থেকে সঙ্ঘবদ্ধ করলেন। ভারতীয় স্বাধীনতা লীগ সংগঠনের সঙ্গে সঙ্গে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনের ব্যবস্থাও করা হল।
আজাদ হিন্দ ফৌজ সংগঠন আমাদের বিপক্ষদলের পক্ষে বিষম আশঙ্কা ও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াল। তারা কিছুকাল এর অস্তিত্বকে অবজ্ঞা করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু যখন সংবাদ আর চেপে রাখা গেল না, তখন তারা নয়াদিল্লীর ভারত-বিরােধী বেতার কেন্দ্রের মারফৎ এই মর্ম্মে প্রচার শুরু করল যে, জাপানের নিয়ন্ত্রণাধীনে ভারতীয় বুদ্ধবন্দীরা জাপানী সেনাবাহিনীতে যােগ দিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এ প্রচারও বেশী দিন কার্য্যকরী হল না—কারণ ভারতে নানাসূত্রে সংবাদ যেতে লাগল যে, পূর্ব্ব-এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু অসামরিক ভারতবাসী আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দিচ্ছে। ভারত-বিরােধী রেডিওর বিশেষজ্ঞদেরও প্রচার-কৌশল পালটাতে হল। তারা তখন এই মর্ম্মে নতুন প্রচার শুরু করল, ভারতীয় যুদ্ধ বন্দীরা আজাদ হিন্দ ফৌজে যােগ দিতে অস্বীকৃত রূয়েছে বলেই বেসামরিক ভারতীয়দের যােগ দিতে বাধ্য করানাে হয়েছে। দিল্লীর সবজান্তাদের মাথায় এ বুদ্ধি জোগায় নি যে, যুদ্ধবন্দীদের উপর বলপ্রয়ােগ করে যদি তাদের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য না করা যায়, তবে স্বাধীন বেসামরিক অধিবাসীদের জোর করে সৈন্যদলে ভর্ত্তি করানাে আরও কঠিন। কিন্তু আমাদের বিপক্ষীয় প্রচারকদের এরূপ মূর্খতা বিস্ময়কর নয়— নিজের বিবেক যদি দুষ্ট হয় কিংবা কোন দুর্ব্বল বিষয়কে যদি সমর্থন করতে হয়, তবে পরস্পর-বিরােধী যুক্তি না দিয়ে উপায় থাকে না। যাই হােক, আজ আমি ঘােষণা করছি যে, বৃটিশ-ভারতীয় বাহিনীর ভূতপূর্ব্ব সদস্য এবং পূর্ব্ব-এশিয়ার অসামরিক ভারতীয়দের নিয়ে ভারতের মুক্তি-ফৌজ গঠিত হয়েছে।
যার সামান্য সাধারণ বুদ্ধি আছে সেও বুঝবে, জোর করে ভাড়াটে বাহিনী গড়ে তােলা সম্ভব হলেও জোর করে স্বেচ্ছাসৈনিকদের বাহিনী গড়ে তােলা যায়না। কোন লােকের ঘাড়ে আপনি জোর করে রাইফেল চাপিয়ে দিতে পারেন, কিন্তু যে আদর্শ তার নিজের নয় তার জন্যে আপনি তাকে প্রাণ দিতে বাধ্য করাতে পারেন না।
আজাদ-হিন্দ ফৌজের অফিসার ও সৈন্যরা আজ দক্ষিণে আরাকান থেকে উত্তরে আসাম পর্য্যন্ত দীর্ঘ রণাঙ্গনে বীরের মতাে লড়াই করছে এবং প্রাণ দিচ্ছে। আজ পৃথিবীর কেউ বিশ্বাস করবে না যে, এই বাহিনীটি বলপ্রয়ােগ করে তৈরী করা হয়েছে। কাজেই বিপক্ষীয় প্রচারকদের নতুন প্রচার-কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে—সে প্রচার শুধু গালাগালিতে ভর্ত্তি। কিন্তু গালাগালি তো সর্ব্বদাই হতাশার সম্বল। একেবারে গােড়ার দিকে আমাদের শত্রুরা বলত যে, আজাদ হিন্দ ফৌজ আদপে কোন বাহিনীই নয়—শুধু মিথ্যা প্রতারণা; এ বাহিনী কখনও যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা যাবে না। পরে দিল্লীর ভারত-বিরােধী বেতার চীৎকার করতে সুরু করল, নির্দ্ধারিত সময়ক্রম অনুসারে আজাদ-হিন্দ ফৌজ ভারত-সীমান্ত অতিক্রম করেনি। এখন যখন আমরা ভারত সীমান্ত অতিক্রম করেছি এবং ভারতের মাটিতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলেছে, তখন বিপক্ষীয় প্রচারকরা হতাশ হয়ে শেষ চেষ্টা করে দেখছে। আমরা দিল্লীতে প্রবেশের তারিখ নির্দ্ধারণ করেছিলাম বলে তারা কাল্পনিক তারিখ আবিষ্কার করেছে, এবং আমাদের দিল্লী-প্রবেশের এই সব কাল্পনিক তারিখ আবিষ্কার করে, নির্দ্ধারিত সময়ানুসারে আমাদের দিল্লীতে না পৌঁছানাের জন্যে গালাগালি করছে। আমি স্বীকার করি যে, ভারত সীমান্ত অতিক্রম করতে আমাদের কিছু বিলম্ব হয়েছে। কিন্তু তাছাড়া গত বারাে মাস যাবত নির্দ্ধারিত সময়-তালিকা অনুসারেই আমাদের কাজ হয়ে এসেছে। এখন আমি ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি, ভবিষ্যতেও আমরা নির্দ্ধারিত সময়-তালিকা অনুসারেই কাজ করে যাব।
গত আগষ্ট মাস থেকেই আমি আমার দেশবাসীদের সর্ব্বদা মনে করিয়ে দিয়েছি যে, ভারত-সীমান্ত অতিক্রমের পরই প্রকৃত যুদ্ধ আরম্ভ হবে; সে যুদ্ধ হবে কঠিন এবং দীর্ঘস্থায়ী। আমি তাঁদের আরও স্মরণ করিয়ে দিয়েছি, ভারতের মাটিতেই বৃটিশরা প্রথম এবং শেষবারের মতো পুরুষের ন্যায় যুদ্ধ করবে। কারণ তারা জানে যে, ভারত হাত-ছাড়া হওয়া মানেই বৃটিশ সাম্রাজ্যের মৃত্যু। কাজেই আমরা দীর্ঘ এবং কঠিন যুদ্ধের জন্যে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। দিল্লী অভিযান খুব সহজ হবে না। এযুদ্ধ হবে ইতিহাসের অন্যতম কঠিন যুদ্ধ—তবে শেষ বিজয়লাভ করব আমরাই। নয়া দিল্লীতে বড়লাটের প্রাসাদের উপর ত্রিবর্ণ-পতাকা উড্ডীন দেখার পূর্ব্বে আমাদের যদি আরও বারো মাস কিংবা চব্বিশ মাস পর্য্যন্তও যুদ্ধ করতে হয়, তবু বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।
আমি ইতিপূর্ব্বেই বলেছি, সেনাবাহিনীর লোক এবং অসামরিক অধিবাসীদের নিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠিত হয়েছে। এ বাহিনী শুধু পুরুষদের নিয়েই গঠিত নয়, এ বাহিনীতে নারী-সৈন্যও আছে। আজ ভারতের অভ্যন্তরে আমাদের বাহিনীর পুরুষরাই লড়াই করছে—কিন্তু এমন দিন শীঘ্রই আসবে যখন আমাদের নারী-সৈনিকরা, ঝাঁসীর রানী বাহিনীর আমাদের কমরেডরা—পুরুষদের সঙ্গে পাশাপাশি রণাঙ্গণে যাবে। আমাদের বাহিনীতে নতুন সৈন্য সংগ্রহেরও অভাব নেই। কার্য্যত সুরু থেকেই এত নতুন সৈন্য আসতে শুরু করেছে যে, আমরা তাদের সবায়ের শিক্ষা-ব্যবস্থা করে উঠতে পারিনি। এবং আমি যতদূর দেখতে পাই, তাতে মনে হয় যে যুদ্ধ যতদিন থাকবে, ততদিন এই রকম নতুন সৈন্য় বহু সংখ্যায় আসতে থাকবে।
আজাদ হিন্দ ফৌজ শুধু ভারতীয়দের দ্বারা গঠিতই নয়—এ বাহিনীকে শিক্ষাও দিয়েছে ভারতীয়রা। সেই বাহিনী আজ ভারতীয় অফিসারদের নেতৃত্বে যুদ্ধ করছে। আজাদ হিন্দ ফৌজ সম্বন্ধে ভারতে আমাদের বিপক্ষীয়েরা যে সব মিথ্যা রটনা করেছে, তার কিছু কিছু আমি জানি।
কিন্তু ভারতীয় জনগণ ভারতের মাটিতে যখন নিজ চোখেই তাদের দেখতে পাবে, তখন তারা বিস্মিত হয়ে যাবে।
আমি আজাদ-হিন্দ ফৌজ সম্বন্ধে অন্য একটি বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই। সেটা হচ্ছে এই, যদিও কোন কোন অত্যাবশ্যক ব্যাপারে আমরা জাপানী গবর্নমেন্ট এবং সেনাবাহিনীর সাহায্য নিতে বাধ্য হই, তবু আজাদ-হিন্দ ফৌজ প্রধানতঃ ভারতীয়দের অর্থ এবং সামর্থ্যের দ্বারা পরিপুষ্ট এবং গঠিত। গতবৎসর আমি পূর্ব্ব-এশিয়ার স্বদেশবাসীদের কাছে যে অর্থ দাবী করেছিলাম, পেয়েছি তার চেয়ে অনেক বেশী। এখনও প্রচুর পরিমাণে অর্থ আসছে এবং যতদিন আমাদের মুক্তি-সংগ্রাম শেষ না হবে ততদিন এই রকম আসতে থাকবে। শুধু তাই নয়, সমগ্র পূর্ব্ব-এশিয়া থেকে ভারতীয় বণিক-সম্প্রদায় এবং ব্যবসায়ীরা আমাদের সেনাদলের জন্যে প্রচুর দ্রব্য সরবরাহ করছেন। অতএব ভারতীয় জনগণের এখন নিজেদের সেনাবাহিনী আছে—সে বাহিনী ভারতীয়দের দ্বারা সংগঠিত, ভারতীয় অর্থ-সামর্থ্যে পরিপুষ্ট, ভারতীয়দের দ্বারা শিক্ষিত এবং ভারতীয় অফিসারদের নেতৃত্বে যুদ্ধরত। এখন শুধু ভারত থেকে শেষ বৃটিশটিকে বিতাড়িত না করতে পারা পর্য্যন্ত দুর্দ্দম শৌর্য্যে এবং অনমনীয় দৃঢ় সঙ্কল্পে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।
উপসংহারে আমি বলতে চাই, আজাদ-হিন্দ ফৌজ সহায়বিহীন প্রতিষ্ঠান নয়। এই প্রতিষ্ঠানের পিছনে আছে পূর্ব্ব-এশিয়ার ত্রিশ লক্ষ ভারতবাসী যারা ভারতীয় প্রচেষ্টায় ভারত স্বাধীন করার জন্যে সামগ্রিক সমর-সজ্জার কর্ম্ম-তালিকা অনুসরণ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাছাড়া, আজাদ-হিন্দ ফৌজের সংবাদবাহক এবং চরেরা ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে এবং সেখানে নীরবে কাজ করে চলেছে—যাতে আমাদের সামরিক অভিযানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ভারতে সমগ্র দেশব্যাপী বিপ্লবের আগুন জ্বলে ওঠে। এই ভাবে পূর্ব্ব-এশিয়ার দূরতম কোণ থেকে ভারতের সীমান্ত পর্যন্ত আমরা একটি রণাঙ্গনের সৃষ্টি করেছি— ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভারতের জাতীয় রণাঙ্গণ।
আমাদের অফিসার ও সৈন্যদের সর্ব্ববাদী-সম্মত ইচ্ছায় আজাদ-হিন্দ ফৌজের সর্ব্বাধিনায়কের পদ গ্রহণ করা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ গৌরবের বিষয় হয়েছে। আজাদ-হিন্দ ফৌজ সাময়িক আজাদ-হিন্দ গবর্নমেন্টের সামরিক মুখপাত্র। সামরিক গবর্নমেন্ট এবং তার সেনাবাহিনী ভারতীয় জাতির ভৃত্য মাত্র। তাদের কাজ হচ্ছে যুদ্ধ করে ভারতকে মুক্ত করা। যখন সে মুক্তি সাধন হয়ে যাবে, তখন ভারতীয় জনগণ ইচ্ছানুযায়ী তাদের গবর্নমেন্টের স্বরূপ নির্দ্ধারণ করবে। সাময়িক গবর্নমেন্ট তখন স্বাধীন ভারতের স্থায়ী গবর্নমেন্টের জন্যে স্থান করে দেবে। এই স্থায়ী গবর্নমেন্ট ভারতীয় জনগণের ইচ্ছানুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই গৌরবময় দিনের প্রতীক্ষায় আমরা আজ স্বেদসিক্ত শ্রম ও যুদ্ধে নিযুক্ত।
বেতার : আজাদ হিন্দ ফৌজ সংগঠনের প্রথম বার্ষিকী