কে তুমি হাস্যময়?
বাকি রাতটা যে আমাদের কী ভাবে কাটল, সে আর খুলে না বললেও চলে। টেনিদা আর হাবুল সেনের কী হল জানি না—আমি তো প্রায় অজ্ঞান । তার মধ্যেই মনে হচ্ছিল, দুটাে তালগাছের মতো পেল্লায় ভূত আমাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাচ্ছে। একজন যেন বলছে : এটাকে কালিয়া রান্না করে খাব, আর-একজন বলছে ; দূর—দুর । এটা একেবারে শুটকো চামচিকের মতো—গায়ে একরত্তি মাংস নেই ! বরং এটাকে তেজপাতার মতো ডাল সম্বরা দেওয়া যেতে পারে ।
আমি বোধহয় ভেউ-ভেউ করে কাঁদছিলুম, হঠাৎ তিড়িক করে লাফিয়ে উঠতে হল । মুখের ওপর কে যেন আঁজলা-আঁজলা করে জল দিচ্ছে। আর, কী ঠাণ্ডা সে জল ! বাঘের নাকে সে জল ছিটিয়ে দিলে বাঘ-সুদ্ধ অজ্ঞান হয়ে পড়বে।
বাঘ অজ্ঞান হোক—কিন্তু আমার জ্ঞান ফিরে এল, মানে, আসতেই হল তাকে।
আর কে ? ক্যাবলা । করেছে কী—বাগানে জল দেবার একটা ঝাঁঝরি নিয়ে এসেছে, তাই দিয়ে আমাকে স্রেফ চান করিয়ে দিচ্ছে ।
—ওরে থাম থাম—-
ক্যাবলা কি থামে ! আমার মুখের ওপর আবার একরাশ জল ছিটিয়ে দিয়ে বললে, কী রে, মাথা ঠাণ্ডা হয়েছে তো ? -
—ঠাণ্ডা মানে ? সারা গা ঠাণ্ডা হবার জো হল—আমি তড়াক করে ঝাঁঝরির আক্রমণ থেকে পাশ কাটালুম।
কাচের জানালা দিয়ে বাইরের ভোরের আলো দেখা যাচ্ছে । ঝন্টিপাহাড়ির ডাক-বাংলোয় একটা দুঃস্বপ্নের রাত শেষ হয়ে গেছে। সামনে লেকের নীল জলটার ওপর ভোরের লালচে রং । পাখির মিষ্টি ডাক শুরু হয়েছে চারদিকে—শিশিরে ভেজা শাল-পলাশের বন যেন ছবির মতো দেখাচ্ছে ।
কোঁচার খুঁটে মুখটা মুছতে মুছতে আমার মনে হল, এমন সুন্দর জায়গায় এমন বিচ্ছিরি ভূতের ব্যাপার না থাকলে দুনিয়ায় কার কী ক্ষতি হত !
আমি তো এ-সব ভাবছি, ওদিকে ক্যাবলার ঝাঁঝরি সমানে কাজ করে চলেছে । খানিক পরে হাই-মই কাই-কাঁই আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখি, ঝাঁঝরির আক্রমণে জর্জরিত হয়ে খাটের তলা থেকে বেরিয়ে আসছে টেনিদা আর হাবুল ।
ক্যাবলা হেসে বললে, তোমাদের জ্ঞান ফিরিয়ে আনবার জন্যে কেমন দাওয়াইটি বের করেছি ! দেখলে তো !
টেনিদা গাঁক-গাঁক করে বললে, থাক, বকিসনি । আমরা অজ্ঞান হয়েছিলাম কে বললে তোকে ? দুজনে চুপি চুপি প্ল্যান আটছিলুম, আর তুই রাস্কেল ঠাণ্ডা জল দিয়ে—
বলেই টেনিদা ফ্যাঁচ করে হেঁচে ফেললে । বললে, ইঃ গেছি—গেছি ! এই শীতের সকালে যেভাবে নাইয়ে দিয়েছিস, তাতে এখন ডবল-নিউমোনিয়া না হলে বাঁচি !
ঝন্টুরামকে জিজ্ঞেস করে কোনও হদিশ পাওয়া গেল না । সে ডাক-বাংলোয় থাকে না। এখান থেকে মাইলখানেক দূরে তার বাড়ি। আমাদের খাইয়ে-দাইয়ে নিজের বাড়িতে চলে গিয়েছিল । সকালবেলায় এসেছে।
টেনিদা বললে, ওটা কোনও কম্মের নয়—একেবারে গাঁড়ল ।
হাবুল সেন মাথা চুলকে বললে, ও নিজেই ভূত কি না সেই কথাটাই বা কেডা কইব ? চেহারাখানা দেখতে আছ না ? যান তালগাছের থন নাইম্যা আসছে ।
আমি আঁতকে উঠলাম ; সত্যিই কি ভূত নাকি ?
টেনিদা বললে, তোরা দুটােই হচ্ছিস্ গোভূত । জানিসনে, ভূত আগুন দেখলেই পালায় ? ও ব্যাটা নিজে উনুন ধরিয়ে চা করে দিলে, রাত্তিরে ওর রান্না মুরগির ঝোল আর ভাত দু-হাতে সাঁটলি, সে-কথা মনে নেই বুঝি ?
আমরা আর সাঁটতে পেরেছি কই—মুরগির দু-এক টুকরো হাড় কেবল চুষতে পেরেছি, বাকি সবটাই টেনিদার পেটে গেছে। কিন্তু এখন আর সে-কথা বলে কী হবে ।
আমি বললুম, ঝন্টুরাম ভূত হোক আর না-ই হোক, তাতে কিছু আসে যায় না। সোজা কথা হচ্ছে, পটল যদি তুলতেই হয়, তাহলে পটলডাঙাতে গিয়েই তুলব। এখানে ভূতের হাতে মরতে আমি রাজি নই। আমি আজকেই কলকাতায় ফিরে যাব।
হাবুল উৎসাহিত হয়ে বললে, হ–হ, আমিও সেই কথাই কইতে আছিলাম ।
টেনিদা খাঁড়ার মতো নাকটা চুলকোতে লাগল।
আমি বললুম, তোমাদের ইচ্ছে হয় থাক। ভূতেরা ধরে ধরে তোমাদের হাঁড়ি-কাবাব করে খাক—কাটলেট বানাক, রোস্ট করে ফেলুক—আমার কিছুই আপত্তি নেই।
আজই আমি পালাব ।
টেনিদা বললে, তাই তো ! কিন্তু জায়গাটা খাসা—বেশ প্রেমসে খাওয়া-দাওয়াও করা যাচ্ছিল, কিন্তু ভূতগুলোই সব মাটি করে দিলে !
হাবুল মাথা নেড়ে বললে, হ, সইত্য কথা। এখানে জঙ্গলের মধ্যে থাইকা ভূতগুলানে কী যে সুখ হয়—তাও তো বুঝি না। আমাগো কইলকাতায় গিয়া বাসা করত, থাকতও ভালো, আমরাও ছুটি পাইতাম । আর যদি বাইছা বাইছা হেড পণ্ডিতের ঘাড়ে উইঠা বসত, তাহলে আমাগো আর শব্দরূপ মুখস্থ করতে হইত না !
—সে তো বেশ ভালো কথা, কিন্তু ভূতগুলোকে সে-কথা বোঝায় কে!
টেনিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলল : যেতে চাস তো চল । কিন্তু সত্যি, ভারি মায়া লাগছে রে । এমন আরাম, এমন খাওয়া-দাওয়া, ঝণ্টেটা আবার রুটির সঙ্গে কতটা করে মাখন দিয়েছিল—দেখেছিস তো ? এখানে দিনকয়েক থাকলে আমরা লাল হয়ে যেতুম ।
আমি বললাম, তার আগে ভূতেরাই লাল হয়ে যাবে। টেনিদা সামনে থেকে একটা প্লেট তুলে নিয়ে তার তলায় লেগে-থাকা একটুখানি মাখন চট করে চেটে নিলে । তারপরের আর একটা বুক-ভাঙা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।
—তা হলে আজই ?
আমি আর হাবুল সমস্বরে বললাম, হ্যাঁ—হ্যাঁ, আজই।
ক্যাবলার কথা এতক্ষণ আমাদের মনেই ছিল না । সেই যে ভোরবেলা ঝাঁঝরি-দাওয়াই দিয়ে আমাদের জ্ঞান ফিরিয়েছে, তারপর আর তার পাত্তা নেই । কোথায় গেল ক্যাবলা ?
আমি বললাম, ক্যাবলা গেল কোথায় ?
টেনিদা চমকে বললে, তাই তো ! সকাল থেকে তো ক্যাবলাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না !
হাবুল সেন জানতে চাইল ; ভূতের সঙ্গে মস্করা করতে আছিল, ভূতে তারে লইয়া যায় নাই তো ?
টেনিদা মুখ-টুক কুঁচকে বললে, বয়ে গেছে ভূতের । ওটা যা অখাদ্য—ওকে ভূতেও হজম করতে পারবে না । কিন্তু গেল কোথায় ? আমাদের ফেলেই চম্পট দিলে না তো ?
ঠিক এই সময় হঠাৎ বাজখাঁই গলায় গান উঠল :
ছপ্লর পর কেীয়া নাচে, নাচে বগুলা—
আরে রামা হো—হে রামা—
গানটা এমন বেখাপ্পা যে আমি চেয়ারসুদ্ধ উলটে পড়তে পড়তে সামলে গেলুম। এ আবার কী রে বাবা! দিন-দুপুরে এসে হানা দিলে নাকি। কিন্তু ভূতে রাম নাম করতে যাবে কোন দুঃখে ?
ভূত নয়—ক্যাবলা । কোত্থেকে একগাল হাসি নিয়ে বারান্দায় উঠে পড়ল ।
—গিয়েছিলি কোথায় ? অমন ষাঁড়ের মতো চেচাচ্ছিসই বা কেন ?—টেনিদা জানতে চাইলে ।
—বলছি—ক্যাবলা করুণ চোখে সামনের পেয়ালা-পরিচগুলোর দিকে তাকাল : এর মধ্যেই ব্রেকফাস্ট শেষ ? আমার জন্যেই কিছু নেই বুঝি ?
—সে আমরা জানিনে, ঝন্টুরাম বলতে পারে --টেনিদা বললে, ব্রেকফাস্ট পরে করবি, কোথায় গিয়েছিলি তাই বল ।
ক্যাবলা মিটমিট করে হেসে বলল, ভূতের খোঁজে গিয়েছিলুম। ভূত পাওয়া গেল না—পাওয়া গেল একঠোঙা চীনেবাদাম ।
—চীনেবাদাম ।
ক্যাবলা বললে, তাতে অর্ধেক খোসা, অর্ধেক বাদাম । মানে অর্ধেকটা খাওয়ার পরে আর সময় পায়নি।
—কে সময় পায়নি ? —আমি বেকুবের মতো জিজ্ঞস করলুম।
—জানালার ও ধারে ঝোপের ভেতরে বসে যারা মড়ার মাথা ছুড়েছিল, তারাই। যদি ভূতও হয়—তাহলে কিন্তু বেশ মডার্ন ভূত, টেনিদা ! মানে–বাদাম খায়, মুড়ি খায়, তেলেভাজাও খায়। তেলেভাজার শালপাতা আর মুড়িও পাওয়া গেল কিনা !
টেনিদা বললে, তার মানে— ক্যাবলা বললে, তার মানে হল, এ সব কোনও বদমাস আদমি কা কারসাজি ! তারাই রাত্তিরে অমনি করে যাচ্ছেতাই রকম হেসেছে, ঘরের ভেতরে মড়ার মাথা ফেলেছে—অথাৎ আমাদের তাড়ানোর মতলব । তুমি পটলডাঙার টেনিদা—গড়ের মাঠে গোরা পিটিয়ে চ্যাম্পিয়ন—তুমি এ-সব বদমায়েসদের ভয়ে পালাবে এখান থেকে !
—ঠিক জানিস ? ভূত নয় ?
—ঠিক জানি । —ক্যাবলা বললে, ভূতে তেলেভাজা আর চীনেবাদাম খায়, এ-কথা কে কবে শুনেছে? তার ওপর তারা বিড়িও খেয়েছে। দু-চারটে পোড়া বিড়ির টুকরোও ছিল ।
—তা হলে বদমাস লোক –পটলডাঙার টেনিদা হঠাৎ বুক ঠুকে সোজা দাঁড়িয়ে পড়ল ; মানুষ যদি হয়, তবে বাবাজীদের এবার ঘুঘু আর ফাঁদ দুই-ই দেখিয়ে ছাড়ব । চলে আয় সব—কুইক মার্চ—
বলে এমনিভাবে আমাকে একটা হ্যাঁচকা টান মারল যে আমি ছিটকে সামনের মেঝেয় গিয়ে পড়লুম।
হাবুল সেন প্যাঁচার মতো ব্যাজার মুখে বললে, কোথায় যেতে হবে?
—লোকগুলোর সঙ্গে একবার মোলাকাত করতে । আমরা কলকাতার ছেলে—আমাদের বক দেখিয়ে কেটে পড়বে— ইয়ার্কি নাকি ! চল-চল, ভালো করে একবার চারদিকটা ঘুরে দেখি।
ক্যাবলা বললে, কিন্তু আমার ব্রেকফাস্ট—
—সেটা একেবারে লাঞ্চের সময়েই হবে । নে—চল—
হাবুল আর ক্যাবলা উঠে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল স্পষ্ট দিনের আলোয়—সেই বেলা আটটার সময়—ঠিক আমাদের মাথার ওপর কে যেন কর্কশ গলায় বলে উঠল । বাঃ—বেশ, বেশ !
তারপরেই হা-হা করে ঠাট্টার অট্টহাসি । .
কে বললে, কে হাসল ? কেউ না। মাথার ওপরে টালির চাল আর লাল ইটের ফাঁকা দেওয়াল—জন-মানুষের চিহ্নও নেই কোথাও । যেন হাওয়ার মধ্যে থেকে ভেসে এসেছে আশ্চর্য শব্দগুলো ।