কুবের পুরীর রহস্য Kuber purir Rohoshyo by হেমেন্দ্রকুমার রায় Hemendra Kumar Roy, chapter name বিমলের ভাগ্যলক্ষ্মী

বিমলের ভাগ্যলক্ষ্মী

বুদি, গারবেয়াং, কালাপানি প্রভৃতি পার হয়ে আমরা লিপিধুরায় এসে পড়েছি। এইখানেই ইংরেজ-রাজ্যের শেষ এবং তিব্বতের আরম্ভ।

আমরা এখন যেখানে এসে উঠেছি, বাংলা দেশে আর ঢের নীচে মেঘের দল আনাগোনা করে। বাঙালিরা দার্জিলিঙে গিয়েই পায়ের তলায় মেঘ-চলাচল দেখে অবাক হয়, কিন্তু দার্জিলিংও এখন আমাদের কত নীচে পড়ে আছে। এখানকার অতিরিক্ত নির্মল বাতাস এত লঘু যে নিঃশ্বাস নিতেও অসুবিধা হয়—আমরা নীচেকার পৃথিবীর ধুলো-মাটির জীব, এত নির্মলতা পর্যন্ত আমাদের সহ্য হয় না!

দেখতে দেখতে শ্যামলতা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বললেও চলে, এখানে-ওখানে কাঁটালতা ছাড়া গাছের আর দেখাই নেই। এখন চলেছি আমরা তুষারের শুভ্র রাজ্য দিয়ে তার কনকনে শীতলতা ভয়াবহ। এমন বিষম ঠান্ডা বাতাস বইছে যে, এর মধ্যেই আমাদের গায়ের চামড়া বুড়োর মতো কুঁচকে গিয়েছে—অথচ সর্বাঙ্গ যেন আগুনে পুড়ে জ্বালা করছে!

কোথাও নদী কি নিঝরের, পাখি কি তরুপল্লবের গান আর শোনা যায় না--চতুর্দিকের নিস্তব্ধতা অসাধারণ। তারই মধ্যে মাঝে মাঝে শব্দের সৃষ্টি করছে হঠাৎ-জাগা শুকনো হাওয়া এবং এক-একটা দাঁড়কাক।

লিপিধুরাতে এসে শৈলশিখর থেকে চোখের সামনে ছবির মতন স্পষ্ট ও সুন্দর ভাবে দেখা যায়, বিচিত্রবর্ণ শৈলসমাকীর্ণ তিব্বত দেশকে। এবং তারই উপরে অনন্তকাল ধরে জাগ্রত প্রহরীদলের মতো বিরাজ করছে তুষারধবল ব্যোমস্পর্শী গিরিশিখরের পর গিরিশিখর।

মানুষের পক্ষে যত তাড়াতাড়ি পথ চলা সম্ভব, আমরা তত তাড়াতাড়িই এই দীর্ঘ বন্ধুর পথ পার হয়ে এসেছি।

কিন্তু লিপিধুরায় পৌঁছবার কিছু আগে এক পথিকের কাছে একটা সন্দেহজনক খবর পেলুম। একদল মানস সরোবরের বাঙালি যাত্রীর সঙ্গে তার নাকি দেখা হয়েছে!

বিমল শুধোলে, সে দলে কজন লোক আছে?

সাতজন।

তারা কি সশস্ত্র?

এ-পথে সবাই মোটা লাঠি নিয়ে চলে, তাদেরও হাতে লাঠি আছে। কেবল একজনের হাতে বন্দুক দেখলুম। কিন্তু তারা ভালো লোক নয়। একজন গরিব দোকানির কাছ থেকে ভয় দেখিয়ে আর জুলুম করে খাবার জিনিস কেড়ে নিয়েছে!

বিমল ফিরে বললে, জাগো কুমার! জাগো দিলীপ! আমরা বোধহয় ভৈরবেরই দলের খবর পেলুম। ধনুকের তির যেমন কোনওদিকে না বেঁকে সিধে লক্ষ্যের দিকে বেগে ছোটে, ভৈরবও এখন তেমনি সোজা ছুটেছে রত্নগুহার দিকে। আমাদেরও পক্ষে সেই রত্নগুহা হচ্ছে চুম্বক, আর আমরা হচ্ছি তার দ্বারা আকৃষ্ট লোহার মতো। মাঝপথের কোনও বাধাই আর মানব না।

অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত চিত্ত নিয়ে আমরা লিপিবুরায় এসে উপস্থিত হয়েছি। কিন্তু এখানে এসে এক দুঃসংবাদ শুনলুম। তিব্বতের রাজ-সরকার থেকে হুকুম না এলে আমরা নাকি ইংরেজ-রাজত্বের বাইরে পা বাড়াতে পারব না।

একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী এই খবরটা দিলে। এবং আরও বললে যে, চার-পাঁচদিনের মধ্যেই তিব্বতে যাতায়াতের পথ খোলবার জন্যে হুকুম আসার সম্ভাবনা আছে।

বিমল বললে, আমরা যদি তার আগেই লুকিয়ে ওদিকে যাই?

বাবুজি, তাহলে আপনারা বিপদে পড়তে পারেন। আমাদের কথা না শুনে কাল একদল বাঙালিবাবু তিব্বতে ঢুকে বন্দি হয়েছে।

বিপুল আগ্রহে প্রদীপ্ত হয়ে বিমল জিজ্ঞাসা করলে, বাঙালিবাবু? কে তারা?

তা জানি না। আমরা বারণ করলুম, তবু তারা তিব্বতের সীমায় গিয়ে ঢুকল। শুনেছি, তিব্বতি চৌকিদাররাও ভালো কথায় তাদের ফিরে আসতে বলেছিল, কিন্তু তারা বোকার মতো

তাদের সঙ্গে ঝগড়া-মারামারি করতে যায়। তখন অনেক চৌকিদার এসে পড়ে তাদের সকলকেই বন্দি করে নিয়ে যায়!

রাজ-সরকার থেকে পথ খোলবার হুকুম এলেই আবার তাদের ছেড়ে দেবে তো?

না। আপাতত কিছুকাল তাদের কয়েদখানাতেই থাকতে হবে। তারা তো কেবল আইন অমান্য করেনি, তিব্বতি চৌকিদারদের সঙ্গে মারামারিও করেছে। এজন্যে তাদের বিচার হবে। বিচার না হওয়া পর্যন্ত তাদের তো কয়েদখানাতে থাকতেই হবে, বিচারে কী হবে সে তো পরের কথা।

তাদের কারুর চেহারা তোমার মনে আছে?

আমাদের চোখে সব বাঙালিবাবুকেই একরকম বলে মনে হয়। তবে তাদের মধ্যে এক বাবুর খুব জোয়ান চেহারা ছিল বটে। আর তার এক হাতে ছিল ছটা আঙুল। সে বাবুর মেজাজও ভারী গরম, কথায় কথায় রুখে ওঠে। সেইজন্যেই তো বিপদ হয়েছে।

বিমলের মুখ আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠল।

আমাদের সংবাদদাতা বিদায় হলে পর সে বললে, দেখলে তো, ভাগ্য আমার উপরে কেমন সুপ্রসন্ন! আমার ভাগ্য সঙিন মুহূর্তে একটা আস্ত সাঁকো উড়িয়ে দেয়, তিব্বতি চৌকিদার লেলিয়ে আমার শত্রুদের গ্রেপ্তার করে!

কুমার হাসতে হাসতে বললে, কেবল তোমার ভাগ্য বলছ কেন, বলো আমাদের সকলকারই ভাগ্য!

 

ও একই কথা, আমরা যে অভিন্ন—এক প্রাণে একই কর্তব্যসাধন করতে চলেছি। কেবল আমাদের ভাগ্য নয়, পৃথিবীর সমস্ত উদ্যোগী পুরুষের ভাগ্যই এমনি যথাসময়ে সুপ্রসন্ন হয়! হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে মানুষ ভাগ্যলক্ষ্মীর অপমান করে, হতাশ হওয়া কাপুরুষতার লক্ষণ। কিন্তু থাক ও-কথা। যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তারা যে ভৈরব আর তার দলবল, এ-বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই। ওই তিব্বতি-চৌকিদারদের প্রাণের বন্ধুর মতো আলিঙ্গন করতে সাধ হচ্ছে। আমরা যা চেষ্টা করেও পারতুম না, তারা তাই করেছে। অতঃপর আমরা এখানে পথ না খোলা পর্যন্ত নিশ্চিন্ত হয়ে বিশ্রাম করতে পারব। তারপরেও আমরা যখন যাত্রা করব, ভৈরব-বাবাজি তখন তিব্বতি জেলখানার ভিতরে শুয়ে হয়তো কড়িকাঠ গণনা করবে,—আঃ, কী সুসংবাদ। ও রামহরি, শিগগির চায়ের কেটলি চড়িয়ে দাও।

খানিক পরেই রামহরির চড়ানো কেটলির জল আগুনের আঁচে গর্জন করে উঠল।

আমি বসে বসে ভাবতে লাগলুম, আশা ও নিরাশার, আনন্দের ও নিরানন্দের এ কী উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে আমরা সবাই কোন পরিণামের দিকে যাত্রা করেছি! অবশেষে সফল হব কি বিফল হব জানি না, কিন্তু এই অপূর্ব বৈচিত্রের দোলায় দুলে জীবন যে পরম উপভোগ্য হয়ে উঠেছে, সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই। সফলতা অর্জন করতে না পারলেও আমার জীবনে এই বৈচিত্রের মূল্য কমবে না! বিমল ও কুমার যে কীসের মোহে বিপদকে এত ভালোবাসে সেটা এখন খুব ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে।

পদে পদে বিপদকে নিয়ে খেলা করা মানুষের পক্ষে একটা মস্ত নেশার মতো। যারা ধনীবিলাসী, আজন্ম পরম সুখের কোলেই মানুষ, সেই রাজা-মহারাজারাও চিরদিন নিশ্চিন্ত আরামে কাল কাটিয়ে আনন্দ পায় না, স্বেচ্ছায় সুখ-শয্যা ছেড়ে গভীর বনেজঙ্গলে শিকার করতে ছুটে যায়, খানিকক্ষণের জন্যে অনিশ্চিত বিপদের বিপুল পুলক উপভোগ করবে বলে। যারা সাহস ও শক্তির অভাবে কাপুরুষ, তারাও শান্তিময় জীবনযাত্রা থেকে মাঝে মাঝে ছুটি পাবার জন্যে, কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে টিকিট কিনে সার্কাসে গিয়ে বিপজ্জনক খেলা দেখে আসে!

প্রত্যেক মানুষ বিপদকে ভয়ও করে, ভালোবাসে!