চারমূর্তি by নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, chapter name ছপ্পর পর কৌয়া নাচে

ছপ্পর পর কৌয়া নাচে

      রাত নয়—অন্ধকার নয়—একেবারে ফুটফুটে দিনের আলো। দেওয়ালের ওপরে টালির চাল—একটা চড়ুই পাখি পর্যন্ত বসে নেই সেখানে। অথচ ঠিক মনে হল ওই টালির চাল ফুড়েই হাসির আওয়াজটা বেরিয়ে এল।

      কী করে হয় ? কী করে এমন সম্ভব ?

      আমরা কি পাগল হয়ে গেছি ? না কি ঝন্টুরাম চায়ের সঙ্গে সিদ্ধি-ফিদ্ধি কিছু খাইয়ে দিলে ? তাই বা হবে কেমন করে ? ক্যাবলা তো চা খায়নি আমাদের সঙ্গে ! তবু সেও ওই অশরীরী হাসির আওয়াজটা ঠিক শুনতে পেয়েছে।

      প্রায় চার মিনিট ধরে আমরা চারমূর্তি চারটে লাটুর মতো বসে রইলুম। আমরা অবশ্য লাটুর মতো ঘুরছিলুম না—কিন্তু মগজের সব ঘিলুগুলো ঝনর-ঝনর করে পাক খাচ্ছিল । খাসা ছিলুম পটলডাঙায়, পটােল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল খেয়ে দিব্যি দিন কাটছিল। কিন্তু টেনিদার প্যাঁচে পড়ে এই ঝণ্টিপাহাড়ে এসে দেখছি ভূতের কিল খেয়েই প্রাণটা যাবে ।

      আরও তিন মিনিট পরে যখন আমার পিলের কাঁপুনি খানিক বন্ধ হল, আমি ক্যাবলাকে বললুম, এবার?

      হাবুল সেন গোঁড়ালেবুর মতো চোখ দুটােকে একবার চালের দিকে বুলিয়ে এনে বললে, হ, অখন কও!

      টেনিদা খাঁড়ার মতো নাকটা টিয়ার ঠোঁটের মতো সামনের দিকে ঝুলে পড়েছিল। জিভ দিয়ে একবার মুখ-টুখ চেটে টেনিদা বললে, মানে—ইয়ে হল, মানুষটানুষ সামনে পেলে চাঁটির চোটে তার নাক-টাক উড়িয়ে দিতে পারি। কিন্তু ইয়ে—মানে, ভূতের সঙ্গে তো ঠিক পারা যাবে না—

      আমি বললুম, তা ছাড়া ভূতেরা ঠিক বক্সিংয়ের নিয়ম-টিয়মও মানে না—

      টেনিদা ধমক দিয়ে বললে, তুই থাম না পুঁটিমাছ !

      পুঁটিমাছ বললে আমার ভীষণ রাগ হয়। যদি ভূতের ভয় আমাকে বেজায় কাবু করে না ফেলত আর পালাজ্বরের পিলেটা টনটনিয়ে না উঠত, আমি ঠিক টেনিদাকে পোনামাছ নাম দিয়ে দিতুম |

      ক্যাবলা কিন্তু ভাঙে তবু মচকায় না। চট করে সে একেবারে সামনের লনে গিয়ে নামল । তারপর মাথা উঁচু করে সে দেখতে লাগল। তারও পরে বেজায় খুশি হয়ে বললে, ঠিক ধরেছি। ওই যে বলছিলুম না ?

 

‘ছিল্পর পর কেীয়া নামে

নাচে বড়ুলা—’

 

      টেনিদা বলল—মানে ?

      ক্যাবলা বললে, মানে ? মানে হল, চালের ওপর কাক নাচে—আর নাচে বক।

      —রাখ তোর বক নিয়ে বকবকানি । কী হয়েছে বল দিকি ?

      —হবে আর কী । একেবারে ওয়াটারের মতো—মানে পানিকা মাফিক সোজা ব্যাপার । ওই চালের ওপরে লোক বসেছিল কেউ । সে-ই ওরকম বিটকেল হাসি হেসে আমাদের ভয় দেখিয়েছে।

      —সে-লোক গেল কোথায় ?

      —আঃ, নেমে এসো না—দেখাচ্ছি সব । আরে ভয় কী—না হয় রাম-রাম জপ করতে করতেই চলে এসো এখানে ।

      —ভয়! ভয় আবার কে পেয়েছে? —টেনিদা শুকনো মুখে বললে, পায়ে ঝিঁ ঝিঁ ধরেছে কিনা —

      ক্যাবলা খিক-খিক করে হাসতে লাগল। —ভূতের ভয়ে বহুত আদমির অমন করে ঝিঁ-ঝি ধরে । ও আমি অনেক দেখেছি। এর পরে বসে থাকলে আর দলপতির মান থাকে না । টেনিদা ডিম-ভাজার মতো মুখ করে আস্তে-আস্তে লনে নেমে গেল। অগত্যা আমি আর হাবুলও গুটি-গুটি গেলাম টেনিদার পেছনে পেছনে ।

      ক্যাবলা বললে, পেছনে ওই ঝাঁকড়া পিপুল গাছটা দেখছ? আর দেখছ—ওর একটা মোটা ডাল কেমনভাবে বাংলোর চালের ওপর নেমে এসেছে ? ওই ডাল ধরে একটা লোক চালের ওপর নেমে এসেছিল। টালিতে কান পেতে আমাদের কথাগুলো শুনেছে, আর হা-হা করে হেসে ভয় দেখিয়ে ডাল বেয়ে সটকে পড়েছে।

      হাবুল আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল ; হ, এইটা নেহাত মন্দ কথা কয় নাই। দ্যাখতে আছ না, চালের ওপর কতকগুলি কাঁচা পাতা পইড়্যা রইছে? কেউ ওই ডাল বাইয়া আসছিল ঠিকোই।

      —আসছিল তো ঠিকোই—হাবুলের গলা নকল করে টেনিদা বললে, কিন্তু এর মধ্যেই সে গেল কোথায় ?

      ক্যাবলা বললে, কোথাও কাছাকাছি ওদের একটা আড্ডা আছে নিশ্চয় । মুড়ি আর চীনেবাদাম দেখেই আমি বুঝতে পেরেছি। সেই আড্ডাটাই খুঁজে বের করতে হবে । রাজি আছ ?

      টেনিদা নাক চুলকে বললে, মানে কথা হল—

      ক্যাবলা আবার খিকখিক করে হেসে উঠল : মানে কথা হল, তোমার সাহস নেই—এই তো ? বেশ, তোমরা না যাও আমি একাই যাচ্ছি।

      দলপতির মান রাখতে প্রায় প্রাণ নিয়ে টান পড়বার জো ! টেনিদা শুকনো হাসি হেসে বললে, যাঃ—যাঃ—বাজে ফ্যাঁচ-ফ্যাঁচ করিসনি। মানে, সঙ্গে দু-একটা বন্দুক-পিস্তল যদি থাকত—

      আমি বলতে যাচ্ছিলুম, বন্দুক-পিস্তল থাকলেই বা কী হত । কখনও ছুঁড়েছি নাকি ওসব ! আর টেনিদার হাতে বন্দুক থাকা মানেই আমরা স্রেফ খরচের খাতায়। ভূত-টুত মারবার আগে টেনিদা আমাদেরই শিকার করে বসত ।

      ক্যাবলা বলল, বন্দুক দিয়ে কী হবে ? তুমি তো এক-এক চড়ে গড়ের মাঠের এক-একটা গোরাকে শুইয়ে দিয়েছে শুনতে পাই। বন্দুক তোমার মতো বীরপুরুষের কী দরকার ?

      অন্য সময় হলে টেনিদা খুশি হত, কিন্তু এখন ওর ডিম-ভাজার মতো মুখটা প্রায় আলু-কাবলির মতো হয়ে গেল । টেনিদা হতাশ হয়ে বললে, আচ্ছা—চল দেখি একবার !

      ক্যাবলা ভরসা দিয়ে বললে, তুমি কিছু ভেবো না টেনিদা। এ সব নিশ্চয় দুষ্ট লোকের কারসাজি । আমরা পটলডাঙার ছেলে হয়ে এত ঘেবড়ে যাব ? ওদের জারি-জুরি ভেঙে দিয়ে তবে কলকাতায় ফিরব, এই বলে দিলাম ।

      হাবুল ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল , হ! কার জারিজুরি যে কেডা ভাঙব, সেইটাই ভালো বোঝা যাইতে আছে না !

কিন্তু ক্যাবল এর মধ্যেই বীরদর্পে পা বাড়িয়েছে। টেনিদা মানের দায়ে চলেছে পেছনে পেছনে । হাবুলও শেষ পর্যন্ত এগোল সুড়সুড় করে । আমি পালাজ্বরের রুগী প্যালারাম, আমার ওসব ধাষ্টামোর মধ্যে এগোনোর মোটেই ইচ্ছে ছিল না, তবু একা-একা এই বাংলোয় বসে থাকব—ওরেঃ বাবা ! আবার যদি সেই ঘর-ফাটানো হাসি শুনতে পাই—তা হলে আমাকে আর দেখতে হবে না ! বাংলোতে হতভাগা ঝন্টুরামটা থাকলেও কথা ছিল, কিন্তু আমাদের খাওয়ার বহর দেখে চ খাইয়ে সামনের গাঁয়ে মুরগি কিনতে ছুটেছে। এক-একা এখানে ভূতের খপ্পরে বসে থাকব, এমন বান্দাই আমি নই।

      কোথায় আর খুঁজব—কীই বা পাওয়া যাবে।

      তবু চারজনে চলেছি। বাংলোর পেছনেই একটা জঙ্গল অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেছে। জঙ্গলটা যে খুব উঁচু তা নয়—কোথাও মাথা-সমান, কোথাও আর একটু বেশি । বেঁটে বেঁটে শাল-পলাশের গাছ—কখনও কখনও ঘেঁটু আর আকন্দের ঝোপ । মাঝখান দিয়ে বেশ একটা পায়ে-চলা পথ একেবেঁকে চলে গেছে । এ-পথ দিয়ে কারা যে হাঁটে কে জানে । তাদের পায়ের পাতা সামনে না পেছন দিকে, তাই বা কে বলবে !

      প্রথম-প্রথম বুক দুর-দুর করছিল । খালি মনে হচ্ছিল, এক্ষুনি ঝোপের ভেতর থেকে হয় একটা স্কন্ধকাটা, নইলে শাকচুন্নি বেরিয়ে আসবে। কিন্তু কিছুই হল না। দুটাে-চারটে বুনো ফল—পাখির ডাক আর সূর্যের মিষ্টি নরম আলোয় খানিক পরেই ভয়-ভয় ভাবটা মন থেকে কোথায় মুছে গেল ।

      গোড়ার দিকে বেশ হুঁশিয়ার হয়েই হাঁটছিলুম—যাচ্ছিলুম ক্যাবলার পাশাপাশি । তারপর দেখি একটা বৈঁচি গাছ—ইয়া-ইয়া বৈঁচি পেকে কালো হয়ে রয়েছে। একটা ছিড়ে মুখে দিয়ে দেখি—অমৃত । তারপরে আরও একটা—তারপরে আরও একটা—

      গোটা-পঞ্চাশেক খেয়ে খেয়াল হল, ওরা অনেকখানি এগিয়ে গেছে ! তাড়াতাড়ি ওদের সঙ্গ ধরতে হবে—হঠাৎ দেখি আমার পাশেই ঝোপের মধ্যে—

      লম্বা শাদা মতো কী ওটা ? নির্ঘাত লাজ ! কাঠবেড়ালির ল্যাজ ।

      কাঠবেড়ালি বড় ভালো জিনিস। ভন্টার মামা কোত্থেকে একবার একটা এনেছিল, সেটা তার কাঁধের ওপর চড়ে বেড়াত, জামার পকেটে শুয়ে থাকত। ভারি পোষ মানে। সেই থেকে আমারও কাঠবেড়ালি ধরবার বড় শখ। ধরি না খপ করে ওর ল্যাজটা চেপে !

      যেন ওদিকে তাকাচ্ছিই না—এমনিভাবে গুটি-গুটি এগিয়ে টক করে কাঠবেড়ালির ল্যাজটা আমি ধরে ফেললুম। তারপরেই হেঁইয়ো টান !

      কিন্তু কোথায় কাঠবেড়ালি ! যেই টান দিয়েছি, অমনি হাই-মই করে একটা বিকট দানবীয় চিৎকার। সে চিৎকারে আমার কানে তালা গেলে গেল । তারপরেই কোথা থেকে আমার গালে এক বিরাশি সিক্কার চড়। ভৌতিক চড় ।

      সেই চড় খেয়ে আমি শুধু সর্ষের ফুলই দেখলুম না। সর্ষে কলাই, মটর, মুগ, পাট, আম, কাঁঠাল—সব-কিছুর ফুলই এক সঙ্গে দেখতে পেলুম । তারপরই—

      সেই ঝোপের ভেতরে সোজা চিত । একেবারে পতন ও মুর্ছা। মরেই গেলুম কি না কে জানে!