কঙ্কাবতী - Konkaboti by Troilokyanath Mukhopadhyay, chapter name দ্বিতীয় খণ্ড - দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় খণ্ড - দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

জলে

নৌকার সহিত কঙ্কাবতীও ডুবিয়া গেল। কঙ্কাবতী জলের ভিতর ক্রমেই ডুবিতে লাগিল। ক্রমেই নীচে যাইতে লাগিল। যাইতে যাইতে অনেক দূর চলিয়া গেল। তখন নদীর যত মাছ সব একত্র হইল। নদীর ভিতর মহা-কোলাহল পড়িয়া গেল যে, কঙ্কাবতী আসিতেছে। রুই বলে, “কঙ্কাবতী আসিতেছে।” পুঁটী বলে “কঙ্কাবতী আসিতেছে।” সবাই বলে, “কঙ্কাবতী আসিতেছে।” পথ পানে এক দৃষ্টে চাহিয়া জলচর জীব-জন্তু সব যেখানে দাঁড়াইয়াছিল, ক্রমে কঙ্কাবতী আসিয়া সেইখানে উপস্থিত হইল। সকলেই কঙ্কাবতীর আদর করিল। সকলেই বলিল, “এস এস, কঙ্কাবতী এস।”

মাছেদের ছেলে-মেয়েরা বলিল, “আমরা কঙ্কাবতীর সঙ্গে খেলা করিব।বৃদ্ধা কাতলা মাছ তাহাদিগকে ধমক দিয়া বলিল, “কঙ্কাবতীর এ খেলা করিবার সময় নয়। বাছার বড় গায়ের জ্বালা দেখিয়া আমি কঙ্কাবতীকে ঘাট হইতে ডাকিয়া আনিলাম। আহা, কত পথ আসিতে হইয়াছে। বাছার আমার মুখ শুকাইয়া গিয়াছে! এস মা, তুমি আমার কাছে এস। একটু বিশ্রাম কর, তারপর তোমার একটা ব্যবস্থা করা যাইবে।”

কঙ্কাবতী আস্তে আস্তে কাতলা মাছের নিকট গিয়া বসিল।

এদিকে কঙ্কাবতী বিশ্রাম করিতে লাগিল, ওদিকে জলচর জীবজন্তুগণ মহাসমারোহে একটি সভা করিল। তপস্বী মাছের দাড়ি আছে দেখিয়া সকলে তাহাকে সভাপতিরূপে বরণ করিলেন। কঙ্কাবতীকে লইয়া কি করা যায় সভায় এই কথা লইয়া বাদানুবাদ হইতে লাগিল।অনেক বক্তৃতার পর, চতুর বাটা মাছ প্রস্তাব করিল, “এস ভাই, কঙ্কাবতীকে আমরা আমাদের রানী করি।”

এই কথাটি সকলের মনোনীত হইল। চারিদিকে জয়ধ্বনি উঠিল।

মাছেদের আর আনন্দের পরিসীমা নাই। সকলেই বলাবলি করিতে লাগিল যে, ভাই! কঙ্কাবতী আমাদের রানী হইলে আর আমাদের কোনও ভাবনা থাকে না। বঁড়শী দিয়া আমাদিগকে কেহ গাঁথিলে হাত দিয়া কঙ্কাবতী সুতাটি ছিঁড়িয়া দিবেন। জেলেরা জাল ফেলিলে ছুরি দিয়া কঙ্কাবতী জালটি কাটিয়া দিবেন। কঙ্কাবতী রানী হইলে আর আমাদের কোনও ভয় থাকিবে না। এস, এখন সকলে কঙ্কাবতীর কাছে যাই, আর কঙ্কাবতীকে গিয়া বলি যে, কঙ্কাবতী, তোমাকে আমাদের রানী হইতে হইবে।তাহার পর মাছেরা কঙ্কাবতীর কাছে গেল, আর সকলে বলিল, “কঙ্কাবতী! তোমাকে আমাদের রানী হইতে হইবে।”

কঙ্কাবতী বলিল, “এখন আমি তোমাদের রানী হইতে পারিব না। আমার শরীরে সুখ নাই, আমার মনেও বড় অসুখ। তাই এখন আমি তোমাদের রানী হইতে পারিব না।”

তখন কাতলানী বলিল, “তোমরা রাজপোশাক প্রস্তুত করিয়াছ? রাজপোশাক না পাইলে কঙ্কাবতী তোমাদের রানী হইবে কেন?”এই কথা শুনিয়া মাছেরা সব বলিল, “ও হো বুঝেছি বুঝেছি। রাজ-পোশাক না পাইলে কঙ্কাবতী রানী হইবে না। রাঙা কাপড় চাই, মেমের মত পোশাক চাই, তবে কঙ্কাবতী রানী হইবে।”

কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “না গো না! রাঙা কাপড়ের জন্য নয়। সাজিবার গুজিবার সাধ আমার নাই। একেলা বসিয়া কেবল কাঁদি, এখন আমার এই সাধ।”

মাছেরা সে কথা শুনিল না। বিষম কোলাহল উপস্থিত করিল। তাহাদের কোলাহলে অস্থির হইয়া সে জিজ্ঞাসা করিল, “ভাল। না হয় আমি তোমাদের রানী হইলাম। এখন আমাকে করিতে হইবে কি?”মাছেরা উত্তর করিল, “করিতে হইবে কি? কেন? দরজীর বাড়ী যাইতে হইবে, গায়ের মাপ দিতে হইবে, পোশাক পরিতে হহবে।”

সকলে তখন কাঁকড়াকে বলিল, “কাঁকড়া মহাশয়! আপনি জলেও চলিতে পারেন, স্থলেও চলিতে পারেন, আপনি বুদ্ধিমান লোক। চক্ষু দুইটি যখন আপনি পিট পিট করেন, বুদ্ধির আভা তখন তাহার ভিতর চিক চিক করিতে থাকে। কঙ্কাবতীকে সঙ্গে লইয়া আপনি দরজীর বাড়ী গমন করুন। ঠিক করিয়া কঙ্কাবতীর গায়ের মাপটি দিবেন, দামী কাপড়ের জামা করিতে বলিবেন। কচ্ছপের পিঠে বোঝাই দিয়া টাকা মোহর লইয়া যান। যত টাকা লাগে, তত টাকা দিয়া কঙ্কাবতীর ভাল কাপড় করাইয়া দিবেন।”কাঁকড়া মহাশয় উত্তর করিলেন, “অবশ্যই আমি যাইব। কঙ্কাবতীর ভাল কাপড় হয়, ইহাতে কার না আহ্লাদ? আমাদের রানীকে ভাল না সাজাইলে গুজাইলে, আমাদের অখ্যাতি। তোমরা কচ্ছপের পিঠে টাকা মোহর বোঝাই দাও, আমি ততক্ষণ ঘর হইতে পোশাকী কাপড় পরিয়া আসি আর মাথার মাঝে সিঁথি কাটিয়া আমার চুলগুলি বেশ ভাল করিয়া ফিরাইয়া আসি।”

কচ্ছপের পিঠে টাকা মোহর বোঝাই দেওয়া হইল। ততক্ষণ কাঁকড়া মহাশয় ভাল কাপড় পরিয়া, মাথা আঁচড়াইয়া, ফিট-ফাট হইয়া আসিয়া উপস্থিত হইলেন।