কুবের পুরীর রহস্য Kuber purir Rohoshyo by হেমেন্দ্রকুমার রায় Hemendra Kumar Roy, chapter name কাচের টুকরো

কাচের টুকরো

নরকের পাপীরা কী রকম যন্ত্রণাভোগ করে জানি না, কিন্তু নিশ্চয়ই তা আমাদের। এখনকার যন্ত্রণার চেয়ে বেশি নয়। দেহের কষ্ট যে এত বেশি হতে পারে এটা ছিল আমার কল্পনাতীত।

নিচু দিকে মুখ করে ঝুলিতে ঝুলতে আকাশের চাঁদ, পাহাড়ের ঝরনা, দূর সমতল ক্ষেত্রের আঁকাবাঁকা নদীর গলানো রুপোর রেখা সব স্পষ্ট ও অস্পষ্টরূপে দেখতে পাচ্ছি কিন্তু সেসমস্তই আজ যেন বিকৃত আকার ধারণ করেছে। মানুষ তো চোখ দিয়ে দেখে না, মন দিয়ে দেখে, মন যখন অসহ্য কষ্টে ছটফট করে, বাইরের সুন্দর জগতে চোখ তখন ব্যর্থ।

মনের ও দেহের ভিতরে যা হচ্ছে, ভাষায় তা বর্ণনা করবার অসম্ভব চেষ্টা আর করব না। বাঘের ডাক শুনে মনে হচ্ছে, সে যদি এখন এসে আমাকে আক্রমণ করতে পারত, তাহলে সুখময় মৃত্যুর সম্ভাবনায় আমি এখনই আনন্দে হেসে উঠতুম! ভৈরব ঠিকই বলেছে, বেঁচে বেঁচে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করা ভয়ানকই বটে!

আর্তস্বরে আমি বলে উঠলুম, বিমল, বিমল! কেন তুমি ম্যাপখানা দিলে না! আমরা যদি মরি, গুপ্তধন ভোগ করবে কে?

বিমল প্রশান্ত কণ্ঠে বললে, আজ ম্যাপ দিইনি, কাল সকালেও দেব না!

আমি বললুম, বলো কী! তোমার কি কোনও কষ্ট হচ্ছে না? বিমল হেসে উঠে বললে, কষ্ট হচ্ছে না! হচ্ছে বইকি! কিন্তু দেহের কষ্ট আমার মনকে অধীর করতে পারে না! জানো দিলীপ, ইউরোপে মধ্যযুগে রোমান ক্যাথলিকদের রাজত্বে কয়েদিদের অমানুষিক ভাবে শাস্তি দেবার জন্যে ভীষণ সব যন্ত্র ছিল। সে-সব যন্ত্র যে ভয়াবহ যন্ত্রণা দিত, তার তুলনায় আমাদের যাতনা যথেষ্ট মোলায়েম। কোনও কোনও যন্ত্র মানুষকে বাঁচিয়ে রেখে তার দেহের সমস্ত হাড় মড়মড়িয়ে ভেঙে দিত! কিন্তু তেমন যন্ত্রণাও মুখ বুজে সহ্য করে সেকালের অনেক বন্দি অপরাধ স্বীকার করেনি। বিশেষ আমরা যখন স্বেচ্ছায় এই যাতনা বরণ করে নিয়েছি, তখন কাতর হওয়া কাপুরুষতা মাত্র।

তাহলে মরণ না হওয়া পর্যন্ত তুমি এই যাতনা সহ্য করতে চাও?

সহ্য করতে চাই না, কিন্তু সহ্য না করে উপায় কী? কুমার, তোমার অবস্থা কেমন? কুমার কেমন জড়িত, অস্বাভাবিক স্বরে বললে, তোমারই মতন।

কুমার, তোমার কি বড়ো বেশি কষ্ট হচ্ছে? তোমার কথা অমন অস্পষ্ট কেন?

আমার মুখে একখানা ধারালো কাচের টুকরো আছে।

কাচের টুকরো?

হুঁ। ওরা যেখানে ফেলে আমার পা বাঁধছিল, সেইখানে পাথরকুচির সঙ্গে এই ভাঙা কাচের ফালি পড়েছিল। আমি সকলের অগোচরে সেটা মুখে পুরে ফেলেছি!

বিমল ঝুলতে ঝুলতে মহা আনন্দে একটা দোল খেয়ে বললে, কুমার, তুমি বাহাদুর! জয় কুমার বাহাদুরের জয়!

তার আনন্দ-ধ্বনি আমার কানে এমন বেসুরো শোনাল! পাগলের মতো ভাঙা কাচের টুকরো মুখে পুরে এমন কী বাহাদুরের কাজ করেছে আমি তো কিছুতেই সেটা বুঝতে পারলুম না!

বিমল আবার সহর্ষে বলে উঠল, এতবড়ো আবিষ্কারের কথা এতক্ষণ তুমি আমাকে বললানি!

ভয়ে বলিনি। কী জানি শত্রুরা যদি কেউ উপরে লুকিয়ে থাকে।

-না, তারা আমাদের সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোতে গিয়েছে। জীবনে অনেকবার অনেক বিপদে পড়েছি, সে-সব হাসিমুখে উড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু আজ এই ভৈরব আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল, ভেবেছিলুম আমাদের লীলাখেলা এইবারে বুঝি সত্যি-সত্যিই ফুরুল–মুক্তির আর কোনও উপায় নেই। কিন্তু ধন্য কুমার, ধন্য তোমার উপস্থিত বুদ্ধি! হয়তো আমাদের মুক্তির উপায় তোমার মুখেই আছে! একবার যদি হাত দুটো খোলা পাই! তুমি তো অনেক রকম ‘বারে’র এক্সারসাইজ করেছ, দেহটা দুমড়ে মুখ তুলে কাচ দিয়ে আমার হাতের দড়ি কাটতে পারো কি না দ্যাখো না!

এই অদ্ভুত লোক দুটির আশ্চর্য কথাবার্তা আমি বিস্ময়ে অবাক হয়ে শুনতে লাগলুম! এরা বিপদকে ডরায় না, সাক্ষাৎ-মৃত্যু নিয়ে খেলা করে, শত কষ্টে অটল থাকে এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধিকেও কখনও হারায় না। কিন্তু এখনও আমি বুঝতে পারলুম না যে, কুমার কী করে বিমলের কথামতো অসাধ্যসাধন করবে!

আমরা তিনজনে প্রায় পরস্পরের সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে ঝুলছিলুম। কুমার সেই অবস্থাতেই নিজের দেহের ঊধ্বদিকটা দুমড়ে উঁচু হয়ে উঠল এবং বিমলও একটা ঝকানি দিয়ে নিজের দেহটা ঘুরিয়ে কুমারের দিকে পিছন ফিরলে এবং তার পিছমোড়া করে বাঁধা হাত দুখানা যথাসম্ভব নামিয়ে কুমারের মুখ-বরাবর আনলে। কুমার তখন কাচের টুকরোটা দাঁতে চেপে ধরে বিমলের হাতের দড়ি কাটার চেষ্টা করতে লাগল।

বিস্ময়ে, আগ্রহে ও কৌতূহলে নিজের অমন বিষম যন্ত্রণাও ভুলে গিয়ে রুদ্ধশ্বাসে চাদের আলোতে আমি তাদের কাণ্ড দেখতে লাগলুম।

একখণ্ড ভাঙা কাচ,-অকেজো বলে কবে কে এখানে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গেছে! শত্রুদের হস্তগত হয়ে আমি যখন উদভ্রান্তের মতো হয়ে উঠেছিলুম, ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমানের কোনও কথাই ভাবতে পারিনি, কুমারের স্থিরবুদ্ধি তখনই বুঝে নিয়েছিল, এই কাচের ফালিই একটু পরে আমাদের কাছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জিনিস হয়ে উঠবে। আজ এই মস্ত শিক্ষা পেলুম--আজ থেকে ধুলোকণাকেও অবহেলা করব না;-মস্তিষ্ক থাকলে, কাজে লাগাতে জানলে পৃথিবীতে কিছুই অকেজো নয়!

কিন্তু কুমারের কাজটা খুব সহজসাধ্য হল না। একে কুমার বদ্ধপদে শূন্যে ঝুলছে, তায় তার দেহের অমন অস্বাভাবিক দুমড়ানো অবস্থা, তার উপরে ভরসা কেবল দাঁত ও একখণ্ড ভাঙা কাচ! মাঝে মাঝে আবার সোজা হয়ে ঝুলে পড়ে কুমার হাঁপ ছাড়ে, মাঝে মাঝে ঝোড়ো হাওয়ার ঝাপটায় বা অন্য কারণে বিমলের ঝুলন্ত দেহ ঘুরে যায়!

প্রায় তিন ঘণ্টা চেষ্টার পর বিমলের হাতের বাঁধন কাটা গেল।

বিমল নিম্নমুণ্ডে ঝুলতে ঝুলতেই বিপুল উৎসাহে দুই বাহু ছড়িয়ে বলে উঠল, আর কারুর কোনও ভয় নেই! কুমার, তুমি একটি জিনিয়াস! তুচ্ছ একখানা ভাঙা কাচ দিয়ে আজ তুমি তিন-তিনটে মূল্যবান মানুষের প্রাণরক্ষা করলে!

আমি করুণ কণ্ঠে বললুম, কিন্তু এখনও আমরা কলার কাঁদির মতো শূন্যে ঝুলছি!

বিমল বললে, জীবনে আর কখনও হয়তো এভাবে শূন্যে ঝোলবার অবসর পাবে না, আরও মিনিট-কয়েক শূন্যে ঝোলার আমোদ ভোগ করো ভায়া! কয়-মিনিটের জন্যে বিদায়! বলেই সে খুব জোরে দুবার দোল খেয়ে নিজের দেহকে উপরদিকে দুমড়ে ফেলে ঊর্ধ্বে উঠে মূল মোটা দড়িগাছা চেপে ধরলে এবং তারপর এক হাত মূল দড়িতে রেখে আর এক হাতে আপনার পায়ের বাঁধন খুলতে লাগল।

পায়ের বাঁধন খুলতে বেশি দেরি লাগল না। বিমল তখন দড়ি ধরে সড়-সড় করে উপরে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল।

তারপরেই সে উপর থেকে বললে, এইবার আমি তোমাদের তুলছি!

আমাদের দুজনের দেহ ওজনে চার মনের কম হবে না। কিন্তু বিমল অনায়াসেই আমাদের টেনে তুলতে লাগল।

পাহাড়ের উপরে গিয়ে আমাদের দেহ যখন বন্ধনমুক্ত হল, তখন পূর্ব-আকাশে রাঙা পদ্মের মতো তাজা রং ফুটে উঠেছে।

আমার দেহের অবস্থা এমন যে, পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে আবার অবশ হয়ে বসে পড়লুম। অথচ এমন অবস্থাতেও বিমলের শক্তি ফুরিয়ে যায়নি-একসঙ্গে আমাদের দুজনের দেহ টেনে উপরে তুলেছে।

পাহাড়ের উপরে আমাদের জুতোগুলো পড়ে রয়েছে, আমাদের পা বাঁধবার সময়ে ভৈরবের দল ওগুলো খুলে নিয়েছিল।

নিজের একপাটি জুতো হাতে তুলে নিয়ে বিমল মৃদু হেসে বললে, এ জুতোর গুপ্তরহস্য, কুমার, জানো তো?

কুমারও হেসে ঘাড় নেড়ে বললে, জানি।

আমি সকৌতুহলে বললুম, জুতোর গুপ্তরহস্য! সে আবার কী?

বিমল বললে, শূন্যে ঝুলতে ঝুলিতে আমার খালি এই ভাবনাই হচ্ছিল যে, পাছে ভৈরব আমার জুতো চুরি করে। কিন্তু তুচ্ছ জুতোগুলো নেড়েচেড়ে দেখা সে দরকার মনে করেনি। দিলীপ, যার জন্যে এত হানাহানি, এই জুতোই হচ্ছে তার ভাণ্ডার! দ্যাখো!' বলেই সে জুতোর গোড়ালি থেকে খুদে ড্রয়ারের মতো একটা অংশ টেনে বার করলে এবং তার মধ্যে রয়েছে। গুপ্তধনের সেই মূল্যবান ম্যাপ!

আমি সবিস্ময়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম!

কুমার বললে, দিলীপ, বিমলের এই স্পেশ্যাল জুতোর চোরা-কুঠুরি আফ্রিকাতেও আর একবার আমাদের মুখরক্ষা করেছিল?

আমি বললুম, ভৈরব যার লোভে এত মহাপাপ করছে, আবার হাতে পেয়েও তাকে হারালে?

কুমার বললে, এই হাতে পেয়েও হারানোর দুঃখ হচ্ছে দুনিয়ার আর একটা বিশেষত্ব। ভগবান আমাদের চারপাশে রয়েছেন, কিন্তু অজ্ঞান মানুষ তবু তাঁকে দেখতে না পেয়ে তীর্থে তীর্থে মন্দিরে মন্দিরে দূরে-দূরান্তরে আকুল হয়ে ছুটে যায় আর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভগবানকে খুঁজে না পেয়ে হাহাকার করতে থাকে।

হঠাৎ বিমল দাঁড়িয়ে উঠে কান পেতে কী শুনতে লাগল। বললে, নীচে যেন কাদের গলা পাওয়া যাচ্ছে! দাঁড়াও, একটু এগিয়ে দেখে আসি! বলেই সে পথের দিকে এগিয়ে গেল এবং তারপরেই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে ফিরে এসে বললে, আট-দশজন লোক আসছে। নিশ্চয় ভৈরবের দল সকাল হয়েছে দেখে আবার আমাদের আদর করতে আসছে!

শুনেই আমাদের সমস্ত শান্তি পালিয়ে গেল, একলাফে আমরা উঠে দাঁড়ালুম।

বিমল ব্যস্ত স্বরে বললে, ওদের সঙ্গে লড়বার শক্তি আমাদের নেই—আমরা নিরস্ত্র! আমাদের পালাতেই হবে। কিন্তু কোনদিকে পালাই? আমাদের ফেরবার পথ দিয়েই ওরা আসছে। উতরাই দিয়ে নামা ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায় নেই! এসো, এসো-জলদি!

আমরা উতরাইয়ের পথ ধরলুম—শুনেছি এই উতরাই দুই মাইল লম্বা। অতিশয় সাবধানে ধীরে ধীরে নামতে হবে কারণ প্রতিপদেই এখানে মৃত্যুর সম্ভাবনা!

কিন্তু পিছনে আসছে যমদূতের দল, ধরতে পারলে তারা আমাদের কুকুরের মতো মেরে ফেলবে! তাদের ভয়ে আমরা সমস্ত সাবধানতা ভুলে গেলুম! পদে পদে মৃত্যুকে সামনে রেখে যে-রকম মরিয়ার মতো আমরা সেই বন্ধুর, প্রায়-খাড়া চড়াইয়ের পাথর থেকে পাথরে লাফিয়ে নামতে লাগলুম, কেউ তা দেখলে নিশ্চয় আমাদের বদ্ধপাগল বলে মনে করত! সেদিন যে আমরা মরিনি কেন, সেটা ভাবলে এখনও বিস্মিত হই! প্রত্যেক লাফেই আমরা মৃত্যুর মুখে ঝাপ দিচ্ছি, কিন্তু প্রত্যেক বারেই মৃত্যু যেন দূরে সরে গিয়ে আবার পরের বারের জন্যে অপেক্ষা করছে।

মাইল-খানেক পথ নেমে আমি শুয়ে পড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললুম, ‘বিমল, আমার দম বেরিয়ে গেছে—আমি আর পারছি না।

বিমল এক টান মেরে আমাকে খাড়া করে তুলে বললে, ভৈরব এতক্ষণে আমাদের পলায়ন আবিষ্কার করেছে! সে-ও হয়তো সদলবলে এই পথেই তেড়ে আসছে।

কুমার বললে, আসছে কী—ওই এসে পড়েছে! উপর দিকে চেয়ে দ্যাখো! সত্য! উতরাইয়ের অনেক উপরে দেখা গেল, একদল লোক তাড়াতাড়ি নীচের দিকে নেমে আসছে!

শরীরের শেষ শক্তি একত্র করে উঠে দাঁড়িয়ে আবার আমি নামতে লাগলুম। ওই রাক্ষসদের কবলে যাওয়ার চেয়ে এই পাহাড় থেকে পড়ে মরা ঢের ভালো।

কিন্তু আমার গতি ক্রমেই কমে আসছে, হাঁপের চোষ্টে বুক যেন ফেটে যাচ্ছে; কাল সারারাত ওরা পায়ে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে রেখেছিল, তার উপরে এই সাংঘাতিক পথ, আমার পা এখন সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়ল, আবার আমি আচ্ছন্নের মতো হয়ে শুয়ে পড়লুম।

ভৈরবের দল তখন বেশ কাছে এসে পড়েছে, তাদের তো সারা রাত হেঁটমুখে শুন্যে দোল খেতে হয়নি, তাই সতেজ দেহে এত শীঘ্র এতখানি পথ নেমে আসতে পেরেছে! বিপদের উপর বিপদ! তারা আমাদের লক্ষ্য করে বড়ো বড়ো পাথরবৃষ্টি করতে লাগল। আমাদের সৌভাগ্যক্রমে দরকার হবে না ভেবে ভৈরব আজ বোধহয় বন্দুকটা সঙ্গে আনেনি, বন্দুক থাকলে এতক্ষণে আমাদের আর দেখতে-শুনতে হত না।

বিমল বললে, ওঠো ভাই দিলীপ, লক্ষ্মীটি। আর বেশি পথ নেই—আমরা তো নীচে এসে পড়েছি!

আবার পুঁকতে ধুকতে ওঠবার চেষ্টা করলুম-কিন্তু বৃথা চেষ্টা! আমার দেহে আর একফোটা শক্তি নেই! ক্ষীণ স্বরে বললুম, বিমল! কুমার! আমার জন্যে এখানে দাঁড়িয়ে থেকে তোমরাও আর মরণকে ডেকে এনো না! তোমরা পালাও—আমার আয়ু ফুরিয়েছে!

শত্রুর দল আরও নিকটস্থ হয়ে হই-হই রবে চিৎকার করে উঠল। তারপরেই একরাশ পাথর বৃষ্টি! একখানা পাথর কুমারের মাথা ঘষে চলে গেল—তার মুখের উপর দিয়ে দর-দর ধারে রক্ত পড়তে লাগল।

বিমল তাড়াতাড়ি নিজের রুমাল বার করে কুমারের মাথাটা বেধে দিলে, তারপর প্রদীপ্ত চক্ষে ঊর্ধ্বমুখে ভৈরবদের উদ্দেশে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে ক্রোধবিকৃত স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, যদি দিন পাই, এই রক্তপাতের প্রতিশোধ নেব!

আমি কাতর স্বরে বললুম, হয় ওদের ম্যাপ ফিরিয়ে দাও, নয় এখান থেকে পালাও!

বিমল একবার আমার দিকে তাকিয়ে দেখলে—তার মুখে দুশ্চিন্তার কোনও চিহ্নই নেই! তারপরেই সে হঠাৎ হেঁট হয়ে পড়ে অতি-অনায়াসে আমাকে ঠিক শিশুর মতোই পিঠে তুলে নিলে। তারপর গায়ের কাপড় দিয়ে আমাকে তার পিঠের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে নিয়ে আবার নীচের দিকে দ্রুতপদে নামতে লাগল। সেই প্রায়-মূর্হিত অবস্থাতেও তার অসাধারণ গায়ের জোর দেখে আমার মন সচকিত হয়ে উঠল! তার মাংসপেশিগুলো কি মহাশক্তির গুপ্তমন্ত্রে তৈরি, শত ব্যবহারেও তারা নিস্তেজ হতে জানে না?

খানিকক্ষণ পরে উতরাই যখন শেষ হল তখন ভৈরবদের দল আমাদের কাছ থেকে মাত্র হাত-ত্রিশ উপরে! আর বোধহয় ওদের খপ্পর থেকে রক্ষা নেই!

সামনেই কালী নদী, কিন্তু তার রূপ আজ বদলে গেছে। তার জলে এখন নূপুর নিক্কণের মতো মিষ্টধ্বনি নেই, নর্তকীর লাস্যলীলাও নেই! নদীর হাত-ত্রিশ চওড়া খাদের ভিতরে ভীষণ প্রবল জলের ধারা যেন রুদ্ধ ক্রোধে ও আক্রোশে ফুলে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে—যেমন ভয়ঙ্কর তার গতি, তেমনি স্তম্ভিত-করা তার গর্জন! তরঙ্গের পর তরঙ্গ তাড়াতাড়ি হুড়োহুড়ি করে সূর্যালোকে চকচকে ইস্পাতের দীর্ঘ অস্ত্রের মতো লকলক করতে করতে লাফাতে লাফাতে ছুটে যাচ্ছে- টগবগ করে ফুটছে পুঞ্জ পুঞ্জ ফেনা! চিরস্থির প্রস্তর-রাজ্যে সেই মৃত্যুরূপিণী তরঙ্গিনীর অস্থিরতা দেখে প্রাণ যেন ভয়ে শিউরে উঠল! কিন্তু তার এই হঠাৎ পাগলামির কারণ তখন বুঝতে পারিনি-পরে বুঝেছিলুম।

সেই কালী নদীর উপরে রয়েছে কাঠ প্রভৃতি দিয়ে তৈরি ছোটো একটা পলকা সেতু-উন্মত্ত তরঙ্গের ধাক্কার পর ধাক্কায় তা থর-থর করে কাঁপছে!

বিমল ও কুমার সেইখানে ক্ষণিকের জন্যে দাঁড়িয়ে বোধহয় কী করবে তাই ভাবতে লাগল। সেই পলকা সাঁকো এখন আমাদের ভার সইতে পারবে কি না, সন্দেহ হয়।

ইতিমধ্যে ভৈরবদের দলের একটা লোক সর্বাগ্রে আমাদের খুব কাছে এসে পড়ল তার হাতে একখানা মস্ত ছোরা!

কুমার চোখের পলক পড়তে-না-পড়তেই মাটি থেকে প্রকাণ্ড একখানা পাথর তুলে নিলে এবং সবেগে ও সজোরে সেই লোকটার দিকে নিক্ষেপ করলে!

আমার মনে হল, সশব্দে হতভাগ্যের মাথার খুলি ফেটে গেল—একটিমাত্র চিঙ্কার করেই লোকটা ধুপ করে মাটির উপরে ঠিকরে পড়ে ছটফট করতে লাগল! তাকে নিশ্চয় আর পৃথিবীর আলো দেখতে হয়নি। চোখের সামনে মানুষ বধ এই আমি প্রথম দেখলুম-শিউরে উঠে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলুম!

কুমার, কুমার, কী করি?

চলো, পোল দিয়ে ওপারে!

তারপর?

লড়তে লড়তে মরব!

বহুৎ-আচ্ছা! বিছানায় শুয়ে বুড়ো হয়ে রোগে ভুগে মরার চেয়ে সে মরণ ঢের ভালো মরণ! শত্রু মেরে মরব।

কুমার ও আমাকে পিঠে নিয়ে বিমল সেতুর উপর দিয়ে ছুটল-আমি সভয়ে মুখ ফিরিয়ে দেখলুম, আমাদের পিছনে পিছনে শত্রুদেরও একজন লোক তরোয়াল উঁচিয়ে তেড়ে আসছে এবং তারও পরে আরও তিনটে লোক হুড়মুড় করে সেতুর উপরে এসে পড়ল! এত চেষ্টার পরেও বোধহয় এ-যাত্রা আর রক্ষা নেই!

কিন্তু এমন সময়ে ঘটল এক কল্পনাতীত ঘটনা!

আচম্বিতে কালী নদীর সেই সেতু ভীষণ শব্দে ক্ষুধিত জলের গর্ভে মড়মড়িয়ে ভেঙে নেমে গেল!

কুমারের পর আমাকে নিয়ে বিমল তখন সবে ওপারে পা দিয়েছে।

যে-চারজন শত্রু সেতুর উপরে ছিল, তারাও তীব্র আর্তনাদে চারিদিক কাপিয়ে তলিয়ে গেল! দুটো দেহ জলের উপরে একবার ভেসে উঠে এবং আর একবার চিৎকার করে বিদ্যুৎবেগে পাক খেয়ে আবার অদৃশ্য হল!

বিমল ও কুমার বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইল। ওপারেও স্তম্ভিতের মতো দাঁড়িয়ে আছে ভৈরব ও তার সঙ্গীরা! চোখের সুমুখে এ কী অভাবিত দুঃস্বপ্নের অভিনয়! এও কি সম্ভব?

মাঝখান দিয়ে নির্দয় কৌতুকে মৃত্যু-প্রলাপে মেতে ও অট্টহাস্য করে বেগে ছুটে চলেছে উন্মাদিনী কালী নদী—সেতুর ভাঙা কাঠগুলো পর্যন্ত কোথায় ভেসে গিয়েছে তার আর কোনও ঠিকানাই নেই! সমস্ত এক মুহুর্তে গ্রাস করে জীবন্ত এক বিরাট জলরূপী অজগরের মতো নদী পাকসাট খাচ্ছে, একবার স্ফীত ও উঁচু হয়ে উঠছে, আবার খলখল চামুণ্ডা-হাসি হেসে নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে, এবং বারে বারে প্রচণ্ড হিংসায় হিমালয়ের দেহ যেন ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবার জন্যে কূলে কূলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে!

আমি বললুম, আর নয় বিমল, এইবার আমাকে ঘাড় থেকে নামাও!

বিমল আমাকে নামিয়ে দিলে।।

ও আবার কার স্বর? কে চেঁচিয়ে কাঁদে, কে সাহায্য চায়?

তীরের কাছে, জলের ভিতরে একটা প্রকাণ্ড পাথর ধরে ঝুলছে সেই লোকটা যে তরবারি নিয়ে আমাদের পিছনে ধেয়ে আসছিল।

আমাদের উদ্দেশে সক্রন্দনে সে বললে, বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও! ঢেউ আমাকে টানছে— আর আমি পারছি না।

স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে বুকে দুই হাত বেঁধে বিমল বললে, যা, তুই নরকে যা! একটা দড়িটড়ি ফেলে দিয়ে হয়তো তোকে আমি বাঁচাতে পারতুম, কিন্তু তোকে আমি বাঁচাব না!

তোমার পায়ে পড়ি, এমন কাজ আমি আর কখনও করব না! বাঁচাও গেলুম, গেলুম, বাঁচাও বাঁচা নদীর স্ফীত জলরাশি হঠাৎ লাফিয়ে উঠে ঠিক কোনও হিংস্র দানবের মতো তাকে যেন কোঁত করে গিলে ফেললে।

কাঁপতে কাঁপতে আমি চোখ মুদে ফেললুম—এ কী ভয়ানক মৃত্যু!

ওপার থেকে এতক্ষণ পরে ভৈরব কথা কইলে! কর্কশ চিল্কার করে বললে, আমাকে বড়ো ফঁকি দিলি তোরা! আচ্ছা, এর পরের বারে তোদর সঙ্গে আবার যখন দেখা হবে—

‘তখন তোকেই আমি আগে বধ করব!’ বলেই বিমল খিল-খিল করে হেসে উঠল।

ব্যর্থ আক্রোশে আমাদের দিকে একখানা পাথর ছুড়ে ভৈরব বললে, জীবন থাকতে আমি তোদের ছাড়ব না!

পকেট থেকে একখানা কাগজ বের করে তুলে ধরে বিমল ব্যঙ্গের স্বরে বললে, এই দেখ সেই ম্যাপ! নিবি তো এগিয়ে আয়!

ভৈরব গর্জন করে উঠল!

কুমার হাসতে হাসতে বললে, আর দরকার নেই বিমল, চলো আমরা এখান থেকে চলে যাই।

সেতুভঙ্গের কারণ পরে শুনেছিলুম।

বেশি বৃষ্টি হলে, কিংবা বেশি গরমে হিমালয়ের টঙে বরফ গলে গেলে, কালী নদীর জল ক্ষেপে উঠে এখানকার পলকা সেতু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। প্রতি বৎসরেই নাকি এমন ব্যাপার হয়।

তবু কেন যে এখানে বড়ো ও দৃঢ় সেতু তৈরি করা হয় না তা জানি না, কেননা মানস সরোবরের যাত্রীদের ও স্থানীয় লোকদের পক্ষে এই সেতুটি অত্যন্ত দরকারি।

কিন্তু আমাদের অদৃষ্টে যথাসময়ে এই সেতু ভাঙার মধ্যে আমি ভগবানের মঙ্গলময় হস্তই দেখতে পাই। এই সেতু আত্মদান করে আমাদের বাঁচালে এবং সেই সঙ্গে পাপীদেরও শাস্তি দিলে।