বড় সোংসারে থই মেলে না
লতুন বউ আমি এসে ওঠলম ডোবা থেকে দিঘিতে। বড় সোংসার, কিছুতেই থই মিলছে না। আমাদের বংশও বড় ছিল বটে, গাঁ-জোড়া বংশ। তবে সিসব আলেদা আলেদা ভাই-ভায়াদের সোংসার। আমাদের নিজেদের সোংসার ছোট, মা য্যাকন বেঁচে ত্যাকনো ছোট। তার মরার পরে কিছুদিন তো আরও ছোট। লতুন মা আসার পরে একে একে ভাইবুনগুলিন হতে হতে য্যাকন আমার বিয়ের সোমায় হলো, ত্যাকন সোংসার কতকটো বড় হয়েছে বটে, তা বলে ই বাড়ির মতুন লয়। কত্তারা পাঁচ ভাই। আমাকে নিয়ে বউ দুটো। মোটে বড় আর মেজ এই দুই ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে। আর আর ভাইয়ের ত্যাকনো বিয়ে হয় নাই। ছোট ভাইটি তো খুবই ছোট, আট-ল বছরের হবে। চার বুনের মধ্যে দুজনার বিয়ে হয়েছে। বড় বুনটি স্বামী-সোংসার নিয়ে গাঁয়েই থাকে। মেজজনার পোড়া কপাল। মাত্তর ল-বছর বয়েসে বেধবা হয়ে এই সোংসারেই ফিরে এসেছে। বাকি দুজনার অ্যাকনো বিয়ে হয় নাই। এত লোক সোংসারে, তবে সবার ওপরে আছে আমার শাশুড়ি। তার বয়েস হয়েছে বটে কিন্তুক ত্যাকনো খুব শক্ত। দু-চারটো চুল পেকেছে, দাঁত একটিও পড়ে নাই, গোটা সুপুরি চিবিয়ে খেতে পারে। শাশুড়ি ফিট শাদা, কত্তার মতুন শামলা লয়। বেধবা মানুষ, শাদা ধুতি পরনে, কপাল পয্যন্ত লাজ-কাড়া, ঠিক বউমানুষের মতুন। দেখার সাথে সাথে বুঝতে পারলম এই শাশুড়ি-ই ই বাড়ির গিন্নি। তার পরের গিন্নি ঐ বেধবা ননদ। ল-বছরেই বেধবা হয়ে ভাইদের সোংসারে এয়েছে। ই বাড়ির লিয়ম ঠিক হিঁদুদের মতুন, বেধবার বিয়ে নাই ই বংশে। এই ননদ ত্যাকন ভরা যোবতী। আমার চেয়ে বড় বটে, তবে বেশি বড় লয়। বয়েসে চার-পাঁচ বছর বেশি হতে পারে।
আমি লতুন বউ হয়ে থাকলম আর কদিন? কানে তুলো পিঠে কুলো চোখে ঠুলি লাগিয়ে সোংসারের ঘানিতে জুতে গ্যালম দু-দিন যেতে না যেতেই। তবে, এই এক সুবিদা, ই সোংসারে আমার দেখার কিছু নাই। বাড়ির গিন্নি আছে, সেই দেখবে। যা করবার সেই-ই করবে। বড় বউ আর আমি শুদু ঘুন্নিপাক খেলেই হয়ে যাবে। হ্যাঁ, সেই যি ঘানি টানতে লাগলম, সারা জেবন একবারও আর থামতে পারলম না। ডাইনে বললে ডাইনে, বাঁয়ে বললে বাঁয়ে। শুদুই হুকুম তামিল করা। অ্যাকন মনে হয়, জেবনের কুনো কাজ নিজে নিজে করি নাই, নিজের ইচ্ছা কেমন করে খাটাতে হয় কুনোদিন জানি নাই। আমি কি মানুষ, না মানুষের ছেঁয়া? তা-ও কি আমার নিজের ছেঁয়া?
তবে নিশ্চিন্তি বটে। কুনো কিছু তো নিজেকে ঠিক করতে হবে না— যা করবার, যা বলবার গিন্নি করবে, গিন্নি বলবে। আর সি কি যে-সে গিন্নি! ঐটুকুন মানুষ, শাদা শাড়িতে কপাল পয্যন্ত ঢাকা, শরীলের কোথাও এতটুকু ধুলোবালি লেগে নাই। এত পোষ্কার থাকে কেমন করে মানুষ তাই ভাবতম। মুখে একটি-দুটি কথা, ভালোবেসেও লয়, মন্দবেসেও লয়। আর না-পছন্দ কুনো কিছু করলে দু-একটি বাক্যি যা বলত তা যেন কল্জে ছ্যাঁদা করে দিত। এইটোতেই ভয় লাগত বেশি। তবে বিচের ছিল বটে। একটি অন্যায় কাজ লয়, অন্যায্য কথা লয়। কুনো কিছু নিয়ে দুই দুই করা লয়। একেবারে সুক্ষ্ম ষোলো আনা ন্যায্য বিচের। এমন না হলে কি অত বড় সোংসার থাকে? সেই লেগে বলি শাশুড়ি যেন ই জগতের লোক ছিল না।
ইদিকে সোংসারের কত্তা কিন্তুক মেজ জনা, আমার সোয়ামি। তার বড় ভাই, আমার ভাশুর, কত্তার চাইতে ক-বছরের বড় হলে কি হয়, সে ছিল খুব আলাভোলা মানুষ, নেতান্তই ভালো মানুষ। বিষয়-সম্পত্তির কুনো কিছুতেই তার আঠা ছিল না। জেবনের শ্যাষ দিন পয্যন্ত সে যেন কত্তার ছোটই থেকে গেল, কুনো দায়-দায়িত্ব নিলে না। ছোট ভাইকে যেন এটু ভয়ই করত মনে মনে। তার ছিল খাওয়ার শখ, জামা-কাপড়ের শখ। তবে সি আর কতোটুকুনি! ছেলেপুলে হলো না কুনোদিন, ভাইবুনদের ছেলেমেয়েরাই ছিল তা সব। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কি ভালোই যি বাসত! বিশেষ আমার ছেলেমেয়েদের। পর পর দুই খোঁকার পরে আমার একটি খুঁকি হয়েছিল। সেই খুঁকি ছিল তার জান। বাড়িতে সে থাকতই না পেরায়। অ্যানেক দিন পরে পরে য্যাকনই বাড়ি আসত, সঙ্গে থাকত হাঁড়িভরা মিষ্টি। মিষ্টি ছাড়া বাড়ি ঢুকত না। হয়তো ব্যাবসার টাকা লষ্ট করে কিংবা টাকা ধার করে ছেলেমেয়েদের লেগে মিষ্টি, খ্যালনা এইসব আনত আর কত্তার কাছে মুখ শুনত এই লেগে। কত্তা বলত শুদু শুদু টাকা লষ্ট করবে কেন? কঠিন কঠিন কথা শুনে ভয় আর লজ্জা নিয়ে এমন করে দাঁড়িয়ে থাকত ছোট ভাইয়ের ছামনে, যেন চোরের দায়ে ধরা পড়েছে। কিন্তুক ঐ পয্যন্তই। কথা এক কান দিয়ে শুনলে আর এক কান দিয়ে বার করে দিলে। বাড়িতে ঢুকলেই ছেলেপুলেরা কেউ ঘাড়ে, কেউ মাথায়। কেউ তো আর তাকে বড় চাচা বলত না, বলত বড় বাপ। সোংসারের সব দায় ঐ মেজ কত্তার হলেও আবার ইদিকে দ্যাখো তেমন দরকার পড়লে সে খবর দিয়ে বড় কত্তাকে বাড়িতে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করত অমুক কাজটো করবে কি না। বড় ভাই-ও তেমনি, তার শুদু একটি কথা, মন হলে করো গা, ভালো মনে হলে করো গা। আমাদের এমন অবাক লাগত! য্যাকন-ত্যাকন বড় ভাইকে এই বকা তো সেই বকা! আবার তেমন তেমন ব্যাপার হলে তার কাছেই হুকুম চাওয়া! কিন্তুক ইকথাও বলতে হবে, ছোটকে যি কতোটো সমীহ করতে হয়, যেদি ছোট তেমন সনমানের যুগ্যি হয়, তা-ও দেখেছি এই সোংসারে।
কত্তাকে ঐ বয়সে যি অতো দায়িত্ব নিতে হয়েছিল তার কারণ হলো, আমার শ্বশুর আট-লটো ছেলেমেয়ে আর বেধবা স্ত্রী রেখে অল্প বয়সেই মারা যায়। কথাবার্তা শুনে আমার মনে হয়, শ্বশুর বোধায় খানিকটো আমার ভাশুরের মতুনই বিষয়-সম্পত্তি দেখে রাখবার মানুষ ছিল না। তবে সে আলাভোলা ছিল না। এলেকার হিঁদু-মোসলমান বড় বড় মানুষের সাথে তার ওঠাবসা ছিল। শখ-সাধও ছিল বোধায় তেমনি। নিজের পালকি ছিল, ছয় বেহারার পালকি। সেই পালকিটি দলিজঘরের বারেন্দায় ভেঙেচুরে পড়ে ছিল অ্যানেকদিন। তা বাদে নিজের আরবি ঘোড়া ছিল তো বটেই। ঘোড়ায় চড়ে ইগাঁয়ে উগাঁয়ে বড় বড় লোকের বাড়িতে যেমন যেত, তেমনি তারাও সবাই ই বাড়িতে আসত। শাশুড়ির ঠেয়ে শুনেছি মানুষজনের আসা যাওয়ার কামাই ছিল না। কোর্মা পোলাও দই মিষ্টি দেদার খরচ হতো। এমনি করে করেই জমি সম্পত্তি কতক বিক্রি হলো, কতক বেহাত হলো। শ্বশুর য্যাকন মারা যায়, ত্যাকন লিকিনি সোংসারের বেহাল আবস্তা। শাশুড়ি বলত, সোংসার য্যাকন ভেসে যায়-যায় হয়েছে ত্যাকন তার এই মেজ ছেলেই এগিয়ে এসে হাল ধরলে। তা নাইলে সব যেত। কত্তার ত্যাকন কতোই বা বয়েস, বিশ বছর হয়েছে কি হয় নাই। সে সব আমোদ-আল্লাদ বাদ দিয়ে ভাইবুনগুলিন আর মাকে নিয়ে জান-পরান দিয়ে এই সোংসারটোকে রক্ষা করলে। ই সোংসারে এসে তাই দেখলম বটে। সোংসারের ভেতরে যা করবে সব মা। মা ছাড়া কথা নাই। নিজের ইস্ত্রী তো বটেই পরে পরে যিসব ভাইয়ের বিয়ে হলো তাদের পেত্যেকের বউকে চোখকান বুজে শাশুড়ির কথা মেনে চলতে হবে। শাশুড়িকে একটি কথা ঝাঁঝিয়ে বলেছে কিম্বা কাজ করতে করতে ঘটি-বাসন মাটিতে একটু ঠুকে আওয়াজ করেছে, আর রক্ষা নাই। কত্তা সোজা বাড়ির ভেতর ঢুকে বলবে, যে এরকম করলে সে আর একবার যদি এমন করে, তাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে। তা কত্তাকে লাগত না, আমার শাশুড়ির শাসনই যাথেষ্ট ছিল।
বউ হয়ে আসার পর থেকে অবশ্যি দেখছি সোংসার অ্যানেকটোই ঠাউরেছে। শ্বশুরের মিত্যুর পরে সাত-আট বছর কত্তাকে কেউ বিয়ের কথা বলতে সাওস পায় নাই। আমার শাশুড়ি-ও লয়। সেই লেগেই এত দেরিতে বিয়ে। সোংসারে ঢুকে দেখলম ত্যাকন একমাত্তর সেজ জনার বিয়ের বয়েস হয়েছে, বাকি ভাইবুনরা সব ছোট। বেধবা বুনটোর পরে তার আর দুই ছোট বুনের বিয়ের বয়েস হব-হব। কিন্তুক কি কপাল, এই সোমায় ঠিক ছোটর বড় যেটি সেই বুনটি মারা গেল। কি অসুখ কে বলবে? মাস দুই-তিন কিছুই পেরায় খেলে না। খাবার দেখলেই বলত অরুচি লাগছে। এই করে শুকিয়ে শুকিয়ে লেয়ালির দড়ি হয়ে গেল। কাটি কাটি হাত পা। তাপর একদিন আমাদের সকলের চোখের ছামনে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলে। আহা, কতোই বা বয়েস, সারাটা জেবন তার ছামনে, সোয়ামি সোংসার সন্তান কিছুই জানলে না, অকালে মা ভাই বুন সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল। ত্যাকনকার দিনে মরে যাওয়াটো যেন কিছুই লয় এমনি ভাব ছিল মানুষের। দু-চার দিন কেঁদেকেটে সব ভুলে যেত। ডাক্তারবদ্যি তো তেমন ছিল না। যা বা ছিল শহরগঞ্জে, পাড়াগাঁয়ে তার কিছুই মিলত না। কঠিন অসুখ হলে যার অসুখ সে যেমন, তেমনি তার সোদররাও সব আশা ছেড়ে দিয়ে মিত্যুর লেগে ঠায় অপেক্ষা করত। কলেরা আর বসন্ত ই দুটো মাহামারীতে বছরে কতো লোক যি মরত তার আর সুমার নাই। অত কাঁদবে কে? কেঁদে কুনো লাভ নাই। যি কাঁদছে সে-ই দুদিন বাদে মরবে কি না কে বলবে? কলেরা-বসন্ত বাদ দিয়ে আর একটো অসুখ ছিল— বুকের ব্যায়রাম, যক্ষ্মা। উ রোগ হলে চিকিচ্ছের চেষ্টাও ছেড়ে দিত মানুষ। এক-একটো বংশ নিব্বংশ হয়ে যেত ই রোগে। যার হয়েছে ই রোগ, সে হয়তো হা হা করে হাসছে, যা মন চায় তাই খেছে, তাপর একদিন ঠুকুস করে মরে গেল। মানুষ যি জান ভরে কাঁদবে তা কি করতে কাঁদবে? দুদিন বাদে সে-ও যে ঠুকুস করে মরবে!