কঙ্কাবতী - Konkaboti by Troilokyanath Mukhopadhyay, chapter name দ্বিতীয় খণ্ড - পঞ্চম পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় খণ্ড - পঞ্চম পরিচ্ছেদ

শ্মশান

দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া পাগলিনী এখন শ্মশানের দিকে দৌড়াইল। কিছু দূর গিয়া দেখিতে পাইল, পথে খেতু মাতাকে রাখিয়াছে মার মস্তকটি আপনার কোলে লইয়াছে, মার কাছে বসিয়া মার মুখ দেখিতেছে আর কাঁদিতেছে। অবিরলধারায় অশ্রুবারি তাহার নয়নদ্বয় হইতে বিগলিত হইতেছে।

কঙ্কাবতী নিঃশব্দে তাহার নিকটে গিয়া দাঁড়াইল। অন্ধকার রাত্রি, সেইজন্য খেতু তাহাকে দেখিতে পাইল না।মার মুখপানে চাহিয়া খেতু বলিল, “মা। তুমিও চলিলে? যখন কঙ্কাবতী গেল, তখন মনে করিয়াছিলাম এ ছার জীবন আর রাখিব না। কেবল মা, তোমার মুখপানে চাহিয়া বাঁচিয়া ছিলাম। এখন মা তুমিও গেলে? তবে আর আমার এ প্রাণে কাজ কি? কিসের জন্য, কার জন্য আর বাঁচিয়া থাকিব? এ সংসারে থাকা কিছু নয়। এখানে বড় পাপ, বড় দুঃখ। বেশ করিয়াছ, কঙ্কাবতী এখান হইতে গিয়াছ। বেশ করিলে মা যে, এ পাপ সংসার হইতে তুমিও চলিলে। চল মা, যেখানে কঙ্কাবতী, যেখানে তুমি, সেইখানে আমিও শীঘ্র যাইব।

কঙ্কাবতী আসিয়া অধোমুখে খেতুর সম্মুখে দাঁড়াইল। খেতু চমকিত হইল, অন্ধকারে চিনিতে পারিল না।

কঙ্কাবতী মার পায়ের নিকট গিয়া বসিল। মার পা দুখানি আপনার কোলের উপর তুলিয়া লইল। সেই পায়ের উপর আপনার মাথা রাখিয়া নীরবে কাঁদিতে লাগিল।

ঘোরতর বিস্মিত হইয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া খেতু তাহার মুখপানে চাহিয়া রহিল।অবশেষে খেতু বলিল, “কঙ্কাবতী, জ্ঞান হইয়া পর্যন্ত এ পৃথিবীতে কখনও কাহারও অনিষ্ট চিন্তা করি নাই, সর্বদা সকলের ইষ্টচিন্তাই করিয়াছি। জানিয়া শুনিয়া কখনও মিথ্যা কথা বলি নাই প্রবঞ্চনা কখনও করি নাই, কোনও রূপ দুষ্কর্ম কখনও করি নাই। তবে কি মহাপাপের জন্য আজ আমার এ ভীষণ দণ্ড, আজ এ ঘোর নরক! বিনা দোষে কত দুঃখ পাইয়াছি, সহিয়াছি। গ্রামের লোকে বিধিমত উৎপীড়ন করিল, তাহাও সহিলাম। প্রাণের পুতলি তুমি কঙ্কাবতী জলে ডুবিয়া মরিলে, তাহাও সহিলাম। প্রাণের অধিক মা আমার আজ মরিলেন, তাহাও সহিলাম। কিন্তু এই সংকট সময়ে তুমি যে আমার শত্রুতা সাধিবে, স্বপ্নেও তাহা কখনও ভাবি নাই! মাতার মৃতদেহ একেলা আমি আর বহিতে পারিতেছি না। মাতার পীড়ার জন্য আজ তিন দিন আমার আহার নাই, নিদ্রা নাই। আজ তিন দিন এক বিন্দু জল পর্যন্ত আমি খাই নাই। শরীরে আমার শক্তি নাই শরীর আমার অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছে। আর একটি পা-ও আমি মাকে লইয়া যাইতে পারিতেছি না। কি করি, ভাবিয়া আকুল হইয়াছি। এমন সময়ে কি না, তুমি কঙ্কাবতী, ভূত হইয়া আমাকে ভয় দেখাইতে আসিলে! দুঃখের এইবার আমার চারি পো হইল! এ দুঃখ আমি আর সহিতে পারি না।”কাঁদ কাঁদ স্বরে অধোমুখ কঙ্কাবতী উত্তর করিল “আমি ভুত হই নাই, আমি মরি নাই, আমি জীবিত আছি!”

আশ্চর্য হইয়া খেতু জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি জীবিত আছ? জলে ডুবিয়া গেলে, তোমায় আমরা কত অনুসন্ধান করিলাম। তোমাকে খুঁজিয়া পাইলাম না। মনে করিলাম, আমিও মরি। মরিবার নিমিত্ত জলে ঝাঁপ দিলাম। সাঁতার জানিয়াও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়া জলের ভিতর রহিলাম, কিছুতেই উঠিলাম না। তাহার পর জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়িলাম। অজ্ঞান অবস্থায় জেলেরা আমাকে তুলিল, তাহারা আমাকে বাঁচাইল। জ্ঞান হইয়া দেখিলাম, মা আমার কাঁদিতেছেন! মার মুখপানে চাহিয়া প্রাণ ধরিয়া রহিলাম। কঙ্কাবতী! তুমি কি করিয়া বাঁচিলে?”কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “সে অনেক কথা। সকল কথা পরে বলিব। আমি গোয়ালিনী মাসীর বাটীতে ছিলাম। এই ঘোর বিপদের কথা সেইখানে শুনিলাম। আমি থাকিতে পারিলাম না, তাই ছুটিয়া আসিলাম। এক্ষণে চল, মাতাকে ঘাটে লইয়া যাই। তুমি একদিক ধর, আমি একদিক ধরি।”

এইপ্রকারে কঙ্কাবতী ও খেতু মাকে ঘাটে লইয়া গেল। সেখানে গিয়া দুইজনে চিতা সাজাইল। মাকে উত্তমরূপে স্নান করাইল। নূতন কাপড় পরাইল। তাহার পর চিতার উপর তুলিল। চিতার উপর তুলিয়া দুইজনে মায়ের পা ধরিয়া অনেকক্ষণ কাঁদিল।অবশেষে চিতা প্রদক্ষিণ, করিয়া খেতু অগ্নিকার্য করিল। চিতা ধু ধু করিয়া জ্বলিতে লাগিল।

কঙ্কাবতী ও খেতু নিকটে বসিয়া মাঝে মাঝে কাঁদে, মাঝে মাঝে খেদ করে, আর মাঝে মাঝে অন্যান্য কথাবার্তা কয়। কি করিয়া জল হইতে রক্ষা পাইয়াছে, কঙ্কাবতী সেই সমুদয় কথা খেতুকে বলিল। খেতু মনে করিল, নানা দুঃখে কঙ্কাবতীর চিত্ত বিকৃত হইয়াছে। দুঃখের উপর দু:খ, এ আবার এক নূতন দুঃখ তাহার মনে উপস্থিত হইল। মনের কথা খেতু কিন্তু কিছু প্রকাশ করিল না।

মার সৎকার হইয়া গেলে দুইজনে নদীতে স্নান করিল।

তাহার পর খেতু বলিল, “কঙ্কাবতী চল তোমাকে বাড়ীতে রাখিয়া আসি।”কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “পুনরায় আমি কি করিয়া বাড়ী যাই? বাবা আমাকে তিরস্কার করিবেন, দাদা আমাকে গালি দিবেন। আমি জলের ভিতর গিয়া মাছেদের কাছে থাকি। না হয়, গোয়ালিনী মাসীর ঘরে যাই।”

খেতু বলিল, “কঙ্কাবতী, সে কাজ করিতে নাই। তোমাকে বাড়ী যাইতে হইবে। যতই কেন দুঃখ পাও না, ঘরে থাকিয়া সহ্য করিতে হইবে। মনোযোগ করিয়া আমার কথা শুন। আর এখন বালিকার মত কথা কহিলে চলিবে না। তুমি বাড়ী চল, তোমাকে বাড়ীতে রাখিয়া আসি। বাটীর বাহিরে তুমি পা রাখিয়াছ বলিয়া জনার্দন চৌধুরী আর তোমাকে বিবাহ করিবেন না। সত্বর অন্য পাত্র সংঘটন হওয়াও সম্ভব নয়। তোমার পিতা ভ্রাতা যাহা কিছু তোমার লাঞ্ছনা করেন, এক বৎসর কাল পর্যন্ত সহ্য করিয়া থাক। শুনিয়াছি পশ্চিম অঞ্চলে অধিক বেতনে কর্ম পাওয়া যায়। আমি এক্ষণে পশ্চিমে চলিলাম। কাশীতে মাতার শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়া সমাধা করিয়া কর্মের অনুসন্ধান করিব। এক বৎসরের মধ্যে যাহা কিছু অর্থ সংগ্রহ করিতে পারি, তাহা আনিয়া তোমার পিতাকে দিব। আমি নিশ্চয় বলিতেছি, তখন তোমার পিতা আহ্লাদের সহিত আমার প্রার্থনা পরিপূর্ণ করিবেন। কেবল এক বৎসর, কঙ্কাবতী, দেখিতে দেখিতে যাইবে। দুঃখে হউক, সুখে হউক, ঘরে থাকিয়া, কোনও রূপে এই এক বৎসর কাল অতিবাহিত কর।”তখন কঙ্কাবতী বলিল, “তুমি আমাকে যেরূপ আজ্ঞা করিবে, আমি সেইরূপ করিব।”

দুই জনে ধীরে ধীরে গ্রামাভিমুখে চলিল। রাত্রি সম্পূর্ণ প্রভাত হয় নাই, এমন সময় দুইজনে তনু রায়ের দ্বারে গিয়া উপস্থিত হইল।

খেতু বলিল, “কঙ্কাবতী, তবে এখন আমি যাই। সাবধানে থাকিবে।”

যাই যাই করিয়াও খেতু যাইতে পারে না। যাইতে খেতুর পা সরে না। দুইজনের চক্ষুর জলে তনু রায়ের দ্বার ভিজিয়া গেল।একবার সাহসে ভর করিয়া খেতু কিছুদূর গেল কিন্তু পুনরায় ফিরিয়া আসিল, আর বলিল, “কঙ্কাবতী একটি কথা তোমাকে ভাল করিয়া বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি। কথাটি এই যে, অতি সাবধানে থাকিও।”

আবার কিছুক্ষণ ধরিয়া দুইজনে কথা কহিতে লাগিল। ক্রমে প্রভাত হইল, চারিদিকে লোকের সাড়া-শব্দ হইতে লাগিল।

তখন খেতু বলিল, “কঙ্কাবতী, এইবার আমি নিশ্চয় যাই। অতি সাবধানে থাকিবে। কাঁদিও কাটিও না। যদি বাঁচিয়া থাকি তো এক বৎসর পরে নিশ্চয় আমি আসিব। তখন আমাদের সকল দুঃখ ঘুচিবে। তোমার মাকে সকল কথা বলিও, অন্য কাহাকেও কিছু বলিবার আবশ্যক নাই।”

খেতু এইবার চলিয়া গেল। যতদূর দেখা গেল, ততদূর কঙ্কাবতী সেই দিক পানে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল। তাহার পর, চক্ষুর জলে সে পৃথিবী অন্ধকারময় দেখিতে লাগিল। জ্ঞানশূন্য হইয়া ভূতলে পতিত হওয়ার ভয়ে, দ্বারের পাশে প্রাচীরে সে ঠেস দিয়া দাঁড়াইল। খেতু ফিরিয়া দেখিল যে, চিত্রপুত্তলিকার ন্যায় কঙ্কাবতী দাঁড়াইয়া আছে। তাহার পর আর দেখিতে পাইল না।