কুবের পুরীর রহস্য Kuber purir Rohoshyo by হেমেন্দ্রকুমার রায় Hemendra Kumar Roy, chapter name গুহা-ভূত

গুহা-ভূত

আজ আমরা একটি পাহাড়ের নীচে তাঁবু ফেলেছি। এই পাহাড়টির নাম গুরলা। এটি পার হলেই রাবণ হুদ বা রাক্ষস তাল।

পথের প্রায় শেষে এসে দাঁড়িয়ে আমাদের মনে উত্তেজনার অন্ত নেই! রাবণ-হ্রদের কাছেই আছে রত্নগুহার গুপ্তধন!

লিধুপুরা থেকে এই গুরলা পাহাড় পর্যন্ত সর্বদাই আমরা সাবধানে এসেছি আমাদের সতর্ক চক্ষু একবারও অন্যমনস্ক হয়নি। কিন্তু শত্রুরা একেবারেই অদৃশ্য। মাঝে মাঝে লাল বা ধূসর রঙের নানা আকারের পাহাড়—তার পরেই তুষার-সাম্রাজ্য। পথে ও প্রান্তরেও বরফের আভাস, সবুজের স্নিগ্ধতা নিঃশেষে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে মধ্যে কখনও কখনও পথিকের সঙ্গে দেখা হয়, কিন্তু তারা সবাই হচ্ছে ভুটিয়া কি তিব্বতি। কেউ ঘোড়ায় চড়ে যায়, কেউ যায় হেঁটে। মাঝে মাঝে তিব্বতি ভিখারির দল এসে জ্বালাতন করে। কিন্তু এদের মধ্যে ভৈরবের ছদ্মবেশে থাকাও অসম্ভব। ভৈরব ভুটিয়া কি তিব্বতি পোশাক পরতে পারে, কিন্তু নিজের নাক থ্যাবড়া, গালের হাড় উঁচু ও চোখ কুতকুতে করে তোলবার জন্যে নিজের মুখ তো আর ভেঙেচুরে তুবড়ে গড়তে পারবে না। আমাদের অপরিচিত তিব্বতি চৌকিদার-বন্ধুরা নিশ্চয়ই এখনও তাদের জেলখানা থেকে বিদায় করে দেয়নি! আমি যেন মানসচক্ষে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, লোহার শিকল পরে ভৈরবচন্দ্র বিফল ক্রোধে মাথার চুল ছিড়ছে, গর্জন করছে এবং ভাবছে এতক্ষণে আমরা হয়তো সদলবলে রত্নগুহা লুণ্ঠন করছি!

এখানেও সকালে ও রাতে রক্ত-জমানো শীত, কিন্তু দুপুরবেলায় বিষম তাপে এবং শুকনো ঝোড়ো হাওয়ার দাপটে পথ চলা অসম্ভব। চোখের সামনে বরফের বিরাট স্থুপ, কিন্তু বুকের ভিতরে মরুভূমির জ্বালা-কাজেই দুপুরে আমরা তাবুর ভিতরে ঢুকে দিবানিদ্রায় সময় কাটাবার চেষ্টা করতুম। সে-সময়ে পাহারা দিত খালি বাঘা বাঘা এমন সজাগ হয়ে পাহারা দিতে শিখেছিল যে, সকলে মিলে একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়তেও আমরা ভয় পেতুম না।

আজ দুপুরে একটা ঘটনা ঘটেছে। যদিও ঘটনাটা বিশেষ কিছুই নয়, তবু মনে একটা খটকা লেগে গেল।

আমরা সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। হঠাৎ বাঘার চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল।

বিস্মিত নেত্রে দেখলুম, তাবুর দরজার কাছে একটা ভীষণ দুষমন চেহারার লোক দাঁড়িয়ে তীক্ষদৃষ্টিতে চারিদিক লক্ষ করছে!

তার দেহ লম্বায় ছয় ফুটেরও বেশি-খুব জোয়ান চেহারা। মুখখানা একেবারে তিব্বতি ছাঁচের। মাথায় টুপি, পিছনে টিকি বা বেণী, গায়ে কোর্তা, পায়ে এদেশি ধ্যাবড়া বুট। কোমরবন্ধে ঝুলছে তরবারি ও পিঠে বাঁধা সেকেলে গাদা বন্দুক এবং ডান হাতে একগাছা খাটো কিন্তু মজবুত লাঠি।।

বিমল ধড়মড় করে বিছানার উপরে উঠে বসে হিন্দিতে রুক্ষস্বরে বললে, কে তুমি?

প্রথমে সে কোনও জবাব দিলে না, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাদের মোটঘাটগুলো দেখতে লাগল। বিমল আবার শুধোলে, এখানে কী দরকার তোমার? অত্যন্ত অবহেলা-ভরে বিশ্রী ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে সে বললে, তোমরা এখানে কী করছ? বিমল বললে, আমরা তীর্থযাত্রী। মানস সরোবর যাচ্ছি।

লোকটা সন্দেহ-ভরা চোখে আমাদের পোশাকের দিকে তাকিয়ে রইল। আমাদের মতো প্যান্ট-কোট-বুট পরা তীর্থযাত্রী দেখতে সে বোধ হয় অভ্যস্ত নয়।

বিমল বললে, তোমার কোনও দরকার আছে? সে জবাব না দিয়েই বেরিয়ে গেল। তারপরেই বাইরে ঘোড়ার পায়ের শব্দ পেলুম। আমি তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখোলম, লোকটা ঘোড়া ছুটিয়ে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

কুমার বললে, কে জানে, এ আবার কোন মূর্তি!

বিমল বললে, দিলীপের বাবার চিঠির কথা মনে করো। এখানে ডাকাতের ভয় আছে। এখানকার লামারাও নাকি সর্বদাই সাবধান হয়ে থাকে, পাছে কেউ গুপ্তধন চুরি করতে আসে। ও লোকটা হয়তো তাদেরই কারুর চর!

আমি ক্ষুব্ধ স্বরে বললুম, তাহলে আবার কি আমাদের নতুন নতুন শত্রুর সঙ্গে যুঝতে হবে?

বিমল হাসতে হাসতে বললে, তা হবে বইকি! গুপ্তধন কি নিজের বাড়ির বাগানে গাছের ফল, যে হাত বাড়িয়ে পেড়ে নিলেই হল? এখনও কত নতুন শত্রুর সঙ্গে দেখা হবে, কে তা বলতে পারে? হয়তো শেষ পর্যন্ত আমরা গুপ্তধনের কাছেই যেতে পারব না!

আমি আরও বেশি মুষড়ে পড়ে বললুম, তাহলে মিছামিছি নিজেদের জীবনকে এমন ভাবে বিপন্ন করে লাভ কী?

বিমল হো-হো করে উচ্চহাসি হেসে বললে, কী বললে দিলীপ? লাভ? তুমি কি কেবল লাভের জন্যেই এখানে এসেছ? তাহলে আমরা এখানে এসেছি কেন? গুপ্তধনে তো অধিকার কেবল তোমারই, আমরা তো কোনওদিনই তোমার অংশীদার হতে চাইনি! আমরা এসেছি শুধু বিপদের শিক্ষালাভের জন্যে। মানুষের ভিতরে কতটা শক্তি লুকিয়ে আছে, এই বিপদের শিক্ষালয়েই তার চরম পরীক্ষা হয়। উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে যাবার জন্যে, হিমালয়ের সর্বোচ্চ শিখরে ওঠবার জন্যে, উড়োজাহাজে চড়ে পৃথিবীর এপার থেকে ওপারে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি পৌঁছবার জন্যে মানুষ এই যে দলে দলে প্রাণ দিচ্ছে, এ-সব করছে তারা কোন লাভের আশায়? প্রাণ গেলে আবার লাভের আশা কী? আমরা বলি—আপনি বাঁচলে বাপের নাম! ওরা তা বলে না! মানুষের সুনামের জন্যে ওরা হাসতে হাসতে আত্মবলি দেয়। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেই মানুষ মৃত্যুজয়ী হয়, এইটুকুই হয়তো ওদের লাভ? কোনও লাভের আশা রেখো না দিলীপ, বিপদের ভিতর দিয়ে স্বেচ্ছায় অগ্রসর হয়ে মনুষ্যত্বের পরিচয় দিতে শেখো। মানুষ আজ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব হতে পেরেছে কেবল এই শিক্ষার গুণেই।

আমি মাথা নামিয়ে লজ্জিত স্বরে বললাম, ভাই বিমল, বিপদের পাঠশালায় সবে আমার হাতেখড়ি হচ্ছে, মাঝে মাঝে তাই ভুল কথা বলে ফেলি। তুমি আমায় ক্ষমা করো।

কুমার আমার পিঠ চাপড়ে সহানুভূতি জানিয়ে বললে, অতটা লজ্জা পাবার দরকার নেই। রোমও একদিনে তৈরি হয়নি, শিশুও একদিনে মানুষ হয় না।

বিমল ততক্ষণে গুপ্তধনের নকল ম্যাপখানা নিয়ে বিছানার উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। অনেকক্ষণ ধরে সেখানা দেখে সে মুখ তুলে বললে, দিলীপ, কুমার, তোমরাও দ্যাখো। এখন চড়াই পার হয়ে আমাদের গুরলার উপরে উঠতে হবে। তারপর উতরাই দিয়ে নেমে গিয়ে পড়ব রাবণ হ্রদের ধারে। ম্যাপের দিকে তাকালেই দেখোতে পাবে, মাঝখানে পাহাড়ের উঁচু পাঁচিল সোজা চলে গিয়েছে, তার একধারে রাবণ হ্রদ, আর একধারে মানস সরোবর--ম্যাপে এই দুটো হ্রদের নাম নেই, শুধু লেখা আছে—সরোবর, কেন, তা তোমরা আগেই শুনেছ। দুই হ্রদের মাঝখানকার পাহাড় শ্রেণীর মধ্যে এক জায়গায় তাঁরকাটা আর পাশেই লেখা গুহা। এই গুহাই হচ্ছে আমাদের গন্তব্য স্থান, কেননা এখানেই আছে গুপ্তধন! কিন্তু কেবল গুহা বললে তো কিছুই বলা হয় না, এমন দীর্ঘ পাহাড় শ্রেণীর মধ্যে গুহা আছে হয়তো শত শত, প্রত্যেক গুহা খুঁজলেও হয়তো বুঝতে পারব না ঠিক কোনটি হচ্ছে গুপ্তধনের রত্নগুহা। যিনি ম্যাপ এঁকেছেন, তিনি সেটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এই দ্যাখো, যেখানে ‘গুহা’ লেখা, ঠিক তার উপরেই আঁকা পাশাপাশি তিনটি শিখর। জায়গাটা দেখছি পাহাড় শ্রেণীর ঠিক মাঝবরাবর। তাহলে ওই পাহাড় শ্রেণীর মাঝবরাবর গিয়ে আমাদের এমন একটা পাহাড় খুঁজে বার করতে হবে, যার উপরে পাশাপাশি তিনটি শিখরের তলায় গুহার অস্তিত্ব আছে। এ ম্যাপ বোঝা খুবই সহজ, কোথাকার ম্যাপ জানলে আর কিছুই বেগ পেতে হয় না। কুমার, মনে পড়ে, আসামে যকের ধন আনতে যাবার আগে মড়ার মাথার উপরে ক্ষোদা সাঙ্কেতিক লিপি পড়বার জন্যে আমাদের কী কষ্টই না করতে হয়েছিল?

কুমার বললে, মনে পড়ে না আবার? সেই তো আমাদের প্রথম বিপদের শিক্ষা, সে কথা কি ভুলতে পারি?

এমন সময়ে রামহরি হঠাৎ আমাদের পিছন থেকে গলাটা লম্বা করে বাড়িয়ে দিয়ে সাগ্রহে বললে, “দেখি খোকাবাবু, আমিও একবার ম্যাপটা দেখি!

বিমল বললে, কেন, তুমি আবার ম্যাপে কী দেখবে?

তোমাদের গুহা-ভূত কোথায় থাকে, একবার দেখোতে সাধ হচ্ছে! কুমার বললে, গুহা-ভূত আছে তোমার মুণ্ডুর ভিতরে, ম্যাপে তার চেহারা আঁকা নেই।

রামহরি চটে বললে, আমার মুণ্ডুর ভিতরে কোনওদিন কোনও ভূতকে আড্ডা গাড়তে দিইনি, ভূত চেপেছে তোমাদের ঘাড়ে, তাই দেশ ছেড়ে এখানে ছুটে এসেছ?

বিমল বললে, রামহরি, প্রস্তুত হও! আজ পূর্ণিমার চাঁদ উঠবে, সন্ধের আগেই তাবু তুলে আমরা গুরলা পাহাড়ে উঠব! হয়তো কালকেই আমরা তোমার সঙ্গে গুহা-ভূতের পরিচয় করিয়ে দিতে পারব।