কাঠবেড়ালির ল্যাজ নয় রে ওটা কাহার দাড়ি?
যখন জ্ঞান হল তখন দেখি, আমি ডাক-বাংলোর খাটে লম্বা হয়ে আছি। ঝাঁটু মাথার সামনে দাঁড়িয়ে আমায় হাওয়া করছে, ক্যাবলা পায়ের কাছে বসে মিটমিটে চোখে তাকিয়ে আছে আর পাশে একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে টেনিদা ঘুঘুর মতো বসে রয়েছে।
ঝাঁটুর হাতের পাখাটা খটাস করে আমার নাকে এসে লাগতেই আমি বললুম, উঁফ। চেয়ার ছেড়ে টেনিদা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল যাক, তা হলে এখনও তুই মারা যাসনি !
ক্যাবলা বললে, মারা যাবে কেন ? থোড়াসে বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিল । আমি তো বলেছিলুম টেনিদা,ওর নাকে একটুখানি লঙ্কা পুড়িয়ে ধোঁয়া দাও— এক্ষুণি চাঙা হয়ে উঠবে।
টেনিদা বললে, আর লঙ্কা-পোড়া ! যেমনভাবে দাঁত ছরকুটে পড়েছিল, দেখে তো মনে হচ্ছিল, পটলডাঙা থেকে এখানে এসেই বুঝি শেষ পর্যন্ত পটল তুলল ।
মাঝখান থেকে ঝাঁটু বিচ্ছিরি রকমের আওয়াজ করে হেসে বললে, দাদাবাবু ডর খিয়েছিলেন !
ক্যাবলা বললে, যাঃ-যাঃ, তোকে আর ওস্তাদি করতে হবে না ! এখন শিগগির এক পেয়ালা গরম দুধ নিয়ে আয় দেখি !
ঝাঁটু পাখা রেখে বেরিয়ে গেল ।
আমি তখনও চোখে ধোঁয়া-ধোঁয়া দেখছি । ডান চোয়ালে অসম্ভব ব্যথা । এমন চড় হাঁকড়েছে যে, গোটাদুয়েক দাঁত বোধহয় নড়িয়েই দিয়েছে একেবারে । চড়ের মতো চড় একখানা ! অঙ্কের মাস্টারের বিরাশি সিক্কার চাঁটি পর্যন্ত এর কাছে একেবারে সুগন্ধি তিন-নং পরিমল নস্যি। আমি পটলডাঙার রোগা ডিগডিগে প্যালারাম, পালাজ্বরে ভুগি, আর পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল খাই, এমন একখানা ভৌতিক চপেটাঘাতের পরেও আমার আত্মারাম কেন যে খাঁচাছাড়া হয়নি, সেইটেই আমি বুঝতে পারছিলুম না ।
টেনিদা বললে, আচ্ছা পুঁটিমাছ তুই হঠাৎ ডাক ছেড়ে অমন করে অজ্ঞান হয়ে গেলি কেন ?
এ অবস্থাতেও পুঁটিমাছ শুনে আমার ভয়ানক রাগ হল, চোয়ালের ব্যথা-ট্যথা সব ভুলে গেলুম। বাজার হয়ে বললুম, আমি পুঁটিমাছ আছি বেশ আছি, কিন্তু ও-রকম একখানা বোম্বাই চড় খেলে তুমি ভেটকিমাছ হয়ে যেতে ! কিংবা ট্যাপামাছ !
ক্যাবলা আশ্চর্য হয়ে বললে, চাঁটি আবার তোকে কে মারলে ?
টেনিদা বললে, ভূত। ভূতের আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই। খামকা তোকে চাঁটি মারতে গেল ? তাও সকালবেলায় ? পাগল না পেট-খারাপ ?
ক্যাবলা বললে, পেট-খারাপ । এদিকে ওই তো রোগা ডিগডিগে চেহারা, ওদিকে পৌছে অবধি সমানে মুরগি আর আণ্ডা চালাচ্ছে । অত সইবে কেন ? পেট-গরম হয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। ভূত-টুত সব বোগাস।
টেনিদা সঙ্গে সঙ্গে সায় দিলে, ঠিক। আমিও ওই কথাই বলতে যাচ্ছিলুম।
ডান চোয়ালটা চেপে ধরে আমি এবার বিছানার ওপরে উঠে বসলুম।
—তোমরা বিশ্বাস করছ না ?
টেনিদা বললে, একদম না। ভূতে আর চাটি মারবার লোক পেলে না !
ক্যাবলা মাথা নাড়ল ; বটেই তো। আমাদের লিডার টেনিদার অ্যায়সা একখানা জুতসই গাল থাকতে তোর গালেই কিনা চাঁটি হাঁকড়াবে ? ওতে লিডারের অপমান হয়—তা জানিস ?
শুনে টেনিদা কটমট করে ক্যাবলার দিকে তাকাল ।
—ঠাট্টা করছিস ?
ক্যাবলা তিড়িং করে হাত-পাঁচেক দূরে সরে গেল। জিভ কেটে বললে, কী সর্বনাশ ! তোমাকে ঠাট্টা ! শেষে যে গাঁট্টা খেয়ে আমার গালপাট্টা উড়ে যাবে ! আমি বলছিলুম কি, ভূত এসে হ্যান্ডশেকই করুক আর বক্সিংই জুড়ে দিক, লেকিন ওটা দলপতির সঙ্গে হওয়াটাই দস্তুর ।
টেনিদার কথাটা ভালো লাগল না । মুখটাকে হালুয়ার মতো করে বললে, যা-যাঃ, বেশি ক্যাঁচোর-ম্যাচোর করিসনি। কিন্তু তোকেও বলে দিচ্ছি প্যালা, এ বেলা থেকে তোর ডিম খাওয়া একেবারে বন্ধ! স্রেফ কাঁচকলা দিয়ে গাঁদালের ঝোল, আর রাত্তিরে সাবু বার্লি । আজকে মুচ্ছে গিয়েছিলি, দু-চারদিন পরে একেবারেই যে মারা যাবি !
আমি রেগে বললু, ধ্যাত্তোর আমার সাবু-বার্লির নিকুচি করেছে! বলছি সত্যিই ভূতে চাঁটি মেরেছে, কিছুতেই বিশ্বাস করবে না !
ক্যাবলা বললে, বটে ?
টেনিদা বললে, থাম, আর চালিয়াতি করতে হবে না ।
আমি আরও রেগে বললুম, চালিয়াতি করছি নাকি ? তা হলে এখনও আমার ডান গালটা টনটন করবে কেন ?
টেনিদা বললে, অমন করে । খামকাই তো লোকের দাঁত কনকন করে, মাথা বনবন করে, কান ভোঁ-ভোঁ করতে থাকে—তাই বলে তাদের সকলকে ধরেই কি ভূতে ঠ্যাঙায় নাকি ?
আমি এবারে মনে ভীষণ ব্যথা পেলুম। এত কষ্টে-সৃষ্টে যদিই বা গালে একটা ভুতুড়ে চড় খেয়েছি, কিন্তু এই হতভাগারা কিছুতেই বিশ্বাস করছে না। ওরা নিজেরা খেতে পায়নি কিনা, তাই বোধহয় ওদের মনে হিংসে হয়েছে।
আমি উত্তেজিত হয়ে বললুম, কেন বিশ্বাস করছ না বলো তো ? তোমরা তো গুটি-গুটি সামনে এগিয়ে গেলে । এর মধ্যে গোটাকয়েক বৈঁচি-টৈচি খেয়ে আমি দেখলুম, ঝোপের মধ্যে একটা কাঠবেড়ালির ল্যাজ নড়ছে। যেই সেটাকে খপ করে চেপে ধরেছি, অমনি—
—অমনি কাঠবেড়ালি তোকে চড় মেরেছে ?—বলেই টেনিদা হা-হা করে হাসতে লাগল। আবার ক্যাবলার নাক-মুখ দিয়ে শেয়ালের ঝগড়ার মতো খিকখিক করে কেমন একটা আওয়াজ বেরোতে শুরু করল।
এই দারুণ অপমানে আমার পেটের মধ্যে পালাজ্বরের পিলেটা নাচতে লাগল। আর সেই সঙ্গেই হঠাৎ নিজের ডানহাতের দিকে আমার চোখ পড়ল । আমার মুঠোর মধ্যে— একরাশ শাদা শাদা রোঁয়া । সেই ল্যাজটারই খানিক ছিড়ে এসেছে নিশ্চয় । সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়ে বললাম, এই দ্যাখো, এখনও কী লেগে রয়েছে আমার হাতে !
ক্যাবলা এক লাফে এগিয়ে এল সামনে । টেনিদা থাবা দিয়ে রোঁয়াগুলো তুলে নিলে আমার হাত থেকে ।
তারপর টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল : এ যে—এ যে—
ক্যাবলা আরও জোরে চেঁচিয়ে বললে, দাড়ি ।
টেনিদা বললে, পাকা দাড়ি ।
ক্যাবলা বললে, তাতে আবার পাটকিলে রঙ । তামাক-খাওয়া দাড়ি ।
টেনিদা বললে, ভূতের দাড়ি ।
ক্যাবলা বললে, তামাকখেকো ভূতের দাড়ি !
ভূতের দাড়ি ! শুনে আর একবার আমার হাত-পা পেটের মধ্যে সেধিয়ে যাওয়ার জো হল। কী সর্বনাশ–করেছি কী ! শেষে কি কাঠবেড়ালির ল্যাজ টানতে গিয়ে ভূতের দাড়ি ছিড়ে এনেছি ? তাই অমন একখানা মোক্ষম চড় বসিয়েছে আমার গালে । কিন্তু একখানা চড়ের ওপর দিয়েই কি আমি পার পাব ? হয়তো কত যত্বের দাড়ি, কত রাত-বিরেতে শ্যাওড়া গাছে বসে ওই দাড়ি চুমরে চুমরে ভূতটা খাম্বাজ-রাগিণী গাইত। অবশ্য খাম্বাজ রাগিণী কাকে বলে আমার জানা নেই, তবে নাম শুনলেই মনে হয়, ও-সব রাগ-রাগিণী ভূতের গলাতেই খোলতাই হয় ভালো । —আমি সেই সাধের দাড়ি ছিড়ে নিয়েছি, এখন মাঝরাতে এসে আমার মাথার চুলগুলো উপড়ে নিয়ে না যায় । ক্যাবলা আর টেনিদা দাড়ি নিয়ে গবেষণা করুক—আমি হাত-পা ছেড়ে আবার বিছানার ওপর ধপাস করে শুয়ে পড়লুম।
ক্যাবলা দাড়িগুলো বেশ মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে বললে, কিন্তু টেনিদা—ভূতে কি তামাক খায় ?
—কেন, খেতে দোষ কী ?
—মানে ইয়ে কথা হল—ক্যাবলা মাথা চুলকে বললে, লেকিন বাত এহি হ্যায়, ভূতে তো শুনেছি আগুন-টাগুন ছুতে পারে না—তাহলে তামাক খায় কী করে ? তা ছাড়া আমার মনে হচ্ছে—এমনি পাকা, এমনি পাটকিলে-রঙ-মাখানো দাড়ি যেন আমার চেনা, যেন এ-দাড়িটা কোথায় আমি দেখেছি—
ক্যাবলা আরও কী বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ দু-পাটি জুতো হাতে করে ঘরের মধ্যে ঝাঁটু এসে ঢুকল। টেনিদার মুখের সামনে জুতোজোড়া তুলে ধরে বললে, এই দেখুন দাদাবাবু—
টেনিদা চেঁচিয়ে উঠে বললে, ব্যাটা কোথাকার গাঁড়ল রে । বলা হল প্যালার খাওয়ার জন্য দুধ আনতে, তুই আমার মুখের কাছে জুতোজোড়া এনে হাজির করল ? আমি কি ও-দুটাে চিবোব নাকি বসে বসে ?
ঝাঁটু বললে, রাম-রাম । জুতো তো কুত্তা চিবোবে, আপনি কেন ? আমি বলছিলাম, হাবুলবাবু কুথা গেল ! জুতোটা বাহিরে পড়েছিল, হাবুলবাবুকে তো কোথাও দেখলম না। ফির জুতোর মধ্যে একটা চিঠি দেখলম, তাই নিয়ে এলম।
জুতোর মধ্যে চিঠি ? আরে, তাই তো বটে। আমি জ্ঞান হওয়ার পরে তো সত্যিই এ-ঘরে হাবুল সেনকে দেখতে পাইনি ।
ক্যাবলা বললে,তাই তো । জুতোর ভেতরে চিঠির মতো একটা কী রয়েছে যে । ব্যাপার কী, টেনিদা ? হাবুলটাই বা গেল কোথায় ?
টেনিদা ভাঁজ-করা কাগজটা টেনে বের করে বললে, দাঁড়া না কাঁচকলা, আগে দেখি চিঠিটা ।
কিন্তু চিঠির ওপর চোখ বুলোতেই—সে দুটাে তড়াক করে একেবারে টেনিদার কপালে চড়ে গেল । বার-তিনেক খাবি খেয়ে টেনিদা বললে, ক্যাবলা রে, আমাদের বারোটা বেজে গেল ।
—বারোটা বেজে গেল ! মানে ?
—মানে—হাবুল ‘গন । ,
—কোথায় ‘গন ?—আমি আর ক্যাবলা একসঙ্গেই চেঁচিয়ে উঠলাম : চিঠিতে কী আছে টেনিদা ? কী লেখা ওতে ?
ভাঙা গলায় টেনিদা বললে, তবে শোন, পড়ি ।
চিঠিতে খেলা ছিল :
'হাবুল সেনকে আমরা ভ্যানিশ করিলাম। যদি পত্রপাঠ চাঁটি-বাঁটি তুলিয়া আজই কলিকাতায় রওনা হও, তবে যাওয়ার আগে অক্ষত শরীরে হাবুলকে ফেরত পাইবে । নতুবা পরে তোমাদের চার মূর্তিকেই আমরা ভ্যানিশ করিব—এবং চিরতরেই তাহা করিব। আগে হইতেই সাবধান করিয়া দিলাম, পরে দোষ দিতে পারিবে না ।
ইতি—ঘচাং ফুঃ । দুর্ধর্ষ চৈনিক দস্যু।’
নিস্যু কচাং কুঃ
টেনিদা ধপাস করে মেঝের ওপর বসে পড়ল । ওর নাকের সামনে অনেকক্ষণ ধরে একটা পাহাড়ি মৌমাছি উড়ছিল, অত বড় নাকটা দেখে বোধহয় ভেবেছিল, ওখানে একটা জুতসই চাক বাঁধা যায়। হঠাৎ টেনিদার নাক থেকে ঘড়াৎ-ঘড় করে এমনি একটা আওয়াজ বেরুল যে—সেটা ঘাবড়ে গিয়ে হাত তিনেক দূরে ঠিকরে পড়ল ।
লিডারের অবস্থা তখন সঙিন । করুণ গলায় বললে, ওরে বাবা—গেলুম। শেষকালে কিনা চীনে দস্যুর পাল্লায় ! এর চেয়ে যে ভূতও অনেক ভালো ছিল ।
আমাক হাত-পা গুলো তখন আমার পিলের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। বললুম, তার নাম আবার ঘচাং ফুঃ অথাৎ ঘচাং করে গলা কেটে দেয়. তারপর ফুঃ করে উড়িয়ে দেয় ।
ঝাঁটু মিটমিট করে তাকাচ্ছিল। আমাদের অবস্থা দেখে আশ্চর্য হয়ে বললে, বেপার কী বটেক দাদাবাবু?
ক্যাবলা বললে, বেপার? বেপার সাঙ্ঘাতিক। হাঁ রে ঝাঁটু, এখানে ডাকাত-ফাকাত আছে?
—ডাকাত ?—ঝাঁটু বললে, ডাকাত ফির ইখানে কেনে মরতে আসবেক ? ই তল্লাটে উসব নাই ।
—নাঃ, নেই —মুখখানাকে কচু-ঘণ্টর মতো করে টেনিদা খেঁকিয়ে উঠল ; তবে ঘচাং ফুঃ কোত্থেকে এল ? তাও আবার যে-সে নয়—একেবারে দুর্ধর্ষ চৈনিক দস্যু !
ক্যাবলা কী পাখোয়াজ ছেলে । কিছুতেই ঘাবড়ায় না । বললে, আরে দুৰ্ত্তোর—রেখে দাও ওসব ? দেখলে তো, তা হলে কিছু নয়, সব ধাপ্পা! ঘচাং ফুর তো আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই—এই হাজারিবাগের পাহাড়ি বাংলোয় এসে ভ্যারেন্ডা ভাজবে । আসলে ব্যাপার কী জানো ? স্রেফ বাংলা ডিটেকটিভ উপন্যাস ।
—বাংলা ডিটেকটিভ উপন্যাস !—টেনিদা চোয়াল চুলকোতে চুলকোতে বললে ; মানে ?
—মানে ? মানে আবার কী ? ওই এনতার সব গোয়েন্দা গল্প—যে-সব গল্পের পুকুরে সাবমেরিন ভাসায়, আর যাতে করে বাঙালী গোয়েন্দা দুনিয়ার সব অসাধ্য সাধন করে—সেই সমস্ত বই পড়ে এদের মাথায় এগুলো ঢুকেছে। আমার বড়মামা লালবাজারে চাকরি করে, তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলুম—এই গোয়েন্দারা কোথায় থাকে। বড়মামা রেগে গিয়ে যাচ্ছেতাই করে বললে, কী একটা কলকেতে থাকে।
—চুলোয় যাক গোয়েন্দা । টেনিদা বিরক্ত হয়ে বললে, তার সঙ্গে ঘচাং ফুর সম্পর্ক কী?
—আছে—আছে ! ক্যাবলা সবজাস্তার মতো বললে, যারা এই চিঠি লিখেছে, তারা গোয়েন্দা-গল্প পড়ে। পড়ে-পড়ে আমাদের ওপরে একখানা চালিয়াতি খেলেছে।
–কিন্তু এ-রকম চালিয়াতি করার মানে কী ? আমাদের এখান থেকে তাড়াতেই বা চায় কেন ? আর হাবুল সেনকেই বা কোথায় নিয়ে গেল ? :
ক্যাবলা বললে, সেইটেই তো রহস্য ! সেটা ভেদ করতে হবে । কতকগুলো পাজি লোক নিশ্চয়ই আছে—আর কাছাকাছিই কোথাও আছে। কিন্তু এই চিঠিটা দিয়ে এরা মস্ত উপকার করেছে টেনিদা !
—উপকার ?—টেনিদা বললে, কিসের উপকার ?
—একটা জিনিস তো পরিষ্কার বোঝা গেল, জিন-টিন এখানে কিছু নেই—ও-সব একদম ভোঁ-কাট্টা । কতকগুলো ছ্যাঁচড়া লোক কোথাও লুকিয়ে রয়েছে—এ-বাড়িটায় তাদের দরকার। আমরা এসে পড়ায় তাদের অসুবিধে হয়েছে—তাই আমাদের তাড়াতে চায় ।
—ক্যাবলা বুক টান করে বললে, কিন্তু আমরা পটলডাঙার ছেলে হয়ে একদল ছিচকে লোকের ভয়ে পালাব টেনিদা ? ওদের টাকের ওপরে টেক্কা মেরে জানিয়ে দিয়ে যাব, ওরা যদি ঘচাং ফুঃ হয়—তা হলে আমরা হচ্ছি কচাং কুঃ !
—কচাং কুঃ —আমি বললুম, সে আবার কী ?
ক্যাবলা বললে, বাঘা চৈনিক দস্যু ! দুধর্ষের ওপর আর-এক কাঠি।
আমি ব্যাজার হয়ে বললুম, আমরা আবার চীনে হলুম কবে ? দস্যুই বা হতে যাব কোন দুঃখে ?
ক্যাবলা বললে, ওরা যদি চৈনিক হয়—আমাদেরই বা হতে দোষ কী ? আমরাও ঘোরতর চৈনিক। ওরা যদি দস্যু হয়—আমরা নস্যু ! -
—নস্যু! —টেনিদার নাক-বরাবর আবার সেই মৌমাছিটা ফিরে আসছিল, সেটাকে তাড়াতে তাড়াতে টেনিদা বললে, নস্যু। কাকে বলে ?
—মানে, দস্যুদের যারা নস্যির মতো নাক দিয়ে টেনে ফেলে, তারাই হল নস্যু। টেনিদা উঠে দাঁড়িয়ে বললে, দ্যাখ ক্যাবলা, সব জিনিস নিয়ে ইয়ার্কি নয় ! যদি সত্যিই ওরা ডাকাত-টাকাত হয়—
ডাকাত হলে অনেক আগেই ওদের মুরোদ বোঝা যেত। বসে-বসে ঝোপের মধ্যে চীনেবাদাম খেত না, কিংবা কাগজে জড়িয়ে মড়ার মাথা ছুড়ত না । ওরাও এক নম্বর কাওয়ার্ড !
—তা হলে হাবুল সেনকে নিয়ে গেল কী করে ?
—নিশ্চয়ই কোনও কায়দা করেছে । কিন্তু সে-কায়দাটা সমঝে ফেলতে বহুত সময় লাগবে না । টেনিদা—
—কী?
—আর দেরি নয় । রেডি ?
টেনিদা বললে, কিসের রেডি ?
—ঘচাং ফুঃ-দের কচাং কুঃ করতে হবে । আজই, এক্ষুনি ।
টেনিদা তখনও সাহস পাচ্ছিল না। কুঁকড়ে গিয়ে বললে, সে কী করে হবে ?
—হয়ে যাবে একরকম । এই বাংলোর কাছাকাছিই ওদের কোনও গোপন আস্তানা আছে । হানা দিতে হবে সেখানে গিয়ে ।
—ওরা যদি পিস্তল-টিস্তল ছোঁড়ে ?
—আমরা ইট ছুঁড়ব!
—ক্যাবলা ভেংচি কেটে বললে, রেখে দাও পিস্তল ! গোয়েন্দা-গল্পে ওসব কথায়-কথায় বেরিয়ে আসে, আসলে পিস্তল অত সস্তা নয়। হ্যাঁ—গোটাকয়েক লাঠি দরকার। এই ঝাঁটু—লাঠি আছে রে ?
ঝাঁটু চুপচাপ সব শুনছিল। কী বুঝছিল কে জানে, মাথা নেড়ে বললে, দুটো আছে। একটো বল্লমও আছে।
—তবে নিয়ে আয় চটপট ।
—লাঠি-বল্লমে কী হবেক দাদাবাবু?—ঝাঁটুর বিস্মিত জিজ্ঞাসা ।
—শেয়াল মারা হবেক ।
—শেয়াল মারা ? কেনে ? মাংস খাবেন ?
—অত খবরে তোর দরকার কী ? —ক্যাবলা রেগে বললে, যা বলছি তোকে তাই কর । শিগগির নিয়ে আয় ওগুলো । চটপট ।
ঝাঁটু লাঠি বল্লম আনতে গেল। টেনিদা শুকনো গলায় বললে, কিন্তু ক্যাবলা, এ বোধহয় ভালো হচ্ছে না। যদি সত্যিই বিপদ-আপদ হয়—
ক্যাবলা নাক কুঁচকে বললে, অঃ—তুমহারা ডর লাগ গিয়া ? বেশ, তুমি তা হলে বাংলোয় বসে থাকো। আমি তো যাবই—এমনকি পালাজ্বরে-ভোগা এই প্যালাটাও আমার সঙ্গে যাবে । দেখবে, তোমার চাইতে ওরও বেশি সাহস আছে ।
শুনে আমার বুক ফুলে উঠল বটে, কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে পালাজ্বরের পিলেটাও নড়-নড় করে উঠল—আমাকেও যেতে হবে । বেশ, তাই যাব । একবার ছাড়া তো দুবার মরব না।
আর আমি মারা গেলে—হ্যাঁ, মা কাঁদবে, পিসিমা কাঁদবে, বোধহয় সেকেন্ডারি বোর্ডও কাঁদবে—কারণ, বছর-বছর স্কুল-ফাইনালের ফি দেবে কে ? আর বৈঠকখানা বাজারে দৈনিক আধপো পটোল আর চারটে শিঙিমাছ কম বিক্রি হবে—এক ছটাক বাসকপাতা বেঁচে যাবে রোজ । তা যাক ! এমন বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগের জন্যে সংসারের একটু-আধটু ক্ষতি নয় হলই বা !
টেনিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, চল,—তবে যাই । কিন্তু প্যালার সেই দাড়িটা—
বললুম, তামাকখেকো দাড়ি ।
ক্যাবলা বললে, ঠিক । মনেই ছিল না। ওই দাড়ি থেকেই আরও প্রমাণ হয়—ওরা চৈনিক নয়। কলকাতায় তো এত চীনা মানুষ আছে—কারও দাড়ি দেখেছ কখনও ?
তাই তো ! দাড়িওলা চীনা মানুষ ! না, আমরা কেউ তো দেখিনি। কখনও না ।
এর মধ্যে ঝাঁটু লাঠি আর বল্লম এনে ফেলেছে। বল্লমটা ঝাঁটুই নিলে, একটা লাঠি নিলে ক্যাবলা—আর-একটা টেনিদা। আমি আর কী নিই ? হাতের কাছে একটা চালাকাঠ পড়েছিল, সেইটেই কুড়িয়ে নিলুম। যদি মরতেই হয়, তবু তো এক ঘা বসাতে পারব ।
অতঃপর ঘচাং ফুঃ দস্যুর দলকে একহাত নেবার জন্যে দস্যু কচাং কুর দল আবার রওনা হল বীরদর্পে। আবার সেই বুনো রাস্তা। আমরা ঝোপ-ঝাপ ঠেঙিয়ে-ঠেঙিয়ে দেখছিলুম, কোথাও সেই তামাকখেকো লুকিয়ে আছে কি না ।
কিন্তু আবার আমি বিপদে পড়ে গেলুম। এবার বৈঁচি নয়—কামরাঙা । বাংলোর ঠিক পেছন দিয়ে আমরা চলেছি। আমি যথানিয়মে পিছিয়ে পড়েছি—আর ঠিক আমারই চোখে পড়েছে কামরাঙার গাছটা । আঃ, ফলে-ফলে একেবারে আলো হয়ে রয়েছে ।
নোলায় প্রায় সেরটাক জল এসে গেল। জ্বরে ভুগে-ভুগে টক খাবার জন্যে প্রাণ ছটফট করে। ঘচাং ফুঃ-টুঃ সব ভুলে গিয়ে গুটি-গুটি গেলুম কামরাঙা গাছের দিকে। কলকাতায় এ সব কিছুই খেতে পাই না—চোখের সামনে অমন খোলতাই কামরাঙার বাহার দেখলে কার আর মাথা ঠিক থাকে !
যেই গাছতলায় পা দিয়েছি— সঙ্গে-সঙ্গেই—ইঃ ! একতাল গোবরে পা পড়ল—আর তক্ষুনি এক আছাড় । কিন্তু এ কী ! আছাড় খেয়ে আমি তো মাটিতে পড়লুম না । আমি যে মহাশূন্যের মধ্যে দিয়ে পাতালে চলেছি। কিন্তু পাতালেও নয়। আমি একেবারে সোজা কার মস্ত একটা ঘাড়ের ওপর অবতীর্ণ হলুম। আঁই দাদা রে— বলে সে আমাকে নিয়ে একেবারে পপাত।
আমি আর-একবার অজ্ঞান ।