গোলাপ ফুলের মুল্লুক
‘নির্পানীকা সড়ক’ নামে পথ বটে, কিন্তু আসলে বিপথ। দুইক্রোশব্যাপী বিষম এক চড়াই, ওঠবার সময়ে তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে যায়, কিন্তু কোথাও জল নেই! কালী নদীর সাঁকো ভেঙে গেলে এই পথই হয় যাত্রীদের অবলম্বন। কাজেই অর্ধ-মৃতদেহ নিয়ে এই বিপথ দিয়েই আমাদের ফিরে আসতে হল।
পথ হোক বিপথ হোক, প্রাণ নিয়ে যে ফিরে আসতে পারলুম, এইটুকুই সৌভাগ্যের কথা! ভৈরব নিশ্চয়ই তখনও এ-পথের কথা জানতে পারেনি, নইলে আমাদের অবস্থা হত হয়তো তপ্ত কটাহ থেকে জ্বলন্ত উনুনে ঝাপ দেওয়ার মতো।
আমাদের সন্ধান না পেয়ে রামহরির উদ্বেগের সীমা ছিল না, বাঘাও নাকি আজ খাবার ছোঁয়নি। রাতে আমরা ফিরিনি, সকাল গেল-দুপুর গেল তবু আমাদের দেখা নেই এবং উত্থানশক্তিহীন আহত রামহরির পক্ষে আমাদের খোঁজ নেওয়াও অসম্ভব। সুতরাং সে কেবল কেঁদেকেঁদেই সময় কাটিয়েছে!
এখন ক্ষতবিক্ষত শ্রান্ত দেহে সকলকে ফিরে আসতে দেখে সে হাঁউ-মাউ করে চেঁচিয়ে উঠল, বিমলের মাথাটা দুই হাতে বুকের কাছে টেনে নিয়ে কান্না-ভরা গলায় রামহরি বললে, খোকাবাবু, তুমি কি আমার সর্বনাশ করতে চাও? গতর যে চূর্ণ হয়ে গেছে, কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
রামহরিকে শান্ত করতে সেদিন বিমল ও কুমারের অনেকক্ষণ লেগেছিল!
ধরতে গেলে, এখন শুধু রামহরির নয়, আমাদের প্রত্যেকেরই অবস্থা শয্যাগত হবার মতো! গায়ের ব্যথা মরতে ও ক্ষতস্থানগুলো সারতে প্রায় দুই হপ্ত লাগল। এই দু-হপ্তা আমরা আর মানস সরোবরের পথে পা বাড়ালুম না।
বিমল বললে, এ একরকম ভালোই হল! আমরা যে পিছিয়ে পড়ে এখানে বসে আছি, ভৈরব তা জানে না। দলবল নিয়ে নিশ্চয়ই সে এগিয়ে যাচ্ছে আর আমাদের চারিদিকে খুঁজছে। আমরা যে মানস সরোবরের দিকে যেতে চাই, তাও সে জানে না। হয়তো আমাদের খোঁজে সে এখন নেপালে ঢুকে পথ হেঁটে মরছে! আমাদের এখন উচিত হচ্ছে, তাকে আরও দূরে আর ভুল পথে যাবার সময় দেওয়া। সুতরাং বুঝতেই পারছ, আমরা এখানে অলস হয়ে বসে থেকেই খুব মস্ত কাজ করছি। আহত না হলেও আমি এখন এই উপায়ই অবলম্বন করতুম!
কুমার বললে, ভৈরবদের দল এখন প্রায় আধাআধি হালকা হয়ে গেছে। তারা গুণতিতে ছিল বারোজন। একজনকে আমি বোধহয় বধই করেছি, আর চারজনকে গ্রাস করেছে কালী নদী, তাহলে ওদের দলে এখন সাতজনের বেশি লোক নেই। আমরা হচ্ছি চারজননা, বাঘাও বড়ো কম নয়, তাকে নিয়ে পাঁচজন! ভৈরবকে আর আমি ডরাই না?
আমি বললুম, কিন্তু ভৈরবের একটা কথায় আমি যে বড়ো দমে গিয়েছি ভাই! আমার ঠাকুরদা তার বাবাকে হত্যা করে গুপ্তধনের ম্যাপ পেয়েছিলেন? তাহলে ধর্মত এই গুপ্তধন থেকে ভৈরব বঞ্চিত হতে পারে না।
বিমল বললে, আমি ভৈরবের মতো মহাপাপীর একটা কথাও বিশ্বাস করি না। তুমি কি তোমার ঠাকুরদার ইতিহাস জানো না?
ও-সব কোনও কথাই আমি শুনিনি। তবে আমার ঠাকুরদা বড়োই বদরাগি মানুষ ছিলেন—বাবা একমাত্র ছেলে হয়েও তার সামনে ভয়ে মুখ তুলে কথা কইতে পারতেন না!
কুমার বললে, কে জানে ভৈরবের বাপ ছেলের মতোই গুণধর ছিল কি না! তোমার ঠাকুরদা হয়তো আত্মরক্ষার জন্যেই তাকে বধ করেছিলেন—যেমন আমার হাতে মরেছে ভৈরবের এক স্যাঙাত!
বিমল বললে, কিছুই অসম্ভব নয়! মোদ্দা কথা হচ্ছে এই যে, ম্যাপ যখন আমাদের কাছে, তখন শেষ পর্যন্ত না দেখে আমরা কিছুতেই ছাড়ব না! অতএব দিন-কয় এখন নিশ্চিন্ত হয়ে বসে খাও-দাও মজা করো, আর ভৈরব পথে পথে ঘুরে কাহিল হয়ে পড়ুক!
দিন-কয় এ-জায়গাটার হালচাল দেখে কাটিয়ে দিলুম। আবার যাত্রা আরম্ভ করবার আগে, মাইল ত্রিশ পথ খুব সন্তর্পণে এগিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখলুম, ভৈরবরাও কোথাও লুকিয়ে আছে কি না! কিন্তু কোথাও তাদের টিকি পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারলুম না!
এ হচ্ছে থ্যাবড়া নাক ভুটিয়াদের মুল্লুক। মেয়েরাই এখানে বেশি কাজকর্ম করে, পুরুষরা বেশির ভাগ সময়ই পিতলের হুঁকায় তামাক টানতে টানতে আড্ডা দিয়ে আয়েস করে কাটায়।
এদের বিয়ে বড়ো মজার। বর আর কনে পরস্পরকে পছন্দ করলেই এবং কনের আংটি গড়াবার জন্যে বর কন্যাপক্ষকে গোটাকয়েক টাকা দিলেই বুঝতে হবে ব্যস, বিয়ে হয়ে গেল,—না আছে সেকেলে বাপ-মায়ের মত নেওয়া, না আছে কোনও আজেবাজে মন্ত্রতন্ত্র, না আছে টিকি-নাড়া পুরুত-টুরুত!
মেয়েরা রুপোর গয়না পরে বাহার দিয়ে বেড়ায়,—গলায় দোলায় সিকি বা আধুলির মালা। কায়দা করে চুল বাঁধবার শখ তাদের খুব বেশি এবং চুল বাঁধবার সময়ে তারা থুঃ থুঃ করে থতু দিয়ে চুল ভিজিয়ে নেয়।
পাহাড়ে পাহাড়ে বনগোলাপ গাছের মেলা। গোলাপ এখানে জন্মে তার বিখ্যাত কাঁটাকে ত্যাহ করেছে এবং তার ফুলও বেলফুলের মতো খুদে খুদে। গোলাপফুল বলতে আমরা যা বুঝি না তা বোঝে না—এরা বোঝে ও বলে গোলাপফল! স্বচক্ষে দেখলুম, ভুটিয়ারা গোলাপগাছ থেকে টোপা কুলের মতো ছোটো লাল বা বেগুনি রংয়ের গোলাপফল পেড়ে মুখে পুরে দিচ্ছে। এবং দিব্যি তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে! কঁচা গোলাপফলের রং সবুজ। ওদের দেখাদেখি আমিও একটা গোলাপফল খেয়ে দেখলুম তা একটু-কষা ও একটু-মিষ্ট! আমাকে অবাক করলে এই পাহাড়ি গোলাপ!
চারিদিকে ভৈরবদের খোঁজ নিয়ে বাসায় ফিরে এসেই বিমল যা বললে, তাতে আবার আমাদের চক্ষুস্থির হয়ে গেল!
যে জুতোর গোড়ালির কুঠুরিতে গুপ্তধনের ম্যাপ লুকানো ছিল, সেই জুতোজোড়া আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
রামহরিকে ডেকে বিমল জিজ্ঞাসা করলে, রামহরি, তুমি কি ঘরের দরজা খোলা রেখে বাইরে গিয়েছিলে?
রামহরি বললে, বাইরে মাঝে মাঝে যেতে হয়েছে বইকি, কিন্তু দরজায় তো তালা না দিয়ে যাইনি!
বিমল বললে, তাহলে নিশ্চয় কেউ অন্য চাবি দিয়ে তালা খুলেছে! কিন্তু কে সে? এত জিনিস থাকতে সে কেবল আমারই জুতো চুরি করলে কেন? জুতোর গুপ্তরহস্য সে কি জানে?
উত্তর পেতে দেরি হল না। বিছানার উপরে একখানা পত্র পাওয়া গেল। তাতে লেখা রয়েছে:
‘বিমল,
তুমি যে চালাক, তা স্বীকার করি। কিন্তু অতিচালাকি দেখাতে গিয়েই তুমি ঠকে মরলে।
তোমরা নিশ্চয় ভেবেছ যে, আমরা আর এ-মুলুকে নেই—কেমন, তাই নয় কি? ভাবছ, আমরা ভুল পথে গিয়ে তোমাদের খুঁজে মরছি?
নিশ্চয়ই নয়! তোমাদের কাছে-কাছেই আমিও আছি, চব্বিশ ঘণ্টাই তোমাদের উপরে সতর্ক পাহারা রেখেছি, কেবল তোমাদের অসাবধানতার সুযোগ খুঁজেছি, কিন্তু আমাদের অস্তিত্ব কিছুতেই জানতে দিইনি, কারণ আমরা কাছে আছি জানলে তোমরাও সাবধান হয়ে থাকতে।
তুমি আমাকে বোকা ভেবে আমার চোখে ধুলো দিতে চেয়েছিলে বটে, কিন্তু আসলে তোমারই চোখে ধুলো দিলুম আমি। শত্রুদের যারা বোকা ভাবে, তারাই হচ্ছে অতিবড়ো বোকা!
কিন্তু অতিচালাকি দেখাতে গিয়ে তুমি যে ভ্রম করেছ, সে-ভ্রম আর কখনও সংশোধন করতে পারবে না।
কালী নদীর তীরে দাঁড়িয়ে সেদিন আমাকে ম্যাপখানা দেখিয়ে তুমি প্রথম শ্রেণীর নির্বোধের মতো কাজ করেছ!
আমি তখনই ভেবে দেখলুম, তোমাদের প্রত্যেকের দেহ আর কাপড়চোপড় খুব তন্ন তন্ন করে খুঁজেও যে ম্যাপ পাওয়া যায়নি তা আবার তোমার কাছে এল কেমন করে?
ভেবে-চিন্তে সন্দেহ করলুম, তোমার জুতো খুঁজতে ভুলে গিয়েছিলুম, ম্যাপ হয়তো সেই জুতোর ভিতরেই লুকানো ছিল!
আজ তোমরা বেরিয়ে গিয়েছ, আমিও তোমার ঘরে ঢুকেছি। আগেই আমার চরের মুখে খবর পেয়েছি, আজ তোমরা সেদিনকার জুতো না পরে বুটজুতো পায়ে দিয়ে গিয়েছ।
আমার অনুমান সত্য হয়েছে! ম্যাপসুদ্ধ এই চমৎকার জুতো জোড়াটি আমি তোমার সাদর উপহার বলে গ্রহণ করলুম। আবার যদি কখনও দেখা হয়, তোমাকে তোমার জুতোজোড়া ফিরিয়ে দেব। কারণ আমি জুতোচোর নই!
আর একটা কথা শুনলেও খুশি হবে। তোমাদের বাসাঘরের দরজায় কান পেতে আমার ছদ্মবেশী চর বসে থাকত। তোমরাও তাকে দেখেছ, কিন্তু চিনতে পারোনি।
তোমাদের অনেক কথাই সে শুনেছে। মানস সরোবরের কাছে রাক্ষস তালে গিয়েই তো তোমাদের পথ চলা শেষ হবে?
সেখানেই তোমাদের সঙ্গে আবার হয়তো আমাদের সাক্ষাৎ হবে।। তোমাদের জন্যে আমি প্রস্তুত হয়েই থাকব। ইতি
শ্রীভৈরবচন্দ্র বিশ্বাস
পুঃ কিন্তু একটা ব্যাপার আমি কিছুতেই আন্দাজ করতে পারছি না। সেদিন পাহাড়ের দড়ির দোলনা থেকে তোমরা মুক্তি পেলে কেমন করে? দেখা হলে এ-খবরটা দিতে ভুলো না। ভৈঃ
বিমল কপালে করাঘাত করে বসে পড়ে বললে, আমি গাধা! আমি গোরু! বাহাদুরি দেখাতে গিয়েই আমি সব মাটি করলুম!
কুমার বললে, আমাদের পিছনে ফেলে ভৈরব এতক্ষণে মানস সরোবরের পথে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। আর কি তার নাগাল ধরতে পারব?
আমি একেবারে ভেঙে পড়ে বললুম, আমাদের এত কষ্ট সব বিফল হল! এখন খালি কাদা ঘেঁটেই দেশে ফিরতে হবে!
বিমল সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে উঠে দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে তীব্র স্বরে বললে, কখনও না, কখনও না! আমরা আজই ঝড়ের বেগে ভৈরবদের পিছনে ছুটব। এতদিন তারা আমাদের অনুসরণ করেছিল, এইবারে আমাদের পালা! তাদের নাগাল আমরা ধরবই—নইলে এ মুখ আর কারুকে দেখাব না! আমার ভাগ্য চিরদিনই আমাকে সাহায্য করেছে, এবারেও নিশ্চয় সে আমার পক্ষ ত্যাগ করবে না। প্রতিজ্ঞা করছি দিলীপ, আমি ভৈরবের মুখের গ্রাস আবার কেড়ে নেব! দেখো, অদৃষ্ট আমাদের সাহায্য করবেই!
আমি কিছুমাত্র উৎসাহিত না হয়ে বললুম, কিন্তু আর রাক্ষস তালে গিয়ে আমাদের লাভ কী? আমরা তো সেখানে বেড়াতে যাচ্ছিলুম না-যাচ্ছিলুম গুপ্তধনের সন্ধানে। কিন্তু এখন আমাদের কাছে ম্যাপ নেই, তবে কেন আর এত কষ্ট আর বিপদ মাথায় করে অন্ধকার হাতড়াতে যাওয়া?
বিমল বললে, ভৈরব আমাকে যতটা মনে করেছে আমি ততটা বোকা নই! আসল ম্যাপ সে পেয়েছে বটে, কিন্তু তার অবিকল নকল আমার কাছে আছে। এখন যে আগে রাক্ষস-তালে গিয়ে পৌঁছতে পারবে, গুপ্তধন হবে তার।
মনের ভিতরে কতকটা আশার সঞ্চার হল। এখনও তাহলে সফল হলেও হতে পারি। বিমল বললে, কিন্তু আর এক মিনিট সময় নষ্ট করবারও সময় নেই। প্রতি মিনিটেই আমাদের আরও পিছনে ফেলে ভৈরব আরও বেশি এগিয়ে যাচ্ছে। ওঠো কুমার, এসো দিলীপ, জাগো রামহরি! রাক্ষস তালে গিয়ে শত্রুদের সঙ্গে রাক্ষসের মতো ব্যবহারই করতে হবে— দয়া মায়া সেই মন থেকে একেবারে মুছে ফেলে দাও! ভৈরব জানে না, দরকার হলে আমি তার চেয়েও কত নিষ্ঠুর হতে পারি!