আমার বিয়ের ফুল ফুটল
দাদি ত্যাকন আর নাই। ভাইটিও কাছে নাই। লতুন মা-ই তার নিজের খোঁকাটিকে দেখে, আমাকে তেমন আর ওকে নিয়ে বেড়াতে হয় না। এই করতে করতে একদিন আমি হঠাৎ কেমন করে যি বড় হলোম, তা নিজেই জানতে পারি নাই। কবে একদিন ফালি ছেড়ে মোটা তাঁতের শাড়ি ধরেছি। তাঁতিবাড়ি থেকেই পাওয়া যেত ত্যাকনকার দিনে শাড়ি ধুতি। শাড়ি ধরার পর আর তেমন বাড়ির বাইরে যাই না।
পুকুর-ডোবা গাছপালা আর পাঁজর -বেরুনো মাটির বাড়ি দেখে বোঝা যেত আমাদের গাঁ-টো খুব পুরনো। পাকা সয়রান হয়েছিল এই সিদিন যুদ্ধর সোমায়। দিনে দুটো, সকালে একটো আর সাঁঝবেলায় একটো—এই দুটো মটরগাড়ি যেত ঐ পাকা রাস্তা দিয়ে।ই ছাড়া সারাদিন শুনশান– গাঁ-টোকে মনে হতো ই দুনিয়ার লয়। আমি তো চিনি গাঁ-টোকে! গেরস্ত বাড়ির ছামনে অত বড় পাকুড়গাছ, ই কি অলক্ষুনে লয়? পাকুড়গাছ থাকবে মাঠের মাঝখানে, নাহয় গাঁয়ের মাঝখানটোয়, যেখানে লোকজন এসে বসবে, তামুক খাবে— তা লয়— পাকুড়গাছ, মাহারুহ গাছ, বাড়ির এগ্নের ওপর। ই অলক্ষুনে লয়? কাকচিল তো বসছেই, শকুনিও এসে বসছে। মরা গরু-বাছুরের হাড়, বেড়াল-কুকুরের ছেঁড়া চামড়া এইসব পড়ছে বাড়ির এগ্নেয়। ভিন পাড়ায় যাবার সোমায় বেলগাছের মাথায় দুটো শাকচুন্নিকে আমি অ্যানেকদিন দোপরবেলায় পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে দেখেছি। কারুর বাড়ির মাছভাজ খাবার যুক্তি। ই গাঁয়ের বাতাসটোই এমনি। মাঠের বড় পুকুরটোর ধারে প্যাত্তা তো যে খুশি দেখতে পেত সাঁঝবেলাটা পার হলেই। লোকে ইসব জানত। তবে এদের ঘরের লোক বলেই মনে করত। লোকে যেন মনে করত মানুষ দুরকম– মরা মানুষ আর জ্যান্ত মানুষ। একসাথে তো থাকবেই। যেসব জ্যান্ত মানুষ ঘরে-বাইরে ঘুরে বেড়াইছে, তাদের মদ্যে দু-একটো মরা মানুষ যি নাই তা কে বলবে? চেনবার তো বাগ নাই। কি রূপ নিয়ে কার ভ্যাকে জ্যান্ত মানুষের সাথেই যি জিন-ভূত আছে তা কেউ বলতে পারবে না। আমার ছোট মামুর ঘরেই একটো জিন থাকত, তার কথা আমি নিজের কানে শুনেছি। সে ছিল ভালো জিন, বাড়িতে হঠাৎ মেহমান এলে সরু গলায় ক্যান ক্যান করে বলত, উসারায় তক্তপোশে মিষ্টি আছে দ্যাখো গা। বাড়িতে অমুক এয়েছে, মিষ্টি লাগবে না?
মিষ্টি লাগবে তো আপনি আনতে গেলেন কেন? মামু জিজ্ঞাসা করলে | বাড়িতে মেহমান এলে মেহমানদারি করতে হয়, মেহমানের খেদমত করতে হয়।
তা তো হয়, তা আপনি কোথা থেকে কার মিষ্টি নিয়ে এলেন?
আমরা জিন, আমরা সব পারি।
কার না কার মিষ্টি এনেছেন, দাম দিয়েছেন?
আমাদের দাম দিতে হয় না।
মামু মক্তবের ওস্তাদজি, এটু রাগ করে বললে, আর কোনোদিন আনবেন না।
টিনের চালে ত্যাকন খুব শব্দ হতে লাগল, জিন-ও রেগেছে বুঝতে পারা গেল। তা সি যাকগো, লোকে জানে না, আমরা জানি যি রাতদোপর আর দিনদোপর একরকম, কুনো তফাত নাই। নিশুতি রাতদোপর যেমন ছমছম ছমছম করে, দিনদোপরও তেমনি। পেত্যয় না হলে জষ্টি মাসের দোপরবেলায় ত্যাকনকার দিনের গাঁয়ের ভেতরে ঢুকতে হবে। দোপর ঠিক নিশুত রেতের মতুন। সারা গাঁ খাঁ খাঁ করছে, রাস্তায় একটি লোক নাই, কুনো পেরানির সাড়া-শব্দ নাই— গরুর গোয়ালের আঁদার মাচান থেকে উই যি গাওড়া খটাশটো রাস্তায় গরম ধুলোর ওপর দিয়ে বাপ বাপ বলে ডাকতে ডাকতে যেচে কে বলবে ওটো খটাশ লয় আর কিছু? আর ঐ যি গাঁয়ের ই কোণে উ কোণে একটো-দুটো পুরনো মাটির ঘর ছিল যিগুনোয় কুনো মানুষ বাস করত না, আলকাতরা মাখানো আমকাঠের দুয়োর শেকল-তালা দেওয়া থাকত, ঐ ঘরগুনো কি একদম ফাঁকা? দেয়ালঘেরা এগ্নে, ঘরের পিঁড়ে কি একদম শুন্যি? তা লয়, তা লয়। ঐসব ভিটে ঐসব ঘর ক্যানে ছেড়ে যেত লোকে? তা কেউ বলতে পারবে না।
আবার এই একই গাঁয়ে সকালে কিংবা বৈকালে যাও— কি সোন্দর! মানুষ যেচে-আসচে, কথা বলছে, ছেলে-পিলেরা খিলখিলিয়ে হাসছে, পাড়ার মেয়েগুনো অমনিই কুনো ভিটেতে ঝাল-ঝাপ্টি খেলছে কোথা ভূত, কোথা জিন? কেউ কোথাও নাই। বিহানবেলায় কোদাল কাঁধে, গরু-মোষের লাঙল নিয়ে জোয়ান মরদ ছেলে-ছোকরার মাঠে যেচে, ওস্তাদজি পোষ্কার একটো খাটো ধুতি পরে মোটা পাঞ্জাবি গাঁয়ে পাঠশালে যেচে, কচি কচি ছেলেরাও যেচে পাঠশালে। কি সোন্দর! তাই বলছেলম একই গাঁ, তার কতোরকম রূপ।
আমি কিন্তুক একদিনও পাঠশালে যাই নাই। বাপজি যেতে দেয় নাই। মেয়ে আবার পাঠশালে যেয়ে ল্যাখাপড়া শিখে কি করবে? খানিকটো বেয়াদপ হবে, মুখের ওপর কথা বলবে- এই তো? এর লেগে পাঠশালে পড়ার কি দরকার? এইরকম দিন যি ছিল একদিন, অ্যাকন আর আমারও পেত্যয় হয় না। ত্যাকন লোকের কুনো নড়াচড়া ছিল না। কেউ কোথাও যেত না— সারা জেবন সবাই একসাথে থাকত। গাঁ থেকে এক কোশ দূরেও কেউ যেত না। মাঠের জমি, ধান, ফসল, আবাদ, পুকুর ঘুরে যে যেখানেই যাক, ঠিক সাঁঝের বেলায় ফিরে আসবে— ইয়ার কিছুতেই বে-লিয়ম হবে না। ক্যানে যাবে মানুষ! হাটে
গঞ্জে কিংবা মোকামে, নাহয় কুটুমবাড়ি যেত দু-চার গাঁ পেরিয়ে। ল্যাখাপড়া শিখে কি করবে গাঁয়ের মানুষ? বাপজি তাই মনে করত কার লেগে ল্যাখাপড়া রে বাপু!
তা পাঠশালে তো গ্যালম না, তাই বলে বয়েস কি বসে থাকবে? হঠাৎ একদিন শুনতে প্যালম আমার বিয়ের সম্বন্ধ এয়েছে। ত্যাকন আমার বয়েস চোদ্দ কি পনেরো। ত্যাকনকার দিনের হিসেবে অ্যানেক বয়েস। এই আমাদের বয়সের মেয়েদের কুনো একটা ভুল হয়ে গেলে মা-চাচিরা বলত, শরম লাগে না ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে? বিয়ে হলে এতদিনে যি দুই ছেলের মা হতিস। তাইলে, আমার বিয়ের সম্বন্ধ যি এল তা আর আচ্চয্যির কথা কি? সম্বন্ধ এল, কথাবাত্তা হতে লাগল কিন্তুক আমাকে কেউ একটো কথাও শুদুলে না। শুদুবেই বা ক্যানে? ই ব্যাপারে আমার তো কুনো কথা নাই। মুরব্বিরা যা করবে তা-ই হবে। তারা যেদি মনে করে একটো কলাগাছের সাথে আমার বিয়ে দেবে, আমাকে তাই মানতে হবে। এইরকমই ছিল ত্যাকনকার দিন। ছেলে হয়তো ত্যাতোটা লয়, মেয়ে হলো বাপের আঘিন্নে দায়। বাপ যেদি মনে করে মেয়েকে কেটে পানিতে ভাসিয়ে দেবে, তাতে কারু কিছুই বলার নাই। সেই লেগে বলছি, মেয়ে ই কথা শুদুতেই পারবে না যি কার সাথে তার বিয়ে হচে। রূপ-গুণের কথা দূরে থাক, পাত্তরের বয়েসটোও শুদুতে পারবে না। বুড়ো হোক, ধুরো হোক, মেয়েকে মেনে নিতেই হবে। ষাট বছরের বুড়োর সাথে পনেরো বছরের মেয়ের বিয়ে ত্যাকনকার দিনে আকছার হতো। দোজবরে তেজবরে হেঁপোরুগি মাতাল চোয়ার কাউরির বিয়ে করার লেগে সোন্দর মেয়ের অভাব হতো না। সিদিক থেকে আমার তো মাহা কপালের জোর যি শোনলম, পাত্তরের বয়েস মাত্তর এক কুড়ি আট বছর। ইয়ার চেয়ে ভালো যোগ ত্যাকনকার দিনে আর কিছু ছিল না। হলোই বা আমার দ্বিগুণ বয়েস বিয়ে যে হচে এই পরম ভাগ্য! অ্যাকনকার দিনে ছেলে পেথম বিয়েই করছে দু-কুড়ি বছর বয়েসে। তাতে কুনো দোষ নাই।
শোনলম চার কোশ দূরের এক গাঁ থেকে সম্বন্ধ এয়েছে। একটু দূর হয়ে যেছে বটে তবে মটরে আর র্যালে খানিকটে রাস্তা যাওয়া যায়। শুকনো দ্যাশ তো, গরুর গাড়িতে মাঠে মাঠে একবেলার মদ্যেই যাওয়া যাবে। তা দূরেই হোক আর কাছেই হোক, ই সম্বন্ধ ছাড়া যাবে না। নামজাদা বেরাট বংশ, আবস্তাটো অ্যাকন একটু পড়ে এয়েছে বটে কিন্তুক ভাত-কাপড়ের অভাব কুনোদিন হবে না।
আমি শুদু এইটুকুই শোনলম। পাত্তর কেমন, কি করে ইসব কথা কেউ তুললেও না, আমিও আর কিছু জানতে প্যালম না। ত্যাকন কি আর জানি এমন সোয়ামি আমার কপালে ছিল! ছিপছিপে ছোটখাটো শামলা রঙের মানুষ, আসমানের বাজের মতুন শক্ত। তবু সে সোনার মানুষ। কিন্তুক আমার লেগে মুটেই লয়— আর সবার লেগে। মা-বাবা, ভাই-বুন, আত্মীয়স্বজনের লেগেই শুদু লয়, সারা দিগরের মানুষের লেগে। আমার কথা আর কি বলব? আমাকে সে সারা জেবন হেনস্তা করেছে, কতো কুবাক্যি বলেছে, হাত ধরে ঘর থেকে বার করে দিতে চেয়েছে, তবু আমি মনের ভেতরে ঠিকই জানি ভেতরে ভেতরে কি সনমান সে আমাকে দিয়ে গেয়েছে। কিন্তুক সে শুদু ভেতরে ভেতরে, নাইলে তামাম লোকের ভালো করবে, শুদু আমার দিকে চেয়ে দেখবে না।
বিয়ে হয়েছিল বৈকালি। সাঁজ রেতে একসাথ্ করা হলো। তা শেষ হতে না হতে লোকজন নিয়ে পালকি করে নিজের গাঁয়ে ফিরবে। একবার কি দুবার বলার পর আর কারুর সাধ্যি হলো না রাতটো থেকে যেতে বলতে। হাজার হলেও মাঠ ভেঙে পালকি নিয়ে এই এতটো পথ যেতে হবে। দিনকাল ভালো লয়, সঙ্গে সোনাদানা আছে, বেপদ হতে কতোক্ষণ? কুনো কথাই সে কানে তুললে না। সঙ্গে কজন লেঠেল আছে আর বাউরি কাহাররা তো সবাই লেঠেল। ভাবনা কিছু নাই। মিশমিশে আঁদার রেতে মিশমিশে কালো চার মুশকো বাউরি কাহার বাতাসের বেগে পালকি নিয়ে ছুটল মাঠের ওপর দিয়ে। কাহারদের হাতে এই বড় বড় লাঠি– এক একজনা যমদূতের মতুন। কে তাদের ছামনে দাঁড়াবে? সঙ্গের বরযাত্রী লোক-লস্কর সেই আঁদারেই তাদের সাথে সাথে ছুটল। খালি একজনার হাতে একটো ডেল্লাইটের আলো।
লতুন মায়ের ত্যাকন আবার ছেলেপুলে হবে। এইটুকুনি মানুষ। তেমন লড়তে-চড়তে পারছে না। ইয়ার মদ্যে তার এক খোঁকা হয়েছে। লিয়ম মতুন লতুন মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলে। আমিও কাঁদলম। এইরকমই লিয়ম ছিল— গলা জড়িয়ে কাঁদতে হবে, নাইলে নিন্দে হবে। তবে কেউ কাঁদত লিয়ম মতুন, একটু হুঁ হুঁ করলে, ফোৎ ফোৎ করে মিছে নাক ঝাড়লে, আবার কারু কারু বুকের কবাট ফেটে যেত যেন। আমার ঠিক তা-ই হলো। এই মা, এই ভাই, এই বাড়ি-ঘর, ঘাট-পুকুর, এই আসমান-জমিন— সব ছেড়ে চেরকালের লেগে বিদেয় লিছি। কতো কথা মনে পড়ছে। কোথা থাকল মা, কোথা থাকল বাপ, কোথা থাকল ভাই! লতুন মা আওয়াজ করে কাঁদতেও পারলে না। পেটের ভারে সে ত্যাকন হাঁসফাঁস করছে। গড়গড়িয়ে চোখে পানির ধারা নামল।
বছরে দু-মাস করে আমার কাছে থাকবি। আমি নিয়ে আসব।
তা মনে হয় আমার বিয়ের পর থেকে শেষ ছেলেটো হওয়া পয্যন্ত এই লিয়মের তেমন লড়চড় হয় নাই। ঐ মা যি আমাকে আমার নিজের মায়ের শোক ভুলিয়ে দিয়েছিল!
ক-দণ্ডের মদ্যে সেই রেতে রেতেই কাহাররা বিয়ের পালকি পৌঁছে দিলে আমার শ্বশুরবাড়ি। আমি আমার জন্মস্থান থেকে চেরবিদায় লেলম।