চারমূর্তি by নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, chapter name চলমান জুতো

চলমান জুতো

      কী যে বিতিকিচ্ছিরি ঝামেলা ! ভূত নয়—তবু কেমন ভূতের ভয় ধরিয়ে দিলে হতচ্ছাড়া ঝন্টুরাম । আধ ঘণ্টা ধরে বুকের কাঁপুনি আর থামতেই চায় না। গোবর-টােবর মেখে টেনিদা উঠে দাঁড়াল । গোটাকয়েক অ্যায়সা অ্যায়সা কাঠ-পিঁপড়ের কামড় খেয়ে প্রাণপণে পা চুলকোতে চুলকোতে নামল ক্যাবলা। হাবুলের হাঁটু দুটাে থেকে-থেকে ধাক্কা খেতে লাগল। আর মাইলখানেক বাঁই-বাই করে দৌড়োনোর ফলে আমার পালা-জ্বরের পিলেটা পেট ফুড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল ।

      টেনিদাই সামলে নিলে সক্কলের আগে ।

      —ঝন্টুরাম ? দাঁত খিচিয়ে টেনিদা বললে, তা অমন ভূতের মতো চেহারা কেন ? +

      —কী করব খোঁকাবাবু, ভগবান বানিয়েছেন ।

      —ভগবান বানিয়েছেন—ছোঃ !—টেনিদা ভেংচি কাটাল - ভগবানের আর খেয়েদেয়ে কাজ ছিল না ! ভগবানের হাতের কাজ এত বাজে নয়—তোকে ভূতে বানিয়েছে, বুঝলি ?

      —হাঁঃ –ঝন্টুরাম আপত্তিও করলে না।

      এবার ক্যাবলা এগিয়ে এল ; তা, এই ঝোপের মধ্যে ঢুকে বসেছিলি কেন ?

      ঝন্টুরাম কতকগুলো এলোমেলো দাঁত বের করে বললে, কী করব দাদাবাবু—ইস্টিশনে তো যাচ্ছিলাম। তা, পথের মধ্যে ভারি নিদ এসে গেল, ভাবলম একটু ঘুমিয়ে নিই। তা ঘুমাচ্ছি তো ঘুমাচ্ছি, শেষে নাকের ভেতরে দু-তিনটে মচ্ছর (মশা) ঘুসে গেল। উঠে দেখি, আপনারা আসছেন । আমি আপনাদের কাছে এলম তো আপনারা ডর খেয়ে অ্যায়সা কারবার করলেন--

      বলেই খ্যাঁক-খ্যাঁক খিকখিক করে লোকটা ভুতুড়ে হাসি হাসতে আরম্ভ করে দিলে ।

      ক্যাবলা বললে, খুব হয়েছে, আর হাসতে হবে না । দাঁত তো নয়—যেন মুলোর দোকান খুলে বসেছে মুখের ভেতর । চল—চল এখন শিগগির, পথ দেখিয়ে নিয়ে চল ঝণ্টিপাহাড়িতে—

      সত্যি, চমৎকার জায়গা এই ঝণ্টিপাহাড়ি ।

      নামটা যতই বিচ্ছিরি হোক—এখানে পা দিলেই গা যেন জুড়িয়ে যায়। তিনদিকে পাহাড়ের গায়ে শাল-পলাশের বন—পলাশ ফুল ফুটে তাতে যেন লাল আগুন জ্বলছে। নানারকমের পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে—কত যে রঙের বাহার তাদের গায়ে । সামনে একটা ঝিল—তার নীল জল টলমল করছে দুটাে-চারটে কলমি-লতা কাঁপছে, তার ওপর আবার থেকে-থেকে কেউটে সাপের ফণার মতো গলা-তোলা পানকৌড়ি টপটপ করে ডুব দিচ্ছে তার ভেতরে।

      ঝিলের কাছেই একটা টিলার ওপর তিনদিকে বনের মাঝখানে মেসোমশায়ের বাংলো । লাল ইটের গাঁথুনি—সবুজ দরজা জানালা—লাল টালির চাল । হঠাৎ মনে হয় এখানেও যেন একরাশ পলাশ ফুল জড়ো হয়ে রয়েছে আর দুটাে-চারটে সবুজ পাতা উকি দিচ্ছে তাদের ভেতরে ।

      এমন সুন্দর জায়গা—এমন মিষ্টি হাওয়া—এমন ছবির মতো বাড়ি—এখানে ভূতের ভয় ! রাম রাম ! হতেই পারে না !

      বাংলোর ঘরগুলোও চমৎকার সাজানো । টেবিল, চেয়ার, ডেক-চেয়ার, আয়না, আলনা—কত কী ? খাটো মোটা জাজিম। আমরা পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই ঝন্টুরাম দুখানা ঘরের চারখানা খাটে চমৎকার করে বিছানা পেতে দিলে । বাংলোর বারান্দায় বেতের চেয়ারে আমরা আরাম করে বসলুম। ঝন্টুরাম ডিমের ওমলেট আর চা এনে দিলে। তারপর জানতে চাইল : খোকাবাবুরা কী খাবেন দুপুরে ? মাছ, না মুরগি ?

      —মুরগি—মুরগি !—আমরা কোরাসে চিৎকার করে উঠলুম।

      টেনিদা একবার উস্ করে জিভের জল টানল : আর হ্যাঁ—চটপট পাকিয়ে ফেলো—বুঝলে ? এখন বেলা বারোটা বাজে—পেটে ব্ৰহ্মা খাই-খাই করছেন। আর বেশি দেরি হলে চেয়ার-টেবিলই খেতে আরম্ভ করব বলে দিচ্ছি !

      —হঃ, তুমি তা পারবা । হাবুল সেন ঠুকে দিলে ।

      —কী—কী বললি হাবুল ?

      —না না—আমি কিছু কই নাই।

      —হাবুল সামলে দিলে, কইতেছিলাম ঝন্টু খুব তাড়াতাড়ি রাঁধতে পারবে ।

      ঝন্টুরাম চলে গেল।

      টেনিদা বললে, চেহারাটা যাচ্ছেতাই হলে কী হয়—ঝন্টুরাম লোকটা খুব ভালো—না রে ?

      আমি বললাম, হ্যাঁ, যত্ন-আত্তি আছে। রোজ যদি মুরগি-টুরগি খাওয়ায়—সাতদিনে আমরা লাল হয়ে উঠব ।

      টেনিদা চোখ পাকিয়ে বললে, আর লাল হয়ে কাজ নেই তোর পালা-জ্বরে ভুগিস, বাসক পাতার রস দিয়ে কবরেজি বড়ি খাস, তোর এ-সব বেশি সইবে না। কাল থেকে তোর জন্যে কাঁচকলা আর গাঁদালের ঝোল বরাদ্দ করে দেব। বিদেশে-বিভুঁয়ে এসে যদি পটাৎ করে পটল তুলিস, তাহলে সে ম্যাও সামলাবে কে—শুনি ?

      আমি ব্যাজার হয়ে বললুম, আচ্ছা আচ্ছা, সেজন্যে তোমায় ভাবতে হবে না । গাঁদালের ঝোল খেতে বয়ে গেছে আমার ! মরি তো মুরগি খেয়েই মরব !

      —আর পরজন্মে মুরগি হয়ে জন্মাবি। ডাকবি, কঁর—কঁর—কোঁকোর—কোঁ— ইস্টুপিড ক্যাবলাটা বদ রসিকতা করলে। আমি বেদম চটে বসে বসে নাক চুলকোতে লাগলাম।

      খেতে খেতে দুটো বাজল । আহা, ঝন্টুর রান্না তো নয়—যেন অমৃত । পেটে পড়তে পড়তেই যেন ঘুম জড়িয়ে এল চোখে । রাত্রে ট্রেনের ধকলও লেগেছিল কম নয়—নরম বিছানায় এসে গা ঢালতেই আমাদের মাঝ-রাত্তির ।

      বিকেলের চা নিয়ে এসে ঝন্টুরাম যখন আমাদের ডেকে তুলল, পাহাড়ের ওপারে তখন সূর্য ডুবে গেছে। শাল-পলাশের বন কালো হয়ে এসেছে, শিসের মতো রঙ ধরেছে ঝিলের জলে । দুপুরবেলা চারিদিকের যে মন-মাতানো রূপ চোখ ভুলিয়েছিল, এখন তা কেমন থমথমে হয়ে উঠেছে। ঝাঁ-ঝাঁ করে ঝিঁঝির ডাক উঠেছে ঝোপঝাড় আর বাংলোর পেছনের বন থেকে ।

      প্ল্যান ছিল ঝিলের ধারে বিকেলে মন খুলে বেড়ানো যাবে, কিন্তু এখন যেন কেমন ছম-ছম করে উঠল শরীর। মনে পড়ে গেল, কলকাতার পথে পথে—বাড়িতে বাড়িতে এখন ঝলমলে আলো জ্বলে উঠেছে, ভিড় জমেছে সিনেমার সামনে। আর এখানে জমেছে কালো রাত—ক্রমাগত বেড়ে চলেছে ঝিঁঝির চিৎকার, একটা চাপা আতঙ্কের মতো কী যেন ছড়িয়ে যাচ্ছে আশেপাশে ।

      বারান্দায় বসে আমরা গল্প করার চেষ্টা করতে লাগলুম—কিন্তু ঠিক জমতে চাইল না । ঝন্টুরাম একটা লণ্ঠন জ্বেলে দিয়ে গেল সামনে, তাইতে চারিদিকের অন্ধকারটা কালো মনে হতে লাগল ।

      শেষ পর্যন্ত টেনিদা বললে, আয়, আমরা গান গাই ।

      ক্যাবলা বললে, সেটা মন্দ নয় । এসো—কোরাস ধরি। —বলেই চিৎকার করে আরম্ভ করলে--

 

আমরা ঘুচাব মা তোর কলিমা,

মানুষ আমরা নহি তো মেষ—

 

      আর বলতে হল না। সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তিনজনে গলা জুড়ে দিলুম। সে কী গান !

      আমাদের চারজনের গলাই সমান চাঁছাছোলা—টেনিদার তো কথাই নেই। একবার টেনিদা নাকি অ্যায়সা কীর্তন ধরেছিল যে তার প্রথম কলি শুনেই চাটুজ্যেদের পোষা কোকিলটা হার্টফেল করে । আমরা এমনই গান আরম্ভ করে দিলুম যে ঝন্টুরাম পর্যন্ত ভ্যাবাচাকা খেয়ে ছুটে এল ।

      আমরা সবাই বোধ হয় একটা কথাই ভাবছিলুম। ঝন্টিপাহাড়ের বাংলোতে যদি ভূত থাকে, তবুও এ-গান তাকে বেশিক্ষণ সইতে হবে না—আপনি উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাবে এখান থেকে ।

      কিন্তু সেই রাত্রে—

      আমি আর ক্যাবলা এক ঘরে শুয়েছি—পাশের ঘরে হাবুল সেন আর টেনিদা। একটা লন্ঠন আমাদের ঘরে মিটিমিটি করছে ঘরের চেয়ার টেবিল আয়নাগুলো কেমন অদ্ভূত মূর্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন । ভয়টা আমার বুকের ভেতরে চেপে বসল। অনেকক্ষণ বিছানায় আমি এপাশ-ওপাশ করতে লাগলুম—কান পেতে শুনলুম, টেনিদার নাকে—সা রে গা মা-র সাতটা সুর বাজছে । কাচের জানালা দিয়ে দেখলুম বাইরে কালো পাহাড়ের মাথায় একরাশ জ্বলজ্বলে তারা । তারপর কখন যেন ঘুমিয়ে গেছি।

      হঠাৎ খুট—খুট—খটাৎ—খটাৎ—

      চমকে জেগে উঠলাম। কে যেন হাঁটছে।

      কোথায় ?

      এই ঘরের মধ্যেই । যেন পায়ে বুট পরে কে চলে বেড়াচ্ছে ঘরের ভেতর। হাত বাড়িয়ে লণ্ঠনটা বাড়িয়ে দিলুম। না—ঘরে তো কিছু নেই। তবু সেই জুতোর আওয়াজ । কেউ হাঁটছে—নির্ঘাত হাঁটছে। খুট-খুট—খটাত-খটাত—

      আমি চেঁচিয়ে উঠলাম : ক্যাবলা !

      ক্যাবলা লাফিয়ে উঠল : কী-কী হয়েছে ?

      —কে যেন হাঁটছে ঘরের ভেতর ?

      কী গোঁয়ার-গোবিন্দ এই পুঁচকে ক্যাবলা ! তক্ষুনি তড়াক করে নেমে পড়ল মেঝেতে । আর সঙ্গে সঙ্গেই একটু ইঁদুর দুড়দুড় করে দরজার চৌকাটের গর্ত দিয়ে বাইরে দৌড়ে পালাল ।

      ক্যাবলা হেসে উঠল ।

      —তুই কী ভিতু রে প্যালা ! একটা পুরোনো ছেঁড়া জুতোর মধ্যে ঢুকে ইঁদুরটা নড়ছিল—তাই এই আওয়াজ । এতেই এত ভয় পেলি !

      শুনেই আমি বীরদর্পে বললুম—যাঃ—যাঃ—আমি সত্যিই ভয় পেয়েছি নাকি –বেশ ডাঁটের মাথায় বললুম, ইঁদুর তো ছার—সাক্ষাৎ ব্রহ্মদত্যি যদি আসে–

      কিন্তু মুখের কথা মুখেই থেকে গেল আমার । সেই মুহুর্তেই কোথা থেকে জেগে উঠল এক প্রচণ্ড অমানুষিক আর্তনাদ । সে-গলা মানুষের নয়। তারপরেই আর-একটা বিকট অট্টহাসি । সে-হাসির কোনও তুলনা হয় না । মনে হল, পাতালের অন্ধকার থেকে তা উঠে আসছে, আর তার শব্দে ঝণ্টিপাহাড়ির বাংলোটা থর-থর করে কেঁপে উঠছে !