কলার খোসা
মুরি। মুরি জংশন।
ধড়মড়িয়ে জেগে উঠতেই দেখি, বাইরে আবছা সকাল। ক্যাবলা কখন উঠে বসে এক ভাঁড় চায়ে মন দিয়েছে। হাবুল সেন দুটাে হাই তুলে শোয়া অবস্থাতেই স্বামী ঘুটঘুটানন্দের দিকে জুলজুল করে তাকালে । কিন্তু স্বামীজীর নাক তখন বাজছে—গোঁ-গোঁ—আর টেনিদার নাক জবাব দিচ্ছে—ভোঁ-ভোঁ—অথাৎ হাঁড়িতে আর কিছুই নেই।
হঠাৎ ক্যাবলা টেনিদার পাঁজরায় একটা খোঁচা দিলে ।
—আই—আই ! কে সুড়িসুড়ি দিচ্ছে র্যা ?—বলে টেনিদা উঠে বসল।
ক্যাবলা বললে, গাড়ি যে মুরিতে প্রায় দশ মিনিট থেমে আছে! স্বামীজীকে জাগাবে না ?
টেনিদা একবার হাঁড়ি, আর একবার স্বামীজীর দিকে তাকাল । তারপর বললে, গাড়িটা ছাড়তে আর কত দেরি রে ?
—এখুনি ছাড়বে মনে হচ্ছে ।
—তা ছাড়ক। গাড়ি নড়লে তারপর স্বামীজীকে নড়াব। বুঝছিস না, এখন ওঠালে হাঁড়ির অবস্থা দেখে কি আর রক্ষা রাখবে? যা ষণ্ডামার্কা চেহারা-রসগোল্লার বদলে আমাদেরই জলযোগ করে ফেলবে । তার চেয়ে—
টেনিদা আরও কী বলতে যাচ্ছিল—ঠিক সেই মুহুর্তেই বাইরে থেকে বাজখাই গলায় বিটকেল হাঁক শোনা গেল : প্রভুজী,—কোন গাড়িতে আপনি যোগনিদ্রা দিচ্ছেন দেবতা ?
সে তো হাঁক নয়—যেন মেঘনাদ । সারা ইস্টিশন কেঁপে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গেই স্বামী ঘুটঘুটানন্দ তড়াক করে উঠে বসলেন ।
—প্রভুজী, জাগুন ! গাড়ি যে ছাড়ল—
অ্যাঁ ! এ যে আমারই শিষ্য গজেশ্বর —জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে স্বামীজী ডাকলেন : গজ—বৎস গজেশ্বর ! এই যে আমি এখানে ।
গাড়ির দরজা খটাৎ করে খুলে গেল। আর ভেতরে যে ঢুকল, তার চেহারা দেখেই আমি এক লাফে বাঙ্কে চেপে বসলুম। হাবুল আর টেনিদা সঙ্গে সঙ্গেই শুয়ে পড়ল—আর ক্যাবলা কিছু করতে পারল না—তার হাত থেকে চায়ের ভাঁড়টা টপাং করে পড়ে গেল মেঝেতে ।
—উহু হুঁ গেছি—পা পুড়ে গেল রে—স্বামীজী চেচিয়ে উঠলেন । উঃ—ছোঁড়াগুলো কী তাঁদোড় ? বলেছিলুম মুরিতে তুলে দিতে—তা দ্যাখো কাণ্ড ? একটু হলেই তো ক্যারেড-ওভার হয়ে যেতুম !
গজেশ্বর একবার আমাদের দিকে তাকাল—সেই চাউনিতেই রক্ত জল হয়ে গেল আমাদের। গজেশ্বরের বিরাট চেহারার কাছে অমন দশাসই স্বামীজীও যেন মূর্তিমান প্যাঁকাটি । গায়ের রঙ যেন হাঁড়ির তলার মতো কালো—হাতির মতোই প্রকাণ্ড শরীর—মাথাটা ন্যাড়া, তার ওপর হাতখানেক একটা টিকি। গজেশ্বর কুতকুতে চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললে, আজকাল ছোঁড়াগুলো এমনি হয়েছে প্রভু—যেন কিষ্কিন্ধ্যা থেকে আমদানি হয়েছে সব ! প্রভু যদি অনুমতি করেন, তা হলে এদের কানগুলো একবার পেঁচিয়ে দিই !
গজেশ্বর কান প্যাঁচাতে এলে আর দেখতে হবে না—কান উপড়ে আসবে সঙ্গে সঙ্গেই ।
আমরা চারজন ভয়ে তখন পাস্তুয়া হয়ে আছি ! কিন্তু বরাত ভালো—সঙ্গে-সঙ্গে টিন-টিন করে ঘণ্টা বেজে উঠল ।
গজেশ্বর ব্যস্ত হয়ে বললে, নামুন—নামুন প্রভু ! গাড়ি যে ছাড়ল ! এদের কানের ব্যবস্থা এখন মুলতুবি রইল—সময় পেলে পরে দেখা যাবে এখন ! নামুন—আর সময় নেই—
বাক্স-বিছানা, মায় স্বামীজীকে প্রায় ঘাড়ে তুলে গজেশ্বর নেমে গেল গাড়ি থেকে । সেই সঙ্গেই বাঁশি বাজিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করে দিল ।
আমরা তখনও ভয়ে কাঠ হয়ে বসে আছি—গজেশ্বরের হাতির শুড়ের মতো প্রকাণ্ড হাতটা তখনও আমাদের চোখের সামনে ভাসছে। মস্ত ফাঁড়া কাটল একটা !
কিন্তু ট্রেন হাতকয়েক এগোতেই স্বামীজী হঠাৎ হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠলেন : হাঁড়ি—আমার রসগোল্লার হাঁড়ি—
যোগসর্প ! এই নিন—
বলেই হাঁড়িটা ছুড়ে দিলে প্ল্যাটফর্মের ওপর ।
—আহা-আহ –করে দু-পা ছুটে এসেই স্বামীজী থমকে দাঁড়ালেন । হাঁড়ি ভেঙে চুরমার । কিন্তু আধখানা রসগোল্লাও তাতে নেই—সিকিখানা লেডিকেনি পর্যন্ত না ।
—প্রভু, আপনার যোগসর্প সব পালিয়েছেেআমি চিৎকার করে বললুম। এখন আর ভয় কিসের!
কিন্তু এ কী—এ কী ! হাতির মতো পা ফেলে গজেশ্বর যে দৌড়ে আসছে । তার কুতকুতে চোখ দিয়ে যেন আগুন-বৃষ্টি হচ্ছে ! এ যেন ট্রেনের চাইতেও জোরে ছুটছে—কামরাটা প্রায় ধরে ফেললে ।
আমি আবার বাঙ্কে উঠতে যাচ্ছি—টেনিদা ছুটেছে বাথরুমের দিকে—সেই মুহূর্তে—ভগবানের দান ! একটা কলার খোসা!
হড়াৎ করে পা পিছলে সোজা প্ল্যাটফর্মে চিত হল গজেশ্বর । সে তো পড়া নয়—মহাপতন যেন ! মনখানেক খোয়া বন্দুকের গুলির মতো ছিটকে পড়ল আশেপাশে ।
—গেল—গেল—চিৎকার উঠল চারপাশে । কিন্তু গজেশ্বর কোথা ও গেল না—প্ল্যাটফর্মের ওপর সেকেণ্ড পাঁচেক পড়ে থেকেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে উঠে দাঁড়াল—
—খুব বেঁচে গেলি !—দূর থেকে গজেশ্বরের হতাশ হুঙ্কার শোনা গেল ।
গাড়ি তখন পুরো দমে ছুটতে শুরু করেছে। টেনিদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, হরি হে, তুমিই সত্য ।