কুবের পুরীর রহস্য Kuber purir Rohoshyo by হেমেন্দ্রকুমার রায় Hemendra Kumar Roy, chapter name বিনামেঘের বজ্র

বিনামেঘের বজ্র

তাঁবুতে ফিরে এসে দেখি, আমাদের জন্যে সামনে খাবার সাজিয়ে রামহরি বসে বসে ঢুলছে এবং তার পাশে বসে আছে বাঘা, ঘুমের ঘোরে তারও দুই চক্ষু মুদ্রিত।

বিমল চিৎকার করে বললে, ওঠো রামহরি, কুলিদের ডাকো! মালপত্তর বাঁধতে থাকো, ততক্ষণে আমরা চটপট খেয়ে নি।

রামহরি মুখ ব্যাজার করে বললে, কেন, এত তাড়াতাড়ি কীসের শুনি?

আমরা এখনই যাত্রা করব! —এই অন্ধকার রাতে?

হ্যাঁ হ্যাঁ, এই অন্ধকার রাতে! সবাই একটা করে পেট্রলের লণ্ঠন নাও, কলিকালের বিজ্ঞান অন্ধকারকে জয় করেছে, তা কি তুমি জানো না রামহরি? ওঠো ওঠো, রামহরি! আমাদের পিছনে শত্রু!

শত্রুর নাম শুনেই রামহরির সমস্ত জড়তার ভাব কেটে গেল,—সে তখনই উঠে মালপত্তরের ব্যবস্থা করতে ছুটল।

প্রবল বিক্রমে খাবারের থালা আক্রমণ করে বিমল বললে, এসো কুমার, এসো দিলীপ, আমার দৃষ্টান্ত অনুকরণ করো! ভৈরবের শিবিরে এতক্ষণে হয়তো পরামর্শ-সভা বসেছে। শত্রুকে পরাজিত করবার প্রধান উপায় কী জানো? তারা যা ভাবেনি, তাই করা! আজ রাত্রেই আমরা যে আসকোট ছেড়ে লম্বা দেব, এটা তারা কল্পনাও করতে পারবে না। তারা এখন কালকের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। কিন্তু কাল আমরা অনেক দূরে থাকব। তারপর আমাদের নাগাল ধরা তাদের পক্ষে সহজ হবে না। এখন আমাদের চাই খালি স্পিড় স্পিড-গতি! আমরা যত গতি বাড়াতে পারব, শত্রুরা তত পিছনে পড়ে থাকবে! স্পিড-স্পিড, আধুনিক সভ্যতার প্রাণ। এই স্পিডের লোভেই একালের মানুষ রেলগাড়ি, ইস্টিমার, উড়োজাহাজ, মোটর সৃষ্টি করেছে! এই স্পিডের জোরেই জীবনের যাত্রাপথে ইউরোপ আজ অগ্রসর, আর তার অভাবেই গরুর গাড়িতে চড়ে ভারতবর্ষ আজও সেকালের গর্ভের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।

আমরা আবার উপরে উঠছি আর উঠছি আর উঠছি! উতরাইয়ের পর চড়াই আর চড়াইয়ের পর উতরাই! যখন উতরাই দিয়ে নীচের দিকে নামছি, তখনও নামছি আরও বেশি উপরে ওঠবারই জন্যে! রাতের পরে দিন আসে, দিনের পরে রাত আসে, কিন্তু আমাদের ঊর্ধ্বগতির বিরাম নেই।

তবু বিমল বার বার বলছে, স্পিড—আরও স্পিড! দ্রুতগতিতেই এখন আমাদের শত্রুদের হারাতে হবে—দ্রুতগতির মহিমাতেই নেপোলিয়ন শত্রুদের হারিয়ে দিগ্বিজয়ী হয়েছিলেন! স্পিড আরও স্পিড!

কুমার বললে, নেপোলিয়ন আল্পস পর্বত পার হয়েছিলেন, ভৈরবকে হারাবার জন্যে যদি দরকার হয় আমরাও হিমালয় পর্বত পার হব!

গাঢ়-নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে অবাক হয়ে যাচ্ছি! আকাশের নীলিমা যে এমন নির্মল হয়, বাংলা দেশে বসে কখনও তা কল্পনা করতে পারিনি! সেই পবিত্র নীলের তলায় হিমালয়ের শিখরের পর শিখরের ভিড়! চতুর্দিকে যেন শিখরের মহাসভা। উপত্যকার পর উপত্যকা এবং শত শত শিশু-শৈল,—তারা যেদিন মেঘ-ছোঁয়া মাথা তুলবে, সেদিন হয়তো সেকালের অতিকায় জীবজন্তুদের মতো একালের মানবজাতিও ধরাপৃষ্ঠ থেকে লুপ্ত হয়ে গিয়ে অন্য কোনও উচ্চতর জীবের জন্যে স্থান ছেড়ে দেবে! এই পর্বত-বিশ্বের ভিতরে মাঝে মাঝে ভুটিয়া স্ত্রী-পুরুষদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে আর মনে হচ্ছে, মানুষ এখানে কী নিকৃষ্ট, অকিঞ্চিৎকর জীব! দেবতার এই বিরাট লীলা-জগতে মানুষের তুচ্ছ দেহ যেন মোটেই মানায় না!

কোথাও রক্ষক মানুষ ও কুকুরের সঙ্গে সঙ্কীর্ণ পাহাড়ে-রাস্তা দিয়ে ভেড়ার পর ভেড়ার পাল চলেছে, কোথাও পাহাড়ের বুকে সাজানো সিঁড়ির সারের মতো সবুজ শস্যক্ষেতে কপনি-পরা পুরুষ ও বুকে ন্যাকড়া-বাঁধা স্ত্রী-চাষিরা কাজ করছে, কোথাও শুকনো পাথরকে ভিজিয়ে ঝরনার লহর মিষ্ট নাচে-গানে মেতে নেমে আসছে।

নীচে বয়ে যাচ্ছে কালী নদী। উপর থেকে দেখা গেল, ছোটো-বড়ো কয়েকটি ঝরনার ধারার সঙ্গে কালী নদীর মিলন হয়ে এক অপূর্বসুন্দর আনন্দ-রাগিণীর সৃষ্টি হয়েছে। চিরস্তব্ধ হিমালয়ের অসাড় প্রাণে চিরঝঙ্কৃত কলসঙ্গীতের সাড়া! যেন এইখানেই আর্য ঋষিরা প্রথম বেদগানের আভাস অনুভব করেছিলেন। এই পবিত্র সঙ্গমের সঙ্গীতে শহুরে মনের সমস্ত ধুলো-মাটি ধুয়ে-মুছে যায়!

এই এক পরম বিস্ময়! নদ-নদী সমতল পৃথিবীকে স্নিগ্ধ করে এবং নদীর নাম করলেই আমাদের মনে হয় মাটির পৃথিবীর কথা! অথচ নদী নরম মাটির সম্পদ হলেও, সমতল জগতে সে বিদেশিনী! তার জন্ম এই কঠিন, অসমোচ্চ, নিষ্করুণ, শুকনো পাথরের কোলে! যে-জল পাথর ভেদ করে ভিতরে ঢুকতে পারে না, সেই জুলই পাথর ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আসে, মানুষের প্রাণ রক্ষা করে। হিমালয় না থাকলে ভারত আজ জীবশূন্য মরুভূমি হয়ে যেত এবং সেইজন্যেই হয়তো কৃতজ্ঞ ভারতবাসী হিমালয়কে দেবতার মতো শ্রদ্ধা করে!

গারবেয়াং নামক স্থান থেকে কিছু এগিয়ে হঠাৎ এক বিপদ! একটা উঁচু জায়গা থেকে পা হড়কে পড়ে গিয়ে রামহরি বিষম চোট খেলে। তার পক্ষে দু-চারদিনের মধ্যে আর পথচলা অসম্ভব।

বিমল হতাশ ভাবে বললে, আমাদের সমস্ত স্পিড় ব্যর্থ হল—এখন এইখানেই বসে থাকতে হবে। রামহরি, তুমিই আমাদের বিপদে ফেললে দেখছি!

রামহরি অত্যন্ত অপরাধীর মতো দুঃখিত স্বরে বললে, কী করব খোকাবাবু, আমি তো সাধ করে আছাড় খেয়ে তোমাদের বিপদে ফেলিনি! তোমরা বরং এক কাজ করো। আমাকে এখানে কোনও লোকের বাড়িতে রেখে তোমরা এগিয়ে যাও--আমার জন্যে কেন তোমরা সব পণ্ড করবে?

কুমার বললে, সে হয় না রামহরি! যত বিপদই আসুক, আমাদের তোমার কাছেই থাকতে হবে?

বিমল বললে, এখানে আর তাঁবু খাটিয়ে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কাজ নেই। যতদিন না রামহরি সেরে ওঠে, ততদিন কারুর বাড়িতে অতিথি হয়ে আমাদের লুকিয়ে থাকতে হবে।

হিমালয়ের এ-অঞ্চলের লোক অতিথি-সকারের জন্যে বিখ্যাত। এখানে অনেক জায়গাতেই বাজার-হাটের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে, পয়সা খরচ করেও সময়ে সময়ে জিনিস পাওয়া সম্ভব নয়, তাই মানস সরোবরের তীর্থযাত্রীরা গৃহস্থের বাড়িতে আতিথ্য স্বীকার করেই পথখরচের টাকা বাঁচাতে পারে। সুতরাং আমাদেরও আশ্রয়ের অভাব হল না।

দুদিন এখানেই কাটল রামহরির আরও দিন-কয়েক বিশ্রাম দরকার।

তৃতীয় দিন বৈকালে বিমল বললে, শুনছি এখানে এক মস্ত উতরাই আছে, প্রায় দু-মাইল ধরে। চলো তো, আমরা তিনজনে সেই উতরাইটা একবার দেখে আসি, রামহরি সে পথে চলতে পারবে কি না, সেটা আগে জানা দরকার।

আমরা এখন মালপা নামক স্থানের কাছে আছি। এখানে বনজঙ্গল শেষ হয়ে হিমালয়ের বৃক্ষশূন্য রুক্ষ ঊধ্বস্তর আরম্ভ হয়েছে। আর্যসুলভ দীর্ঘ নাক, আয়ত চক্ষু ও সুগোল কপোলের দেশ ছেড়ে তিব্বতের খুব কাছে এসে পড়েছি। এ-জায়গাটায় তিনটি রাজ্যের মিলন হয়েছে— ভারত, নেপাল ও তিব্বত।।

কালী নদীর ওপার থেকে দেখা যাচ্ছে নেপালের ঝাউ ও দেবদারু গাছের বন। আশে-পাশে পাখিদের গানের সভা বসেছে, দূরে দূরে পাহাড়ের উপর থেকে ঝরনা ঝরছে—যেন চকচকে জলের ফিতা ঝুলছে! নির্জনতা এখানে যেন ধ্যানে মগ্ন হয়ে আছে।

 

তারপর সেই উতরাই দেখলুম—এটি এখানকার প্রসিদ্ধ উতরাই! পাহাড়ের ঢালু গা প্রায় সোজা হয়ে নীচে-নীচে-আরও কত নীচে যে নেমে গেছে তা জানি না, মানুষের পক্ষে এপথে দু-পায়ে খাড়া হয়ে নামা একেবারেই অসম্ভব, লাঠির সাহায্যে প্রায় বসে বসেই নামা ছাড়া উপায়ান্তর নেই। সেই ঢালু পাহাড়ের গায়ে বৃক্ষলতার চিহ্ন পর্যন্ত নেই—আছে কেবল ধসে পড়া ছোটো-বড়ো শৈলখণ্ড, একবার পা ফসকালেই দেহের সঙ্গে আত্মার সকল সম্পর্ক ঘুচে গিয়ে সর্বাঙ্গ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে!

বিমল মাথা নেড়ে বললে, ‘রামহরিকে নিয়ে তিন-চারদিন পরেও হয়তো এ-পথ দিয়ে নামা চলবে না! স্পিড় বাড়িয়ে এতটা এগিয়েও কোনও লাভ হল না, ভৈরব হয়তো শীঘ্রই আমাদের নাগাল ধরবে। অদৃষ্টের মার, উপায় কী?

সঙ্গে সঙ্গে মূর্তিমান অদৃষ্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল মনে করলে এখনও বুকের কাছটা ধক ধক করে ওঠে।

সেই মূর্তিমান অদৃষ্ট আমাদের পিছন থেকে কঠিন কৌতুকের স্বরে বললে, এই যে বন্ধুর দল! নমস্কার!

আমরা তিনজনেই চমকে ফিরে দাঁড়ালুম!

আমাদের কাছ থেকে চার-পাঁচ হাত তফাতে একদল লোক ঠিক যেন মাটি খুঁড়ে আবির্ভূত হয়েছে! সর্বাগ্রে দাঁড়িয়ে আছে ভৈরব বিশ্বাস, তার উজ্জ্বল তীক্ষ্ণ চোখ দুটো যেন আগুনের ফিনিক ছড়িয়ে দিচ্ছে, অথচ ওষ্ঠাধরে ঝরছে শিশুর মতো সরল ও মিষ্ট হাসি! এবং তার হাতে রয়েছে একটা দোনলা বন্দুক।

ভয়েভয়ে লক্ষ করলাম, তার সঙ্গীদেরও কারুর হাতে মোটা লাঠি, কারুর হাতে বর্শা, কারুর হাতে তরোয়াল, কারুর হাতে ছোরা!

আর, আমরা একেবারেই নিরস্ত্র!

শুনেছি বিমলের গায়ে অসুরের মতো শক্তি এবং কুমার ও আমিও দুর্বল নই। কিন্তু দশবারোজন সশস্ত্র লোকের বিরুদ্ধে আমরা তিনজনে খালি হাতে কী করতে পারি?

পিছনে খাড়া উতরাই—পালাবারও পথ নেই।

বিমল কিন্তু একটুও দমল না। দু পা এগিয়ে গিয়ে হাসিমুখে বললে, ভৈরববাবু যে! এত শীঘ্র আপনার চন্দ্রবদন দেখতে পাব বলে আশা করিনি।

ভৈরব বললে, কিন্তু আমার মনে বরাবরই আশা ছিল যে, শীঘ্রই তোমাদের দেখতে পাব।

বিমল বললে, আপনার আশা সফল হয়েছে, আপনি ভাগ্যবান। এখন পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ান, আমরা বাসায় ফিরব।

ভৈরব একগাল হেসে দু-পাটি বড়ো বড়ো হলদে দাঁত বার করে বললে, এত ব্যস্ত কেন? এসো না, খানিকক্ষণ গল্প করি।

আমাদের এখন গল্প করবার সময় নেই বলে বড়ো দুঃখিত হচ্ছি। পথ ছাড়লে বাধিত হব।

কিন্তু গল্পে যখন তোমার আপত্তি, তখন দয়া করে আমার দুটো উপকার করে যাও।

কী উপকার, আজ্ঞা করুন।

তোমরা কোন দেশে যেতে চাও বলল, আর সেই ম্যাপখানা আমাকে দিয়ে যাও। তারপর তোমরা স্বর্গে বা নরকে যেখানেই যাও, আমি আর কোনও আপত্তি করব না।

বিমল বললে, মাপ করবেন ভৈরববাবু, আপনার অনুরোধ আমি রক্ষা করতে পারব না।

পারবে না?

না। প্রাণ গেলেও নয়।

দিলীপ, তোমারও কি ওই মত? আমি বললুম, নিশ্চয়। ও ম্যাপ আমার সম্পত্তি, আপনাকে দেব কেন?

ঘুমন্ত বাঘ যেন জেগে উঠল! ভৈরব ভীষণ গর্জন করে বললে, মিথ্যা কথা! ও ম্যাপে তোমার কোনও অধিকার নেই। তোমার ঠাকুরদা আমার বৃদ্ধ পিতাকে হত্যা করে ওই ম্যাপ চুরি করেছিল, তুমি হত্যাকারীর বংশধর! আজ আমি ওই ম্যাপ আবার আদায় করে তোমাকেও প্রাণে মেরে প্রতিশোধ নেব। আমি দেবতার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি, আমার পিতৃহত্যাকারীর বংশ রাখব না! তোমার বাবাকে নরকে পাঠিয়েছি, আজ তোমার পালা।

এই অদ্ভুত কথা শুনে আমি বিস্ময়ে একেবারে অবাক হয়ে গেলুম!

বিমল ধীর স্বরে বললে, ভৈরববাবু, আপনার মতো ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের কোনও কথাই আমি বিশ্বাস করি না।।

ভৈরব মুখ খিচিয়ে বললে, ছোকরা, তোমার বিশ্বাসে-অবিশ্বাসে আমার কিছু যায় আসে । আমি ম্যাপ চাই!

ম্যাপ আপনি পাবেন না।

এখনও ভেবে দ্যাখো! নইলে যে-শাস্তি আমি দেব, তোমরা তা কল্পনাতেও আনতে পারবে না!

বিমল সহাস্যে বললে, ভৈরববাবু, আমাদের আপনি চেনেন না, তাই শাস্তির ভয় দেখাচ্ছেন! আমরা হাসতে হাসতে মরতে পারি।

মৃত্যু? সে তো খুব সহজ ব্যাপার! কিন্তু বেঁচে বেঁচে তোমরা কি কখনও মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করেছ? ম্যাপ না পেলে আজ আমি তোমাদের সেই শিক্ষাই দেব!

বিমলের মুখে হাসি তখনও মেলাল না। সে স্থির ভাবেই বললে, আমরা তিনজন, আপনারা দশ-বারো জন। আমরা নিরস্ত্র, আপনারা সশস্ত্র। কাজেই সমস্ত শাস্তি আজ আমাদের মাথা পেতে নিতেই হবে। কিন্তু প্রাণ থাকতে ম্যাপ আমরা দেব না।

ভৈরব হুঙ্কার দিয়ে বললে, বেশ, দেখা যাক! শ্যামা! সিধু! তোরা সবাই মিলে ওদের হাতগুলো দড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে ফ্যাল তো! তারপর ওদের জামাকাপড় হাতড়ে দেখ, ম্যাপখানা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে!

তারা পিছমোড়া করে আমাদের হাতগুলো বেঁধে ফেললে—আমরা কোনও বাধা দিলুম না।

অকারণে বাধা দিয়ে লাভ কী? তারপর আমাদের জামাকাপড় তারা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলে, কিন্তু ম্যাপ কোথাও পাওয়া গেল না!

বিমল যে ম্যাপখানা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে, আমিও তা জানতুম না। সে-সময়ে আমার মন এমন আতঙ্কগ্রস্ত হয়েছিল যে, ম্যাপের সন্ধান জানলে সকলের প্রাণরক্ষার জন্যে আমি হয়তো বলে ফেলতুম!

ভৈরব গজরাতে গজরাতে বললে, হুঁ, ম্যাপখানা তাহলে দেবে না?

বিমল বললে, না বন্ধু, না! খুঁজে পাও তত দ্যাখো না!

ভৈরব বললে, ম্যাপখানা তাহলে কী করে আদায় করি, এইবারে সেইটেই দ্যাখো!... ওরে, ওদের প্রত্যেকের পাদুটো আলাদা আলাদা দড়িতে বেঁধে ফ্যাল তো!

আমাদের ধাক্কা মেরে মাটিতে পেড়ে ফেলে, এক-একটা দড়িতে এক-একজনের পা শক্ত করে বেঁধে ফেলা হল। আচ্ছন্নের মতন হয়েও ভাবতে লাগলুম, এই নরপিশাচ আমাদের নিয়ে কী করতে চায়?

ভৈরব আবার হুকুমজারি করলে, এইবারে একগাছা মোটা দড়িতে ওদের পায়ে-বাঁধা দড়িতিনগাছা শক্ত গেরো দিয়ে বাঁধ দেখি?

তৎক্ষণাৎ তার আদেশ পালিত হল।

আচ্ছা, এখন পাহাড়ের ধার দিয়ে ওদের নামিয়ে দিয়ে মোটা দড়িগাছা উপরে কোথাও বেঁধে রাখ। অন্ধকার হয়ে এসেছে, রাতে এ-পথে কোনও লোক আসবে না। সারারাত ওরা লাউ-কুমড়োর মতো শূন্যে ঝুলতে থাক!

সেই ভয়ানক প্রস্তাব কার্যে পরিণত হতে দেরি হল না।

এখন আমরা শন্যে দোদুল্যমান! নীচের দিকে তাকিয়েই শিউরে চোখ মুদে ফেললম-~-দডি যদি ছিড়ে যায়, একেবারে দুইশো কি আড়াইশো ফুট তলায় গিয়ে পড়ে আমাদের দেহগুলোর চিহ্ন পর্যন্ত থাকবে না।

উপর থেকে চেঁচিয়ে ভৈরব বললে, এখনও ম্যাপ কোথায় রেখেছ বলো?

বিমল সহজ স্বরেই বললে, বন্ধু, বলব না?

ভৈরব বললে, বেশ, তাহলে সারারাত দোল খাও। কাল সকালে আমি আর একবার আসব। তখনও যদি ম্যাপ না দাও তো, তোমাদের ওইভাবে ঝুলিয়ে রেখেই বিদায় হব! তারপর হাহাহাহা করে একটা শয়তানি হাসির শব্দ, তারপর সব চুপচাপ!...

নিম্নমুণ্ডে এমন করে শূন্যে ঝুলে আমরা কি সকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারব? এখনই আমার দেহের রক্ত মুখে নেমে এসেছে এবং পা দুটো ছিড়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে।

দিনের আলো নিবে গেছে বটে, কিন্তু আকাশে চাঁদ দেখা দিয়েছে—চারিদিকে আলোআঁধারির লীলা। এবং দূর থেকে স্তব্ধতা ভেঙে একটা বাঘ ডেকে উঠল।