ভাই কাঁকালে পুঁটুলি হলো
আমার মায়ের য্যাকন মিত্যু হলো আমার বয়েস ত্যাকন আট-ল বছর হবে। ভাইটোর বয়েস দেড়-দু বছর। এই দুই ভাই-বুনকে অকুলে ভাসিয়ে মা আমার চোখ বুজল। ত্যাকনকার দিনে কে যি কিসে মরত ধরবার বাগ ছিল না। এত রোগের নামও ত্যাকন জানত না লোকে। ডাক্তার-বদ্যিও ছিল না তেমন। মরবার আগে মুখে যেদি ওষুধ পড়ত, তাই কতো! পেরায় পিতি বছর কলেরা-বসন্তেই কতো যি লোক মরত, তার সীমাসংখ্যা নাই। আমার মা যি কলেরা-বসন্তে না মরে অজানা কি একটো রোগে মারা গেল তাই কতো ভাগ্যি!
মায়ের মওত আমার পষ্ট মনে পড়ে। এক বাদলের রাত-দোপরে জান গেল। কাঁদবার পয্যন্ত লোক নাই। বাপজি দখিন-দুয়োরি ঘরের উসারায় গালে হাত দিয়ে বসে থাকলে। তার এক খালা ছিল, আমি দাদি বলতম – সেই দাদি এসে সব দেখাশোনা করলে। আমার মনে আছে – ঘরে জ্বলছে পিদিম, দেড় বছরের ভাই ঘুমিয়ে আছে অঘোরে, গাঁয়ে একটো ক্যাঁথা চাপানো। মাঝে মাঝে ঘরে ঢুকছে বাদুলে হাওয়া। পিদিম নেবে নেবে। তা সকাল না হলে তো করার কিছু নাই। মওতা সারা রাত অমনি করে থাকলে, একটো পুরনো শাড়ি চাপা দেওয়া, মুখ মাথা ঢাকা। মনে হছিল দুনিয়ায় আমাদের কেউ নাই। সবই ছিল আমাদের, তবু মনে হছিল।
মা মরার পরে ভাইটি সেই যি আমার কোলে উঠল আর তাকে নামাইতে পারলম না। যেখানে যাই, সে আমার কাঁকালে আছে। ইদিকে বাড়ি ফাঁকা, দেখার কেউ নাই। অতো বড় বাড়ি! উঁচু-উসারা-অয়লা দখিন-দুয়োরি ঘরটো ত্যাকন করা হয়েছে। তা বাদে বিরাট লম্বা এগ্নে, তার দখিন মাথায় আর একটো বড় ঘর। ই ঘরটো উত্তর-দুয়োরি। ত্যাকন ঘরটো পড়ে থাকে। দখিন-দুয়োরি ঘরেই আমাদের ওঠা-বসা। বাপজি ঘরটো বানিয়েছিল খুব যত্ন করে। হোক মাটির— আমাদের দ্যাশের পেরায় সব বাড়িই তো মাটির— ঘরটোর মাটির দেয়াল ছিল খুব চ্যাওড়া, খরানির কালে ঘর যেন ঠান্ডা হিম, ঢুকলেই জানটো একেবারে তর হয়ে যেত। ছাউনি খ্যাড়ের, গরম হবে কোথা থেকে? খ্যাড়ের চালের তলায় কাঠামো ছিল লোহার মতুন কালো কুচকুচে সারি তালকাঠের।
তা অ্যাকন আমি বাড়িতে দিনরাত থাকি কেমন করে? বাপজি দিনের বেলায় কতোক্ষণই বা বাড়িতে থাকত। দখিন-দুয়োরি ঘরের উসারার ছামনেই আঁজির গাছ। ঐ পেয়ারাই, আমরা বলতম আঁজির। ই আঁজির গাছটো ঠিক যেন মাহারুহ, পেল্লায় বড়। পেয়ারা গাছ কুনোদিন অতো বড় হয় না। মণ মণ আঁজির হতো, ভেতরটো ছিল গোলাপি লাল আর মিষ্টি যেন গুড়। ভাইকে নিয়ে এই আঁজির গাছের তলাতেই দিন কেটে যেত। দখিন-দুয়োরি ঘরটোর ঠিক পেছনেই ছিল আর একটো ছোট ঘর। ঐ ঘরে থাকত আমার ঐ দাদি, বাপজির খালা। তিন কুলে কেউ নাই। সোয়ামি-ছেলেমেয়ে সব মরে-ঝরে যেয়ে দাদি একা। ছোট ঐ ঘরে সারাদিন খুটুর খুটুর করে বেড়াত। ঘরের ভেতরটো আঁদার, একটিমাত্র দরজা ঘরে ঢোকার লেগে, কুনোদিকে কুনো জানেলা নাই। ঘরের বাইরে উসারার এক পাশে একটো মাটির চুলো। রান্নাবাড়া সব ঐখানে। ঘরের ভেতরে শুদু হাঁড়ি সাজানো। কালো কালো হাঁড়ি, বড়-ছোট হিসেব করে একটোর ওপরে আর একটো বসানো। সার সার শুদু হাঁড়ি, অতো হাঁড়িতে কি যি থাকত কে জানে! একটো মোটে মানুষ, কি-ই বা থাকবে?
দাদি আমাকে খুব ভালোবাসত। আমিই বা আর কোথা যাই, ভাই-কোলে দাদির কাছে কাছেই থাকতম। বয়েস তো ত্যাকন অ্যানেকটেই হয়েছে, দাদির এটা-ওটা ফাই-ফরমাশ খাটতম। কিন্তুক ভাই কি কোল থেকে নামবে? সব সোমায় আমাকে আঁকড়ে ধরে আছে। কাঁকালে আমার ঘা হয়ে গেল। দাদি বুড়ি মানুষ। খুব ফরশা, মুখে বসন্তের দাগ। অমন মানুষ হয় না। ফল-পাকুড় যা পেত আমার হাতে তুলে দিত। পেরায়ই আমাকে বলত, আমার যা আছে সব তোকে দিয়ে যাব। কি-ই বা এমন ছিল তার? সেই দাদির দেওয়া বড় একটো কাঁসার জামবাটি এখনো আছে আমার কাছে। দাদির ঐ একমাত্র জিনিশ আজও টিকে আছে।
আমার বাপ দাদির ইসব দেওয়া-থোয়া তেমন পছন্দ করত না। খুব রাশভারি মানুষ ছিল, কাউকে তেমন গেরাহ্যি করত না। মাহা বেপদ হলেও কাউরি কাছে যেয়ে কিছুতেই কুনো ব্যাগোতা করত না। তাই বলে বাপজির কিন্তুক মেজাজ গরম ছিল না। বরং উল্টো, খুব আস্তে আস্তে তার কথা। হড়বড় করে কিছু বলত না কুনোদিন। তেমন একটো হাসত না, তবে ভেতরে ভেতরে মজা ছিল খুব কথায়। তা সি যা-ই হোক- কে এসে কি হাতে দেবে ছেলেমেয়ের, বাপজি তা তেমন ভালোবাসত না। তা বলে কি আপন খালার ওপর রাগ করবে? তা লয়।
দাদি পড়ে থাকত এক কোণে। এই গতর, মিশিমাখা দাঁত। দাঁতে তুঁত দিত যি! কুনো পাউডার ত্যাকন ছিল না। গায়ে-মাখা সাবান তা-ও ত্যাকন তেমন পাওয়া যেত না। দাদি কুনো গন্ধ কি কুনো বাস একটুও সইতে পারত না। বোধায় ফুলের গন্ধও নাকে গেলে থু থু করে থুতু ফেলত। কুনো ভালো গন্ধ কি কুনো বাস যেদি দাদির নাকের ছামনে ধরেছি মজা দেখার লেগে, দাদি অমনি কাপড় দিয়ে নাক চেপে ছুটে যেয়ে ঘরে ঢুকত। তা-বাদে শুকুইয়ের হাঁড়ি শুঁকে তবে তার ধড়ে জান আসত। এমন মানুষের ওপর কেউ কুনোদিন রাগ করতে পারে! আমরা দুই ভাই-বুন ছেলম তার জানের জান। বাপজি তাইলে তার খালাকে আর কি বলবে? সে তো নিজেই বুঝতে পারছে যি, সোংসার অচল হয়ে গেয়েছে। কে রাধে, কে খেতে দেয়? কে ঘর বাট দেয়? সব যি আঁদার। আমি নইলে এটু বড় হয়েছি কিন্তুক ঐটুকু ভাইটিকে কে দেখে? কে লাওয়ায়, খাওয়ায়?
শেষতক বাপজিকে আবার বিয়ে করতে হলো। লতুন মা এল ঘরে। পাতলা কালো মেয়ে, আমার চেয়ে ছ-সাত বছর বড় হবে। মাথায় লম্বা কালে চুল, হেঁটোর নীচে পড়ছে। বড় বড় চোখদুটিতে ভারি মায়া। নিজের মা গেলে কি আর মা পাওয়া যায়! সি কথা সত্যি বটে। মা ফিরে প্যালম না ঠিকই, তবে মায়েরই মতুন আর সেই সাথে সখির মতুন একজনাকে প্যালম। সংসারে আবার ছিরি ফিরল।
কিন্তুক ভাইটি আমাকে ছাড়লে না, আঁকড়ে ধরে থাকলে। কোল থেকে তাকে আর নামাইতে পারি না। লতুন মা অ্যানেক চেষ্টা করলে ওকে কাছে টানতে। সে কিন্তুক হরগেজ আমাকে ছাড়বে না। খাবে আমার কাছে, শোবে আমার কাছে। আমার কাঁকালে সে যেন সব সোমায়ে একটো পুঁটুলি!