পূর্ব্ব-এশিয়ার যুদ্ধ এখন আমাদেরই
ব্রহ্মের আরাকান অঞ্চলে ১৯৪৪-এর ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ভারতের মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়েছিল। সেই ঐতিহাসিক দিনটিতে আজাদ-হিন্দ ফৌজের কয়েকটি দল অভিযান আরম্ভ করেছিল। ইতিহাসে আরাকান-যুদ্ধ বড় ঘটনা না হলেও আমাদের পক্ষে দুইটি কারণে এ যুদ্ধের বিশেষ তাৎপর্য্য আছে। প্রথমতঃ, আরাকানেই শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের প্রথম অভিযান শুরু হয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ এই আরাকান যুদ্ধেই আমাদের সৈন্যরা প্রথম “অগ্নি-শুদ্ধি” (Baptism of fire) লাভ করেছিল। এই প্রথম পরীক্ষায় তারা সগৌরবে উত্তীর্ণ হয়ে ভবিষ্যতে আজাদ-হিন্দ ফৌজের অবশিষ্টাংশের অনুসরণযোগ্য নতুন আদর্শ স্থাপন করেছে। এই সব কারণে, যে সব অফিসার ও সৈন্য আরাকান-অভিযানে বীরের মতো যুদ্ধ করে মাতৃভূমির মর্য্যাদা ও গৌরব বৃদ্ধি করেছেন, তাঁদের কাছে আজাদ-হিন্দ ফৌজ চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।
২২শে মার্চ্চ আমাদের আরাকান-অভিযানের সৈন্যাধ্যক্ষ মেজর এল. এম. মিশ্রকে সাহস এবং কর্ম্ম-নিপুণ নেতৃত্বের জন্যে “সর্দার-ই-জঙ্গ” পদক দিয়ে সম্মানিত করার ব্যক্তিগত সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তারপর, আজাদ হিন্দ ফৌজের অন্যান্য অফিসার ও সৈন্যদের মধ্যে যাঁরা বীরত্ব ও কর্ত্তব্যনিষ্ঠার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন, তাঁদের কয়েকজনের সামরিক সম্মান ঘোষণা করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। লেঃ পিয়ারা সিং এঁদের অন্যতম; তিনি আজ এখানে উপস্থিত আছেন। এই অফিসারটি আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্যদের পক্ষে আদর্শ-স্থানীয় তিনি সমগ্র অভিযানে অপূর্ব্ব স্বদেশ প্রেম, সাহস ও কর্ত্তব্যনিষ্ঠা দেখিয়ে আমাদের প্রশংসাভাজন হয়েছেন। ১৯৪৪ এর ৫ই ফেব্রুয়ারী বিপক্ষদলের সঙ্গে সংঘর্ষে তিনি অভূতপূর্ব সাহস, বুদ্ধি এবং কর্ম্মতৎপরতা দেখিয়েছিলেন। এই কৃতিত্বের জন্য তাঁকে ব্যক্তিগত সাহসের পরিসূচক প্রথম শ্রেণীর পদক “বীর-এ-হিন্দ” দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিল। ৫ই ফেব্রুয়ারীর এই ঘটনার পর ১৬ই ফেব্রুয়ারী এবং ২০শে ও ২১শে ফেব্রুয়ারীর অপর দুইটি সংঘর্ষেও লেঃ পিয়ার সিং কৃতিত্ব প্রদর্শন করে ছিলেন। শেষের সংঘর্ষটিতে তিনি ট্রেঞ্চ সর্টারের (এক প্রকারের ক্ষুদে কামান) গুলিতে আহত হয়েছিলেন; তাঁর দুটি পা-ই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কিছুকাল তাঁর অবস্থা খুবই উদ্বেগজনক হয়ে দাড়িয়েছিল এবং তাঁকে রণাঙ্গন থেকে সরিয়ে আনতে হয়েছিল। বর্ত্তমানে আমাদের হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলছে এবং আমি সানন্দে আপনাদের জানাচ্ছি যে, তাঁর অবস্থা এখন অনেকটা ভাল।
আজ আমি লেঃ পিয়ারা সিংকে পদক দিয়ে বিভূষিত করছি। এই পদক তিনি নিজের রক্ত দিয়ে অর্জ্জন করেছেন এবং তিনি এ পদকের যোগ্যতম অধিকারী। এ রকম সাহসী অফিসারকে সম্মানিত করে আমি নিজেকে, আমার সেনাবাহিনীকে এবং আমার গবর্নমেন্টকে সম্মানিত করছি।
এই প্রসঙ্গে আমাদের সেনাদলের মনোবল সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলতে চাই। আরাকান-অভিযানের পর ইন্দোব্রহ্ম-সীমান্তের অন্য কয়েকটি অঞ্চলে— বিশেষ করে হাকা, টিড্ডিম এবং কালাদন অঞ্চলে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। তারপরই গত মার্চ্চের মাঝামাঝি এসেছিল গৌরবময় মুহূর্ত্ত, যখন আমাদের সাহসী সেনাবাহিনী নিপ্পন-বাহিনীর পাশাপাশি ভারত-সীমান্ত অতিক্রম করে মণিপুর এবং আসামে প্রবেশ করে। সেই থেকে আমাদের সেনাবাহিনী মাতৃভূমির পবিত্র মাটিতে বিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। সীমান্ত অতিক্রমের ফলে আমাদের সেনাদলের মনে অপূর্ব্ব প্রেরণা এসেছে। পূর্ব্ব-এশিয়ায় ১৯৪১-এর ডিসেম্বর মাসে নিপ্পনের যুদ্ধ রূপে যে যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল—সে যুদ্ধ এখন আমাদের যুদ্ধ, ভারতের মুক্তির যুদ্ধ। কাজেই, কোন কষ্ট কোন অসুবিধা কোন স্বার্থত্যাগেই আমাদের কুণ্ঠিত হওয়া উচিত নয়। এ শুধু আমাদের স্বাধীনতার মূল্য। বর্ত্তমান যুদ্ধারম্ভের পরে আমরা নিপ্পনের সাম্রাজ্যিক-বাহিনীর কাছ থেকে কয়েকবার অভিনন্দন বাণী পেয়েছি। এ রকম প্রত্যেক বাণীতে ভবিষ্যতে আমাদের প্রচেষ্টা বৃদ্ধির সংকল্প দৃঢ়তর হয়েছে, এবং বীরত্ব ও সাহসের উচ্চতর শিখরে আরোহণের প্রবৃত্তি জেগেছে। আমি পুনরায় নিশ্চিত করে বলছি যে, এ যুদ্ধ আমাদের জীবন-মৃত্যুর যুদ্ধ; এর মধ্যে যত যন্ত্রণা-ভোগ ও আত্মত্যাগের দাবীই থাকুক না কেন, চূড়ান্ত বিজয় সম্বন্ধে আমরা নিশ্চিন্ত আছি বলে শেষ পর্য্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে দৃঢ়-সংকল্প।
ব্রহ্ম গবর্নমেন্ট এবং সাম্রাজ্যিক নিপ্পন-বাহিনীর মাননীয় প্রতিনিধিরা তাঁদের উপস্থিতির দ্বারা বর্ত্তমান অনুষ্ঠানের গৌরব বৃদ্ধি করেছেন বলে আমি তাঁদের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। আমাদের সাধারণ বিজয় লাভ না হওয়া পর্য্যন্ত তাঁদের সেনাদলের সঙ্গে এবং তাঁদের জাতির সঙ্গে আমরা হাতে হাত মিলিয়ে এগিয়ে যাব।
সম্মান-দান উৎসবের কুচ-কাওয়াজ উপলক্ষে: ৪ঠা জুলাই, ১৯৪৪