এক বৎসর পরে
(১৯৪৪ অব্দের ৪ঠা জুলাই থেকে ১০ই জুলাই আজাদ-হিন্দ গবর্নমেণ্টের উদ্যোগে নেতাজী-সপ্তাহ অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্ত্তী প্রসঙ্গগুলি ঐ অনুষ্ঠান উপলক্ষে রচিত। এগুলি ‘ব্লাড-বাথ’(রক্ত-স্নান) নামক স্বতন্ত্র পুস্তকাকারে ছাপা হয়েছিল।)
মাতৃভূমির মুক্তি-সাধনের জন্য এক বৎসরের প্রাণপাত প্রয়াসের পর আমাদের অতীত কার্য্যকলাপের হিসাব-নিকাশ নেওয়া এবং ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা প্রস্তুত করা আবশ্যক। বার মাস পূর্ব্বে পূর্ব্ব-এশিয়ায় ভারতীয়দের সম্মুখে যে কার্য্যতালিকা উপস্থাপিত করা হয়েছিল, তার মূল কথা ছিল ‘সামগ্রিক সমর-প্রস্তুতি’ (Total Mobilisation)। তখন আমি আমার দেশবাসীদের কাছে চেয়েছিলাম অফুরন্ত মানুষ, অর্থ এবং সমরোপকরণের সরবরাহ—যাতে আমরা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে পারি। সঙ্গে সঙ্গে আমরা আমাদের সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন, বিস্তৃতি-সাধন এবং শিক্ষা-বিধানেও হাত দিয়েছিলাম।
সেই সময় আমি একথাও ঘোষণা করেছিলাম যে, আমার দেশবাসীরা যদি “সামগ্রিক সমর-প্রস্তুতির” আহ্বানে সাড়া দেন, তবে আমরা ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামে দ্বিতীয় রণাঙ্গন সৃষ্টি করতে পারব। যদিও “সামগ্রিক সমর-প্রস্তুতি”র প্রস্তাব পুরোপুরি কার্য্যে পরিণত করা এখনও সম্ভব হয়নি—তবু পূর্ব্ব-এশিয়ার ভারতীয়েরা আমার ডাকে সানন্দে সাড়া দিয়েছেন, একথা আমি কৃতজ্ঞ চিত্তে স্বীকার করি। আমি একথাও ঘোষণা করতে আনন্দ অনুভব করছি যে, আমার অঙ্গীকার অনুযায়ী আমরা দ্বিতীয় রণাঙ্গন সৃষ্টি করতে পেরেছি এবং আমাদের সৈন্যেরা বর্ত্তমানে পবিত্র মাতৃভূমিতে দাঁড়িয়ে বিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করছে।
এক বৎসর পূর্ব্বে আমি ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সাহায্যের জন্য কিছু অর্থ চেয়েছিলাম। আজ আমি গর্ব্ব এবং আনন্দের সঙ্গে বলছি, আমি যা চেয়েছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি নগদ টাকা আমি পেয়েছি। তা ছাড়া, এ পর্য্যন্ত আমরা যা সংগ্রহ করেছি, ভবিষ্যতে আমাদের প্রত্যাশিত অর্থের তুলনায় তা ভগ্নাংশ মাত্র। আমাদের অর্থনৈতিক কর্ম্মতালিকার অঙ্গ হিসাবে আমরা ১৯৪৪-এর এপ্রিল মাসে নিজেদের একটি জাতীয় ব্যাঙ্ক স্থাপন করতে পেরেছি—তার নাম ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক অব আজাদ-হিন্দ লিমিটেড্। ব্যাঙ্কটি এরই মধ্যে এত সাফল্য লাভ করেছে যে, ইতিমধ্যেই কয়েকটি স্থানে এর শাখা-কার্য্যালয় খােলা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও খােলা হবে। ভবিষ্যতে আমরা ভারতীয় অর্থের সাহায্যে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন চালাতে পারব—এ বিষয়ে এখন আর আমার কোন সন্দেহ নেই।
নগদ টাকা দিয়ে সাহায্য করা ছাড়াও পূর্ব্ব-এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলনিবাসী ভারতীয়েরা নানা দ্রব্যাদি দিয়েও সাহায্য করছেন। তাঁদের সহৃদয়তা এবং পরিশ্রমের গুণেই সমগ্র পূর্ব্ব-এশিয়া থেকে আমাদের সেনাবাহিনী ও স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্যে প্রয়ােজনীয় সরবরাহ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। এত বেশী সাড়া পাওয়া গেছে যে, যানবাহনের অসুবিধা না থাকলে সরবরাহ সংগ্রহে এ পর্য্যন্ত আমরা যে কৃতিত্ব দেখিয়েছি তার চেয়ে অনেক বেশী কৃতিত্ব দেখানাে যেত। কার্য্যত আমরা পূর্ব্ব এশিয়ার কয়েক স্থানে সরবরাহ মজুত করে রাখতে পেরেছি— এখন আবশ্যক যানবাহন পেলেই হয়। ভবিষ্যতে আমরা যে সব সমস্যার সম্মুখীন হব, তাদের মধ্যে একটা বড় সমস্যা হবে যানবাহন সমস্যা এবং অংশত নিজেদের চেষ্টায় এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।
লােকের জন্য আমি যে আবেদন জানিয়েছিলাম, তাতেই সাড়া পাওয়া গেছে সব চেয়ে বেশী। সৈন্যদলে যােগদানের জন্যে অসংখ্য লােক এগিয়ে এসেছে বলে সৈন্যসংগ্রহে আমাদের একটুও কষ্ট হয় নি। এপ্রসঙ্গে আমাদের একমাত্র সমস্যা ছিল কি করে যত শীঘ্র সম্ভব শিক্ষার্থীদের শিক্ষা-ব্যবস্থা করা যায়। এক বৎসর পূর্ব্বের তুলনায় আমাদের সেনাদল এখন বিপুল বর্দ্ধিত-শক্তি। এর জন্য সন্তুষ্টি প্রকাশ করেও আমাকে একথা বলতে হচ্ছে যে, যারা ব্যাকুল আগ্রহে সৈন্যদলে যোগদানের জন্যে তৈরী হয়ে আছে, তাদের সবাইকে শিক্ষা-শিবিরে গ্রহণ করতে পারলে আমি আরও খুসী হতে পারতাম। পূর্ব্ব-এশিয়ায় আমাদের জন্য সম্ভাব্য শিক্ষার্থী বহু আছে, প্রয়োজন হলে যে কোন মুহূর্ত্তে তাদের ডেকে আনা যাবে। কাজেই আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামের সাফল্যপূর্ণ অবসান না হওয়া পর্য্যন্ত ভবিষ্যতে আমাদের সেনাবাহিনীর সম্প্রসারণ অব্যাহত থাকবে।
আমাদের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব, পূর্ব্ব-এশিয়ার ভারতীয় নারী সমাজে অভূতপূর্ব্ব জাগরণ দেখা দিয়েছে এবং ‘ঝাঁসীর রাণী’-বাহিনীকে যোগদানের জন্যে আমরা যে আবেদন জানিয়েছি, সে আবেদনে তাঁরা সাগ্রহে সাড়া দিয়েছেন। এই বাহিনীর যে সব দলের শিক্ষা সমাপ্ত হয়েছে তাদের বৈপ্লবিক উৎসাহ, তৎপরতা এবং সামরিক কর্ম্মনৈপুণ্য প্রত্যেকের মনেই গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। আমার মনে এ বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই যে, তাদের যখন প্রত্যক্ষ রণে প্রেরণ করা হবে তখন তারা তাদের ব্যবহার দ্বারা মাতৃভূমি তথা ভারতীয় নারী-সমাজের সম্মান ও গৌরব বৃদ্ধি করবে।
১৯৪৩এর অক্টোবর মাসে যখন আসন্ন সংগ্রামের জন্যে আমাদের প্রস্তুতি পূরো দমে চলছিল এবং আমাদের সৈন্যদল ইন্দো-ব্রহ্ম সীমান্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন পৃথিবীর সর্ব্বত্র সুবিদিত এবং অনুসৃত, বৈপ্লবিক কর্ম্মপদ্ধতিসম্মত একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ আমাদের পক্ষে অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেটা হচ্ছে ১৯৪৩-এর ২১শে অক্টোবর আজাদ-হিন্দ সামরিক গবর্নমেন্ট সংগঠন। একটি সংগ্রামশীল প্রতিষ্ঠান রূপে এই সামরিক গবর্নমেন্ট স্থাপিত হয়েছিল; এই গবর্নমেন্টে সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিরূপে মন্ত্রী তো আছেনই, তা ছাড়া আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামের জন্যে প্রয়োজনীয় অন্যান্য বিভাগের মন্ত্রী ও উপদেষ্টারাও আছেন। জাপান, জার্ম্মানী এবং অন্য সাতটি মিত্রশক্তি আজাদ-হিন্দ সামরিক গবর্নমেন্টকে স্বীকার করে নিয়েছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলস্থিত আমাদের বন্ধু এবং মিত্রশক্তিদের ধন্যবাদ! সামরিক গবনমেন্টের প্রতিষ্ঠা এবং অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে বহু মিত্রশক্তি কর্ত্তৃক তার স্বীকৃতির ফলে আমাদের নব মর্য্যাদার সৃষ্টি হয়েছে, এবং সমগ্র পৃথিবীর চোখে আমাদের সম্মান বেড়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের সৈনিকরা এর দ্বারা যথেষ্ট অনুপ্রাণিত হয়েছে। ১৯৪৩-এর ২৩শে অক্টোবর ব্রিটেন এবং আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এই নবগঠিত সামরিক গবর্নমেন্ট প্রথম উল্লেখযোগ্য পদপাত করেছিল।
নিপ্পন-গবর্নমেন্ট কর্ত্তৃক সামরিক গবর্নমেন্টের স্বীকৃতির পরেই ১৯৪৩-এর ৫ই ও ৬ই নবেম্বর টোকিওতে বৃহত্তর পূর্ব্ব-এশিয়ার স্বাধীন জাতিপুঞ্জের প্রতিনিধিদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দ্রষ্টা হিসাবে এই সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্যে আমন্ত্রিত হয়ে সামরিক গবর্নমেন্ট ধন্যবাদের সঙ্গে সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করে। এই সম্মেলন বৃহত্তর পূর্ব্ব-এশিয়ার স্বাধীন জাতিপুঞ্জ এবং ভারতের মধ্যে দৃঢ়সংবদ্ধ মৈত্রীভাব সংস্থাপনে সাহায্য করে। এই সম্মেলনে নিপ্পনের প্রধান মন্ত্রী জেনারেল তোজো এই মর্ম্মে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করেন যে, তাঁর গবর্নমেন্ট সামরিক আজাদ-হিন্দ গবর্নমেন্টের হাতে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ অর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। এই ঘোষণা অনুসারে আজাদ-হিন্দ ফৌজের উচ্চপদস্থ কর্ম্মচারী এবং সামরিক গবর্নমেন্টের মন্ত্রী কর্নেল এ. ভি. লোকনাথনকে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রথম চীফ-কমিশনার নিযুক্ত করা হয়। ১৯৪৪-এর ২১শে ফেব্রুয়ারী কর্নেল লোকনাথন তাঁর নূতন কর্ম্মভার গ্রহণ করেন।
১৯৪৩-এর ডিসেম্বর মাসের প্রথম ভাগে ভারতবর্ষে—বিশেষ করে বৃটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশ্যে আমাদের সেনাবাহিনীর অফিসার এবং সৈন্যেরা যাতে বাণী প্রচার করতে পারেন, সেই জন্য ভারতীয় জাতীয় বাহিনী বেতার-কেন্দ্র নামে একটি বিশেষ বেতার-কেন্দ্র গঠিত হয়। ব্রহ্মে আমাদের প্রধান কর্ম্মকেন্দ্র স্থানান্তরিত হবার পর ইন্দো-ব্রহ্ম সীমান্তের কাছে ভারতীয় জাতীয় বাহিনীর একটি দ্বিতীয় বেতার-কেন্দ্র খোলা হয়। সামরিক গবর্নমেন্ট কর্ত্তৃক পরিচালিত অপর দুইটি বেতার-কেন্দ্র ছাড়াও এ দু’টি বেতার কেন্দ্র তখন থেকেই চালু আছে।
১৯৪৩-এর শেষদিকে আমাদের সমর-প্রস্তুতি এতদূর অগ্রসর হয়েছিল যে, আমরা সোনান (সিঙ্গাপুর) থেকে ব্রহ্মে আজাদ-হিন্দ ফৌজের সামরিক গবর্নমেন্ট এবং ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের প্রধান কর্ম্মকেন্দ্র স্থানান্তরিত করার প্রয়োজন অনুভব করি। ১৯৪৪-এর জানুয়ারী মাসে এই স্থানান্তরণ হয়। তখন থেকে আমরা স্বাধীন ব্রহ্ম গবর্নমেন্টের সদয় সহানুভূতি ও সমর্থন পাচ্ছি এবং তার ফলে আমাদের কাজের যথেষ্ট সুবিধা হয়েছে।
আমাদের সমরোদ্যোগের গতি বাড়িয়ে বৃটেন-আমেরিকার বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ ঘোষণাকে কার্য্যকরী করে তোলার জন্য ১৯৪৪-এর জানুয়ারী মাস ব্যয়িত হয়েছিল। এর পর ৪ঠা ফেব্রুয়ারী আরাকান অঞ্চলে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রথমারম্ভ। আরাকান অঞ্চলের যুদ্ধকে আজাদ-হিন্দ ফৌজের অগ্নি-শুদ্ধি (baptism of fire) বলা চলে। এই পরীক্ষায় আমাদের সৈন্যরা পূর্ণ বিজয়ী হয়ে এসেছে। আজাদ-হিন্দ ফৌজের সদস্যরা যে চরমতম অসুবিধা এবং কঠিন অবস্থার মধ্যেও বীরের মতো যুদ্ধ করবে—এ বিষয়ে সকলেই এখন নিঃসংশয়। আরাকান-যুদ্ধে আমাদের যেসব সৈন্য ও অফিসার বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন তাঁদের কয়েক জনকে সামরিক গবর্নমেন্টের তরফ থেকে সম্মানে বিভূষিত করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
প্রায় একমাস পরে, সঠিক তারিখ বলতে গেলে ৮ই মার্চ্চ—ইন্দোব্রহ্ম সীমান্তের টীড্ডিম নামক নূতন অঞ্চলে পুনরায় যুদ্ধারম্ভ হয়। এক সপ্তাহ পরে মণিপুর ও আসামের দিকে অভিযান শুরু হল এবং অচিরে কয়েকটি স্থানে আমাদের সৈন্যরা ভারত-সীমান্ত অতিক্রম করল। আজাদ-হিন্দ ফৌজের কয়েকটি দল নিপ্পনের সাম্রাজ্যিক বাহিনীর পাশাপাশি মণিপুর ও আসামে প্রবেশ করে। তারপর থেকে ভারত-সীমান্তের মধ্যে যুদ্ধ চলেছে। কালাদন এবং হাকা অঞ্চলেও আমাদের সৈন্যরা যুদ্ধ করছে। যদিও সম্প্রতি আমাদের অগ্রগতি চমকপ্রদ হয়নি, তবু আমরা ধীর স্থির গতিতে এগিয়ে চলেছি। হতাহত হওয়া যুদ্ধের অবশ্যম্ভাবী ফল; তার সঙ্গে জুটেছে প্রবল বর্ষা ঋতু ও আনুষঙ্গিক ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য রোগ এবং অপর বহুপ্রকারের কষ্ট ও অসুবিধা। এ সত্ত্বেও আমাদের সৈন্যরা যুদ্ধে অসামান্য কৃতিত্ব দেখাচ্ছে। অপরিসীম তাদের মনোবল। ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করছে—এই অনুভূতি তাদের অফুরন্ত প্রেরণা জোগাচ্ছে। গৃহ রণাঙ্গণে যাঁরা কর্মব্যস্ত তাদের মনেও আজ এই একই প্রেরণা।
১৯৪৪-এর মার্চ্চ মাসে আমাদের সৈন্যরা ভারত-সীমান্ত অতিক্রম করার পর বিপক্ষদল পশ্চাদপসরণ শুরু করল। তখন এক নূতন সমস্যা দেখা দিল—মুক্ত অঞ্চলের শাসন ও পুনর্গঠনের সমস্যা। সুখের বিষয়, ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের পুনর্গঠন বিভাগের প্রচেষ্টায় আমরা পূর্ব্ব থেকেই এর জন্যে প্রস্তুত ছিলাম। গত মার্চ্চে বহু নরনারী নিয়ে অন্য একটি নূতন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হল—তাদের কাজ, আমাদের অগ্রসরমান সৈন্যদের সঙ্গে গিয়ে মুক্তিপ্রাপ্ত অঞ্চলের শাসন ও পুনর্গঠনের কার্য্যভার গ্রহণ। আজাদ-হিন্দ দল নামক এই প্রতিষ্ঠানটি প্রধানত বেসামরিক হলেও একে সামরিক ভিত্তিতে এমন ভাবে গড়ে তোলা হয়েছে—যাতে এই প্রতিষ্ঠান যুদ্ধকালীন অবস্থায় কাজ করতে পারে এবং রণক্ষেত্রের সৈন্যদেরই ন্যায় অসুবিধা ও বিপদের সম্মুখীন হতে পারে। যে ভাবে বেসামরিক নরনারীরা দলে দলে এসে আজাদ-হিন্দ দলে যোগ দিয়েছে তাতে তাদের বিশেষভাবে প্রশংসা করতে হয়। এদের অনেকেই পূর্ব্বে কোন প্রকারের সামরিক শিক্ষা পায় নি। এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, পূর্ব্ব-এশিয়ার সমগ্র ভারতীয় সমাজের চিত্তে আত্মত্যাগের বহ্নি জ্বলছে এবং তারা স্বাধীনতা লাভের জন্যে সব কিছু করতে প্রস্তুত। “করব অথবা মরব” এই মনোবৃত্তি শুধু আজাদ-হিন্দ ফৌজকেই অনুপ্রাণিত করছে না—বে-সামরিক ভারতীয়দের মনে মনেও আজ এই একই প্রেরণা। রণাঙ্গনের সৈন্যদের মত গৃহাঙ্গনের কর্ম্মীদের মনোবলও আজ অভূত ও অপূর্ব্ব।
আমাদের গত এক বৎসরের কাজ নিম্নোক্ত রূপে সংক্ষেপে বর্ণনা করা চলে:—
১। আমরা “সামগ্রিক সমর-প্রস্তুতির” কর্ম্মতালিকা অনুসারে লোক, অর্থ এবং দ্রব্যাদি সংগ্রহ করতে পেরেছি।
২। আমাদের বাহিনীকে আমরা আধুনিক যুদ্ধের উপযোগী করে শিক্ষিত করেছি এবং তার যথোচিত বিস্তৃতি-সাধন করেছি।
৩। সেনাবাহিনীতে আমরা “ঝাঁসীর রাণী বাহিনী” নামে একটি নারী-বিভাগ গড়ে তুলেছি।
৪। আমরা আজাদ-হিন্দ সামরিক গবর্নমেণ্ট নামে নিজেদের গবর্নমেন্ট গঠন করেছি এবং মিত্রশক্তিদের কাছ থেকে তার স্বীকৃতি পেয়েছি।
৫। নিপ্পন-গবর্নমেন্টের আনুকূল্যে আমরা স্বাধীন রাজ্যরূপে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ পেয়েছি।
৬। ব্রহ্মে আমাদের প্রধান কর্ম্মকেন্দ্র এগিয়ে এনেছি এবং ১৯৪৪এর ফেব্রুয়ারী মাসে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম-সুরু করেছি। ২১শে মার্চ্চ আমরা বিশ্বের দরবারে ঘোষণা করতে পেরেছিলাম যে, আমাদের সৈন্যদল ভারতে পৌঁছেছে।
৭। আমরা সংবাদ ও প্রচার বিভাগের কাজ যথেষ্ট বাড়িয়েছি।
৮। আমরা স্বাধীন ভারতের শাসন ও পুনর্গঠনের কাজ গ্রহণের জন্যে “আজাদ-হিন্দ দল” নামে একটি পৃথক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি।
৯। আমরা ব্রহ্মে “ন্যাশন্যাল ব্যাঙ্ক অব আজাদ-হিন্দ লিমিটেড” নামে আমাদের নিজেদের ব্যাঙ্ক স্থাপন করেছি। আমরা নিজেদের স্বতন্ত্র মুদ্রা-নির্ম্মাণের নির্দ্দেশ দিয়েছি এবং আশা করি, অদূর-ভবিষ্যতে সে মুদ্রা আমাদের হাতে আসবে।
১০। আমরা রণাঙ্গনের প্রত্যেক অঞ্চলে নিজেদের কৃতিত্ব দেখিয়েছি এবং সর্ব্বপ্রকার অসুবিধা ও কষ্ট সত্ত্বেও আমাদের সৈন্যরা ধীর স্থির ভাবে ভারতের মাটির উপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে।
আমাদের ভবিষ্যৎ কার্যক্রম নিম্নোক্ত সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশ করা চলে—
১। রণাঙ্গনে আমাদের সাফল্য বজায় রাখতে হবে এবং ভারতের মধ্যে ক্রমাগত আরও এগিয়ে যেতে হবে। এই উদ্দেশ্যে রণাঙ্গনে অবিরত আমাদের নতুন সৈন্য ও সরবরাহ প্রেরণ করতে হবে।
২। আজাদ-হিন্দ দলকে সম্প্রসারিত করতে হবে। ভবিষ্যতে আমাদের সেনাবাহিনী যতই ভারতের মধ্যে এগিয়ে যাবে ততই আজাদ হিন্দ দলকে আরও বেশী কার্য্যভার গ্রহণ করতে হবে। স্বাধীন ভারতের শাসন ও পুনর্গঠনের জন্যে আমাদের পরিকল্পনা ও আয়োজনকে আরও পূর্ণাঙ্গ করে তুলতে হবে।
৩। আমাদের গৃহ-রণাঙ্গন আরও শক্তিশালী করে তুলতে হবে এবং সেই উদ্দেশ্যে লোক, অর্থ ও সরবরাহের আয়োজন বাড়িয়ে তুলতে হবে।
এই তিনটি প্রধান ব্যাপার সম্পন্ন করতে হলে ভবিষ্যতে নীচের সমস্যাগুলোর দিকে আরও বেশী মনোেযোগ দিতে হবে—
(ক) ভারতের মধ্যে বিপ্লব জাগিয়ে তোলা।
(খ) বিপক্ষদলীয় ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে কার্য্যকর প্রচার চালানো।
(গ) গৃহ-রণাঙ্গনের সমস্যা সমাধানের জন্যে নতুন প্রচেষ্টা—বিশেষ করে সরবরাহ ও যানবাহন ঘটিত সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা।