ঝন্টিপাহাড়ির ঝন্টুরা
পথে আর বিশেষ কিছু ঘটেনি। গজেশ্বরের সেই আছাড়-খাওয়া নিয়ে খুব হাসাহসি করলুম আমরা । অত বড় হাতির মতো লোকটা পড়ে গেল একেবারে ঘটোৎকচের মতো ! তবে আমাদের ওপর চেপে পড়লে কী যে হত, সেইটেই ভাববার কথা ।
হাউল বললে, আর একটু হইলেই প্রায় উইঠ্যা পড়ছিল গাড়িতে। মাইর্যা আমাগো ছাতু কইর্যা দিত!
টেনিদা নাক-টাক কুঁচকে হাবলাকে ভেংচে বললে, হঃ–হঃ—ছাতু কইর্যা দিত । বললেই হল আর-কি ! আমিও পটলডাঙার টেনি মুখুজ্যে—অ্যায়স্যা একখানা জুজুৎসু হাঁকড়ে দিতুম যে মুরি তো মুরি–বাছাধন একেবারে মুড়ি হয়ে যেত ! চ্যাপটাও হতে পারত চিড়ের মতো !
শুনে ক্যাবলা খিকখিক করে হাসল।
—অ্যাই ক্যাবলা, হাসছিস যে ? টেনিদার সিংহনাদ শোনা গেল ।
ক্যাবলা কী ঘুঘু ! সঙ্গে সঙ্গেই বললে, আমি হাসিনি তো—প্যালা হাসছে !
—প্যালা— !
বা—আমি হাসতে যাব কেন ? যোগসর্পের হাঁড়ির লেডিকেনি খেয়ে সেই তখন থেকে আমার পেট কামড়াচ্ছে। আমার পেটেও গোটাকয়েক ডেয়ো পিঁপড়ে ঢুকেছে কিনা কে জানে ! মুখ ব্যাজার করে বললাম, আমি হাসব কেন—কী দায় পড়েছে আমার হাসতে !
টেনিদা বললে, খবরদার—মনে থাকে যেন ! খামকা যদি হাসবি তাহলে তোর ওই মূল্যের মতো দাঁতগুলো পটাপট উপড়ে দেব !—ইস-স, ব্যাটা গজেশ্বর বড় বেঁচে গেল ! একবার ট্রেনে উঠে এলেই বুঝতে পারত পটলডাঙার প্যাঁচ কাকে বলে। আবার যদি ওর সঙ্গে দেখা হয়—
কিন্তু সত্যিই যে দেখা হবে সে-কথা কে জানত! আর আমি, পটলডাঙার প্যালারাম, অন্তত সে-দেখা না হলেই খুশি হতুম।
ট্রেন একটু পরেই রামগড়ে পৌঁছল। ক্যাবলার মেসোমশাই বলে দিয়েছিলেন গোরুর গাড়ি চাপতে, কিন্তু কলকাতার ছেলে হয়ে আমরা গোরুর গাড়িতে চাপব ! ছোঃ—ছোঃ !
টেনিদা বললে, ছ-মাইল তো রাস্তা ! চল—হেঁটেই মেরে দিই—
আমি বললুম, সে তো বটেই—সে তো বটেই ! দিব্যি পাখির গান আর বনের ছায়া—
ক্যাবলা বললে, ফুলের গন্ধ আর দক্ষিণের বাতাস—
টেনিদা বললে, আর পথের ধারে পাকা পাকা আম আর কাঁঠাল ঝুলছে—
হাবুল সেন বললে, আর গাছের মালিক ঠাঙা নিয়া তাইড়া আসছে—
টেনিদা বিরক্ত হয়ে বললে, ইস, দিলে সব মাটি করে ! হচ্ছিল আম-কাঁঠালের কথা, মেজাজটা বেশ জমে এসেছিল—কোত্থেকে আবার ঠ্যাঙা-ফ্যাঙা এসে হাজির করলে ! এইজন্যেই তোদের মতো বেরসিকের সঙ্গে আসতে ইচ্ছে করে না ! নে, এখন পা চালা—
সুটকেস কাঁধে, বিছানা ঘাড়ে আমরা হাঁটতে শুরু করলুম।
কিন্তু বিকেলে গড়ের মাঠে বেড়ানো আর সুটকেস বিছানান নিযে ছ’-মাইল রান্তা পাড়ি দেওয়া যে এক কথা নয় সেটা বুঝতে বেশি দেরি হল না । আধ মাইল হাঁটতে না-হাঁটতে আমার পালাজ্বরের পিলে—টন-টন করে উঠল ।
—টেনিদা, একটু জিরিয়ে নিলে হয় না ?
টেনিদা তৎক্ষণাৎ রাজি ।
—তা মন্দ বলিসনি। খিদেটাও বেশ চাঙা হয়ে উঠেছে। একটু জল-টল খেয়ে নিলে হয়—কী বলিস ক্যাবলা ?—বলে টেনিদা ক্যাবলার সুটকেসের দিকে তাকাল । এর আগেই দেখে নিয়েছে, ক্যাবলার সুটকেসে নতুন বিস্কুটের টিন রয়েছে একটা ।
ক্যাবলা সঙ্গে সঙ্গেই সুটকেসটাকে বগলে চেপে ধরল। —জল-টল খাবে মানে ? এক্ষুনি তো রামগড় স্টেশনে গোটা-আষ্টেক সিঙ্গাড়া খেয়ে এলে ।
—তা খেয়েছি তো কী হয়েছে –একটানে ক্যাবলার বগল থেকে সুটকেসটা কেড়ে নিয়ে টেনিদা : ওই খেয়েই ছ-মাইল রাস্তা চলবে নাকি ! আমার বাবা খিদেটা একটু বেশি—সে তোমরা যাই বলো !
বলেই ধপ করে একটা গাছতলায় বসে পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গেই খুলে ফেলল সুটকেস । চাবি ছিল না—পত্রপাঠ বেরিয়ে এল টিনটা ।
একরাশ খাস্তা ক্রিম-ক্র্যাকার বিস্কুট । কী করি, আমরাও বসে পড়লুম। টেনিদা একই প্রায় সব-কটা সাবাড় করলে—আমরা ছিটে-ফোঁটার বেশি পেলুম না। শুধু ক্যাবলাই কিছু খেল না, হাঁড়ির মতো মুখ করে বসে রইল ।
ছ-মাইল রাস্তা—সোজা কথা নয়। হাবুল সেন দুখানা পাউরুটি রেখেছিল, এর পরে সেগুলোও গেল। কিন্তু টেনিদার খিদে আর মেটে না। রাস্তায় চিড়ে—মুড়ির দোকান দেখলেই বসে পড়ে আর হাঁক ছাড়ে ; দুআনা পয়সা বের কর, প্যালা—খিদেয় পেটটা ঝিম-ঝিম করছে !
মাইল-চারেক পেরুতেই পাহাড়ি পথ আরম্ভ হল। দু-ধারে শালের জঙ্গল, আর তার ভেতর দিয়ে রাঙামাটির পথ ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। খানিকটা হাঁটতেই গা ছম-ছম করতে লাগল ।
ক্যাবলা বলে বসল : টেনিদা—এ-সব জঙ্গলে বাঘ থাকে ।
টেনিদার মুখ শুকিয়ে গেল, বললে, যাঃ—যাঃ–
হাবুল বললে, শুনছি ভালুকও থাকে।
টেনিদা বললে, হুম্ !
বাঘ ভালুকের পরে আর কী আছে আমার মনে পড়ল না । আমি বললাম, বোধহয় হিপোপোটেমাসও থাকে ।
টেনিদা দাঁত খিচিয়ে উঠল : থাম থাম প্যালা, বেশি পাকামো করিসনি ! আমাকে ছাগল পেয়েছিস, না ? হিপোপোটেমাস তো জলহস্তী । জঙ্গলে থাকে কী করে ?
আমি বললুম, আচ্ছা যদি ভূত থাকে ?
টেনিদা রেগে বললে, তুই একটা গো-ভূত । ভূত এখানে কেন থাকবে শুনি ? মানুষই নেই, চাপবে কার ঘাড়ে ?
ক্যাবলা ফস করে বলে বসল ; যদি আমাদের ঘাড়েই চাপতে আসে ? আর তুমি তো আমাদের লিডার—যদি তোমার ঘাড়টাই ভূতের বেশ পছন্দ হয়ে যায় ?
টেনিদা সঙ্গে সঙ্গেই ধাঁ করে ডান হাতটা লম্বা করে বাড়িয়ে দিলে ক্যাবলার কান পাকড়ে ধরার জন্যে । তৎক্ষণাৎ পট করে সরে গেল ক্যাবলা, আর টেনিদা খানিকটা গোবরে পা দিয়ে একেবারে গজেশ্বরের মতো—
ধপাস—ধাই !
আনন্দে আমার হাততালি দিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু ঠিক তৎক্ষণাৎ— জঙ্গলের মধ্য থেকে হঠাৎ প্রায় ছ-হাত লম্বা একটা মূর্তি বেরিয়ে এল। প্যাকাটির মতো রোগা—মাথায় ঝাঁকড়া-ঝাঁকড়া চুল—কটকটে কালো গায়ের রঙ । বিকট মুখে তার উৎকট হাসি। ভূতের নাম করতে করতেই জঙ্গল থেকে সোজা বেরিয়ে এসেছে।
—বাবা গো—বলে আমিই প্রথম উর্ধ্বশ্বাসে ছুট লাগালুম। ক্যাবলা এক লাফে পাশের একটা গাছে উঠে পড়ল, টেনিদা উঠতে গিয়ে আবার গোবরের মধ্যে আছাড় খেল, আর হাবুল সেন দু-হাতে চোখ চেপে ধরে চ্যাঁচাতে লাগল ; ভূত—ভূত—রাম—রাম—
সেই মূর্তিটা বাজখাই গলায় হা-হা করে হেসে উঠল।
—খোঁকাবাবু আপনারা মিছাই ভয় পাচ্ছেন ! হামি হচ্ছি ঝণ্টিপাহাড়ির ঝন্টুরাম—বাবুর চিঠি পেয়ে আপনাদের আগ বাড়িয়ে নিতে এলাম। ভয় পাবেন না—ভয় পাবেন না—
আমি তখন আধ মাইল রাস্তা পার হয়ে গেছি—ক্যাবলা গাছের মগডালে । হাবুল সমানে বলে চলেছে ; ভূত আমার পুত, শাকচুন্নি আমার ঝি ! টেনিদা তখনও গোবরের মধ্যেই ঠায় বসে আছে। ভিরমিই গেছে কি না কে জানে ।
মূর্তিটা আবার বললে, কুছ ডর নেই খোঁকাবাবু, কুছ ডর নেই। আমি হচ্ছি ঝণ্টিপাহাড়ির ঝন্টুরাম—আপনাদের নোকর—